সাভানায় শরণার্থীদের করোনাক্রান্ত ঈদ



মঈনুস সুলতান
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

ঈদ উপলক্ষে পারিবারিক পরিসরে আমি রান্নাবান্না করছি প্রায় দুই যুগের মতো, কিন্তু এ শিল্পে আমার কামিয়াবি হাসিল হয়েছে স্বল্প, খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে বিব্রত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে প্রচুর। হাল ছাড়িনি, কিন্তু আজ ভোরবিহানে সেমাই রান্না করতে গিয়ে যে হালত হয়েছে, তাকে সফলতা বলার কোনো কায়দা নেই। আজকের এ করোনাক্রান্ত ঈদে আমি সাভানা শহরের আরো দুয়েকজন সমমনা মানুষের সঙ্গে মিলেঝুলে—পৃথিবীর হরেক দেশ থেকে নানাবিধ যুদ্ধ কিংবা সামাজিক সংঘাতে বাস্তুচ্যুত হয়ে এখানে এসে রিসেটেল্ড হওয়া কয়েকটি রেফিউজি পরিবারকে খাবার পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। আমার স্পেসিফিক দায়িত্ব হচ্ছে ফিস কাবাব ও সেমাই প্রস্তুত করা। টুনা মাছের কাবাবগুলো আকৃতিতে বটবৃক্ষের ঝরা-পাতার মতো দেখালেও তা স্বাদে হয়েছে উমদা। এ নিয়ে হীনমন্যতার কোনো কারণ নেই, তবে বিপত্তি ঘটেছে সেমাইকে জর্দায় রূপান্তরিত করতে গিয়ে। তা চটকে হান্ডির তলায় এমন চেরা-চ্যাপ্টা লেগে সেঁটে আছে যে, চিমটা দিয়ে টেনেও তা বর্তনে উপস্থাপন করার কোনো কুদরত থাকেনি। বিপদগ্রস্ত হয়ে টেলিফোনে কন্যা কাজরিকে মুশকিল আসান করতে এত্তেলা দিই। পরিস্থিতি যে কতটা খতরনাক—তা বোঝানোর জন্য টেক্সট্ ম্যাসেজের সাথে যুক্ত করি, হান্ডির তলদেশের ফটোগ্রাফ। মেয়ে আমোদ পেয়ে জবাবে জানায়—জকড়িমকড়ি লাগা সেমাইগুলোকে দেখাচ্ছে আরবি হরফে ক্যালিওগ্রাফি করে লেখা ঈদ মোবারকের মতো। আমি বিলা হয়ে সেলফোন সরিয়ে রাখি।

যুক্তরাষ্ট্রে ভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর হার লাখের দিকে আগাচ্ছে। বিষয়টিকে আমলে না এনে মূলত রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের সক্রিয় উৎসাহে হরেক রাজ্যের গভর্নররা লকডাউন তুলে নিয়েছেন। আমাদের রাজ্য জর্জিয়ার গভর্নর আরেক কাঠি সরস, তিনি মৃত্যুর হারকে ডেটা মেনিপুলেশনের মারপ্যাঁচে কম করে দেখিয়ে চেষ্টা করছেন—মুভি থিয়েটার, স্টেডিয়াম, সমুদ্রসৈকত ও স্কুলগুলো খুলে দিতে। দোকানপাট বেশ কিছু খুলে গেছে বটে, তবে আমার মতো যে সব নাগরিক—হয় বয়সের ভারে পরিশ্রান্ত অথবা নানাবিধ রোগেশোকে আক্রান্ত, স্বাস্থ্য বিভাগের তরফ থেকে তাদের গ্রোসারি শপ ইত্যাদিতে যেতে জোরেশোরে নিষেধ করা হচ্ছে। তো এ পরিস্থিতিতে চাইলেই আমি কোনো দোকানে গিয়ে সেমাইয়ের বিকল্প অন্য কোনো মিষ্টান্ন কিনে আনতে পারি না। কাজরি পরবর্তী টেক্সটে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। আমি অপেক্ষা করি, দেখা যাক কী হয়...।

ড্রাইভওয়েতে এসে থামে ফেডএক্স-এর মালামাল সরবরাহ করা গাড়ি। মাস্ক পরা ড্রাইভার একটি গিফট প্যাকেট সিঁড়িতে রেখে ফিরে যান। বুঝতে পারি, কাজরির কাছ থেকে এসেছে ঈদের উপহার। অ্যালকোহল রাব দিয়ে ঘঁষামাজা করে সাবধানে বাক্সটি খুলি। বেরিয়ে আসে গোলাপজলের সুন্দর একটি শিশি। চটজলদি তা সাবানজলে চুবিয়ে গামছা দিয়ে মুছে-টুছে অপেন করি। পুরো আঙিনা ভরে ওঠে পুষ্পের চনমনে খোশবুতে। কাজরির কাছ থেকে টেক্সট্ আসে ফের। জানতে পারি, সে জখমি সেমাইয়ের বিকল্প রাইস পুডিং নিয়ে আসছে। আমি জলদি করে খাবারের কৌটা ও তার ঈদোপহারের প্যাকেট ড্রাইভওয়েতে এনে রাখি। আমাদের মেয়ে কাছেই বসবাস করছে, তার কোনো কোনো বান্ধবী করোনার ব্যাপক বিস্তারে এক্সপোজড্ হয়েছে, তাই আমরা আজকাল সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আমাদের হাটবাজার করতে সে সহায়তা যোগাচ্ছে, তবে দৈহিকভাবে কাছে আসছে না, আমরা বাতচিত করছি কেতাবি কায়দায় ছয় ফুট দূরত্ব বহাল রেখে।

সড়কের পাশে গাড়ি পার্ক করে কাজরি ড্রাইভওয়েতে এনে রাখে রাইস পুডিংয়ের সওদা। ঈদোপহারের প্যাকেট খুলে সাবানজলে ভিজে নেতানো ফ্লোরাল হেয়ার ক্লিপের দিকে নজর দিয়ে সে চোখ কুঁচকে তাকায়। আমি উপহারটি বিশদভাবে ধোয়াপাকলা করে জীবাণুমুক্ত করার জন্য ‘স্যারি’ বলি। ‘নো প্রবলেম, বাপি, ইটস্ আ কুল ঈদ গিফট... ইট উইল ড্রাই সুন..।’ সে খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে গাড়ির দিকে হেঁটে যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে বলে, ‘ঈদ মোবারক।’ আমি মনে মনে হিসাব কষি, আর কতদিন আমাদের পারিবারিক পরিসরে জারি থাকবে সামাজিক দূরত্ব?

বেলা পনে-এগারটা হতে চলল, মিসেস নিয়ামা ইবরিম এখনো এসে পৌঁছেননি, তাঁর দশটা পনেরতে এসে পৌঁছার কথা, তাই বিরক্ত লাগে। ওয়েস্ট আফ্রিকার ঘানা থেকে অনেক বছর আগে অভিবাসী হয়ে এসে এদেশে সেটেল্ড হওয়া মিসেস ইবরিম হাইস্কুলের ক্যাফেটেরিয়াতে কুক হিসাবে কাজ করেন। পার্টি-পর্বে তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে প্রস্তুত করে দেন আফ্রিকান ডিশ। রান্নার হাতটি তাঁর চমৎকার, তবে সময় মতো কোথাও এসে পৌঁছানোর স্বভাবটি এখনো আয়ত্ত করে উঠতে পারেননি। আজকের ঈদ-খাবারের আয়োজনে তিনি ওয়েস্ট আফ্রিকান কেতার জলোপ রাইস রান্না করে নিয়ে আসছেন। তিনি এসে না পৌঁছানো অব্দি কিছু করা যাবে না।

আমি ড্রাইভওয়েতে আগুপিছু পায়চারি করতে করতে মিসেস নিয়ামা ইবরিমের বিষয়টা নিয়ে ভাবি। সাভানা শহরকে বিষয়বস্তু করে কিছু একটা লেখার প্রয়াশে আমি মাস কয়েক আগে তাঁকে অনানুষ্ঠানিকভাবে ইন্টারভিউ করি। তাঁর জীবনের কিছু ঘটনা নোটবুকে ইন ডিটেইলস্ টুকে রেখেছিলাম। আমার স্টাডিতে খুঁজলে হয়তো খাতাটি পাওয়া যাবে। বাগিচার বড়সড় গাছটিতে ফুটেছে গোলাপি বর্ণের অজস্র পাউডার পাফ ফুল। একটি মকিং বার্ড পাতায় ডানা ঘষে সুরেলা কণ্ঠে ছড়াচ্ছে সুইট টিউন। নোটবুকে টুকে রাখা কিছু কিছু তথ্য ফিরে আসে আমার করোটিতে। সেপ্টেম্বর এলেভেনের ঘটনাটি ঘটার মাস খানেক আগে নববধূ হিসাবে সাভানা শহরে এসেছিলেন মিসেস ইবরিম। তাঁর স্বামী ডক্টর আবদু ইবরিম জর্জিয়া সাদার্ন ইউনিভারসিটিতে পোস্ট ডক্টরেল ফেলো হিসাবে কাজ করছিলেন। বিয়ের পর ভিসার প্রতীক্ষায় প্রায় তিন বছর নিয়ামা ইবরিম বাস করেছিলেন ঘানার রাজধানী আক্রায় তাঁর পিতা-মাতার বসতবাড়িতে। এখানে এসেই হাল ধরেছিলেন সংসারের। ঈদের পর দিন ছিল তাঁদের বিবাহবার্ষিকী।

ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে গেছে সেপ্টেম্বর এলেভেনের ট্র্যাজিডি। এর প্রতিক্রিয়ায় কোনো কোনো জায়গায় ভিন্ন গাত্রবর্ণের আমেরিকান মুসলমানদের হেরাস করার বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যাপার ঘটতে শুরু হয়েছে। ঈদের আগে চানরাতে সাভানার শহরের ইসলামিক সেন্টার নামক ছোট্ট মসজিদটিকে কে বা কারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তো স্ত্রী নিয়ামাকে ঘরে একা রেখে ডক্টর ইবরিম মসজিদ প্রাঙ্গণে গিয়ে অন্যান্য মুসলমানদের সাথে হাত লাগান জ্বলাপোড়া ছাই ইত্যাদি পয়পরিষ্কারের কাজে। ড্রাইভওয়েতে খাটানো হয় চাঁদোয়া, তার তলায় বিছানার চাদর বিছিয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে ডক্টর ইবরিম পুলিশ প্রহরায় আদায় করেন ঈদের নামাজ। তারপর তিনি ঘরে না ফিরে ঈদের বাহারে ধড়াচূড়া ও টুপি পরে চলে যান শৌখিন শপিং সেন্টারে। ওখানে বিবাহবার্ষিকীর রাতে নববধূর জন্য একটি ব্যক্তিগত উপহার কিনে নিয়ে হেঁটে হেঁটে চেষ্টা করছিলেন ট্যাক্সি পাওয়ার। ছুটন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে ফায়ার করা গুলির আঘাতে তিনি নিহত হন।

মিসেস নিয়ামা ইবরিমের গাড়ি ঠিক এগারটা বাইশে এসে ড্রাইভওয়েতে থামে। ফুলের মোটিফ আঁকা বাহারে হেজাব পরে এসেছেন তিনি। নিজেই টেনে নামান কার্ডবোর্ডের ভারী বাক্সটি। আমাকে ঈদ মোবারক বলে হাতের ইশারায় ব্যাকসিটে রাখা গান ভায়োলেন্স বিরোধী প্লেকার্ডটি দেখিয়ে ড্রাইভিং সিটে ফিরে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেন। আমি তাঁর অপস্রিয়মাণ টেইল লাইটের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। তাঁর দিনযাপন সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না। এক যুগের নববধূটি হালফিল প্রৌঢ়ত্ব অতিক্রম করে পড়েছেন বয়সের ভাটিতে। ঘানায় আর ফিরে যাননি নিয়ামা, সাভানাতেই থিতু হয়েছেন। কোনো পুরুষ পার্টনার জুটেছে কী—না জেনে বলা মুশকিল। তবে বিদেশ বিভূঁইয়ে নিহত ডক্টর ইবরিমের স্মৃতিকে তিনি জিইয়ে রেখেছেন। প্রতি ঈদে মৃত স্বামীর প্রিয় খাবার—টমেটো সচে সব্জি মেশানো জলোফ রাইস প্রচুর পরিমাণে রান্না করে মসজিদে এনে বিতরণ করেন মুসল্লিদের মধ্যে। তারপর ডক্টর ইবরিমের গুলিবিদ্ধ ফটোগ্রাফ সাঁটা একটি প্লেকার্ড নিয়ে গিয়ে দাঁড়ান বন্দুকের দোকানের সামনে, নীরবে প্রতিবাদ করেন, নিরপরাধ মানুষকে অস্ত্রাঘাতে হত্যা করার বিরুদ্ধে। সাভানা শহরে সয়ংক্রিয় অস্ত্র বিক্রি হয় প্রচুর। গান ভায়োলেন্সে প্রতিবছর মৃত্যু হয় অনেক মানুষের। মাঝেসাজে এখানে আয়োজিত হয় বন্দুক সংক্রান্ত ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, এ সব অ্যাক্টিভিটির পয়লা কাতারে প্লেকার্ড হাতে দেখা যায় বিধবা নিয়ামা ইবরিমকে।

সাভানা শহরটি সরকারি উদ্যোগে খুলে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে, কিন্তু মুসল্লিদের ব্যাপক অংশ বয়স্ক বিধায় মসজিদে এবার ঈদের জামাত হয়নি। তাই ডক্টর ইবরিমের ইয়াদগারিতে প্রস্তুত জলোফ রাইস নাইমা রেফিউজিদের সেবার জন্য ডোনেট করে দিলেন। ক্যাটারিং সার্ভিসে কাজ করা মহিলা ইনি, স্টাইরোফোমের বক্সে জলোপ রাইস এর সঙ্গে প্লাস্টিকের চামচ, কাঁটা ও ন্যাপকিন দিয়ে সমস্ত কিছু পেশাদারি যত্নে পুরে দিয়েছেন পলিথিনের আলাদা আলাদা ব্যাগে। আমি গ্লাভস্ পরে তাতে ফিস কাবাব ও রাইস পুডিং রাখতে যাই। খাবার বিতরণে দেরি হয়ে যাচ্ছে, বড্ড অস্থির লাগে। জোসেফ মরগ্যানকে রিং করবো কিনা—ভাবি। সুহৃদ মরগ্যান আমাকে লিফট দিয়ে খাবার বিতরণে সহায়তা করার কথা দিয়েছেন। তিনি এখনো এসে পৌঁছাননি কেন? বেজায় টেনশন লাগে। আমার কব্জিতে ইনজুরির জন্য আমি ড্রাইভ করতে পারছি না। নিয়মিত পেইন কিলার নিতে হচ্ছে। প্বার্শ-প্রতিক্রিয়ায় আমার মধ্যে ধৈর্যটা কমে গেছে, সাথে সাথে বেড়েছে টেলিফোনে বেফজুল কথাবার্তা বলার প্রবণতা।

সারোকিন সেকেজির কাছ থেকে টেক্সট্ আসে। ইরানের নারী সারোকিন মরগ্যান সাহেবের সংসার করছেন অনেক দিন ধরে। বছর তিনেক হলো এ বয়স্ক নারী মারাত্মক রকমের বাত ও অন্যান্য ব্যাধিতে পঙ্গু প্রায়। চলাফেরা করেন চাকাওয়ালা ওয়াকার ঠেলে ঠেলে, তবে এখনো প্রতি ঈদে খরিদ করেন কয়েক জোড়া হাইহিল স্যান্ডেল। তাঁদের ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বাড়ির একটি স্বতন্ত্র কামরা জুড়ে রাখা আছে শতাধিক হাইহিলের কালেকশন। টেক্সটে সারোকিন আমাকে টেলিফোন করার পার্মিশন চেয়েছেন। এ মহিলার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলে ইনি অনুমতি ছাড়াই আমার ডান হাতে চুমো খেয়ে খোশআমদেদ জানান। তো এ মুহূর্তে রিং করার জন্য এত আদব-কায়দা করছেন কেন? তাঁর অনুরাগ-ঋদ্ধ স্বামী মরগ্যান সাহেবের তো আমার বাড়িতে এসে পৌঁছানোর কথা? তিনি আসেননি কেন? মেজাজ খাট্টা হয়ে ওঠে।

রোদের তাপ বাড়ছে, আমি বাগানের ছাতাটি খুলে দিয়ে তার নিচে গিয়ে বসি। মরগ্যান সাহেবের প্রচুর বয়স হলেও তিনি শারীরিকভাবে সক্ষম আছেন। আমাদের ত্রাণ তৎপরতায় তিনি সাহায্য করছেন বিগতভাবে। পেশায় মানুষটি প্রকৌশলী, আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে কয়েক বছর কন্সট্রাকশন ওয়ার্কের কন্টাকটারিও করেছেন। রেজা শাহ পাহলবির রাজত্বের শেষ দিকে ইনি ইরানে যান নগর নির্মাণে সহায়তা করতে। তখন বিবাহিত হয়েছিলেন সারোকিনের সঙ্গে। ফার্সি বলেন ভালোই। ধর্মে মুসলমান নন, তবে কলেমা জানেন, হাফিজ ও শেখ সাদির কিছু গজল ও কসিদা মুখস্থ করে রেখেছেন। মরগ্যান সাহেবের বিত্ত প্রচুর, পার্সিয়ান গালিচা সংগ্রহ করে চিত্ত বিনোদন করে থাকেন। তাঁর বসতবাড়ির ড্রয়িংরুমটিকে কার্পেটের দোকানের মতো দেখায়।

আমার বিরক্তি বাড়ে। টেক্সটের জবাব না দিয়ে সারোকিনকে সরাসরি রিং করি। তিনি প্রচুর সময় নিয়ে আমাকে ঈদ মোবারক জানিয়ে বলেন, কাজরির জন্য নিজ হাতে তৈরি করেছেন পার্সিয়ান রাইস ও শিসকাবাব প্রভৃতি। মহিলা কেবলই কথা বলছেন, থামেন না, ঠিক বুঝতে পারি না, তাঁর স্বামী মরগ্যান কোথায় গুম হলেন? গরমের মৌসুমে ঈদ হলে কী ধরনের আতর ইস্তেমাল করতে হয়—তার বিশদ বর্ণনা দিয়ে অতঃপর সারোকিন জানান, স্বামীকে তিনি একটু আগে পাঠিয়েছেন শপিং মলে খেলনা কিনতে। গেল রাতে মরগ্যান টেলিফোনে জানতে চেয়েছিলেন রেফিউজিদের নির্দ্দিষ্ট কোনো চাহিদা আছে কিনা। আমি জবাব দিয়েছিলাম, পাঁচটি পরিবারে আছে ছোট ছোট শিশু। আমরা সপ্তাহ খানেক আগে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে ফুড ব্যাংক থেকে জোগাড় করা খাবার-দাবার পৌঁছে দিয়েছি বটে, কিন্তু ঈদে শিশুদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি। মরগ্যানের সেলফোনে চার্জ ছিল না, তাই তাঁর হয়ে সারোকিন অ্যাপোলজি চান। বুঝতে পারি শিশুদের জন্য কিছু কেনা যায়নি—এ তথ্যের প্রতিক্রিয়ায় সারোকিন মরগ্যানকে শপিংমলে পাঠিয়েছেন খেলনা কিনতে। বয়সের নিরিখে মরগ্যান সাহেব আমার মতো হাই-রিস্ক ক্যাটাগরিতে পড়েন। খোদা-না-খাস্তা তাঁর কিছু হলে জগত-সংসারে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব সবচেয়ে বেশি।

আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। ড্রাইভওয়েতে এসে থামে মরগ্যানের গাড়ি। কাচের হেড-শিল্ডের সাথে পলিথিনের স্বচ্ছ সুরক্ষা গাউন পরে এসেছেন। সাথে করে খেলনা ছাড়াও তিনি নিয়ে এসেছেন প্রতিটি রেফিউজি পরিবারদের জন্য দুই রকমের কাবাব ও ফলমূলে পূর্ণ আলাদা আলাদা শপিংব্যাগ। কাজরির জন্য পার্সিয়ান রাইসের ডিশের ওপর সেলোফোনে মোড়া ফুলের তোড়াসহ আস্ত একটি বাস্কেট নামিয়ে দিয়ে আমাকে গাড়িতে উঠতে ইশারা দেন। আমরা কথাবার্তা তেমন বলি না, তবে মরগ্যানের অনুরোধে আমি টেলিফোন স্ক্রিনে তাঁর লেখা একটি ফেসবুক পোস্টিং পড়ি।

পোস্টিংয়ে তিনি নগরীর চেনা মুখ—রাজ্যসভার এক আইনপ্রণেতা সম্পর্কে নাম উল্লেখ না করে আলোচনা করেছেন। রিপাবলিকান এ রাজনীতিবিদ করোনা সংক্রমণের প্রথম থেকে তার মিডিয়া চ্যানেলে প্রচার করে আসছেন যে, ভাইরাসের বিস্তৃতি হচ্ছে আদতে বিদেশ থেকে আগত অভিবাসী—বিশেষ করে চীনাদের আমেরিকার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বিশেষ। তিনি সামাজিক দূরত্ব যে ভ্রান্ত একটি আইডিয়া—তা নিয়ে তৈরি করেছেন প্রচার ভিডিও। সামাজিক দূরত্বের নীতিমালাকে অগ্রাহ্য করে নিজ মালিকানাধীন কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে শ্রমিকদের মাস্ক ও ডিসইনফেকশন লোশন ইত্যাদি সরবরাহ না করে কাজে বাধ্য করেছেন। আইনসভায় ইনি কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-আমেরিকানদের শহরতলীতে ভাইরাস টেস্টিং সেন্টার স্থাপন করার বিরোধিতা করেন। দরিদ্র কর্মচারীদের বেকার ভাতা বাতিলের প্রস্তাবও উত্থাপন করেছেন। আইনপ্রণেতা মরগ্যান সাহেবের প্রতিবেশি হিসাবে একই পাড়ায় বাস করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সামাজিক দূরত্ব বহাল রেখে তার পরিবারকে আইসোলেশনে নিয়ে রক্ষা করছেন। এক দিকে ভাইরাস টেস্টিংয়ের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিরোধিতা করছেন, অন্য দিকে ইনি তার নিরাপত্তারক্ষী ও ব্যক্তিগত স্টাফদের প্রতি সপ্তাহে টেস্ট করাচ্ছেন। আমি পোস্টিং পড়া শেষ করে চোখ তুলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাই। ড্রাইভ করতে করতে তিনি মুখোশটি সামান্য নামিয়ে এ আইনপ্রণেতা সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘ফার্সিতে এ ধরনের আচরণকে বলা হয় মুনাফিকি।’ লবজটির সঙ্গে আমি পরিচিত, ফেসবুকে আইনপ্রণেতার নাম উল্লেখ না করে আলোচনা করে ফায়দা কী—ঠিক বুঝতে পারি না। পাশাপাশি বসেও আমরা দুজনে কমবেশি মুখে মাস্ক বজায় রাখছি। এ হালতে গুছিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা মুশকিল। ভাবি পরে একসময় টেলিফোন করে এ ব্যাপারে ফলোআপ করতে হবে।

যাত্রাপথে ট্র্যাফিক নেই একেবারে, তবে আমরা কথাবার্তা বলছি না, তাই দীর্ঘ মনে হয়। আমরা এ মুহূর্তে রওয়ানা হয়েছি সাভানা শহর থেকে খানিকটা দূরে আইল অব হোপ নামে ব্রিজে সংযুক্ত একটি আইল্যান্ডের দিকে। ওখানকার বিশাল একটি ম্যানসনে একাকী বাস করছেন ইরাকের অভিবাসী চিত্রকর আহাদ কালাব। ছবি আঁকার হাত তাঁর দুর্দান্ত। এ দেশে সেটেল্ড হয়ে চিত্রকলা বিক্রি করে দিন গোজরান করছিলেন। সংক্রমণের সংবাদ চাউর হওয়ার সপ্তাহ দিন আগে ইনি অত্যন্ত বিত্তশালী একজন মানুষের বিরাট একটি ম্যানসনের বলরুমে দেয়াল-জোড়া ফ্রেস্কো আঁকার কমিশন পান। বিত্তবান বাস করেন লস এঞ্জেলসে। বছরে একবার ক্রিসমাসের সময় ফিরে এসে বলরুমে আয়োজন করেন নিউইয়ার্স পার্টি। তারপর পুরো বছর ম্যানসনটি খালি পড়ে থাকে। আহাদ কালাবের গাড়ি-টাড়ি নেই। প্রতিদিন সাভানা থেকে আইল অব হোপে গিয়ে ছবি আঁকার কাজ করাটা মুশকিল। তাই তাকে ম্যানসনের বাগিচায় এক কামরায় গেস্ট-কটেজে থাকতে দেওয়া হয়। মাত্র কয়েকদিন কাজ করার পর কালাবের শরীরে ফুটে ওঠে করোনার আলামত। জ্বর, কাশি ও মাথা ধরা। তাঁর হেল্থ ইনস্যুরেন্স নেই, সিম্পটনও মাইল্ড, তাই তিনি গেস্ট-কটেজে নিজেকে আইসোলেটেড করে রাখছেন।

নগরীর এখানে ওখানে আহাদ কালাবের প্রদর্শনী হয়েছে কয়েকবার। তাঁর সঙ্গে একবার অন্তরঙ্গভাবে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তাও বলেছি। কথা দিয়েছিলাম, তাঁকে নিয়ে লিখব, লিখতেও বসেছিলাম, কিন্তু শেষ করতে পারিনি। ধর্ম বিশ্বাসে কালাব ইয়াজিদি। যতটা জেনেছি, ইয়াজিদি হচ্ছে দজলা-ফোরাত অঞ্চলের অতি প্রাচীন একটি একেশ্বরবাদী ধর্মমত। এদের সাথে কারবালায় নবী (দঃ)-এর দৌহিত্রের সঙ্গে নির্মম আচরণ করা মোয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদের কোনো সম্পর্ক নেই। এদের উপাসনা পদ্ধতির সঙ্গে সুফি তরিকার রীতি-রিচ্যুয়েলের মিল আছে। এরা কথা বলেন কারমানজি ভাষায়, অনেকেই দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে আরবি জবানটাও জানেন। পালন করেন ঈদ ও শবেবরাত।

আহাদ কালাব ইরাকের নিনেভ অঞ্চলের শেখান শহরের মানুষ। সম্প্রতি ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা অত্র এলাকা দখল করে নিলে প্রায় চল্লিশ হাজার ইয়াজিদি হয়ে পড়ে বাস্তুহারা। এদের ‘কুফফার’ ফতোয়া দিয়ে ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা হত্যা করে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। একই সাথে তাদের হাতে মালে গনিমত হিসাবে বন্দী হন প্রায় ৭০০০ জন নারী। এদের কাউকে কাউকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। অনুগতদের নিকাহ প্রথার মাধ্যমে উপপত্নি হিসাবে যোদ্ধা পুরুষদের সংসার করার অনুমতি দেওয়া হয়। যারা ধর্মান্তরিত হতে আপত্তি জানায়, তাদের কাউকে কাউকে সেক্স-স্লেভ হিসাবে বিক্রি করে দেওয়া হয় সিরিয়ার হিউম্যান ট্র্যাফিকারদের কাছে।

আহাদ কালাব ও তাঁর স্ত্রী জাবিলা কালাব আরো হাজার খানেক ইয়াজিদির সঙ্গে বন্দী হয়েছিলেন ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের হাতে। তাদের মাউন্ট শিনজারের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় কুর্দি গেরিলাদের আক্রমণে কিছু বন্দীকে পেছনে ফেলে ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা উঠে যায় পর্বতের দুর্গম হাইড আউটে। আহাদ কালাব কুর্দি গেরিলাদের সহায়তায় লেবাননে পালিয়ে এসে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অতঃপর রেফিউজি কেটাগরিতে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ পান।

ইসলামি স্টেটের সঙ্গে কুর্দিদের যুদ্ধজনিত গোলযোগে আহাদ কালাব বিচ্ছিন্ন হন তাঁর স্ত্রী জাবিলা কালাবের সঙ্গে। অনেক চেষ্টা করেও জাবিলার অদৃষ্টে কী ঘটেছে—কোনো খোঁজ পাননি তিনি। কিছু দিন আগে সাভানা শহরে হয়ে গেছে তাঁর একটি একক প্রদর্শনী। তাঁর আঁকা অনেকগুলো চিত্রে আবছাভাবে ফুটে উঠেছে জাবিলার মুখচ্ছবি। পত্রিকায় ভালো রিভিউ হয়েছে, কিছু চিত্রকলা বিক্রিও হয়েছে। অন্তরঙ্গ আলাপে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর প্রতিক্রিয়া। চোখের জল মুছে বলেছিলেন, ‘আই আর্নড সাম মানি বাই সেলিং দ্য পেইনটিংস্, বাট...ইউ নো...ডিডন্ট গেট ব্যাক মাই লাভ।’

যে ম্যানসনের গেস্ট-কটেজে এ মুহূর্তে আইসোলেশনে আছেন কালাব, ওখানে স্থলপথে যেতে পড়ে একটি ট্রেইলার পার্ক, যেখানে ক্যারিবিয়ান ক্রুজে গিয়ে যে কয়েকজন মানুষ সংক্রমিত হয়েছিলেন কোভিড-১৯-এ, তাঁরা আইসোলেশনে বাস করছেন। অন্য উপায় হচ্ছে, নোনা জলবাহী লেগুনে নৌকা বেয়ে গিয়ে ওঠা ম্যানসনের পেছন দিকে জেটিতে। মরগ্যান আইল অব হোপের বোট ডক করার জেটির দিকে ড্রাইভ করতে করতে কালাবের সঙ্গে সেলফোনে কথা বলে নেন। গাড়িটি পার্ক করে খাবারের ব্যাগ হাতে আমরা জেটিতে আসি। ওখানে বাঁধা নানা আকারের অনেকগুলো বোট। খানিক খুঁজে আমরা চারজন বসার উপযোগী একটি ছোট্ট নৌকা লকেট করি। মরগ্যান কালাবের দেওয়া কোড ব্যবহার করে খুলে ফেলেন লক। লেগুনের জলে ভাসছে ম্যালার্ড জাতীয় হাঁস। চতুর্দিক এমন সুনশান হয়ে আছে যে, ইঞ্জিন স্টার্ট করতে ইচ্ছা হয় না। মরগ্যান ঢিমেতালে বৈঠা ফেলেন। যেতে যেতে দেখি দুপাশে নলখাগড়ার মতো দীর্ঘ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে শ্বেতশুভ্র সারস।

জেটিতে বোট ভিড়িয়ে আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠি। বাগান পেরিয়ে ম্যানসনটির চকমিলান আকার-আয়তন দেখে আমার চোখ দুটি ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। জেটির লাগোয়া বোট-হাউসে নোঙর করে রাখা একটি শৌখিন ত্রিমারান বোট, পাশেই ঢেউয়ে মৃদু মৃদু দুলছে বর্ণাঢ্য সিপ্লেন। দেখতে পাই, সেলফোন কানে লাগিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন কালাব। আমরা বোট-হাউসের বারান্দায় খাবারের ব্যাগটি রাখি। বেশ দূরে দাঁড়িয়ে তিনি হাত নেড়ে সেলফোনে ঈদ মোবারক বলেন। মরগ্যান লাউড স্পিকার অন করেন। জানতে পারি, তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন, চলাফেরা করতে পারেন, তবে সারাক্ষণ বড় দুর্বল লাগে। যে বলরুমের দেয়ালে তিনি ফ্রেস্কো আঁকতে শুরু করেছিলেন—তা আকারে এত বড় যে, পার্টি-পর্বে ওখানে শত খানেক গেস্ট এন্টারটেন করা যায়। বিশাল পরিসরের ফ্রেস্কোটি শেষ করতে সময় লাগবে। অসুবিধা কিছু নেই। ম্যানসনের কেয়ার টেকার তাঁকে প্রায়োজনে আরো মাস-দেড়মাস গেস্ট-কটেজে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। ডিপ ফ্রিজে খাবার-দাবারও আছে যথেষ্ট। আমাদের দেখতে পেয়ে কালাব এত খুশি হয়েছেন যে, ইশারায় আলিঙ্গনের ভঙ্গি করে গেয়ে ওঠেন ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের পালা-পার্বণে গীত একটি জনপ্রিয় গানের দুটি কলি।

আইল অব হোপ থেকে সাভানা শহরে ফিরে ডাউন টাউনের দিকে ড্রাইভ করতে গিয়ে কী ভেবে মরগ্যান ঢুকে পড়েন একটি গলিতে। দুটি ব্লক পেরিয়ে আমরা চলে আসি ছোট্ট একটি শপিং কমপ্লেক্সের কাছে। মারণাস্ত্র বিক্রির দোকান ‘গান স্মিত’র সামনের পেভমেন্ট তিনি গাড়িটি দাঁড় করান। বন্দুকের দোকানে ক্রেতাদের ভিড়। সামাজিক দূরত্বের প্রয়োজনে একসাথে মাত্র দুজন ক্রেতাকে দোকানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। বাকিরা সারি দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছেন তাদের পালা আসার। খানিক দূরে পার্কিংলটে মারণাস্ত্র ব্যবহার বিরোধী প্লেকার্ড হাতে একাকী দাঁড়িয়ে মাস্কে মুখ ঢাকা হেজাব পরা মিসেস নিয়ামা ইবরিম। আমরা তাঁর সমর্থনে নিরাপদ দূরে দাঁড়িয়ে রুমাল নাড়ি। কয়েকজন বন্দুক খরিদ করনেওয়ালা যুবক ঘাড় ফিরিয়ে আমাদের দিকে তাকান। দুজন আঙুল নিচু করে অশ্লীলভাবে ইশারা করেন। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে ভাবি অত্র এলাকায় যেভাবে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে—আমার জীবদ্দশায় কি এ প্রবণতার অবসান ঘটবে?

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হয় জর্জিয়া সাদার্ন ইউনিভারসিটির পেছন দিককার দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুসিত পল্লীতে। ওখানে বাস করছেন কেম্বোডিয়া থেকে অভিবাসী হয়ে আগত বয়োবৃদ্ধ চাম দম্পতি। সপ্তাখানেক আগে মিসেস লেবু-কে চাম তাঁর পক্ষাঘাতে স্থবির স্বামী মি. ফাটেল সান চামকে ঘরে একা রেখে উবার চড়ে গ্রোসারি শপিংয়ে গিয়েছিলেন। বাজার সওদা নিয়ে দোকান থেকে বেরোতেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ছবি আঁকা টিশার্ট পরা এক শ্বেতাঙ্গ মুণ্ডিত মস্তক যুবক ‘এক্সকিউজ মি...’ বলে তাঁকে থামায়। তারপর কেশে তাঁর শরীরে থুতু ফেলে চিৎকার করে বলে, ‘ইউ ফাকেন চায়নিজ, ইউ ব্রট করোনা ভাইরাস হিয়ার...গো ব্যাক টু ইয়োর আগলি হোম।’ আমি নিরীহ এ বৃদ্ধার হেরাসমেন্টের কাহিনী বর্ণনা করে স্থানীয় পত্রিকায় চিঠি লিখেছিলাম, পত্রটি ছাপেনি। মরগ্যান সাহেব পত্রিকার অ্যাডভাইজারি বোর্ডে আছেন, আমি তাঁকে গতকাল বিষয়টি অবহিত করি। তিনি ড্রাইভ করতে করতে ঘটনাটি ফের ব্যাখ্যা করতে বলেন। বিরক্ত হয়ে আমি বলি, মহিলা প্রথমত চায়নিজ নন। আর চায়নিজরা যে আমেরিকাতে ভাইরাস পাঠিয়েছে, তারও কোনো প্রমাণ নেই। গবেষকরা নিউইয়র্কে আক্রান্তদের শরীর থেকে নেওয়া জীবাণু পরীক্ষা করে বলছেন এগুলো এসেছে ইউরোপ থেকে। তো ভাইরাসের বিষয়-আশয় যাই হোক চাম পরিবার অভিবাসী হয়ে এদেশে এসেছে মূলত আমেরিকার যুদ্ধনীতির কারণে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের জামানায় যুক্তরাষ্ট্রের কার্পেট বম্বিংয়ে কেম্বেডিয়ার কমপঙচনঙ এলাকায় অবস্থিত তাঁদের পুরো গ্রামটি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। এ কারণে বাস্তুহারা হয়ে পুরো এগারো বছর চাম পরিবার কাটান থাইল্যান্ডের শরণার্থী ক্যাম্পে। তারপর কপালগুণে রেফিউজি ক্যাটাগরিতে অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকেন।

মরগ্যান এবার জানতে চান, ‘ডু ইউ নো এনিথিং আবাউট দিস কাপোলস্ কালচারেল ব্যাকগ্রাউন্ড? সম্পাদক ঠিক বুঝতে পারেননি চাম শব্দটি, কেম্বোডিয়ার মানুষজনকে খেমার বলে না? আমি জবাব দিই, কেম্বোডিয়ার মূলধারার মানুষজনের নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি হচ্ছে খেমার। এরা বৌদ্ধ, অনুশীলন করে তারাবাদা সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস। চামরা মুসলমান, সংখ্যালঘু, এরা খেমার মুসলিম বলেও পরিচিত।’

মরগ্যানের পরবর্তী প্রশ্ন হয়, ‘দেশে এসে অভিবাসী হওয়ার আগে এঁনারা কী ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? ডু ইউ হ্যাভ অ্যানি আইডিয়া?’ কেন জানি আমার বিরক্তি আরেক দফা বাড়ে, তবে জবাব দেই, ‘মিসেস লেবু-কে চাম তারুণ্যে ছিলেন নৃত্যশিল্পী। নমপেনের রাজদরবারে তিনি একবার নৃত্য উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর স্বামী মি. ফাটেল সান চাম ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক। এঁরা খেমার ভাষায় কথা বলেন বটে, তবে এঁদের নিজস্ব ভাষার নাম হচ্ছে খা-খা। এ ভাষার লিখনশৈলী আজকাল আর কেউ ব্যবহার করে না, ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ফাটেল সান চাম হচ্ছেন খা-খা ভাষার একজন বিশেষজ্ঞ।’ মরগ্যান এবার আসল কথায় এসে বলেন, ‘আমাদের ছোট্ট শহরের নাগরিক বৈচিত্রে এরা যুক্ত করছেন নতুন একটি এলিমেন্ট। সম্পাদক এদের সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে চান। চিঠি নয়, তুমি এঁদের নিয়ে একটি ফিচার-স্টোরি করতে পারবে কি? ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড...দু-তিনটি ছবি লাগবে কিন্তু।’ গাড়ি এসে থামে চাম দম্পতির ঘরের সামনে। ইঞ্জিন অফ করে দিয়ে মরগ্যান প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান, আমি জবাব দিই, ‘আই উইল থিংক আবাউট দিস...আজ থাক, এ নিয়ে পরে কথা বলব। ও-কে।’

ঘরের বারান্দায় চুপচাপ বসে আছেন মিসেস লেবু-কে চাম। আমি হাত নাড়ি, তিনি চোখ তুলে তাকান, কিন্তু কিছু বলেন না। আঙিনায় ঘাস ও আগাছা বেড়ে জংলা হয়ে ওঠছে। ট্র্যাশ বিনের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা বর্জ বোঝাই আবর্জনার একাধিক ব্যাগ। মিসেস লেবু-কে চাম উঠে দাঁড়ান, তিনি কোমর সিধে করতে প্রচুর সময় নেন, টিপয় থেকে তুলে চশমাটিও চোখে লাগান। আমি কুঁজো ভঙ্গিতে এক-পা, দু-পা করে এগিয়ে আসা বৃদ্ধার দিকে তাকাই। মাস তিনকে আগে আমি একবার তাঁদের খোঁজ নিতে এ বাড়িতে এসেছিলাম। তখন মিসেস লেবু-কে চাম আমাকে তাঁদের ফ্যামিলি অ্যালবামটি দেখিয়ে ছিলেন, ওখানে আমি সটিন-রেশম ও ব্রোকেডে ঝলমলে নৃত্যের ট্র্যাডিশন্যাল পোশাক পরা যে তরুণীর ফটোগ্রাফ দেখেছি, তার সঙ্গে আমার দিকে এগিয়ে আসা কুঁচকানো ত্বক কুঁজো বৃদ্ধার কোনো মিল দেখতে পাই না।

মিসেস লেবু-কে চাম আমার কাছে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দেন। সচেতন হই যে, এ মুহূর্তে সামাজিক দূরত্ব বহাল রাখা সম্ভব হবে না। দ্বিধা ঝেড়ে আমি তাঁর হাত স্পর্শ করি। মৃদু হেসে জানতে চান, কী ধরনের খাবার নিয়ে এসেছি? কাবাবে হাড়গোড় কিছু নেই জানতে পেরে খুশি হন, বলেন, ‘মাই হাজবেন্ড লাভ মিট, কিন্তু চামরা মৎস্যজীবী, অনেকে বাস করে নদী বা দারিয়ার কিনারায়, ঈদে আমরা নারকেলের দুধ দিয়ে চিংড়ি মাছ রান্না করি।’ মরগ্যান এগিয়ে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে বাঁও করে পরিচিত হন। তিনি আবর্জনার ব্যাগগুলো তুলে ট্র্যাশ বিনে রাখার অনুমতি চান। মিসেস লেবু-কে মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে তাঁর কোমরের দিকে ইঙ্গিত করেন। বুঝতে পারি, এ বৃদ্ধাও বাত-ব্যাধির আরেক ভিকটিম। আমি খাবারের ব্যাগটি নিয়ে সিঁড়ির উপর রাখি। মিসেস লেবু-কে আফসোস করে বলেন, ‘গ্রোসারিতে চিংড়ি মাছ ছিল প্রচুর, কিন্তু যে ব্যাগের দাম মাস খানেক আগে ছিল নয় ডলার, তা বেড়ে হয়েছে সাতাইশ ডলার, এত দাম দিয়ে কিছু কেনা যায় নাকি?’ অতঃপর তিনি জানান যে, তাঁরা অপেক্ষা করে আছেন সরকারের পাঠানো স্টিমুলাস চেকটি পাওয়ার। করোনা সংক্রমণজনিত মন্দায় অর্থনীতিকে জিইয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস নাগরিকদের জন-প্রতি ১,২০০ ডলারের চেক পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের অব্যবস্থাপনায় অনেকে চেক পেয়েছেন, অনেকে পাননি। অনেক বছরের পুরানো অভিবাসী চাম দম্পতি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। চেক পাওয়ার হক তাঁদের আছে। চেক আমি নিজেও পাইনি, আমার জানাশোনা আরো অনেকেও পাননি। পরিস্থিতি যেভাবে চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনার দিকে আগাচ্ছে, কী বলব, বৃদ্ধাকে কোনো ভরসা দিতে পারি না। খিন্ন মনে বিদায় নিয়ে ফিরে আসি গাড়িতে।

মরগ্যান ডিসইনফেকশনের শিশিটি বাড়িয়ে দেন। আমি লোশন দিয়ে হাত পরিষ্কার করে গাড়িতে উঠি। তিনি স্টার্ট দিতে দিতে বলেন, ‘লেটস্ কাম ব্যাক টু দিস হাউস টুমরো। আমি পর্টেবল লনমোয়ার নিয়ে আসব। তুমি বৃদ্ধাকে রিং করে পার্মিশন নিয়ে রাখো। আমি তাঁর অঙিনার আগাছাময় ঘাসগুলো কেটে দিতে চাই।’

মাথায় একটি আইডিয়া খেলে যায়। চাম দম্পতির ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখা আছে খা-খা ভাষায় লেখা তালপাতার কয়েকটি পুঁথিপত্র। মিসেস লেবু-কের নৃত্যের পোশাক পরা যুবতী বয়সের একটি ছবির কপির সাথে তালপাতার পুঁথিপত্রের দুটি ছবি তুলে নিতে পারলে—স্থানীয় পত্রিকার জন্য অনায়াসে একটি ফিচার দাঁড় করানো যায়। আমি সম্ভাবনা নিয়ে ভাবি, কিন্তু ভেতর থেকে সায় পাই না। ত্রাণকাজের হিল্লা ধরে আমার একটি লেখার প্রয়োজনে এ দম্পতির ব্যক্তিগত সম্পদকে ব্যবহার করব, কাজটা কি নৈতিকভাবে সঠিক হবে?

আমরা যে রেফিউজি পরিবারদের খাবার দিতে যাচ্ছি, তাঁরা বাস করছেন শহর থেকে সামান্য দূরে—সস্তা হাউজিং ফেসিলিটিতে। মরগ্যান অই দিকে টার্ন নেন। সিগনালের লাল বাতিতে থামতেই মি. ইদ্রিসা বেনী ইসামের কাছ থেকে টেলিফোন আসে। তাঁরা অপেক্ষা করছেন। মরোক্ক থেকে অনেক বছর আগে অভিবাসী হয়ে এদেশে আসা মি. ইদ্রিসার ছেলে আবদেল বেনী ইসামের মৃত্যু হয়েছে সম্প্রতি কারাগারে, সম্ভবত করোনাক্রান্ত হয়ে। মরগ্যান ড্রাইভ করতে করতে মি. ইদ্রিসা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। মরোক্কর তানজিয়ার্স অঞ্চলের মানুষ ইনি। রাজবন্দী হয়ে সাত বছর কাটিয়েছেন ওই দেশের একটি কুখ্যাত কারাগারে। তারপর রাজা পঞ্চম মোহাম্মদের সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পেয়ে কিভাবে যেন ইমিগ্রেশন নিয়ে এদেশে আসেন। এক সময়ে ফুটপাতে দোকান সাজিয়ে সাভানা নগরীতে আগত পর্যটকদের কাছে বিক্রি করতেন—মরোক্কর কুটিরশিল্পজাত পণ্য। বয়সের কারণে আজকাল আর দোকানটি ম্যানেজ করতে পারেন না। গেল ঈদেও মসজিদ-ভিত্তিক পার্টিতে তিনি নিয়ে এসেছিলেন সবচেয়ে মজাদার কুসকুস। এবারকার দুর্বিপাকে খাবারের অনটনে ভুগছেন মি. ইদ্রিসার পরিবার। তাঁরা স্টিমুলাস চেকও পাননি। তাঁর ছেলে আবদেল বেনী ইসাম কাজ করত একটি শপিংমলে। ওখানকার একটি দোকানের কিছু সৌখিন পণ্য খোয়া গেলে সিসি টিভির সূত্র ধরে গ্রেফতার হয় আবদেলসহ আরো দুটি শ্বেতাঙ্গ তরুণ। মামলায় লইয়ারের আইনি মারপ্যাঁচে শ্বেতাঙ্গ ছেলে দুটি ছাড়া পায়। কিন্তু লইয়ার জোগাড় করার মতো আর্থিক সঙ্গতি মি. ইদ্রিসার ছিল না। তাই, সম্ভবত মিথ্যা মামলায় তাঁর সন্তান আবদেল চার বছর মেয়াদের সাজা পায়। কারাগার থেকে টেলিফোন করে সে জ্বর-কফ-কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভোগার সংবাদ তাঁর পিতাকে জানায়। কারাগারে এ সময় আরো অনেক কয়েদির শরীরে ফুটে উঠেছিল এ ধরনের রোগলক্ষণ। বেশ কয়েক জন কয়েদির মৃত্যু হয় অবশেষে। টেস্টিংয়ের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, তাই নিশ্চিত করে বলার কোনো উপায় নেই যে, এরা মারা গেছেন করোনা সংক্রমণে। আবদেলের মৃত্যুর আগে মি. ইদ্রিসা সন্তানের সঙ্গে দেখা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু কারাগারের ভিজিট আওয়ার বাতিল করা হয়েছিল। অতঃপর মি. ইদ্রিসা কারা-কতৃপক্ষের অনুমতি চেয়েছিলেন, যাতে ছেলেকে টেলিফোনে তওবা পড়াতে পারেন। তাঁকে এ ধর্মীয় অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়।

আমরা এসে পৌঁছি সস্তা হাউজিং ফেসিলিটিতে। পেভমেন্টের পাশে একটি বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছেন মি. ইদ্রিসা। আমাদের সালামের আলেক দেন তিনি, হাসেন, হাত নাড়েন, কিন্তু কিছু বলেন না। লাঠি হাতে অন্যমনস্ক হালতে বসা মরোক্কান কেতার অজানুলম্বিত সফেদ পোশাকপরা মানুষটিকে চিন্তামগ্ন সুফি-দরবেশের মতো দেখায়। আমরা খাবারের প্যাকেটগুলো পাশের আরেকটি বেঞ্চে রাখি। তিনি হাত তুলে আমাদের আশ্বস্ত করে বলেন, রেফিউজিদের অ্যাপার্টমেন্টগুলোর দোরগোড়ায় খাবার পৌঁছে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সোমালিয়ার শরণার্থী আহমদ গুদ একটু পর এসে অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে খাবার ক্যারি করে পৌঁছে দেবে।

একটু দোনামোনা করে অবশেষে বলেই ফেলি, ‘মি. ইদ্রিসা, আই অ্যাম সো স্যারি...সিনসিয়ার কনডোলেন্সসেস্ ফর ইয়োর সন’স ডেথ।’ বোবাদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি আমাকে তাঁর ছেলের মাগফেরাতের জন্য মোনাজাত করতে বলেন। আমি তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিই—ঘরে ফিরে প্রার্থনা করব। মরগ্যান এগিয়ে এসে বিনীতভাবে বলেন, ‘আমি ধর্মে মুসলমান নই, তবে ইসলাম ধর্মের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। আপনি যদি অনুমতি দেন, আমি আপনার ছেলের জন্য প্রার্থনা করতে চাই।’ ঘাড় হেলিয়ে মি. ইদ্রিসা সম্মতি দেন। মি. মরগ্যান দুহাত তুলে প্রার্থনা করেন, আমি ও ইদ্রিসা আমিন বলে দোয়ায় শরিক হই।

সোমালিয়া থেকে আগত দীর্ঘদেহী নওজোয়ান আহমদ গুদ এসে আমাদের ঈদ মোবারক বলে। ছেলেটি শহরের একটি বারবার সেলুনে চুল কাটার কাজ করত। প্রায় দুইমাস লকডাউনের পর শহরের সেলুন ইত্যাদি খুলেছে। জানতে চাই, ‘হাউ ইজ ইয়োর জব গোয়িং? কাজে গিয়েছিলে কি?’ নেতিবাচকভাবে হাত উল্টিয়ে আহমদ জানায়, গেল কয়েকদিন ধরে সেলুন খুলেছে, তবে এখনো কাস্টমাররা সেলুনে আসতে সাহস পাচ্ছে না। সে প্রতিদিন একবার করে সেলুনে হাজিরা দিচ্ছে, কিন্তু চুল কাটার লোকজন না আসলে মাথাওয়ারি পারিশ্রমিক পাওয়ার কোনো উপায় নেই। আমি দূরত্ব বজায় রেখে খেলনাগুলো খাবারের সাথে কোন কোন অ্যাপর্টমেন্টে পৌঁছে দিতে হবে তা বুঝিয়ে বলি। আহমদ একটি ঝুড়িতে প্যাকেটগুলো তুলছে। আমি এক পা সামনে গিয়ে জানতে চাই, ‘হাউ ইজ ইয়োর ফাদার মি. মোহাম্মদ গুদ?’ সে ‘আই উইল আনসার ইউ ইন আ মিনিট,’ বলে ইশারায় জানায় প্যাকেটগুলো গুছিয়ে নিয়ে সে আমাকে জবাব দিচ্ছে। আমি এ সুযোগে সংক্ষিপ্তভাবে মরগ্যানকে তার বাবা মোহাম্মদ গুদের করোনাক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠার ঘটনাটি জানাই। ডাক্তাররা প্রায় আশি বছরের এ বৃদ্ধের রিকভার করার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। পুরো চার সপ্তাহ যুঁজে যেন জাদুবলে তিনি রিকভার করেন। হাসপাতাল থেকে তাঁর রিলিজের দিন নার্স ও ডাক্তাররা জড়ো হয়ে হাততালি দিয়ে তাঁর সুস্থ হওয়ার বিষয়টি সেলিব্রেট করে। ঘটনাটি আমিও প্রত্যক্ষ করি স্যোশাল মিডিয়ায়। ঝুড়িতে প্যাকেটগুলো গুছিয়ে আহমদ গুদ বলে, ‘মাই ফাদার সেন্ড ইউ আ ম্যাসেজ মি. সুলতান। তুমি যে খাবার দিয়ে গিয়েছিলে, শুকনা বিস্কিটগুলো বাবার পছন্দ হয়নি। তিনি খেতে চাচ্ছেন এক পেয়ালা দুধ।’ আমি দুধ পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিই। আহমদ গুদ আতরের ছোট্ট একটি শিশি বের করে তাতে তুলা গুঁজতে গুঁজতে বলে, ‘বাবা তোমাদের জন্য সামান্য আতর পাঠিয়েছেন।’ সচেতন হয়ে উঠি যে, আহমদ গুদের হাত থেকে আতর নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামাজিক দূরত্বের নীতিমালা, আমি ও মরগ্যান পরস্পরের দিকে তাকাই, কিছু বলি না, অতঃপর খোশবুদার তুলা নাকে দিতে দিতে ভাবি—ঈদের দিন না হয় সামাজিক দূরত্বের সামান্য ব্যতিক্রমই হলো।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;