দস্তার কফিনে বন্দী ছেলেরা



সেভৎলানা আলেক্সেয়িভিচ ।। অনুবাদ: সঞ্জয় দে
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

নোবেল বিজয়ী বেলারুশিয়ান সাহিত্যিক সেভৎলানা আলেক্সেয়িভিচ রচিত ‘দস্তার কফিনে বন্দী ছেলেরা’ গ্রন্থটি কোনো প্রচলিত উপন্যাস নয়; সুইডিশ একাডেমির ভাষ্যমতে এই গ্রন্থটি বরং প্রত্যক্ষ্যদর্শীর বয়ানে রচিত ইতিহাস। সে ইতিহাস আবেগের, সে ইতিহাস আত্মার। সেভৎলানা যুদ্ধে যাওয়া সৈনিক, ট্যাংকচালক, সেবিকা, সন্তানহারা মা, স্ত্রী, বোন—এমন বহু মানুষের গল্প শুনেছেন। তাদের সেই গল্পগুলোকে, না বলা কথাগুলোকে এক এক করে অক্ষমালায় সাজিয়ে যুদ্ধের এক ভিন্ন ধরনের চিত্রপট আমাদের সামনে মেলে ধরেছেন। অসংখ্য গল্পের মাঝ থেকে জুরালেভ নামক এক ছত্রীসেনার মায়ের গল্পটি এখানে নিবেদন করা হলো।


দস্তায় মোড়া কফিনটির পাশে বসে বিলাপ করে বলছিলাম, ‘ওখানে কে শুয়ে রে? আমার ছোট্ট সোনাটা নাকি?’ বারবার ওই একই প্রলাপ বকেই যাচ্ছিলাম—‘কে শুয়ে ওখানে? আমার মানিক, তুই কি?’ সবাই ভাবছিল, আমি বুঝি পাগল হয়ে গেছি।

তারপর সময় বয়ে যায়। একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, খুঁজে বার করব আমার পুত্রের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ। সেনাবাহিনীর স্থানীয় নিয়োগ দপ্তরে গেলাম।

‘আমাকে অন্তত এটুকু বলুন, ঠিক কোথায় আর কিভাবে ছেলেটার মৃত্যু হয়েছিল’—ওদের কাছে ফরিয়াদ জানিয়ে বললাম, ‘ও মরে গেছে—এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমি নিশ্চিত—সেদিন একটা খালি কফিন কবর দিয়েছিলাম, আর আমার প্রাণের ধনটা হয়তো বেঁচে আছে কোনো একখানে।’

দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার আমার ওপর খুব রেগে গিয়ে চিৎকার শুরু করে দিলেন। ‘এটা রাষ্ট্রীয় একান্ত গোপনীয় বিষয়। আপনি এভাবে জনে জনে গিয়ে জানাতে পারেন না যে, আপনার ছেলে যুদ্ধে নিহত হয়েছে। এভাবে ঢ্যাঁড়া পেটানো যে নিষিদ্ধ, সেটা জানেন না?’

ওর জন্মের সময়টা ছিল দীর্ঘ আর বেদনাক্লিষ্ট। কিন্তু প্রসবের পর যখন ছেলের মুখ দেখলাম, আমার সমস্ত যন্ত্রণা যেন নিমেষেই উবে গেল। ওর জন্যে দুশ্চিন্তা করতাম সেই প্রথম দিন থেকেই, কারণ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ও-ই যে ছিল আমার একমাত্র অবলম্বন। আমরা একটা ছোট কুঁড়েঘরে থাকতাম। একটা মাত্র ছোট ঘর। কেবল একটা খাট, একটা প্যারামবুলেটর আর দুটো চেয়ার পাতা যায় সে ঘরে। রেলওয়েতে চাকরি করতাম। আমার কাজ ছিল রেলের পয়েন্ট বদলানো। মাসে ষাট রুবল বেতন পেতাম। ওকে জন্ম দিয়ে যেদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলাম, সেদিনই রাতের শিফটে কাজে ফিরে যেতে হয়েছিল। প্যারামবুলেটরের ভেতরে করে ওকে কাজে নিয়ে যেতাম। আমার সাথে সব সময় একটা খাবার গরম করার হটপ্লেট থাকত। ওতে করেই ওকে খাওয়াতাম, তারপর ঘুম পাড়াতাম। এর ফাঁকে ফাঁকে ট্রেনের পয়েন্ট বদলাবার কাজগুলো চলত। একটু যখন বড় হলো, তখন ওকে বাড়িতে একা রেখে আসতাম। ওর গোড়ালিটা প্যারামবুলেটরের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে আসতাম, কিন্তু... এভাবে অবহেলায় বড় হবার পরও কিন্তু একটা চমৎকার ছেলে হিসেবে ও গড়ে উঠেছিল।

স্কুল শেষে ছেলেটা ভর্তি হয়েছিল পেত্রযাভদস্ক-এর একটা স্থাপত্য কলেজে। কারেলিয়া অঞ্চলে। ফিনিস সীমান্তের কাছে। একবারই মাত্র দেখতে গিয়েছিলাম ওকে। ছুটে এসে আমাকে চুমু খেল, তারপর দৌড়ে কোথায় যেন পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণ বাদেই হাসতে হাসতে ফিরে এসে বলল, ‘মেয়েরা আসছে’।

‘কোন মেয়েরা?’—অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

ও আসলে তখন ছুটে গিয়েছিল বান্ধবীদের খবর দিতে—মা এসেছে। সেই মা, যার অসংখ্য গল্প এতকাল এই মেয়েরা ওর মুখ থেকে শুনে এসেছে।

আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ কোনো উপহার দেয়নি। একবার মা দিবসে ও বাড়ি এলে স্টেশন থেকে আনতে গেলাম।

‘তোর ব্যাগটা আমি ধরছি।’—ওকে বললাম।

‘এটা অনেক ভারী, মা। তুমি বরং আমার পোর্টফলিও কেইসটা নাও। তবে সাবধানে ধোরো।’

আমি ওটা সাবধানেই ধরলাম। নিশ্চয়ই কোনো দরকারি ড্রয়িং আছে ভেতরে—ভাবলাম। বাড়ি ফেরার পর ও কাপড় বদলাতে গেল, আর আমি ব্যস্তসমস্ত হয়ে গেলাম রান্নাঘরে—পাইকেক বানাতে। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, ছেলে আমার হাতে তিনটে তাজা রক্তিম টিউলিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হায় ঈশ্বর! এই মার্চ মাসে কোথা থেকে এই টিউলিপ জোগাড় করল? পরে বুঝলাম, সেই পোর্টফোলিও বাক্সে আসলে কাপড় দিয়ে ভালো করে মুড়ে আমার জন্যে এই টিউলিপগুলো নিয়ে এসেছিল, যাতে ঠান্ডায় জমে না যায়! সেই প্রথম কেউ আমাকে ফুল উপহার দিল।

সে বছর গ্রীষ্মে ও ভবন নির্মাণের একটা স্পেশাল প্রজেক্টে কাজ করছিল। আমার জন্মদিনের ঠিক আগে আগে বাড়িতে এল। ‘আমি খুব দুঃখিত মা, আর কটা দিন আগে আসতে পারলাম না। তবে তোমার জন্যে ছোট্ট একটা জিনিস এনেছি’—বলে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। চোখ বুলিয়ে দেখি—একটা মানি অর্ডার। বারো রুবল, পঞ্চাশ কোপেকের।

‘মা, তুমি মনে হয় দশমিক গুলিয়ে ফেলছো। ওটা আসলে বারশ পঞ্চাশ রুবলের।’

ইহজন্মে এত টাকা হাতের মুঠোয় দেখিনি। আমি কী করে জানব কোথাকার দশমিক কোথায়?

ওর মনটা বড্ড মায়াভরা ছিল। প্রায়ই বলত, ‘মা তুমি তো রিটায়ার করছো, ওদিকে সামনে আমিও মেলা টাকা কামাব। আমাদের দুজনের ও-দিয়ে ভালোভাবেই হয়ে যাবে। তোমার মনে আছে, ছোটবেলায় আমি তোমাকে বলতাম, বড় হয়ে আমি তোমাকে কোলে করে ঘুরব?’

ও কিন্তু সেটাই করেছিল। ৬ ফুট ৫ ইঞ্চির ছেলে আমার। আমি তখন ওর কাছে ছোট্ট খুকি। আমাদের দুজনেরই তো দুজন ছাড়া আর কেউ ছিল না, সেজন্যেই হয়তো নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে আমরা মা-ছেলে একে অপরকে ভালোবাসতাম। ওর ঘরে বৌ এলে কী হতো, কে জানে! মাঝে মাঝে ভাবতাম, বৌ না এলেই হয়তো ভালো হয়।

একদিন বাধ্যতামূলক সামরিক ট্রেনিংয়ের সমন এলো। ছেলেটার আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল—ছত্রীসেনা হবে। ‘মা, ওরা ছত্রীসেনা দলে লোক নিচ্ছে। কিন্তু আমায় নেবে কিনা কে জানে! আমি তো যে লম্বা! ওরা তো বলছে, আমার উচ্চতার কারণে নাকি প্যারাসুটের দড়ি ছিঁড়ে যাবে। আমার অবশ্য এই দলটিতেই যোগ দেবার বেশি ইচ্ছে।’

তো সেভাবেই একদিন ভিতেবস্ক ছত্রীসেনা ডিভিশনে নাম লেখাল। শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে আমি গেলাম। যখন শপথ বাক্য পাঠ করছে, তখন দেখলাম, ছেলেটা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখমণ্ডল—উচ্চতা-সংক্রান্ত সংকোচ-বিহীন।

‘মা, তুমি এত ছোট কেন বল তো?’—ও জিজ্ঞেস করেছিল।

‘তোর জন্যে আমার যে শূন্যতাবোধ, সেটি আমায় বাড়তে দেয়নি। ছোট করে রেখে দিয়েছে।’—একটু ঠাট্টা করে বললাম।

‘আমাদের দলকে আফগানিস্তানে পাঠাচ্ছে, মা। তবে আমি হয়তো যাচ্ছি না। তোমার একমাত্র সন্তান আমি। কী করে যাই! আচ্ছা আমি হবার পর আরেকটা মেয়ে হওয়ালে না কেন বলো তো?’

সেই শপথ অনুষ্ঠানে বহু মা-বাবা এসেছিল। হঠাৎ শুনি, মঞ্চ থেকে কে যেন ঘোষণা করছে, ‘শ্রীমতী জুরালেভা কোথায়? জুরালেভা, এদিকে আসুন। আপনার ছেলেকে অভিনন্দন জানান।’ আমি উঠে গেলাম ওকে চুমু খাবার জন্যে। কিন্তু এই ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি ছেলের কপাল কী করে ছুঁই?

‘প্রাইভেট জুরালেভ, একটু ঝুঁকে দাঁড়াও, যাতে তোমার মা চুমু খেতে পারেন।’—কমান্ডেন্ট আদেশ করলেন জুরালেভকে। ওর কপালে চুমু খাবার মুহূর্তে একজন ফটোগ্রাফার পাশ থেকে ছবি তুলল, উর্দি পরা অবস্থায় ওর সাথে আমার একমাত্র ছবি।

সেদিন অনুষ্ঠান শেষে ওদেরকে কয়েক ঘণ্টা ফ্রি টাইম দেওয়া হলো। কাছেই একটা পার্কে গেলাম। ঘাসের ওপর বসার সময়ে ও যখন বুটজোড়া খুলে ফেলল, লক্ষ করলাম—ওর গোড়ালিতে রক্ত। ওদেরকে নাকি প্রতিদিন প্রায় ৩০ মাইল দৌড়ুতে হয়। পায়ের মাপ ১১ হলেও ওকে দেওয়া হয়েছে সাড়ে নয়ের বুট। ছেলেটা প্রতিবাদ করেনি; বরং বাকিরা যেখানে পিঠে বেঁধে রাখা ব্যাগ থেকে কৌশলে আদ্দেক বালি ফেলে দিয়ে দৌড়ুত, সেখানে ও দৌড়ুত পুরো ওজন নিয়েই।

ভাবছিলাম ওর জন্যে বিশেষ কিছু একটা করব। তাই জিজ্ঞেস করলাম—‘কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাবি বাবা? আমরা দুজনে তো কখনো রেস্টুরেন্টে খাইনি।’

‘তুমি বরং আমাকে কয়েক পাউনড মিষ্টি কিনে দাও, মা। মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে।’

ব্যারাকে ফিরে যাবার সময় ঘনিয়ে আসছিল। বিদায়বেলায় ও আমার দিকে ফিরে হাত নাড়ল। অন্য হাতটিতে তখন আমার কিনে দেওয়া সেই মিষ্টি।

গ্যারিসন থেকে আমাদেরকে, মানে ক্যাডেটদের পরিবারের সদ্যসদেরকে রাত কাটাবার জন্যে রাখা হয়েছিল স্পোর্টস হলে। মেঝেতে মাদুর পেতে। কিন্তু সে রাতে আমাদের কেউই এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের পাতা এক করতে পারিনি। উৎকণ্ঠায় আমরা বরং হেঁটে বেড়িয়েছি ব্যারাকের চারপাশে—যেখানে আমাদের ছেলেরা ঘুমে অচেতন।

ভোরের দিকে বিউগলের শব্দে ধড়মড় করে উঠে বাইরে এলাম। ভাবলাম শরীরচর্চা কেন্দ্রের পাশ দিয়ে মার্চ করে যাবার সময়ে ওকে হয়তো দূর থেকে এক ঝলকের জন্যে হলেও দেখতে পাব। ওদেরকে দৌড়ুতে দেখলাম। কিন্তু সবার পরনেই ওই একই ডোরাকাটা জামা থাকায় কে যে আমার মানিক, সেটা ঠাহর করতে পারলাম না। ওরা সবসময় দল বেঁধে চলত। সেটা ক্যান্টিনে যাবার সময়েই হোক, কিংবা টয়লেটে যাবার সময়েই হোক। ওদেরকে একা-একা কোথাও যেতে দেওয়া হতো না। কারণ, এর আগে নাকি এমন ঘটেছে যে—যখন কোনো সৈনিক জেনেছে যে তাকে আফগানিস্তানে পাঠানো হচ্ছে, সে টয়লেটে গিয়ে গলায় দড়ি দিয়েছে, নয়তো ব্লেড দিয়ে কবজির নাড়ি কেটে ফেলেছে।

বাসের ভেতরে কেবল আমি একাই কাঁদলাম। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল—ওকে আর কখনো দেখতে পাব না। মায়ের মন! কিছুদিনের মধ্যেই ওর একটা চিঠি পেলাম—‘তোমার বাসটা দেখে পেছন-পেছন দৌড়ে গিয়েছিলাম, মা। ভেবেছিলাম তোমাকে শেষবারের মতো আবারও দেখতে পাব।’

সেই শপথ গ্রহণের দিনে পার্কে যখন আমরা বসেছিলাম, তখন লাউডস্পিকারে একটা পুরনো মিষ্টি গানটা বাজাচ্ছিল—‘মা যখন আমায় বিদায় দিল।’ আজকাল আমার মাথায় এই গানের কলিটা সবসময় ঘোরে।

ওর পরের চিঠিটা শুরু হয়েছিল এইভাবে—‘কাবুল থেকে বলছি, কেমন আছো মা?’ প্রথম লাইনটুকু পড়েই আমি এত জোরে চিৎকার করে উঠেছিলাম যে, পাশের বাড়িরা পড়শিরা পর্যন্ত হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। ‘এটা পুরোপুরি আইন আর স্বাধিকার পরিপন্থী।’—টেবিলে মাথা ঠুকতে ঠুকতে ওদেরকে বলছিলাম। ‘ও আমার একমাত্র ছেলে... এমনকি সেই জারের আমলেও একমাত্র ছেলেদেরকে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হতো না। আর আজ কিনা ওকে পাঠানো হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে।’ সাসার জন্মের পর সেদিনই প্রথমবারের মতো মনে হচ্ছিল—এ জীবনে বিয়ে না করে হয়তো ভুলই করেছি। এখন তো আমাকে আগলে রাখার মতো আর কেউ রইল না।

সাসা কিন্তু আমাকে মাঝে মাঝেই খোঁচাত—‘মা, তুমি এখনো বিয়ে করছো না কেন বলো তো?’

‘কারণ, তুই হিংসা করবি, তাই।’—ওকে বলতাম। ও হাসত শুনে। তারপর আর কিছু বলত না। চুপ হয়ে যেত। আমরা দুজনেই ভাবতাম—এভাবেই বুঝি জীবনটা একসাথে কেটে যাবে অনন্তকাল।

ও এরপরও আমাকে বেশ কয়েকটা চিঠি পাঠিয়েছিল। নিয়মিতভাবে নয়। বেশ কিছুটা সময় বাদে বাদে। একবার তো এমন হলো যে, ওর চিঠি না পেয়ে ওর কমান্ডিং অফিসারকে চিঠি লিখে বসলাম। তার ঠিক পরপরই সাসা-র কাছ থেকে চিঠি পেলাম। খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে লিখেছে—‘মা, তুমি আমার কমান্ডিং অফিসারকে চিঠি লিখো না। তোমার শেষ চিঠিটার জন্যে আমাকে বেশ ভুগতে হয়েছে। শেষেরবার চিঠি লিখতে দেরি হয়েছিল—কারণ, আমার হাতে মৌমাছি কামড়েছিল। আমি হয়তো অন্য কাউকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে তোমাকে পাঠাতে পারতাম, কিন্তু অচেনা হাতের লেখা চিঠি পেয়ে তোমার দুশ্চিন্তা বাড়ত বই কমত না।’

আমার উৎকণ্ঠা আঁচ করতে পেরে ও হয়তো গপ্পোটা বানিয়ে বলেছে। কিন্তু এদিকে আমি তো প্রতিদিনই টিভি দেখি। বেশ বুঝতে পারি—ছেলেটা হয়তো যুদ্ধে আহত হয়েছে। তারপর থেকে প্রতিদিনই একটা করে চিঠি না পেলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারতাম না। আতঙ্কে। আমাকে প্রবোধ দেবার জন্যে ও লিখত—‘মা, তুমি কী করে প্রতিদিনই একটা করে চিঠি আশা করো, যেখানে কিনা আমরা খাবার বিশুদ্ধ জলই পাই দশ দিনে একবার করে?’

একদিন চিঠিতে ওর আনন্দ ঝরে পড়ল—‘হুররে, আজ আমরা একটা গাড়ি বহরকে পাহারা দিয়ে সোভিয়েত সীমান্ত অবধি পৌঁছে দিয়েছি। যদিও সীমান্ত পার হইনি, তবুও দূর থেকে মাতৃভূমির দেখা তো পেলাম! এই সোভিয়েত দেশটাই পৃথিবীর সেরা দেশ!’

শেষ চিঠিটায় ও লিখেছিল—‘এই গ্রীষ্মটা পার করতে পারলেই ঘরে ফিরব আমি।’

সে বছর আগস্টের ২৯ তারিখে ভাবলাম, গ্রীষ্ম তো শেষ হয়ে এলো। সাসা-র জন্যে বরং একটা স্যুট আর কিছু জুতো কিনে রাখি। ছেলেটা বাড়ি ফিরে পরবে। ওগুলো আজও দেরাজে তোলা আছে...।

ত্রিশ তারিখে কাজে যাবার আগে হঠাৎ কী মনে হলো। কানের দুল আর হাতের আংটি খুলে ফেললাম। কেন যেন ওগুলো আর পরতে মন চাইছিল না।

পরে জেনেছি, ওই বিশেষ দিনটাতেই ও মারা গিয়েছিল।

ওর মৃত্যুর পর এই যে আজও বেঁচে আছি, সে আমার ভাইয়ের বদৌলতে। সাসা-র মৃত্যু সংবাদ পাবার পর পুরো একটা সপ্তাহ ও আমার বিছানার পাশে মেঝেতে শুয়ে থেকেছে। মনিবকে সঙ্গ দেওয়া কুকুরের মতো। ভাই হয়তো অনুমান করেছিল, যে কোনো মুহূর্তে আমি দৌড়ে আমাদের সাত তলার ফ্ল্যাটটির ব্যালকনিতে যেয়ে নিচে ঝাঁপ দিতে পারি।

সাসা-র কফিনটা যখন আমাদের বসার ঘরে নিয়ে এলো, সেটার ওপর আছড়ে পড়লাম। আমার হাত দিয়ে বারবার মেপে দেখলাম কফিনের দৈর্ঘ্য। তিন ফুট...ছ ফুট...সাড়ে ছ ফুট...ঠিক অতটুকুই তো ওর উচ্চতা ছিল। কফিনটা কি ওর তুলনায় ছোট ছিল? উন্মাদিনীর মতো সেই কফিনের দিকে তাকিয়ে প্রলাপ বকতে থাকলাম—‘ওখানে কে রে? আমার মানিক? আমার মানিক ওখানে?’ কফিনটাকে ওরা সিল করে এনেছিল। তাই ওকে শেষবারের মত চুমু খাওয়া হলো না। এমনকি শেষ শয্যায় ওর পরনে কী ছিল, সেটা পর্যন্ত আমি জানি না।

আমি ওদেরকে বলেছিলাম, গোরস্থানে আমি নিজে ওর জন্যে একটা জায়গা বাছাই করব। ওরা আমাকে কয়েকটা সম্ভাব্য স্থানের কথা জানাল। ভাইয়ের সাথে সেই স্থানগুলো দেখতে গেলাম। ওখানে আগে থেকেই বেশ কিছু আফগান-যুদ্ধে মৃত সৈনিকের কবর ছিল। মধ্য সারিতে।

‘ওই জায়গাটা আমি আমার সাসা-র জন্যে চাই, নিজের বন্ধুদের সাথে চিরনিদ্রায় ঘুমুতে পেরে ওর নিশ্চয় ভালোই লাগবে।’—কবর খোঁড়ার দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদেরকে বললাম।

সেখানে কর্তামতো যিনি ছিলেন তিনি ঈষৎ মাথা নেড়ে বললেন, ‘দুঃখিত। ওখানে হবে না। আফগান যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের একসাথে সার বেঁধে দাফন করার অনুমতি নেই। ওদেরকে গোরস্থানের এখানে ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাফন করতে হবে।’

ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল এবারে। ‘সোনিয়া, এত রেগে যাস না, শান্ত হ, শান্ত হ বোন।’—ভাই আমাকে থামাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কী করে শান্ত থাকি আমি?

টিভিতে যখন কাবুলের কিছু দেখায়, ইচ্ছে হয়—একটা মেশিনগান নিয়ে ওখানে গিয়ে ওদের বহু লোককে মেরে ফেলি। টিভির সামনে বসে এভাবেই আমি দিনের পর দিন ওদেরকে গুলি করে মেরে ফেলার স্বপ্ন দেখতাম। এই বিশেষ ইচ্ছেটা অবশ্য একদিন মরে গেল, যেদিন দেখলাম—আমার মতোই একজন আফগান মা যুদ্ধে তার একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আহাজারি করছেন।

আজকাল ভাবছি, অনাথালয় থেকে একটা ছেলেকে দত্তক নেব। সাসা-র মতোই সোনালি চুলের কোনো বালককে। না থাক, ছেলে হলে আতঙ্কের মাঝে থাকব। আবার হয়তো যুদ্ধে গিয়ে মরে আসবে। তার চেয়ে বরং মেয়েই ভালো। তারপর আমরা মা-মেয়ে মিলে সাসা-র জন্যে অপেক্ষা করব... আমি উন্মাদ নই, কিন্তু আমি আজও সাসা-র জন্যে অপেক্ষা করি। এমনও গল্প শুনেছি, ওরা কোনো মায়ের কাছে হয়তো ছেলের কফিন পাঠিয়েছে। মা সেই দস্তায় মোড়া কফিন দাফন করেছেন। তারপর এক বছর বাদে হঠাৎ সেই ছেলে বাড়িতে উপস্থিত। যুদ্ধে আহত হয়েছিল, কিন্তু বেঁচে গেছে কোনোভাবে। সেই মায়ের তো তখন আত্মা খাঁচাছাড়া হবার দশা! তেমনটা কি আমার সাসা-র ক্ষেত্রে ঘটতে পারে না? পারে হয়তো। আমি তাই আজও ওর জন্যে অপেক্ষা করছি। ওর মৃতমুখ আমি দেখিনি। আমার কাছে তাই সাসা আজও জীবিত, আজও ওর প্রতীক্ষায় দিন গুনি আমি...

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;