ব্রানসউইক শহরে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ আহমুদ আরবারি (শেষ পর্ব)



মঈনুস সুলতান
গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

[পূর্ব প্রকাশের পর] পেছনের সিটে ধড়মড় করে জেগে ওঠেন মিসেস মেলবো। পিচ্যুত করে তিনি আইসটির ক্যানটি খুলে বিড়বিড়িয়ে বলেন, ‘হিয়ার উই আর.. এগেইন হোয়াইটম্যান মার্ডারড্ অ্যান আন-আর্মড ব্ল্যাক মেইল।’ হলেণ লো-স্পিডের লেইনের দিকে সরে যেতে যেতে অনুরোধ করে, ‘কুড ইউ টক আবাউট দিস ইস্যু এগেইন, আই মিন দ্যা কনটেক্সট্ অব দিস কিলিং, মিসেস মেলবো?’ একটু বিরক্ত হয়ে তিনি জবাব দেন, ‘সেইম ওল্ড স্টোরি অব আমেরিকান সাউথ।’ আমরা মনোযোগ দিয়ে তাঁর বিররণ শুনি।

তরুণ আহমুদ আরবারি ভালোবাসত শরীরচর্চা। সে জগ করতে বেরিয়ে সাটিলা শৌরস এলাকার একটি বৃক্ষছায়াময় সরণি ধরে দৌড়াচ্ছিল। পথে একটি কন্সট্রাকশন সাইটের পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সে কাঠ দিয়ে তৈরি হওয়া বাড়িটি খুঁটিয়ে নিরিখ করে। সিসিটিভি তাঁর উপস্থিতি রেকর্ড করে রেখেছে। না, সে কন্সট্রাকশন সাইট থেকে কিছু চুরি করেনি। আহমুদ ফের দৌড়াতে শুরু করলে তাঁকে ব্রাগলার বা ছিঁচকে চোর সন্দেহ করে শ্বেতাঙ্গ পিতাপুত্র গ্রেগরি ও ট্রেবিস ম্যাকমাইকেল হ্যান্ডগান হাতে পিকাপ ট্রাকে করে অনুসরণ করে। এক পর্যায়ে দৌড়রত আহমুদের গায়ে পিকাপের ধাক্কা লাগিয়ে তারা তাঁকে থামিয়ে ফেলে। প্রাক্তন পুলিশ অফিসার গ্রেগরি আহমুদ আরবারিকে সিটিজেন অ্যারেস্ট করতে যায়। সিটিজেন অ্যারেস্ট হচ্ছে কোথাও কোনো অপরাধ সংঘঠিত হলে, পুলিশের অপেক্ষা না করে নাগরিকদের উদ্যোগে অপরাধীকে তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করা। ঔপনিবেশিক জামানায় যখন জার্জিয়া অঙ্গরাজ্যে কেবলমাত্র হোয়াইটম্যানরা ছিল নাগরিক, তখন থেকে সিটিজেন অ্যারেস্ট প্রথা প্রচলিত আছে। ঐতিহাসিকভাবে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে অজস্রবার—ক্রীতদাস হওয়ার কারণে যাদের নাগরিক অধিকার ছিল না, সেসব কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের গ্রেফতার করার কাজে। তো গ্রেগরি ও ট্রাবিস আহমুদ আরবারিকে গ্রেফতার করতে গেলে সে বাঁধা দেয়, দস্তাদস্তি বাঁধে। এক পর্যায়ে ট্রাবিস আরবারিকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার সবচেয়ে ট্র্যাজিক দিক হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের চারমাস পরও স্থানীয় পুলিশ খুনি পিতা-পুত্রকে গ্রেফতার করেনি।

আরবারি পরিবারের উকিল এ নিয়ে প্রশাসনে দেনদরবার করেন। ডিসট্রিক্ট অ্যার্টোনির অফিস থেকে তাঁকে জানানো হয় যে, ম্যাকমাইকেলরা অ্যারেস্টের সময় দৈহিক প্রতিরোধের মুখে আত্মরক্ষার তাগিদে গুলি ছুড়েছেন। আত্মরক্ষার বৈধ অধিকার তাদের আছে। তাই এ হত্যাকাণ্ডে লংঘিত হয়নি বিশেষ কোনো আইন। তারপর এ ঘটনার ভিডিওসহ নিউইয়র্ক টাইমস্ সংবাদটি প্রকাশ করে। শুরুয়াত হয় প্রতিবাদী কর্মকাণ্ড। বর্ণবাদ-বিরোধী মানুষদের চাপে জর্জিয়ার ব্যুরো অব ইনভেশটিগেশন অতঃপর তদন্তের দায়িত্ব নেয়। ততদিনে তামাম রাজ্য জুড়ে আন্দোলনের বিস্তৃতি হয়েছে, পিতা-পুত্রও গ্রেফতার হয়েছে তীব্র প্রতিবাদের চাপে, কিন্তু এখনো আদালতের রায় বেরোয়নি। ঘটনাটি যাতে জনবিস্মৃতির আড়ালে না যায়, সে লক্ষ্যে সংঘঠিত হয়েছে আজকের ক্রুশ-কাঠ পুষ্পমণ্ডিত করার প্রতিবাদী অনুষ্ঠান।

মিসেস মেলবো হঠাৎ করে চুপ হয়ে ঘন ঘন হাই তোলেন, তাতে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে কাচের ফেসশিল্ড। ‘দিস ড্যাম থিং জাস্ট ক্লাউডেড মাই ভিশন’ বলে তিনি খুলে ফেলেন কাচের রক্ষাকবচ। চলমান সড়কের দুপাশে লোনাজলে জারিত ওয়েটল্যান্ডকে আশ্চর্য সুন্দর দেখায়। হলেণ সে দৃশ্যপট থেকে চোখ ফিরিয়ে বলে, ‘আই নো ইউ লুক আপ ইন্টারন্যাট আর্লি ইন দ্যা মনিং, ডিড ইউ ফাইন্ডআউট অ্যানি থিংক আবাউট দিস ব্রানসউইক টাউন?’ আমি জবাব দিই, ‘আই ওয়াজ অ্যাকচুয়েলি লুকিং অ্যাট দি ব্যাকগ্রাউন্ড অব রেস রিলেশন ইন দিস টাউন।’ বলে আমি নোটবুক খুলে তাতে টুকে রাখা কিছু তথ্য পড়ে শোনাই। ১৯৬৪ অব্দি ব্রানসউইক শহরে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের জন্য চালু ছিল সম্পূর্ণ আলাদা মুভি থিয়েটার, পার্ক ও আইসক্রিম পার্লার। এ শহরকে কোনো কোনো নিবন্ধে মোস্ট ‘সেগ্রিগেটেড পার্ট অব দি আমেরিকান সাউথ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শ্বেতাঙ্গ ছাত্রদের সঙ্গে একই স্কুলে যাওয়ার অধিকার ছিল না কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেমেয়েদের। পৌরসভা পরিচালিত খেলার মাঠ ও জিমনেশিয়ামে চালু ছিল একই রকমের বিভাজন রীতি। ১৯৬৫ সালে বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সিভিল রাইটস্ অ্যাক্ট অনুমোদিত হয়, তখন আইনিভাবে বর্ণভিত্তিক সেপারেশনের বিলোপ ঘটে। এ পরিবর্তনের পর উদারনৈতিক এক মেয়র নগরীতে কালো ও ধলো উভয় সম্প্রদায়ের ব্যবহারের জন্য তৈরি করেন একটি বারোায়ারি সুইমিং পুল। প্রথমে শ্বেতাঙ্গরা পুলে যাওয়া বয়কট করে, তারপর রাতের অন্ধকারে তারা ট্রাকভর্তি মাটি ও আবর্জনা দিয়ে সুইমিং পুলটি ভরাট করে দেয়।

চোখের সামনে ওয়েটল্যান্ডটি ভরে ওঠে অজস্র পাখপাখালিতে। নিচু জলাভূমি থেকে যেন আসমানের দিকে রওয়ানা হয়েছে বেজায় উঁচু একটি সাসপেনশন ব্রিজ। হলেণ ড্রাইভ করতে করতে বলে, ‘আই হেইট দিস সিডনি ব্রিজ, এত উঁচু ব্রিজে ঠিকমতো রেলিং দেয়নি কেন?’ মিসেস মেলবো সিট থেকে গজ গজ করেন, ‘চার শত ছিয়াশি ফুট উঁচু এ ব্রিজের ওপর দিয়ে ড্রাইভ করতে আমার এত নার্ভাস লাগত যে.. ডু ইউ নো হোয়াই দে কল ইট সিডনি লেনিয়ার ব্রিজ, মি. লেনিয়ার ওয়াজ অ্যান একমপ্লিশড পোয়েট এন্ড মিউজিশিয়ান, তাঁর দ্যা মার্শেজ গ্লিন কবিতাটি খুবই সুন্দর, তবে একটা কথা.. মি. লেনিয়ার ক্রীতদাস মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় যুদ্ধকারী কনফেডারেট আর্মির হয়ে কাজ করেছিলেন।’ আমি তথ্যটি নোটবুকে টুকি। মিসেস মেলবো জানতে চান, ‘তুমি তো কবিতা ভালোবাসো সুলতান, তুমি চাইলে আমি মার্শেজ গ্লিন কবিতাটির কপি স্ক্যান করে পাঠাতে পারি।’ ক্রীতদাস প্রথা বহাল রাখার পক্ষে সার্ভিস দেওয়া কবির কবিতা পাঠ করার জন্য আমি তেমন একটা আগ্রহ দেখাই না। ব্রিজ অতিক্রম করে হলেণ ব্রানসউইক শহরের দিকে টার্ন নেয়।

শহরে ঢুকে পড়ে আমরা সিটি হলের পার্কিংলটে থামি। প্রতিবাদীদের এ জায়গায় জড়ো হয়ে, মিছিল করে আহমুদ আরবারি যে সরণীতে খুন হয়েছেন, ওখানে গিয়ে পুষ্পিত ক্রুশ-কাঠ স্থাপন করার কথা। সুনসান পার্কিংলটে কোনো মানুষজন দেখতে না পেয়ে আমরা অবাক হই! সিটি হলের সুদর্শন ইমারতটি ভিক্টোরীয় স্থাপত্যের দৃষ্টিনন্দন নজির হয়ে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ ভোরে ইন্টারন্যাটে পড়েছি, দালানটি আদিতে ছিল শ্বেতাঙ্গ সাহেবদের প্রশাসনিক দফতর, ক্রীতদাস বেচাকেনার রসিদ দেওয়া হতো এখান থেকে। প্রতিবাদীদের তালাশে গাড়ি থেকে নেমে আমি ও মিসেস মেলবো হেঁটে যাই দালানটির পেছন দিকে। ওখানে ছোটখাট স্কোয়ারের মতো বাঁধানো পরিসরে জড়ো হয়েছেন জনা কয়েক মুণ্ডিত-মস্তক শ্বেতাঙ্গ। এদের হাতের প্লেকার্ডগুলোতে ঝলমল করছে কনফেডারেট ফ্ল্যাগ। কনফেডারেসি ছিল ক্রীতদাস মালিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী অবৈধ রাষ্ট্র। তাদের নীতি-আর্দশ পত্র-পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, “..ইডিওলজি ইজ বেইসড্ আপঅন দ্যা গ্রেট ট্রুথ দ্যাট দ্যা নিগ্রো ইজ নট ইকুয়েল টু দি হোয়াইট ম্যান; দ্যাট স্লেভারি, সাবডিনেশন টু দ্যা সুপিরিওর রেস, ইজ হিজ নেচার‌্যাল এন্ড নরম্যাল কন্ডিশন।” যে সব শ্বেতাঙ্গ ‘নিগ্রো’ বা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের তাদের সমকক্ষ বিবেচনা করেনি, যারা বলপ্রয়োগে তাঁদের ক্রীতদাসের জীবনযাপনে বাধ্য করাটা স্বাভাবিক মনে করেছিল, তাদের অধঃস্থন পুরুষরা আজকাল হোয়াইট সুপ্রিমেসি নামক বর্ণবাদী নীতিমালার প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করছে কনফেডারেট ফ্ল্যাগ। একটি বড়সড় ব্যানার ক্যারি করে দুজন মুণ্ডিত-মস্তক শ্বেতাঙ্গ আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, তাতে লেখা ‘ব্ল্যাক ইজ দ্যা কালার অব হেল।’ তারা পিপিই, মাস্ক ও ফেসশিল্ড পরা মিসেস মেলবোর দিকে ইশারা করে বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বলে, ‘হেই পেঙ্গুইন-লেডি, দিস ইজ আওয়ার টাউন, নো ফাকিং প্রোটেস্ট হিয়ার।’ দ্বন্দ্ব এড়ানোর প্রয়োজনে চোখ নামিয়ে, কোনো কথা না বলে আমরা চুপচাপ ফিরে আসি গাড়িতে। হলেণ পার্কিংলট থেকে বেরিয়ে আসে মেইন রোডে।

সিটিহল : ভিক্টোরীয় স্থাপত্যের দৃষ্টিনন্দন নজির

বেশি দূর আগাতে পারি না আমরা। দেখি, সড়ক জুড়ে মার্চ করে আগাচ্ছে বর্ম পরা, সঙ্গীনে টিয়ার গ্যাসের শেল লাগানো কাচের ঢাল হাতে রায়ট পুলিশের ট্রুপ। গাড়ি সাইড করে হলেণ তাদের পাস দেয়। আমাদের কাছাকাছি সড়ক ছেড়ে ঘাসের ওপর সাইড করে থেমেছে আরো কয়েকটি মোটরকার। তারা রায়ট পুলিশের সমর্থনে হর্ন বাজায়। জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে কাছে সাইড করা একটি গাড়ির বাম্পার স্টিকারটি আমি পড়ি, তাতে বড় বড় হরফে লেখা লেখা, বি প্যাট্রিয়ট এন্ড সার্পোট আওয়ার হোয়াইট পুলিশ অফিসারস্।’ গেল রাতে টেলিভিশনের টকশোতে শোনা পুলিশি হত্যার একটি উপাত্ত মনে ফিরে আসে। যুক্তরাষ্ট্রে গেল এক বছরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন এক হাজার মানুষ, যাদের অধিকাংশ ছিলেন তরুণ বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ। টকশো হোস্ট ইউরোপের আরো দুটি দেশের সাথে তুলনা দিয়ে জানিয়েছেন, একই সময় জার্মানিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন মাত্র তিন জন ও গ্রেট ব্রিটেনে পাঁচজন মানুষ। মিসেস মেলবো সেলফোনে ব্রাউজ করে আজকের জমায়েত সংক্রান্ত তথ্য বের করেন। প্রতিবাদীরা সিটি হলের সামনেই জড়ো হয়েছিলেন, কিন্তু কয়েকজন হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট সশস্ত্রভাবে ওখানে চলে আসলে, সংঘর্ষ এড়াতে তারা সিটি হল ত্যাগ করে চলে গেছেন লাভারর্স ঔকের দিকে। জমায়েতের আয়োজকরা প্রতিবাদীদের সম্পূর্ণরূপে অহিংস থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন।

আমরা গড়ি ঘুরিয়ে রওয়ানা হই লাভারর্স ঔকের দিকে। পথে দেখি দুটি বাড়ির বিশাল আঙিনায় স্ট্যান্ডে আটকানো পেল্লায় সাইজের প্লেকার্ড, তাতে লেখা, ‘ইউজিং মাস্ক ইজ আন আমেরিকান, ইট সার্পোটস্ চায়নিজ ইকোনমি,’ ও ‘করোনাভাইরাস ইজ অভার, লেটস্ রিস্টার্ট আওয়ার ইকোনমি।’ প্লেকার্ড দুটিতে যথারীতি সাঁটা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আলোকচিত্র। লাভাস্ ঔকে পৌঁছার সরণীর মুখে পড়ে লো-ইনকাম হাউজিং এর রঙচটা একটি বিল্ডিং। তার ফেনসিংয়ে আটকানো ব্যানারে লাভ সাইনের পাশে আহমুদের সঙ্গে লেখা শ্বেতাঙ্গ পুলিশের গুলিতে সম্প্রতি নিহত ব্রিয়ানা ও জর্জ ফ্লয়েডের নাম, তার তলায় টানা হাতে ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার’ স্লোগানটি।

পরস্পরের সাথে সংযুক্ত যুগল বৃক্ষ লাভার্স ঔক

লাভার্স ঔকের কাছে এসে আমাদের ফের অবাক হওয়ার পালা! না, ঔকগাছের থানটিতে প্রতিবাদী মানুষজন দূরে থাক, কোনো পোক-পরিন্দাও আমরা দেখতে পাই না। বিভ্রান্ত হয়ে আমরা গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি, শত বছরের পুরানো পরস্পরের সাথে সংযুক্ত যুগল বৃক্ষের দিকে। গেল বার আমরা যখন ব্রানসউইকে আসি, তখন লাভার্স ঔকের এ গাছতলা ছিল প্রেমিক যুগলে নন্দিত, বৃক্ষের গোঁড়ায় হেলান দিয়ে বসে যুবক-যুবতীরা চুমো খাচ্ছিল, কোনো কোনো দম্পতি আধশোয়া হয়ে স্পর্শ করছিল পরস্পরের শরীর। আমরা সিদ্ধান্ত নিই সাটিলা শৌরস—যে সরণীতে নিহত হয়েছেন আহমুদ আরবারি ওখানে যাওয়ার।

হলেণ আবাসিক এলাকার ভেতর দিয়ে ড্রাইভ করে। শহরটি দাবার ছকের মতো কালো ও ধলো মানুষের ঘরবাড়িতে বিভক্ত। শেতাঙ্গরা বাস করছে দেড়-দুই একরের প্লটে, আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে নির্মিত ভিলা টাইপের—ঘোড়ার গাড়ি রাখার ক্যারেজ হাউসসহ কাঠে তৈরি দোতালা দালানে। স্প্রিংক্লার থেকে উৎসারিত ঝিরিঝিরি জলধারা সয়ংক্রিয়ভাবে ভিজিয়ে স্নিগ্ধ করে তুলছে তাদের অঙিনা। কোনো কোনো বাড়ির সুইমিংপুলে টমমল করছে নীলাভ জল। ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে গল্ফকার্ট ও ঝকঝকে কোয়াডবাইক। পাশেই কালো মানুষদের টিনে তৈরি ট্রেইলার কেবিন। উঠানের রোপলাইনে শুকাচ্ছে কাপড়চোপড়। বজরা গোছের রঙচটা রিকন্ডিশনড্ গাড়িগুলোর বাম্পার স্টিকারে লেখা, ‘বিয়িং ব্ল্যাক ইজ নট অ্যা থ্রেট’ কিংবা ‘হ্যান্ডস্ আপ, ডোন্ট শুট।’ কোনো কোনো অপরিসর আঙিনায় ট্র্যাশবিন উপচে পড়ছে আবর্জনা। আমরা চলে আসি আরেকটি লো-ইনকাম হাউজিং কমপ্লেক্সের কাছাকাছি। ট্র্যাশবিনের কাছে দাঁড়িয়ে মাস্ক পরা তিনটি কৃষ্ণাঙ্গ শিশু মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তুলে আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়। প্রতিক্রিয়ায় হলেণ হর্নে সমর্থন-সূচক আওয়াজ তোলে।

মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তুলে মাস্ক পরা তিনটি কৃষ্ণাঙ্গ শিশু

আমরা চলে আসি বৃক্ষশোভিত সাটিলা শৌরস সরণীতে। যে জায়গায় শ্বেতাঙ্গ পিতাপুত্রের হাতে খুন হয়েছিলেন আহমুদ আরবারি, ওখানে প্রতিবাদীরা একটি পুষ্পিত ক্রুশ-কাঠ স্থাপন করেছেন বটে, কিন্তু তাদের কাউকে কোথাও দেখতে পাই না। মোবাইল ঘেঁটে মিসেস মেলবো ফের তথ্য বের করেন। প্রতিবাদীরা পুষ্পিত ক্রুশ পুঁতে দিয়ে মিছিল করে চলে গেছেন শহরের সিগনেচার স্কোয়ারের দিকে। ওদিকে আগ বাড়ার আগে মিসেস মেলবো দুই মিনিটের জন্য আহমুদ আরবারির বসতবাড়িতে থেমে শ্রদ্ধা জানাতে চান। তিনি প্লাস্টিকের কৌটায় করে নিয়ে এসেছেন গামবো নামে এক ধরেনর খাবার। পশ্চিম আফ্রিকার সংস্কৃতিতে—প্রয়াত মানুষের পরিবারের প্রতি সহমর্মীতার নিদর্শনস্বরূপ তার বসতবাড়িতে রান্না করা খাবার নীরবে রেখে আসার চল আছে। বিষয়টি ইন্টারন্যাট থেকে জানতে পেরে মিসেস মেলবো বেশ রাত অব্দি খেটেখুঁটে গামবো তৈরি করেছেন। হলেণও পরিবারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে নিজ হাতে তৈরি করেছে একখানা চিত্রিত কার্ড। তো আমরা আরো মিনিট কয়েক ড্রাইভ করে চলে আসি আরবারির বাড়িতে।

বাড়িটি সাদামাটা। আঙিনায় সহানুভূতিশীল মানুষজন রেখে গেছেন কিছু ফুল ও বেলুন। হলেণ ওখানে হাতে লেখা কার্ডটি রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আমি মিসেস মেলবোর সঙ্গে কয়েক কদম হেঁটে বাড়িটির দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়াই। এ বাড়িতে মায়ের সাথে বসবাস করত, আমার মেয়ের সমবয়সী পচিশ বছরের আহমুদ আরবারি। বাড়িতে কেউ নেই। কিছু মানুষ দোরগোড়ায় একটি বাস্কেটে চকোলেট, কুকি ও কোকাকোলার ক্যান প্রভৃতি রেখে গেছেন। মিসেস মেলবো ওখানে তাঁর খাবারের কৌটাটি রেখে ফিরে আসেন গাড়িতে। যেতে যেতে ভাবি আরবারির মা কি স্কোয়ারে গিয়ে যোগ দিয়েছেন প্রতিবাদীদের জমায়েতে?

আরো কয়েকটি ব্লক পাড়ি দিয়ে অবশেষ আমরা এসে পৌঁছি সিগনেচার স্কোয়ারে। ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত ইংলিশ গার্ডেনটির ফোয়ারা চত্বরে কোনো মানুষজন নেই। তবে পামগাছগুলোর তলায় ঘাসে শুয়ে সূর্যস্নান করছে দুটি শ্বেতকায় তরুণী। পাশেই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে পিকনিকে মেতেছে আরেকটি হোয়াইট পরিবার, চড়ানো হয়েছে বার্বিকিউ, পরিবারের কর্তা-গিন্নি দুজনের হাতে ওয়াইন গ্লাস। স্কোয়ারের পার্কটি আকারে বিশাল। ঘাসপাতা মাড়িয়ে আমরা চলে আসি স্কোয়ারের এক প্রান্তে—গাছপালায় নিবিড় কৃত্রিম উদ্যানে। এখানে প্রতিবাদীদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিছু কৃষ্ণাঙ্গ মানুষজন এদিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। ভিড়ভাট্টা তেমন হয়নি। এদের অনেকেই মাস্ক পরে এসেছেন, তাতে স্বস্তিবোধ করে দূরত্ব রেখে আমরাও প্লেকার্ড হাতে দাঁড়াই। স্কোয়ারের পেছন দিকে পুরো সরণী ব্লক করে দাঁড়িয়ে আছে রায়ট পুলিশের জোয়ানরা। একজন কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাক্টিভিস্ট মেগাফোন হাতে কথা বলেন, তাঁর বক্তব্য হচ্ছে—এ আন্দোলন তাবৎ শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়, প্রতিবাদীরা শুধু মুষ্টিমেয় হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের বর্ণবাদী আচরণের নিন্দা জানাচ্ছে। তিনি জমায়েতে আংশগ্রহণকারীদের যে কোনো উস্কানির মুখে ভায়োলেন্ট কিছু করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানান। অ্যাক্টিভিস্ট কথা শেষ করতে পারেন না। পুলিশের কয়েকজন অফিসার এগিয়ে এসে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন, এটা পার্ক, এখানে মানুষজন নিরিবিলিতে রিল্যাক্স করতে আসে, এখানে সাউন্ড পলিউশন সৃষ্টি করা যাবে না। জোরে আওয়াজ করতে হলে পার্ক অথরিটির পারমিশন নিতে হবে। তারা মেগাফোন ব্যবহার না করার অনুরোধ করেন। অ্যাক্টিভিস্ট মেগাফোন মাটিতে রেখে চেঁচিয়ে কিছু বলেন। দূরত্বের জন্য আমরা কী বলছেন—কিছু শুনতে পাই না।

সিগনেচার স্কোয়ারের জনহীন ফোয়ারা

বেশ কিছুক্ষণ প্রায়-নীরব জমায়েতে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। অতঃপর সচেতন হয়ে উঠি যে, সন্ধ্যা গাঢ় হওয়ার আগে আমাদের ফিরতে হবে সাভানা শহরে, কারণ দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতার জন্য অন্ধকারে ড্রাইভ করা হলেণের জন্য মুশকিল। গাড়িতে ফেরার পথে দেখি রাজপথে পা দিয়ে বাইসাইকেল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছেন একজন শ্বেতাঙ্গ প্রতিবাদী। ক্যারিয়ারের সাথে আটকানো তাঁর প্লেকার্ডে লেখা ‘হোয়াইট পিপুল, দিস ইজ আওয়ার ফাইট টু।’

হাইওয়েতে ওঠার মুখে খিদা তীব্রভাবে জানান দেয়। কিছু মুখে না দিয়ে এতটা পথ ড্রাইভ করা কঠিন। হলেণ ওয়াটারফ্রন্ট পার্কে গাড়ি থামায়। বেশ কয়েকটি সিসাইড রেস্টুরেন্টে বেচাকেনা চলছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে গ্রিল করা চিংড়ি ও ফেঞ্চফ্রাইয়ের মুখরোচক গন্ধ। একটি রেস্তোরাঁর আউটডোর সিটিংয়ে আমারা বসতে যাই, কিন্তু মেনু হাতে ওয়েটার এসে বলেন, ‘স্যারি, উই ডু নট এলাও কাস্টমারস্ ওয়ারিং মাস্কস্ ইন দিস সিটিং এরিয়া।’ তর্ক-বিতর্কে না গিয়ে হলেণ ফিস এন্ড চিপসের অর্ডার করে। খাবার না হয় গড়িতে বসে গিলে ফেলা যাবে। নোনা বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দেয়। চিংড়িমাছ ধরার ছোট ছোট নৌকায় বিকালের সমুদ্রটি চিত্রপট হয়ে উঠেছে। চোখের কোণ দিয়ে দেখি, বোটর‌্যাম্পের কাছে দাঁড়িয়ে জটলা করছে চারটি শ্বেতাঙ্গ মুণ্ডিত-মস্তক তরুণ। এদের সকলের কোমরে গোঁজা হ্যান্ডগান। আগ্নেয়াস্ত্র জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে আইনিভাবে বহন করা যায়। তবে ছেলেগুলো আমাদের দিকে তাকিয়ে কী একটা বলাবলি করছে। আমি হলেণের কব্জি স্পর্শ করে নীরবে তাকে সতর্ক করি। বিষয়টা মিসেস মেলবোও নজর করেছেন, তিনি ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘লেটস্ ট্রাই টু অ্যাভোয়েড দ্যা ট্রাবোল।’ ওয়েটার ফিরে এসে হলেণের হাতে তুলে দেয় রিসিটসহ ক্রেডিটকার্ড। সে তা অ্যালকোহল-রাব দিয়ে মুছে পার্সে পুরে।

আধ-উদলা গতরের পেশিতে রঙচঙে উল্কি করা একটি সশস্ত্র যুবক এসে আমার দিকে তর্জনী তুলে জানতে চায়, ‘ম্যাম, ইজ দিস ম্যান ট্র্যাভেলিং উইথ ইউ?’ পেশাদারী ভঙ্গিতে সে জবাব দেয়, ‘ইয়েস, উই আর রিলেটেড?’ চোখমুখ লাল করে যুবকটি যেন তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণে আনছে, সে চিবিয়ে চিবিয়ে ফের বলে, ‘ম্যাম, ইউ আর ডিসগ্রেইসিং আওয়ার কালচার।’ জবাবে হলেণ নিরুত্তর থাকে, ছেলেটি ফের ‘প্লিজ থিং আবাউট দিস,’ বলে হেঁটে ফিরে যায়। আমরা চোখেচোখে বার্তা বিনিময় করি। ট্রাবোলে জড়ানোর কোনো আগ্রহ আমাদের নেই, ভয়োলেন্স এভোয়েড করাই আমাদের স্ট্র্যাটেজি। তাই চুপচাপ কোনো দিকে না তাকিয়ে ফিরি পার্কিংলটে। হলেণ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ব্যাক করে। দেখি, ওয়েটার খাবারের টেকআউট প্যাকেট তিনটি নিয়ে ছুটে আসছেন। আমি জানালা নামাই, আমার হাতে প্যাকেটগুলো তুলে দিতে দিতে তিনি বলেন, ‘স্যারি আবাউট দ্যা ট্রাবোল।’ কোনো কথা না বলে হলেণ একসেলেটারে পা দেয়।

আমরা চুপচাপ ফিস এন্ড চিপস্ চিবাই। স্পিড তুলে হলেণ হাইওয়ে হিট করে। বেলা পড়ে আসছে, বিকালের মায়াবী আলোয় সিডনি ব্রিজকে পর্যটনী ভিউকার্ডের চিত্রটির মতো দেখায়। আমি আহমুদ আরবারির কথা ভাবি, পঁচিশ বছরের সদর্শন যুবকটি ছিল আমাদের কন্যা কাজরির সমবয়স্ক। হাইস্কুলের স্টার ফুটবলার সে, ভালোবাসত ব্যায়াম ও জগ করা। তাঁর ক্লাসমেটরা স্যোশাল মিডিয়ায় পোস্টিং দিয়ে জানাচ্ছে, আরবারি ছিল অত্যন্ত বন্ধুবৎসল, সতীর্থ ছেলেমেয়েদের দিনযাপনে কোনো সংকট উপস্থিত হলে টেলিফোন করত, কোনো দ্বন্দ্ব-বিবাদ বাঁধলে নিজে উদ্যোগ নিয়ে চেষ্টা করত তা নিরসনের। চারিত্রিক এ বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে আমাদের মেয়ে কাজরির আচার আচরণের মিল আছে প্রভূত। গাত্রবর্ণে সেও শ্যাম বর্ণের, যা কালোর কাছাকাছি। শ্বেতাঙ্গ পুলিশদের আগ্রাসনের মুখে সে নিরাপদ কি?

পেছনের সিট থেকে দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে মিসেস মেলেবো অস্থিরতা ছড়ান। অতঃপর ফেসশিল্ড এডজাস্ট করতে করতে ম্রিয়মান স্বরে অনুরোধ করেন, ‘ইফ ইউ গাইজ ডোন্ট মাইন্ড, কুড ইউ টার্ন অন দ্যা টেইপ?’ আমরা সুফি-দরবেশ নিয়াজ আর মিসরির ক্যাসেটটি ফের বাজাই। উদ্ধৃত চরণ দুটি গাড়ির বাতাবরণে তৈরি করে মোহ ছাড়ানো আবেশ—

শিরিন ই মি ভারমাসা
হার কানিবিম হল ওলডু

সাথে সাথে ভাবতর্জমাটিও ফিরে আসে স্মৃতিতে:

পৌঁছতে চাই প্রেমাষ্পদের মঞ্জিলে
যে দিকে তাকাই তৈরি হয় পথরেখা
আশা জাগে মনে হয় পাব তাঁর দেখা
চরাচর ভরে ওঠে সঠিক সড়কের মিছিলে..

আমি প্রেমাষ্পদ শব্দটির মানবিক ব্যঞ্জনা নিয়ে তর্পণ করি। একটি কৌতূহল আমার করোটিতে ঘুরপাক করে, আন্দাজ করি, আহমুদ আরবারি হয়তো কোনো সতীর্থ মেয়ের সঙ্গে ডেট করত, তাঁর খুন হওয়াতে তাঁর গার্লফ্রেন্ড নিঃসঙ্গ হয়েছে নিশ্চয়ই, সে কি ব্রানসউইক শহরের এ বিঁধুর বিকালে শোকে বিষণ্ণ হয়ে আছে?

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;