এত নিশ্চিন্ত হইয়া মানুষ নিজের মৃত্যুরে খায় ক্যামনে



আশরাফ জুয়েল
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

বড় বড় ধর্মগাছগুলারে চিন্তার করাত দিয়া ফালাফালা কইরা, খড়ি বানাইয়া রেশনের মতো এথেন্সের ঘরে ঘরে ছিটাইয়া দিতাছেন, এই খড়ি নাকি সাধারণ খড়ির তুলনায় তেজী, সবকিছুই রাইন্ধা ফালাইতেছে। এবং যুবসমাজনামক আয়নার দুদিকেই আলকাতরা মাখাইতেছেন তিনি, ফলত গ্রিস নামক নৌকাখানা বেউলভাবে দুলতেছে, মাইনষের চৌক্ষের তারায় সাইনবোর্ড হইয়া ঝুলতেছে কিছু ভ্রান্ত জিজ্ঞাসা।

বাটিডার মইধ্যে ডুব দিয়া চুপ মাইরা আছিলাম, আল্লার কিরা, একফোঁটা হেমলকও খাই নাই আমি, কিন্তু যা চাইছিলাম, কাম হইয়া গ্যাছে। তিনি চোখ বন্ধ কইরা খায়ছিলেন, শেষ আরকটুকুও, বাটির ভিত্রে ডুবন্ত আমি, দেখছি, কী শান্তিতে একজন মানুষ খাইতেছেন নিজের মৃত্যুরে।

ইচ্ছা হইছিল, সুযোগ হয় নাই, তাঁরে জিজ্ঞেস করতে, ‘সত্য কী? বিশ্বাস কী? ধর্ম? রাজনীতি? বা ক্ষুধা?’ তাঁরে এও জিজ্ঞেস করতে বুকটা আঁকুপাঁকু করতেছিল, ‘শইলের বিরুদ্ধে আত্মার যুদ্ধটা কী? ক্যান?’ পারি নাই। তিনি যহন হেমলকের বাডিতে ঠোঁট ঠেকাইয়া নিশ্চিন্তে ঢোক গিলতেছিলেন, তাঁরে বিরক্ত করার ইচ্ছা চইলা গেছিল আমার, অবশ্য এ কথাটাও পুরাপুরি সত্য না, আসলে আমার হাত-পা-মাথা-বুক জইমা কাঠ হইয়া যাইতেছিল, স্থির হইয়া আসতেছিল চোখের তারা, চাইলেও নড়তে পারুম না, বুইঝা গেছিলাম। কিন্তু তিনি বোঝেন নাই, বিড়বিড় কইরা কইতেছিলেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমাকে আমার ঠিকানায় পৌঁছে দিচ্ছে বলে এঁদের সকলকে আন্তরিক অভিবাদন।’

২।
ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম, জীবনে এত ভয় কখনোই পাইনি। গল্পটা বলি, সেদিন সন্ধ্যায়, হ্যাঁ, সন্ধ্যা হবারই কথা, সন্ধ্যা? আচ্ছা, এই শহরে বেলা কয়টা পর্যন্ত বিকাল? কখন থেকে সন্ধ্যা আরম্ভ? কখনই বা আরম্ভ হয় রাত? সেটা কয়টা পর্যন্ত চলে? সকাল? অবশ্য আমি এই সকাল বিকাল বা রাতের হিসাব রাখি নিয়ন আলো জ্বলে ওঠা এবং নেভানোর সময়কে ধরে নিয়ে। এই শহরের সকাল বিকেল, রাত, আসলে সব কিছুই নির্ভর করে বিভিন্নজনের দখলে থাকা কিছু সুইচের ওপর। ধুর, এসব আমার জানার বিষয় না। যে গল্পটা বলতে চেয়েছিলাম, গল্প তো নয়, ঘটনা, গত সপ্তাহেই ঘটেছে, আমার সাথেই। কী ভয়ানক ঘটনা! বিশ্বাস করার কথা না, না করারই কথা, অবশ্য বিশ্বাস না করলেও কিছু যায় আসে না। আসলে বিশ্বাসের সর্বোচ্চ সীমানা হলো সেখানে, যেখানে এসে মিথ্যে শেষ হয়ে যায়। সেদিন রাতে, রাতই বলছি কারণ নিয়নবাতিগুলো জ্বলেছে বহুক্ষণ—যাচ্ছিলাম বা আসছিলাম, হ্যাঁ যাচ্ছিলাম, না আসছিলাম, আচ্ছা যাওয়া বা আসাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ ঘটানাটা, শাহবাগে কিছুক্ষণ অর্থহীন দাঁড়িয়ে থাকার পর আমার কিছু একটা মনে হয়েছিল, কাঁটাবনের দিকে এগুতে চাইছিলাম, পা দুটো অনিচ্ছাকৃতে এগুচ্ছিল। আসলে সময়টা সন্ধে ছিল না, ঘড়ির হিসাবে রাত, অনেক রাত। কিন্তু গভীর রাতকে কেন আমার সন্ধ্যে মনে হয়েছিল?

‘আমি? ফুরকান।’

৩।
: ইউ ফাকডআপ পিপল, ডেমোক্রাসি ইজ ফাকিং ইয়োর অ্যাস অল দ্য টাইম...? ইয়েস, হেই ইয়োলা কালারড শার্ট ম্যান, ডোন্ট ইউ ফিল পেইন?

গুলশান এক থেকে দুইয়ের দিকে যাবার পথে অনিক টাওয়ার, রবি-র হেড অফিস এবং উল্টো দিকে বেঙ্গলের আর্টগ্যালারির ঠিক মাঝের আইল্যান্ডে একজন পাগল, প্রায় প্রতিদিন অফিসভাঙা টাইমে বক্তৃতা করে, বক্তৃতা তো নয় রীতিমতো চিৎকার। অদ্ভুত ভঙ্গিমায়, দুই হাত নাচিয়ে নাচিয়ে, মাঝেমাঝে সামনের জমায়েতের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। সামনের ছোট্ট জমায়েতটা মাঝেমাঝে দেহ বাঁকিয়ে গলা কাঁপিয়ে স্লোগান তোলে। জমায়েতে সাকুল্যে জনা সাতেক, যাদের বয়স চার থেকে নয় দশ, সবাই পথশিশু। এই সরু কণ্ঠের স্লোগানকে ভূমিকম্প ভেবে গুলশানের বড় বড় দালানগুলো ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে, কেঁপে যে ওঠে তা বোঝা যায় দুইদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কথা শুনতে থাকা মানুষগুলোকে দেখলে, সুড়সুড় করে তারা কেটে পড়ে সুবিধাজনক অন্ধকারে। ভীরু মানুষদের এই পালিয়ে যাওয়া দেখে আনন্দে ফেটে পড়ে ক্ষীণ দেহের দলটি। মানুষকে ভয় দেখানোর মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই, তা তারা বুঝে গেছে ইতোমধ্যে। এরকম সময়ে পাগলটি স্থির হয়, চোখ বন্ধ করে দুই হাত তুলে শান্ত হতে বলে তাঁর সম্মুখের সমাবেশটিকে।

৪।
শ্যাষ ঢোক গেলার সাথে সাথে গইলা গ্যালাম আমি, তিনিও ঢইলা পড়লেন। তিনি ভালো কইরাই জানতেন দাঁড়াইয়া থাকার মানে কী? ভালোই আছি, কিন্তু তিনি বেশিদিন থির থাকলেন না।

হঠাৎ হঠাৎ সূর্যের মতোন উদয় হন, কোনো অচেনা নগরীর আন্ধার ফুটপাতে একটানা কথা কইতে থাকেন তিনি। কে শুনল, কে শুনল না এতে তাঁর কিছুই যায় আসে না। তিনি কইতেই থাহেন নিজের মতো কইরা। তাঁর চোখ হইয়া আমি মানুষ দেহি, মানুষ দেহা আমার শখ হইয়া দাঁড়াইছে। পশুদের আলাদা আলাদা চেহারা, আলাদা আলাদা আচরণ আলাদা আলাদা হিংস্রতা, মানুষের শারীরিক গঠন একই রকম, কিন্তু আদতেও ভিন্ন ভিন্ন হিংস্রতা নিয়া নিজেদের প্রতিদিন একটু একটু কইরা হত্যা করে এরা।

মাঝেসাঝে গাছেদের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে হাজির থাকি, আবার উড়তে উড়তে মাঝেমইধ্যে চইলা যাই, পাখিদের এসাইল্যামে। তিনিও কই থিকা জানি চইলা আসেন। চুপ কইরা দূরে খাড়াইয়া থাকেন। আমি তখন বিস্কুটগুঁড়া, আমি তখন ক্ষুধার্ত পাখিদের ঠোঁটে ঠোঁটে, আমি তখন নিঃশ্বাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড।

‘জীবনকে পরীক্ষার মুখোমুখি ফেলবে, বারবার।’ ভাইবা ভাইবা ব্যাকুল হইয়া যাই, এই লাইগাই কি তিনি নিজেরে সঁইপা দিছিলেন মৃত্যুর ডেরায়? অথচ বাঁইচা আছেন তিনিই, এথেন্সের সেই নৌকা শুকনা মাটিতে ভাস্তাছে।

৫।
জাদুঘরের ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি, বিপরীতে সাবেক পিজি, রাস্তা ফাঁকা, রাত পৌনে একটা। হাঁটতে হাঁটতে বাম দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বুকে দুধ না থাকা মায়ের মতো শুকিয়ে যাওয়া পুকুরটাকে দেখছিলাম। এই পুকুরে কাউকে কোনোদিন মাছ ধরতে দেখা যায়নি, অবশ্য এমন নয় যে, সারাক্ষণ পুকুরের পাশে বসে থেকেছি, তবে বসে থাকতে পারলে মন্দ হতো না, বদ্ধ পানির নিজস্ব একটা ভাষা আছে।

হঠাৎ কুত্তার কু কুউউ কুউউ চিৎকার পুকুরভাবনা থেকে তুলে এনে আমাকে ছিটকে ফেলে মাঝরাস্তায়, ফুটপাতে শুয়ে থাকা কুকুরের পেটে পা পড়ায় এই দৃশ্যের অবতারণা, দর্শকহীন ফুটপাতের এই দৃশ্য অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। একটা ট্রাক সজোরে চুমো দিল আমাকে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড...

কুত্তাটা ছাড়া কেউই ছিল না আশপাশে, সে আমার দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া শরীরের দিকে তাকাচ্ছে, তাঁর শরীরে সামান্য পা পড়ার খেসারত আমাকে এভাবে দিতে হবে, বুঝতে পারেনি সেও। অবশ্য এ নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো অপরাধবোধ কাজ করছে না। তাঁরই বা দোষ কী? আমাকে মেরেছে ‘সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন’।

দুইদিক থেকে পাঠকসমাবেশ রাস্তার যে অংশটুকুর গলা চেপে রেখেছে ঠিক সেইখানে ধোয়াকাপড়ের মতো পড়ে আছি, শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে আমার তেইশ বছরের অতীত, রক্তের প্রবাহটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে কোনদিকে যাবে, তবে রেডব্লাডসেলগুলোর শরীরে এখনো জীবন আছে।

শিক্ষিত কুত্তাটা রেডসেলগুলোকে চেটেপুটে খেয়ে আমাকে রেখে চলে গেল পরীবাগের দিকের সুনশান রাস্তা ধরে, বার দুয়েক পেছন ফিরে তাকাল, কে জানে কী চলছে তাঁর মনে।

‘আমি? ফুরকান।’

৬।
সেই একই জায়গা, গুলশান এক থেকে দুই নাম্বারের দিকে যাবার পথে—অনিক টাওয়ার, রবি-র হেড অফিস এবং উল্টো দিকে বেঙ্গলের আর্টগ্যালারির ঠিক মাঝের আইল্যান্ডে সেই পাগল, আজ তাঁর পরনে হালকা বাদামী কালারের একটা ফুলহাতা শার্ট, নিচে ব্লাক কালারের গ্যাবাডিন, পায়ে স্লিপার। সেই পরিচিত ভঙ্গি, আজ এখন পর্যন্ত তাঁর নিয়মিত অডিয়েন্স এসে পৌঁছায়নি। তাতে তার সামান্য অসুবিধা হচ্ছে না। আজও রাস্তার দুইদিকের ফুটপাতে জমে গেছে কাজ ভুলে যাওয়া কিছু মানুষ, পাগলটি মানুষের দৃষ্টিতে পাগল, হয়তো পাগলটির দৃষ্টিতে বাকি সবাই পাগল। আজও সেই পরিচিত ভঙ্গি;
‘আই অ্যাম চার্চিল, আই রিপিট, আই অ্যাম উইন্সোটোন চার্চিল, ডু ইউ নো মি?’ বোকাচোদার পাবলিক, আমারেও চেনে না। সরি, সরি, নো স্ল্যাং নো স্ল্যাং। লেটস স্টার্ট,’—এই বলে জোরে জোরে তালি দেয় সে, কিন্তু এ তালি দেওয়ার মধ্যে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণের কোনো চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় না। তিনি কথা বলা আরম্ভ করেন, ‘নো ওয়ান প্রিটেন্ডস দ্যাট ডেমোক্রাসি ইজ পারফেক্ট অর অল-ওয়াইজ। ইনডিড ইট হ্যাজ বিন সেইড দ্যাট ডেমোক্রেসি ইস দ্য ও’স্ট ফর্ম অফ গভর্নমেন্ট একসেপ্ট অল দোস আদার ফরম’স দ্যাট হ্যাভ বিন ট্রাইড ফর্ম ঠাইম ঠু ঠাইম...’

নির্ভুল ইংরেজিতে বক্তব্য চলল আরো কিছুক্ষণ। ততক্ষণে মানুষের পেটে ঘরে ফেরার সাইরেন বাজতে আরম্ভ করেছে। ইতোমধ্যে পাগলটির পোষা অডিয়েন্স এসে গেছে, আজ সংখ্যায় একটু বেশিই, জনা দশেক তো হবেই। ক্ষুধার্ত মানুষের কণ্ঠ থেকেই সর্বোচ্চ শব্দের চিৎকার বের হয়, কেন?

আবারও স্লোগান, আবারও ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের পলায়ন। পলায়নপর মানুষের এই চেহারাটা দেখতে খুব ভালো লাগে যুবকটির, যাকে সবাই পাগল বলে।

অবশ্য বক্তব্য শেষ হলেই প্রত্যেকের জন্য একশো টাকার একটা করে চকচকে নোট পথশিশুদের এখানে আসতে বাধ্য করে, যতবার বক্তব্য ততবার একশ টাকার কড়কড়ে একটা করে নোট।

৭।
নিজেরে বেকুব লাগতেছে। বুঝি নাই, কোন স্কুলে ভর্তি হইয়া গেছি! নিজেরে দুই মাড়ির ফাঁকের মাংস মনে হইতেছে, মনে হইতেছে নিজেই নিজেরে চাবাইতেছি অনবরত। আমি কি চাইছিলাম এমন জীবনস্কুলের প্রোডাক্ট হইতে! শইলে এই ‘মানুষ মানুষ’ গন্ধ আর সহ্য হইতেছে না।

শান্তি বলতে গাছেদের শেষকৃত্যানুষ্ঠান—যখন এক নিঃশব্দ প্রার্থনায় ঘুমাইয়া থাকে গাছেরা, যখন অন্যরে বাঁচাইতে নির্দ্বিধায় নিজেরে ঠেইলা দ্যায় করাতের দাঁতে, বার্নিশের পালিশে। আর শান্তি পাই আর যখন পাখিদের এস্যাইলামে গিয়া গুঁড়া বিস্কুট হইয়া তাদের ঠোঁটে ঠোঁটে ঘুরি।

স্বেচ্ছায় এই জীবন বাইছা নেই নাই আমি, কোনো অপশন কেউ দ্যায় নাই আমারে, আমি পাখি হইতে চাই নাকি গাছ? নাকি সামান্য ঘাসফুল নাকি নিমফল?

এও জিজ্ঞাসা করে নাই, আদৌ আমি এই দুইনাই আসতে চাইছিলাম নাকি? মাঠে নামাই দিয়া, খেলার নিয়মকানুন না শিখাইয়া খেলতে কইয়া, গোল দিতে না পারলে প্লেয়ারের দোষ ধরলে আমি কী করতাম?

কেউ আমার দিকে হেমলক আগাইয়া দিতাছে না ক্যান? এই প্রশ্ন করছিলাম বসরে। স্বভাবসুলভ গম্ভীর, কইছেন আমি য্যান গাছেদের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে বেশি বেশ উপস্থিত থাকি, বলছেন, যাদের কারণে অরণ্য কাঁন্তাছে হেগোর নামের লিস্টি বানাইতে।
‘সুন্দরবন?’
‘মৃত্যুর মতো মহান আর কী আছে?’ তিনি কইছিলেন।
‘রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্ট?’
‘কাউকেই কিছু শেখাতে পারব না আমি, বরং তাঁদের মনে ভাবনার উদ্রেক ঘটাতে পারি মাত্র।’

৮।
ভেবেছিলাম মরে পড়ে আছি, কেউ না কেউ কিম্বা ফজর থেকে সদ্যমুক্ত ভোরে এ পথ দিয়ে রমনা পার্কে মর্নিংওয়াকে যাবার সময় কারো রিবোক কেডস বাঁচাতে যদি পুলিশকে খবর দেয়?
না তেমন কিছু লাগেনি, আমার ভাবনাকে অবাক করে দিয়ে, ছিন্নভিন্ন দেহটা আবার আমার শার্ট-প্যান্টের ভেতরে আশ্রয় নিল। ভীষণ সন্দেহ উড়িয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম, পারছি, পারছি!

চিৎকার করে উঠলাম, বেঁচে আছি, বেঁচে আছি, হুররে বেঁচে আছি তো!

মুখে, বুকে, পেটে, মাথায়, পাছায়, থাইয়ে, পায়ে সব, সব জায়গায় হাত দিয়ে দেখলাম, সবই আছে, আমি বেঁচে গেছি, তবে খুব তৃষ্ণা অনুভূত হচ্ছে। আশপাশে পানি নাই, যেটুকু আছে, জাদুঘরের পেছনের পুকুরটায়, কিন্তু গেইটে তো তালা!

হঠাৎ তৃষ্ণা অনুভূত হবার কারণ খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ল, সেই কুকুরটার কথা, যে আমার রক্ত চেটে পরীবাগের দিকে চলে গেছিল।

এতই তৃষ্ণা, পানি পাই কোথায়? না কাউকে দেখাও যাচ্ছে না। দেখা গেলেই বা কী!

পানিতে বাঁধ দিয়ে রেখেছে ফারাক্কা, যা আসছে সব চুয়ানি। হঠাৎ ফারাক্কার কথা মনে আসতেই মহানন্দার কথা মনে পড়ে গেল, মহানন্দার কথা ভাবলেই আমার সকল তৃষ্ণা মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে যাবার কথা, কিন্তু তা আর হলো না, কারণ ফারাক্কা অনেক আগেই তাঁকেও ডায়রিয়া রোগীর চামড়া বানিয়ে রেখেছে।

হঠাৎ দেখলাম পরীবাগের সন্দেহ ফুঁড়ে ধীর পায়ে সেই কুকুরটা এগিয়ে আসছে আমার দিকে, যে আমার রক্ত খেয়ে নিঃসংশয়ে চলে গেছিল।

তৃষ্ণায় ছটফট করছি, কিন্তু কেন আসছে কুকুরটা?

আমি? ফুরকান।

৯।
: ‘ইফ ইউ ডু নট টেক এন ইন্টারেস্ট ইন দ্য এফেয়ার্স অফ ইয়োর গভর্নোমেন্ট, দেন ইউ আরে ডুমড ঠু লাইভ আণ্ডার দ্য রুল অফ ফুলস।’
: ‘পোভার্টি ইস দ্য পারেন্ট ওফ রেভ্যুলেশন এন্ড ক্রাইম।’
: ‘দ্য প্রাইস অব অ্যাপ্যাথি টুওয়ার্ডস পাবলিক এফেয়ার্স ইস টু বি রুলড বাই এভিল মেন।’
: ‘দ্য ফারস্ট এসেনশিয়াল রেস্পনসিবিলিটি অফ দ্য স্টেট ইজ কন্ট্রোল অফ দ্য মার্কেটপ্লেস, দেয়ার মাস্ট বি সাম অফিসিয়াল চার্জড উইথ দ্য ডিউটি অব সিইং দ্যাট হোনেস্ট দ্যাট ডিলিং এন্ড গুড অর্ডার প্রিভেইল…’
: ‘দোস হু আর টু স্মার্ট টু এনগেইজ ইন পলিটিক্স আরে পানিশড বাই বিং গভর্নড বাই দোস হু আর ডাম্বার...’
: ‘ইভিল ব্রিংস মেন ঠুগেদার...’

গুলশান থানার হাজতখানায় এক অদ্ভুত দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। হুলুস্থুল ব্যাপার। থানা এখন দুই দলে বিভক্ত। এক দলে দশ জন অন্য দলে সেই পাগল, গতকাল যে নিজেকে চার্চিল দাবি করেছিল।

পাগলকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা চলছিলই। হাজতের গরাদের ভেতর সে একা। কখনো সে নিজেকে প্লেটো দাবি করছে, কখনো এরিস্টটল, চমৎকার ইংরেজিতে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। হাজতের ঘরকে সে স্টেজ বানিয়েছে, একবার ডানে যাচ্ছে, একবার বামে—কখনো সে এরিস্টটল, কখনো প্লেটো।

থানার গরাদে এরিস্টটল বা প্লেটো ব্রাত্য, এরা একথা জানবে কিভাবে? প্রথম প্রথম কথাগুলো খুবই উপভোগ করছিল সবাই। পাগলটি তখন মহা উৎসাহে আবার নতুন করে আরম্ভ করছে। মাঝে মাঝে চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে, আবার কখনো চিৎকার। মনে হচ্ছে কোনো নাটকের মহড়া।

এক পর্যায়ে বিরক্তির উদ্রেক হলে খেঁকিয়ে উঠে ওসি, ‘এই পাগলা চুপ কর তো! এই বালটাকে কে ধইরা আনছে?’

পাগল হঠাৎ বলতে আরম্ভ করে—
‘মরুর দারুণ দুর্গ হতে; যুদ্ধ চলে ফিরে ফিরে;/ সন্তরি সমুদ্র-ঊর্মি দুর্গম দ্বীপের শূন্য তীরে/ শ্যামলের সিংহাসন প্রতিষ্ঠিলে অদম্য নিষ্ঠায়,/ দুস্তর শৈলের বক্ষে প্রস্তরের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়/ বিজয়-আখ্যানলিপি লিখি দিলে পল্লব-অক্ষরে/ ধূলিরে করিয়া মু্‌গ্ধ, চিহ্নহীন প্রান্তরে প্রান্তরে।’

‘দ্যাখো বালে আবার কবিতাও লেখছে, পাগলাচোদা... অই চোপ, কাম করতে দে... এই এই এই বালডার একটা ব্যবস্থা করত? শুয়োরের বাচ্চা...’

‘হা হা হা, ইটস আ পোয়েম অব টেগর... আপনাদের ঠাকুর, রবি... মনে নেই?’

‘চুপ করবি শালা... পাগলা।’

‘জয় বাংলা, জয়...’ মুষ্ঠিবদ্ধ করে শ্লোগান তুলল পাগল, কাজ হলো। কাজে মন দিল থানা, নিজ ভাবনায় মন দিল সেও, ‘কই আমি তো কাউকে পাগল বলি না, যে নিজে পাগল সে শুধু অন্যকে পাগল বলে। সত্যিকারের পাগল চেনা এতই সহজ?’

১০।
‘কিন্তু পৃথিবীর ফুসফুস, অ্যামাজন? অস্ট্রেলিয়ার আগুন? সবখানেই তো পুড়তাছে অরণ্য? এগিলার কী হইব?’ আমি হাহাকারের ঢোক গিইলা নিয়া কইলাম।

তিনি মেঘথমথম মুখে পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘কাউকেই কিছু শেখাতে পারব না আমি, বরং তাঁদের মনে ভাবনার উদ্রেক ঘটাতে পারি মাত্র।’

‘বালের দুনিয়া ভাল্লাগে না, চ্যাট। রোজ রোজ নিজের রক্ত খাইতে খাইতে না একটু একটু কইরা না মইরা এক্কেরে গেলেই তো হয়? আর টানতে পারতাছি না। কই যামু, কার কাছে? কে আমারে দিব ছুটি। উস্তাদ তো হেমলক খাইয়া এমুন এক্ষান চড় মাইরা গেছিলেন সেই সময়রে!

রাগে দুঃখে নিজেরে কাইট্টা কুইট্টা দুইন্ন্যার মাইনষের মুখে ছিটাইয়া দিতে ইচ্ছা করে, এই শালারা করতাছে কী? আমার শইলেও মাইনষের মাংস, হালারা খাইব ভালা।’

আমিও অরণ্য আর পাখিদের ভালোবাইসা ফেলেছি, এগোর স্থায়ী কোনো ঠিকানা নাই, আমারও নাই। বাস্তুচ্যুত আমরা ভাসতে থাকি, এখানে সেখানে। ‘যাইতে আমারে হইবই, আর না। ম্যালা হইছে। কিন্তু যামুটা কই? যদিও আমার কুনু ঠিকানা নাই, তাই উচ্ছেদ হওনের ভয়ও নাই। অবশ্য গোটা দুনিয়াই ভাস্তাছে, আমি বাল কোন হোগার হোগা...’

১১।
যতটুকু পিপাসার্ত হলে একজন মানুষ মারা যায়, আমি প্রায় তার কাছাকাছি অবস্থায়, সদ্য লটারিরে পাওয়া জীবন, আর হারাতে চাই না। পানির খোঁজে দুই পা শাহবাগের দিকে এগোয় তো তিন পা দৌড়ায় কাঁটাবনের দিকে।

কুত্তাটা আমার একেবারেই নিকটে এসে দাঁড়ায়, আমাকে ইশারা করলে চিত হয়ে শুয়ে পড়ি আমি, সে ডান পা তুলে আমার মুখ বরাবর প্রস্রাব করতে থাকে, আমি চুক চুক করে তার প্রস্রাব খাই, জীবনের কাছে এসব প্রস্রাব ট্রস্রাব কিছু না, কুত্তাটা ঠিক ততখানি প্রস্রাব করে যতটুকু পরিমাণ রক্ত সে চেটেছিল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে পরীবাগের অন্ধকারে হারিয়ে যায়, এবার পেছন ফিরে তাকনোর কোনো তাগিদ তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না, সে ঋণ শোধ করল?

এ ঘটনার পরপরই আরো কয়েকটা ঘটনা ঘটল; আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের কাছে, সন্ধ্যায়, ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাত। মৃত ভেবে তারা আমাকে ফেলে চলে যায়, আমিও ভেবেছিলাম মরে গেছি, কিন্তু না ফিরে এসেছি। এরপরের ব্যাপারটা আরো ভয়ানক, আমার মাদ্রাসাপড়ুয়া ছোটভাইকে দেখে ফিরছিলাম, যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডের কাছেই—তিনজন পাগল আমার পথ আগলে ধরল, তাদের দুইজন দুই দিক থেকে ধরে রাখল আমাকে আর বাকিজন একটা ধারালো দা দিয়ে ইচ্ছেমত কুপালো, তারপর তাদের সুবিধামতো দিকে দৌড়ে চলে গেল। সবাই দেখল, এবং যার যার কাজে আবার মনোনিবেশ করল।

ঘাড়ের বাম দিকের কোপটা ছিল মারাত্মক, হাতটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল, বাম হাতকে বাঁচাতে ডান হাত এগিয়ে দিয়েছিলাম, তিনটা আঙুলের অর্ধকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। সেগুলোকে কুড়িয়ে এনে যত্ন করে যার যার জায়গায় বসিয়েছিলাম, না কোনো সমস্যা হয় নাই।

এর পরের ঘটনা? সেদিন অনেক রাত করে ঘুমিয়েছিলাম। মেসে কেউ ছিল না, দরজা নক করতে ঘুমের ঘোরেই খুলে দিয়েছিলাম। তারপর চোখ বেঁধে, সারারাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আফতাবনগর আবাসিক এলাকা পেরিয়ে প্রজেক্টের কাশবনে নিয়ে ঠিসুম, ঠিসুম...। প্রতিবারই ওরা নিশ্চিত করে, কিন্তু মরে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি আমি, এ ব্যাপারগুলো আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে, মনে হচ্ছে আমাকে কেউই মারতে পারবে না, আমি অমর।

কুত্তাটার কথা প্রায়শই মনে পড়ে আমার, সে যদি সে রাতে আমার মুখে প্রস্রাব না করত তাহলে এই অমরত্ব!

আমি? ফুরকান।

১২।
‘বাবা, তুমি? সময় নষ্ট হলো না তোমার? আমি চাই না আমার জন্য একমুহূর্ত সময়ও নষ্ট হোক তোমার? আমি আর তুমি তো একই বাবা, পার্থক্য শুধু এই এই গরাদটা, এক পাশে তুমি, তোমরা, ঐ যে অফিসারটা, ঐ যে ওরা, ওরা ওরা ওরা সবাই, আর এ পাশে শুধু আমি, আমি, আমি, তোমার রূপ ধরে আমি, উনার রূপে আমি, ওদের রূপে, সবার রূপে আমি, বাবা আসলে সবাই পাগল, আমি স্বীকার করি, তোমরা করো না।’

চৌধুরী ফয়সাল করিম খান, লোহার শিকের অন্যপ্রান্ত থেকে দেখলে তাঁকেও কয়েদির মতো লাগবে অনায়াসে। সাকসেসফুল ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, চেম্বার অব কমার্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, পত্রিকার মালিক, টিভি চ্যানেল, দুইবারের এমপি...

তাঁর পেছনেই কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরও অনেকেই। ‘স্যার রাস্তায় দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র, পলিটিক্স কী কী সব রাষ্টবিরোধী কথা বলছিল।’ ততক্ষণে তালা খুলে গেছে।

‘বাবা, আই ক্যান হোল্ড মাইসেলফ, তোমার কথা ভেবেই রেফেরেন্স দেইনি, আফটার অল তোমার রেপুইটেশনস। বাট এঁরা খুব ভালো ব্যবহার করেছে, সম্ভবত এঁরা আমার রক্তে তোমার ঘ্রাণ পেয়ে গিয়েছিল, অথচ আমার যুদ্ধ এই ঘ্রাণটার বিরুদ্ধেই।’

‘সরি স্যার’ হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়ায় যুবকটি, সেই অফিসারের দিকে।

‘ঠিক আছে, সরি, সরি।’

‘নো সরি, আই এম আ ব্লাডি শুয়োরের বাচ্চা, আপনিই তো বলছিলেন, যা বলেছেন, একদম ঠিক বলেছেন, বাবা ঠিক বলেছে না? বাবা যাও, বাবা, কান অন... আই এম এ সিম্পল প্রোডাক্ট, নাথিং এলস...’

নিয়মানুযায়ী সরকারি কাগজে স্বাক্ষর করে ছেলেকে নিয়ে বের হতে হতে পেছন ফিরে তাকালেন চৌধুরী ফয়সাল করিম খান, এই তাকানোর মধ্যে কী আছে সেটা হয়তো পরে অনুমান করতে পারবে সবাই।

থানা থেকে বের হয়ে ছেলেটি বাবার গাড়িবহরের তোয়াক্কা না করে হনহন করে ফুটপাত ধরে হাঁটতে আরম্ভ করে, কিছুদূর গিয়ে পেছন ফিরে চিৎকার করে বলল, ‘বাবা আমি বনানী কবরস্থানে যাচ্ছি, মার কোলে শুয়ে থাকব একটু... তুমি যাও, সরি, আমার জন্য তোমার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, যাও, আই অ্যাম জাস্ট আ প্রোডাক্ট, ম্যান!’

শেষ হয় না গল্পেরা...

সময়ে সবকিছু পরিবর্তিত হয়—পাগলটির জন্য পৃথিবী যখন আত্মহত্যার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে ঠিক তখনই হেমলকের বাটিতে ডুবে থাকা ছেলেটি পাখিদের এসাইলাম থেকে গাছেদের শেষকৃতানুষ্ঠান সেরে আত্মহত্যার মঞ্চে এসে মুক্তি দেয় পাগলটিকে, পাগলটি হয়ে যায় বারবার মৃত্যুকে লাত্থি মেরে ফিরে এসে অমর হতে যাওয়া ফুরকান, আর বারবার মৃত্যু থেকে ফিরে আসা ফুরকান অদম্য আগ্রহে ডুব দেয় সক্রেটিসের জন্য সদাপ্রস্তুত হেমলকের বাটিতে।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;