নবগঙ্গার চিতল



তাপস বড়ুয়া
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

“ঘর খুলিয়া বাহির হইয়া জোছনা ধরতে যাই
হাত ভরতি চান্দের আলো, ধরতে গেলে নাই”
- হুমায়ূন আহমেদ

১.
সন্ধ্যার শিয়ালদহ আজও তেমনই ব্যস্ত। লোকে লোকারণ্য। একটা করে ট্রেন আসছে, মাইকে ঘোষণা হচ্ছে আর মানুষ ছুটছে সেই প্লাটফরমের দিকে। অন্যদল ট্রেন থেকে নামছে; ছুটছে গন্তব্যে। প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে ক্যানিং লোকালে উঠে পড়েন ধীরেণবাবু। কাজ করেন গড়িয়াহাটের একটা কাপড়ের দোকানে। সরকার বা অন্যকথায় ম্যানেজার। থাকেন ক্যানিংয়ে। রেলস্টেশন থেকে নেমে টাউনের দিকে যেতে বা হাতের প্রথম গলি। তারপর পূজামণ্ডপ বামে রেখে পুকুর পাড় দিয়ে হাতের ডানের গলি। আজও গন্তব্য সেই চরপাড়া। চরপাড়ায় তার নিজের বাড়ি। সম্পন্ন গৃহস্থ বলা যায়।

আটটার ট্রেন শেয়ালদা ছাড়ে সোয়া আটটার দিকে। ট্রেনে তখন ‘ঠাঁই নাই’ ‘ঠাঁই নাই’ অবস্থা। দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া কঠিন। এই ভিড়ের মধ্যেই নিজেকে সেঁধিয়ে দিয়েছেন ধীরেণবাবু। ক্যানিং লোকালের পঁচিশ বছরের ডেইলি প্যাসেঞ্জার। অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, ছটফট করে কোনো লাভ নেই; চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাই ভালো। চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাগটা দিয়েছেন সুরেণের কাছে। সুরেণ সিট পেয়েছে। সুরেণের সাথে ধীরেণ বাবুর কখনো সেরকম কথা হয় নি। দু-একদিন সিগারেট ধরাতে গিয়ে আগুন চেয়ে নিয়েছেন স্টেশনে—এটুকুই। সুরেণ নামবে সোনারপুর। প্রতিদিন দেখছেন; তাই জানেন। প্রায়-অপরিচিত মানুষের কাছে ব্যাগ দিতে পারাটা এখানে স্বাভাবিক ব্যাপার। দাঁড়িয়ে যাওয়া যাত্রীদের অধিকার বলেই ধরে নেওয়া হয়। সবাই ডেইলি প্যাসেঞ্জার। মুখচেনা। যেদিন যে বসতে পারে অনেকের ব্যাগ নিয়ে বসতে হয়।

যাদবপুরে এসে আরো যাত্রী উঠল। এটাই শেষ ট্রেন। যেতেই হবে। কারো কারো যেতে যেতে রাত দশটা সাড়ে দশটা বাজবে। তারপর রাতটা বাড়িতে কাটিয়ে সকাল সাড়ে ছটায় আবার ট্রেনে ওঠা। আবার যাত্রা মহানগর কলকাতার দিকে। নতুন আরেকটা দিন শুরু। একই রকম দিন। ব্যস্ততা, ভিড়, ভালো, মন্দ অভিজ্ঞতার দিন। যাদবপুর থেকে ট্রেন ছাড়ার পর সবাই যেন হাফ ছাড়ে। জানে আর ভিড় বাড়বে না। এর পরের স্টেশন থেকে লোক নামতে শুরু করবে। ট্রেন তখন ভিড়ে-ঠাসা কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে। চলছে মাঠের ভিতর দিয়ে—দুপাশে গ্রাম, গঞ্জ আর জনপদকে পেছনে ফেলে। সোনারপুর এসে যাত্রী নামা শুরু। এরপর যাত্রী শুধু কমতেই থাকবে। ভিড় একটু পাতলা হতেই চারজন যাত্রী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাস খেলতে শুরু করে। চারজনের প্যান্টের কোমরের কাছে গুঁজে নেয় বড় একটি রুমালের চারটি কোনা। তারপর ওই রুমালকে বোর্ড করে তার ওপর চলে তাস খেলা। সেই সকাল থেকে রাত—জীবিকার জন্য জীবনকে টেনে নিয়ে যাওয়া। সমস্ত দিনে হয়তো এটুকুই বিনোদন। এখন বস বা মালিকের কড়া চোখ নেই, ছেলের স্কুলের বেতন নেই, ঘরের চাল বা তরকারি নেই। শুধুই বিনোদন—সেই ছেলে বেলার মতো। মধ্যবয়সী মানুষগলো যেন হারিয়ে যায় অন্য জগতে।

ওদিকে ধীরেণবাবু হারিয়ে গেছেন তার জগতে। সোনারপুরে এসে তিনি বসার জায়গা পেয়েছেন। সুরেণ নেমে যাওয়ার সময় তাকে ডেকে ওই সিটে বসিয়ে দিয়ে গেছে। ধীরেণবাবু তার সদ্য কেনা খেলনাটি নিয়ে বসেছেন—স্মার্ট ফোন।

মাসখানেক আগে মেয়ে-জামাই এসেছিল বেড়াতে। তার স্মার্টফোন নিয়ে নাতনি দেবলা এসে বলল, “দাদু আমার স্কুল দেখবে ইন্টারনেটে?” ধীরেণ বাবু প্রথমে বিশ্বাস করেননি; ভেবেছেন ছেলেমানুষি। কিন্তু দেবলা সত্যিই গুগল আর্থে গিয়ে তাকে দেখিয়ে দিল তার স্কুল। তারপর দেবলা দেখিয়ে দিল ক্যানিং স্টেশন থেকে ধীরেণবাবুর বাড়িতে আসার পথ, তার বাড়ি আর ক্যানিংয়ের পাশের মাতলা নদী। আঙুলের ছোঁয়ায় ছোট জায়গাকে বড় করে যেমন দেখা যায় আবার বড় জায়গাকে ছোট করে চারপাশটা দেখা যায়। ধীরেণবাবু চমৎকৃত হয়েছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলেন, এই জিনিস তার একটা চাই। মাস শেষে কিনেও ফেলেন একটি সস্তা দামের স্মার্টফোন। খোকার মা অবশ্য বলেছিল, অযথা পয়সা খরচের দরকার কী, আগের ফোনে তো কথা শুনতে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্ত দরকার যে কী তা জানেন একমাত্র ধীরেণবাবু—তিনি ইন্টারনেট ব্রাউজ করবেন, গুগল আর্থে যাবেন।

দোকানের কর্মচারী গোবিন্দ আবার ইন্টারনেট-ফেসবুকে ওস্তাদ। সারাক্ষণ ফোনেই লক্ষ; খদ্দেরকে কাপড় দেখাতে দেখাতেও পারলে একবার স্ক্রিনে চোখ রাখে। ধীরেণ বাবু অনেক বকাবকিও করেন তাকে এ নিয়ে। সেই ধীরেণ বাবু যখন গোবিন্দকে বললেন, একটু শিখিয়ে দে, গোবিন্দ তখন মহা উৎসাহে লেগে পড়ে তার ধীরেনদাকে শেখাতে। বসের চাইতে একটা বিষয়ে সে ভালো, বস সেটা স্বীকার করে তার কাছ থেকে শিখতে চাইছেন, এর চাইতে আনন্দের আর কী হতে পারে গোবিন্দের কাছে।

২.
গত কয়েকদিন ধরে তিনি ট্রেনে আসা যাওয়ার সময় ফাঁক পেলেই ইন্টারনেট ব্রাউজ করেন। খবর পড়েন, রাজধানী এক্সপ্রেসের সময়সূচি দেখেন, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী পড়েন। একটা সার্চ তিনি দেবেন, যে জন্য এই ফোন তিনি বুড়ো বয়সে কিনেছেন। সেই সার্চটি দিতে গিয়েও কোথায় যেন বাঁধছে। দেওয়া হয়ে উঠছে না। আজ তিনি সেই সার্চ দিলেন। গুগলে গিয়ে লিখলেন, ‘নবগঙ্গা’; চাপ দিলেন সার্চ বাটনে। নেট বেশ স্লো। লোডিং ইন্ডিকেটর ঘুরছে তো ঘুরছেই। ধীরেণবাবুর মনে হচ্ছে অনন্তকাল তিনি সার্চ দিয়ে বসে আছেন, অনেক দূরে তিনি যাচ্ছেন।

তারপর অনেকগুলো ওয়েবপেজের নিশানা আসে; একটা মানচিত্র আসে; আসে কতকগুলো ছবিও। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন বয়স্কমানুষ, লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা, মাথায় টুপি, বিশাল এক চিতল মাছ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হাসি হাসি মুখ। পাশে সম্ভবত তার স্ত্রী দাঁড়ানো; তার মুখও হাসি হাসি। ধীরেণবাবু অন্য পেইজগুলো বাদ দিয়ে ওই ছবিটাতেই ক্লিক করেন। চিতল তার খুব প্রিয় মাছ। গড়াই নদীর চিতল মাছ বিখ্যাত।

গড়াইয়ের শাখানদী নবগঙ্গার মাছের স্বাদও অনন্য। নবগঙ্গার চিতল জিরা, গরম মশলা আর চুই দিয়ে মা রান্না করতেন। সেদিন একটা উৎসব-মুখর দিন থাকত। তাদের বাড়িতে মাংসের চল ছিল না। বড় আকারের চিতল ছিল একটা বিশাল ব্যাপার। ধীরেণবাবু চিতলের পেটির মাছ ভালোবাসতেন। গাদার অর্থাৎ পিঠের দিকের মাছ তিনি খেতে পারতেন না; বড্ড কাঁটা। ভাবতে ভাবতে চোখে জল চলে আসে। তিনি ছবির ওয়েবসাইটটিতে ক্লিক করেন। বিষয়টা হচ্ছে, ছবির এই বয়স্ক মানুষটি বিশাল আকারের এই মাছটি ধরেছেন। খালি হাতে। তিনি স্নান করতে নেমেছিলেন নবগঙ্গায়। ১৪ কেজি ওজনের মাছটি তিনি তখন ধরে ফেলেন লুঙ্গিতে পেঁচিয়ে।

গামছা পরে স্নান করতে নেমে গামছার একমাথা পরে থেকে অন্য মাথা দিয়ে কলমি ঝোপের নিচে ছেঁকে তুলে চুনোপুটি তিনিও ধরেছেন ছোটবেলায়। সমস্যা হচ্ছে গামছার অন্যমাথা কলমির নিচে দিয়ে ছেকে তুলতে তুলতে এমাথা কোমর থেকে খুলে পড়ার রিস্ক খুব বেশি। চুনোপুটি ধরতেই ওই অবস্থা; আর ১৪ কেজি ওজনের চিতল! হেসে ফেলেন ধীরেণবাবু। পাশের যাত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান, “দাদা খুব মজার কিছু পেলেন নাকি; হাসছেন যে বড়।” ধীরেণবাবু নিজেকে সামলে নেন, “না, ওই আর কি।”

ব্যাক করে তিনি সার্চ দেন, ‘পলিতা বাজার’। একটা মানচিত্র আসে গুগলের। সাথে কতকগুলো ওয়েবসাইট। তিনি মানচিত্রে ক্লিক করেন। দেখতে চান পলিতা বাজার, তার শৈশব কৈশোরের সেই পলিতা বাজার, যেখান থেকে নবগঙ্গার খেয়া পার হয়ে মামাবাড়ি যেতেন, এখন কেমন আছে সেসব জায়গা। ওখানকার কেউ কি আর চিনবে তাকে!

৩.
ধীরেণবাবুর শৈশব-কৈশোর কেটেছে নবগঙ্গার তীরে। যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার পরমেশ্বরপুর গ্রামে। নদীর তীরে দৌড়াদৌড়ি করে, নদীতে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করে বড় হয়েছেন তিনি। তারপর একদিন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি, ভরা বর্ষায় দু কূল ছাপানো নবগঙ্গা বেয়ে পরমেশ্বরপুর ছেড়ে নৌকায় করে নড়াইল। সাথে বাবা-মা, একটিন চিড়ামুড়ি, একটা বোচকার মধ্যে কতকগুলো কাপড়চোপড় আর সামান্য সোনাদানা। নৌকা ভর্তি মানুষ। সবার একই অবস্থা। কেউ জানে না কোথায় গিয়ে থামবে তারা।

ঠাকুরমার অস্থি ছিল বাড়ির উঠোনের তুলসীতলায় পোঁতা। গত তিন বছরে বাবার সময় হয় নি ভারতে গিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়ার। কেউ খেয়াল করেনি, বাবা আসার সময় সেই অস্থি নিয়ে এসেছেন সাথে করে। নড়াইলের ঘাটে সুর্যোদয়ের মুহূর্তে বাবা ডাকেন—“ধীরেণ, ওঠ, আয় গাঙে ছ্যান করি।” মা বলেছিল, “এত ভোরে ছ্যান কিসির? ক’নে যাচ্ছি তার ঠিক নেই। তুমি যাচ্চো ছ্যান করতি।” বাবা কোনো কথা শোনেননি। এক প্রকার হাত ধরে টেনে তিনি ধীরেণকে নামান নৌকা থেকে। স্নান সেরে নদীতে দাঁড়িয়ে সূর্য প্রণাম করে তিনি বললেন, “ধীরেণ, তোর ঠাম্মার অস্থি গঙ্গায় বিসর্জন দিতি পারলাম না। এও তো সেই একই জলের ধারা। এহেনিই বিসর্জন দিই সেই অস্থি।” বাবা তার গায়ে জড়ানো গামছার নিচ থেকে বের করেছিলেন ঠাকুর ঘরের সিঁদুরের-ফোঁটা-দেওয়া কাঁসার ঘট। এর মধ্যে করে তিনি মায়ের অস্থি নিয়ে এসেছিলেন। তারপর বাবা-ছেলে মিলে অস্থি বিসর্জন দেন নড়াইলের ঘাটে। বারানসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে তিনি জাগযজ্ঞের মাধ্যমে যা তিনি করতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি করলেন চলতি পথে নড়াইলের খেয়াঘাটে। অথচ তখন তিনি ভারতের উদ্দেশ্যেই যাচ্ছেন। বাবা কি জানতেন, ভারতে আসা হলেও গঙ্গা পর্যন্ত যাওয়া তার হবে না?

সন্ধ্যারাতে রওনা হয়ে ভোর নাগাদ নড়াইল। তারপর সারাদিন পায়ে হেঁটে যশোর। পেছনে নবগঙ্গা, পেছনে পরমেশ্বরপুর, পেছনে শৈশব-কৈশোর। সামনে উদ্বাস্তু মানুষের স্রোত। যাচ্ছে বেনাপোলের দিকে। প্রায় তিন দিনের এই পথচলার শেষে যখন বনগাঁর একটা ক্যাম্পে জায়গা হলো, ততক্ষণে বাবা হারিয়ে ফেলেছেন তার সমস্ত জীবনী শক্তি। রিফিউজি ক্যাম্পে বাবা চার দিন বেঁচে ছিলেন। পঞ্চম দিন ভোরে, শীর্ণ-ক্লান্ত রিফিউজিরা সারারাত জেগে থেকে যখন কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ ঝিমাচ্ছে তারই কোনো এক ফাঁকে তিনি চলে যান। স্ট্রোক করেছিল হয়তো।

কয়েক মাস পরে যুদ্ধ থামে; দেশ স্বাধীন হয়। অধিকাংশ মানুষ ফিরে যায় স্বাধীন বাংলাদেশে নিজের শিকড়ের কাছে। তাদের চোখেমুখে স্বপ্ন। কিশোর ধীরেণ যায় না; মাকে নিয়ে সে থেকে যায় বনগাঁয়। তারপর বহু পথ ঘুরে, বহু ঘাটে ধাক্কা খেয়ে একেবারে দক্ষিণে সুন্দরবন সংলগ্ন মহাকুমা শহর ক্যানিংয়ে এসে বসতি গড়েন। কয়লা ফেরি করতেন শুরুতে। তারপর অনেক রকম কাজ করেছেন। শেষটা থিতু হয়েছেন গড়িয়াহাটের এই কাপড়ের দোকানে। ফুট ফরমাস খাটা ছেলে থেকে আজ সরকার বা ম্যানেজার। মাঝে পঁয়ত্রিশটা বছর। মাঝে বনগাঁর ক্যাম্প ছেড়ে যাদবপুরের বস্তি। মাঝে বিয়ে সংসার। মাঝে মাকে হারানো। মাঝে দুই ছেলে মেয়েকে পাওয়া। এরই মাঝে দূর থেকে দূরে চলে গেছে নবগঙ্গা; দূরে চলে গেছে পরমেশ্বরপুর, পলিতা বাজার; দূরে চলে গেছে জিরা-গরম মশলা-চুই দিয়ে রাঁধা চিতল। দূরে চলে গেছে তার শৈশব-কৈশোর। কখনো যাওয়া হয়নি আর। স্ত্রী যাদবপুরের মেয়ে। শেকড় ছেঁড়ার কষ্ট সে বুঝবে না; ধীরেণবাবু বোঝাতে যাননি কখনো। হঠাৎ কখনো বৃষ্টির দুপুরে জানালার কাছে বসে মনে পড়েছে বৃষ্টির দুপুরে নবগঙ্গায় লুটোপুটি ঝাপাঝাপি। চোখের কোনে অশ্রু জমেছে। মুছে ফেলেছেন। এটুকুই।

৪.
শুধু সেবার। অম্বরিশ মাগুরা থেকে ফেরার পর তিনি অম্বরিশের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। অম্বরিশ থাকতেন ডানলপের দিকে। অম্বরিশ লক্ষীদিয়ার মানুষ। পরমেশ্বরপুরের পাশের গ্রাম। মাগুরার লক্ষীদিয়া থেকে এসে কলকাতার উপকণ্ঠে থিতু হওয়া অম্বরিশের গল্পটাও প্রায় একই রকম। অনেক বছর বাদে অম্বরিশ যখন মাগুরা যান, তখন তিনি ক্যান্সারে ভুগছেন। হয়তো শেষ দেখা দেখতে চেয়েছিলেন নিজের জন্মভিটাকে। হয়তো খুঁজে ফিরতে চেয়েছিলেন হারানো সেইসব দিনকে যেখানে ক্যান্সারের যন্ত্রণা নেই; অভাব-অনটনের জীবন যাপনের গ্লানি নেই।

মাগুরা এখন জেলা, পরমেশ্বরপুর পড়েছে মোহাম্মদপুর থানায়। মাগুরা শহর থেকে নবগঙ্গার তীর ধরে পাকা রাস্তা। বাস চলে। পলিতা বাজারের ঘাট আর নেই। সেখানে ব্রিজ। নদীটা আর সেই নবগঙ্গা নেই; প্রায় মরে গেছে। এসব কথার মধ্যে ধীরেণবাবু প্রশ্ন করে বসেন, “তা আমাগে কথা কেউ বাত্তা ন’লো না?” এত বছর পর সেই ভাষা! কোথায় ছিল এত দিন! পশ্চিমবঙ্গের কথার সাথে এর কোনো মিল নেই। প্রতিদিন এখানকার ভঙ্গিতে কথা বলছেন। মনের মধ্যে কোথায় লুকানো ছিল সেই নবগঙ্গাপাড়ের ভাষা! নিজেই চমকে যান। অম্বরিশও চমকে তাকান ধীরেণের দিকে।

পরমেশ্বরপুরের বসুরা ছিল সম্ভ্রান্ত পরিবার। তাদের কথা অনেকে জিজ্ঞাসা করেছে। জিজ্ঞাসা করেছে আরো অনেকের কথা। এদের সাথে অম্বরিশের যোগাযোগ নেই; যোগাযোগ থাকার কথাও নয়। একই এলাকা থেকে এলেও সমাজের বিভিন্ন ভাগে তাদের অবস্থান। জীবন যুদ্ধে ছিটকে পড়েছে বিভিন্ন জায়গায়। যে যার মতো ব্যস্ত। কোনো খবরও দিতে পারেনি সে। কিন্তু বিশেষত্বহীন কিশোর ধীরেণের কথা কেউ তেমন জিজ্ঞেস করেনি। শুধু একজন এসেছিল শুধুমাত্র ধীরেণের খবর জানতে—আলেক। আলেকের বাড়ি পানিঘাটায়। ঈশ্বরপুরের পাশের গ্রাম। ধীরেণের ছোটবেলার বন্ধু। একসাথে খেলার বন্ধু, একসাথে মাছ ধরার বন্ধু, ভরদুপুরে আম পাড়ার বন্ধু। আলেকদের বাড়িতে খেজুরের রস দিয়ে গুড় বানানো হতো। বড় বড় তাফালে রস জাল দেওয়া হতো সকাল থেকে। পাশে বসে দেখেছে কত কত দিন! আবার গুড় ঠান্ডা হওয়ার পর আঙুল দিয়ে খুঁচে তুলে খেয়েছেও দুজনে। অসম্ভব রঙিন অসংখ্য দিন মনে পড়ে যায়। প্রশ্ন করেন, “আলেক আছে কী র’ম?” সেই ভাষায় তিনি খুঁজছেন ছেলেবেলাকে। অম্বরিশ জানান, আলেকের শরীরও খুব ভালো নয়; বয়স তো সবার হচ্ছে। তার ছেলেপেলেরা বড় হয়েছে। পলিতাবাজার আর আশপাশের গ্রামে এখন মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, আলেকের এক ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে। এখন ট্রেনিং চলছে; কদিন বাদেই পোস্টিং হবে। “মেজিচটেট!” উচ্ছ্বসিত ধীরেণবাবু চিৎকার করে ওঠেন। এ যেন তার নিজের ছেলের বিশ্বজয়। একটা আন্তর্জাতিক সীমানার ওধারের একজন মানুষ, যাকে কোনো দিন দেখেননি; হয়তো কখনো দেখবেনও না; তার সাফল্যে তিনি গর্বিত বোধ করেন।

৫.
একটু ঝিমুনি মতো এসেছিল কি? ঠক করে ফোনটা পড়ে যায় হাত থেকে। ধীরেণবাবুর ঘুম এমনিতেও পাতলা। তার ওপরে এমন সাধনার ধন হাতে, অবচেতন মনও বুঝি সচেতন ছিল। তিনি চোখ মেলে ফোনটি কুড়িয়ে নিলেন। প্যান্টের পকেটে রাখলেন।

সোয়া দশটার দিকে ট্রেন যখন ক্যানিং স্টেশনে থামল তখন আর খুব বেশি যাত্রী নেই সেখানে। লাস্ট স্টেশন বলেই হয়তো কারো মধ্যে তাড়াহুড়ো নেই; ধীরে সুস্থে নামছে সবাই। স্টেশনের দু-একটা দোকান তখনও খোলা। অপেক্ষায় ছিল শেষ ট্রেনের যাত্রীদের। এত রাতেও কেউ কেউ বাড়ির দিকে পা বাড়ানোর আগে স্টেশনে বসে এক ভাড় চা খাবেন; দোকানদারের সাথে গল্পগাছা করবেন। খোঁজ নেবেন সারাদিন কী কী উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল ক্যানিংয়ে। এখানে তারা বাস করেন সত্যি। কিন্তু রবিবার ছাড়া দিনের বেলার ক্যানিং তো তারা দেখেন না। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে বেরিয়ে যান কলকাতার উদ্দেশ্যে আর ফেরেন এই প্রায়-মধ্যরাতে; ক্যানিং তখন প্রায় ঘুমানো। তাই ঘরে ফেরার আগে চায়ের দোকানে বসে একটু চা সিগারেট খাওয়া। ক্যানিংয়ের গল্প শোনা আর কলকাতার গল্প দেওয়া।

ধীরেণবাবু সাধারণত কারো পাল্লায় না পড়লে ট্রেন থেকে নেমে আর কোথাও দাঁড়ান না। হাঁটতে থাকেন বাড়ির দিকে। এ পথটুকু তিনি হেঁটেই যান প্রতিদিন। তাতে একটু হাঁটাচলাও হয়; পয়সাও বাঁচে। প্রতিদিনের তার এই নিয়ম সহযাত্রীরা জানেন বলেই কেউ আর তাকে রিকশায় ওঠার সময় ডাকেন না।

ধীরেণবাবু ট্রেন থেকে নামলেন একটু দেরি করে। ততক্ষণে ঝাড়ুদার ট্রেনে উঠে গেছে। শরীরটা যেন একটু ভারী ভারী লাগছে তার। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে দু হাতে দুপাশের হাতল ধরে সাবধানে নামবার চেষ্টা করলেন। বাঁ পাটা প্রথম সিঁড়িতে দিয়েছেন আর অমনি হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ চলে গেল। তারাভরা আকাশ। মেঘ ভেসে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে একখণ্ড মেঘ চাঁদকে আড়াল করে আবার ছেড়ে দিল। ধীরেণবাবু হঠাৎ অভিভূত হলেন, যেটা তিনি সাধারণত হন না। সাবধানে নামলেন। হাঁটতে শুরু করলেন বাড়ির দিকে।

৬.
মামাবাড়ি শত্রুজিৎপুর থেকে বাড়ি ফিরছে ধীরেণ। হাঁটা রাস্তা। হাতের বামে নবগঙ্গা। তার তীর ধরে রাস্তা। রাস্তা মানে ওয়াপদা বাঁধ। ষাটের দশকের শেষ দিকে মূলত বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরো দক্ষিণ বঙ্গে নদীর তীর ঘেঁষে এই বাঁধগুলি দেয় পাকিস্থান সরকার। বন্যার ভয় কমলো; সাথে কমলো মাছ। ছোট গাঙগুলোর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হলো। তার কিছুদূর গিয়ে কৃত্রিম খালের মাধ্যমে নবগঙ্গার সাথে ছোট গাঙের যোগাযোগ। মাঝখানে স্লুইজ গেইট। গাঙগুলো হয়ে পড়ল খাল। প্রকৃতির জোয়ার-ভাটা নেই সেখানে। মানুষ যদি গেইট খোলে তবেই জল ঢুকতে পারে; বেরোতে গেলেও একই নিয়ম। ফলে মরে গেল ছোট ছোট খাল বা শিশে। মাছ কমলেও কিছু কিছু মাছ, বিশেষত চিতল, তখনও নবগঙ্গায় পাওয়া যেত প্রচুর। আজ সকালে ধরা পড়েছে দুটি দশাসই চিতল—এক একটা সাড়ে তিন চার কেজির কম হবে না। বাবা বললেন, “ধীরেণ, এট্টা মাছ দিয়ে আয় তোর মামাগে।” ধীরেণও খুশি। সেই পুজোর পরে আর মামাবাড়ি যাওয়া হয়নি। একটা চটের থলেয় চিতল মাছ নিয়ে ধীরেণ রওনা হয় শত্রুজিৎপুর। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা হতে হতে বিকেল। কী ক্ষতি হতো একটা দিন থেকে আসলে? না, বাবার কড়া হুকুম আজই ফিরতে হবে। কাল সকালে জমিতে মই দিতে হবে।

শত্রুজিৎপুর থেকে পলিতা বাজার অন্তত মাইল চারেক। সেখানে খেয়াঘাট। ঘাট পেরিয়ে নবগঙ্গার অন্য পার ধরে আরো প্রায় এক মাইল দূরে পরমেশ্বরপুরে তার বাড়ি। সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারবে তো পলিতা বাজার? শেষ খেয়া ছেড়ে যাবে না তো। ধীরেণ যেভাবে চলতে থাকে তাকে ঠিক হাঁটা বলা যাবে না, আবার দৌঁড়ানোও বলা যাবে না—মাঝামাঝি কিছু একটা।

হিমালয় থেকে নেমে আসা গঙ্গা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন বাংলাদেশে ঢোকে তখন তার নাম হয় পদ্মা; চলতে থাকে দক্ষিণ-পশ্চিমে। পদ্মা যখন কুষ্টিয়ার কাছ দিয়ে গোয়ালন্দের দিকে যাচ্ছিল তখন তার থেকে বেরিয়ে পড়ে এক শাখা। কুষ্টিয়া থেকে মাগুরা হয়ে চলে গেছে ফরিদপুরের দিকে। কখনো তার নাম গড়াই; কখনো মধুমতি। কুমারখালীর কাছে এই গড়াইয়ের একটি ছোট্ট শাখা উঠে এসেছে। চলে গেছে নড়াইলের দিকে। ছোট্ট শাখাটি ফিরে পেয়েছে সেই আদি ধারার নাম—গঙ্গা। এ নদীর নাম নবগঙ্গা। গঙ্গার ধারা হিসেবে অথবা নামের কারণে এ নদীর ধারাকে শ্রদ্ধা করে দুই পারের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। অনেকে স্নানের সময় নাভি-সমান জলে দাঁড়িয়ে নদীকে প্রণাম করেন।

নবগঙ্গার পলিতা ঘাটের পাটনী অর্থাৎ খেয়ার মাঝি বিষ্ণুদা। লোক ভালো। কিন্তু সন্ধ্যায় একবার বৈঠা রেখে পা ধুয়ে ঘরে উঠতে পারলে আর নামতে চায় না। বাড়িতে ডাকতে গেলে আসে, কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করতে ছাড়ে না। আর কোথাও গিয়ে তাসের আড্ডায় বসলে তো কথাই নেই। যতই যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকুক দু দান না খেলে উঠবে না। বয়স্ক কোনো যাত্রী হলে তবু কতকটা; কিন্তু ধীরেণকে সে পাত্তা দেবে না। যাত্রী পার করা নিয়ে তার কোনো বাড়তি গরজ নেই। এ ঘাটে খেয়া পার হয়ে কাউকে টাকা পয়সা দিতে হয় না। বছরে একবার, ধানের সিজনে, বিষ্ণুদা আর তার বাবা পাশের সবগুলো গ্রামের সব বাড়িতে যাবেন। সারা বছরের পারানি বাবদ ধান আনবেন। সাধারণত প্রতি পরিবারের জন্য দুই পা’লে। পা’লে হচ্ছে বেতের ধামা, পাঁচ সের ওজনের ধান ধরে এমন সাইজের। তবে ধরাবাঁধা নয়; কেউ কম দিলে কমই সই। সারা বছরের পারানি সবার দেওয়া থাকে; কে কতবার পার হলো কেউ হিসাব করে না।

৭.
সন্ধের মধ্যে ঘাটে যেতেই হবে। ধীরেণবাবু জোরে জোরে পা চালাতে চাইলেন। যত জোরেই তিনি চলতে যান গতি যেন বাড়ছে না। দু-একবার হোঁচটও খেলেন। হুমড়ি খেয়ে পড়লেনও একবার। আবার উঠে চললেন। ওয়াপদা রাস্তা থেকে নদীর ঘাট পর্যন্ত সরু ভেড়ি—জমির আলের ওপর দিয়ে হাঁটার রাস্তা। ধীরেনবাবু পড়িমরি করে ছুটছেন। ওই যে বটগাছ দেখা যাচ্ছে। দূর আর বেশি নেই। ওয়াপদা রাস্তার বাম দিকে সোজা চলে গেছে ভেড়ি আর ডান দিকে একটা বটগাছ; বিষ্ণুদাই লাগিয়েছে। বলেছে এটা তার ঘাটের নিশানা।

বটগাছ দেখে নিজের গতি আরো বাড়ালেন ধীরেণবাবু। ততক্ষণে চাঁদ উঠেছে। মাথার উপরে ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি’। ঝলমলে, ভীষণ উজ্জ্বল আকাশ; চারদিক আলোময়। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে মনেই হয় না। ধীরেণবাবু পড়িমরি করে ছুটছেন। শেষ খেয়া ধরতেই হবে। মূল রাস্তা থেকে ভেড়িতে উঠে আবার হোঁচট খেলেন। হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। এবার বোধহয় বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটা গেল। কিছুটা যন্ত্রণা বোধ হলো বটে। হাত দিয়ে চেপে ধরলেন আঙুলটি। হাতে রক্তের উষ্ণতা টের পেলেন তিনি। তবু উঠে ছুটতে শুরু করলেন।

বিষ্ণুদার গলা শোনা যাচ্ছে—“কেডা রে? যাবা নাহি?” ধীরেণবাবু শরীরের সব শক্তি সঞ্চয় করে বলতে চাইলেন, “যাব… আমার যাতিই হবে …আমারে নিয়ে যাও।”

নদীতে এখন ভাটা। জল অনেক নিচে। কাদার মধ্য দিয়ে গিয়ে নৌকায় উঠতে হবে। বিষ্ণুদা তাড়া দিচ্ছে, “তোমার জন্যি এতগুনো মানুষ দাঁড়া নে…জোয়ান ছাওয়াল… এট্টু তাড়াতাড়ি আসতি পারো না?” ধীরেণবাবু স্যান্ডেল খুলে হাতে নিলেন। প্যান্ট গোটানোর সময় পেলেন না—কাদার মধ্যে হাঁটতে থাকলেন। তিনি যত এগোচ্ছেন নৌকার দিকে, নৌকা যেন তত দূরে সরে যাচ্ছে; কিছুতেই তিনি নৌকার কাছে ভিড়তে পারছেন না। “বিষ্ণুদা, এর’ম করতেছো কেন?”

৮.
সারারাত বাড়ি ফেরেননি ধীরেণবাবু। স্টেশনের নাইট গার্ড বলছে যে, সে দেখেছে ধীরেণবাবুকে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে যেতে। লোকটা যাবে কোথায়? পাড়ার লোকেরা রাতভর খুঁজে কোনো কিনারা না পেয়ে সাব্যস্ত করে কাল সকালে থানায় জানাতে হবে। কিছু একটা সমস্যা তো হয়েছে। তা না হলে জলজ্যান্ত মানুষ স্টেশন থেকে বাড়ি পর্যন্ত পাঁচ-সাত মিনিটের পথ যেতে গিয়ে কোথায় হারাবে? সমস্যা হচ্ছে, গলির মোড়ের মন্দিরের শিবু বলতে পারছে না ধীরেণবাবু রাতে মন্দিরের সামনে দিয়ে গেছেন কিনা। তার মানে বাজারের রাস্তা থেকে গলি পর্যন্ত তিনি এসেছেন কিনা বলা যাচ্ছে না। সাধারণত প্রতিরাতে ধীরেণবাবু এই জায়গা দিয়ে যাওয়ার সময় হাঁক দেন... “কী করিস শিবু? খেয়েছিস?” গতরাতে সেরকম কোনো হাঁক যে তিনি দেননি এটা নিশ্চিত। তা হলে শিবু ঘরের মধ্যে থাকলেও শুনত।

ধীরেণবাবুর বাড়িতে কান্নার রোল। এরই মধ্যে সাতটা নাগাদ খবর এলো মাতলার খেয়াঘাটে একটা লোক কাদার মধ্যে পড়ে আছে। জীবিত কি মৃত বোঝা যাচ্ছে না। কেউ গায়ে হাত দেয়নি। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। সবাই পড়িমরি করে ছুটল সে দিকে।

ধীরেণবাবুর বাড়ি যাওয়ার জন্য স্টেশন থেকে যেতে হয় পুবদিকে। আর খেয়াঘাট উত্তরে। তাও মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাজার ছাড়িয়ে মাতলা নদীর পাড় ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। সেই বাঁধই এখানকার বড় রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে ওদিকে তিনি কেন যাবেন? মাতলা নদীর এপারে ক্যানিং আর ওপারে সুন্দরবন। সুন্দরবনের মধ্যে আছে ছোট ছোট লোকালয়, আছে ছোটখাটো পর্যটন কেন্দ্রও। লোকজন তাই এপথে যাতায়াত করে। কিন্তু দিনের বেলায়। সন্ধ্যার পর আর নয়। মাতলা বড় বিচিত্র নদী। ভাটার সময় একদম শুকিয়ে যায়। তখন লোকে হেঁটে পার হয়। আবার যখন জোয়ার আসে, মারাত্মকভাবে আসে। একেবারে ফুলে ফেঁপে ওঠে; সবকিছু ভাসিয়ে নেয়। মনে হচ্ছে এই লোকটিকেও ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে মাতলার স্রোত। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় নদীর স্রোতে কখনো কখনো মানুষের লাশও ভেসে আসে না তা নয়। কতরকম কাণ্ড চলে জঙ্গলে! তাই পুলিশ না আসা পর্যন্ত কেউ কাছে যাচ্ছে না; সবাই দাঁড়িয়ে আছে দূরে।

বড় রাস্তা থেকে সরু একটা ভেড়ি চলে গেছে খেয়া ঘাট পর্যন্ত। ভেড়ি যেখানে শুরু তার উল্টোদিকে একটা বটগাছ। তার নিচে একটা কাঠের বেঞ্চি। ঘাটের মাঝিই করেছে। বটগাছের গোড়ায় এসে রিকশা ভ্যান থেকে নামে ধীরেণবাবুকে খুঁজতে বেরোনো লোকজন। তারপর একপ্রকার দৌঁড়ে তারা চলে যায় নদীর ঘাটে। ঘাট থেকে বেশ একটু দক্ষিণে লোকজন ভিড় করে আছে। ভেড়ি থেকে নেমে সেখানে যায় সবাই।

ধীরেণবাবুর ছেলে অর্ধেন্দু দলটির মধ্যে সবার আগে পৌঁছে যায় ভিড়টার কাছে। চরের কাদার মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা মানুষের দেহ, মাথাটা একদিকে কাত হয়ে আছে। জামা-কাপড় দেখে কিছুটা দূর থেকেও চিনতে দেরি হয় না—এ তার বাবা। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সে। কয়েকজন বলে উঠল, “করেন কি দাদা... শেষে পুলিশ কেসে পড়বেন যে... পুলিশ আসার আগে যাবেন না।”

কোনো দিকে কর্ণপাত না করে অর্ধেন্দু ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে কাদায়। বাবার শরীরটাকে ধরে চিৎ করে মাথাটা কোলের উপরে তোলে। শরীরটা ঠান্ডা নয়। বরং ভীষণ গরম। অর্ধেন্দু চিৎকার করে ওঠে, “বাবা! বাবা!” ইতোমধ্যে আরো লোক পৌঁছে গেছে। একজন দৌঁড়ে খেয়া নৌকা থেকে মাঝির জলের ঘটি নিয়ে এসে ধীরেণবাবুর চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিতে থাকে। ওদিকে অর্ধেন্দু বাবার কাঁধ ধরে হালকা ঝাঁকুনি দিচ্ছে আর ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে চিৎকার করে যাচ্ছে।

তাকে যুগপৎ আনন্দিত এবং বিস্মিত করে ধীরেণবাবু কাতর স্বরে টেনে টেনে বলে ওঠেন, “মা আমারে পেটির মাছ দেবা কিন্তু... গাদার মাছে বড্ড কাঁটা...”

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;