সাধারণ মৃত্যুর জীবনচক্র



মেহেদী ধ্রুব
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

কে যায়? কারা যায়? ওটা কিসের ঘ্রাণ? কালো মুখোশের? যাই, একটু দেখে আসি, হ্যাঁ, ওই তো কালো মুখোশেরা যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে? এই জগতে কাকে নিয়ে আসবে? অন্ধকার নেমে এলে ওরা বের হয়, আলো ফোটার আগেই বাতাসে মিলিয়ে যায়; এই জায়গায় মুখোশদের সাথে আমাদের হুবুহু মিল; এই যে গাঢ় হচ্ছে অন্ধকার, এই যে ওরা বের হয়ে হচ্ছে, আমিও তবে বের হই; আহ্, কী শান্তি! এসো হে অন্ধকার, এসো, এসো; আজ আমি তন্নতন্ন করে খুঁজব, আমি আমার ঠল্লইটা খুঁজে পাচ্ছি না, গুলাইটাও খুঁজে পাচ্ছি না, কোথায় যে রেখেছিলাম; মরে যাবার এই এক অসুবিধা, কিছুই মনে থাকে না; অহ্, আপনারা ‘ঠল্লই’ চিনেন তো? ‘গুলাই’ দেখেছেন তো? বাঁশ দিয়ে ঠল্লই বানানো হয়, এটাকে বাঁশের বন্দুকও বলা যায়; ঠল্লইয়ের এক ছিদ্রে দাতই ফল বা পিছন্দি ফল বা বাজনা ফল ঢুকিয়ে কাঠি দিয়ে জোরে ঠেলা দিলেই অন্য ছিদ্র দিয়ে বুলেটের মতো বেরিয়ে যায়, আর গুলাইয়ের কথা কী বলব, এটা আপনারা কম বেশি দেখেছেন, আজ সারারাত এগুলো খুঁজব।

এই ডিসেম্বরে আমার মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু একদিন আমি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পরে কী যে হলো, আমি হয়ে গেলাম নেতা, পত্রিকায় আমার নাম, টিভিতে আমার নিউজ, টকশোতে আমি, সেসব দেখে আমি ভীষণ মজা পেতাম, তখন কত মহল থেকে যে আমার সাথে যোগাযোগ করা হতো, এই দল, সেই দল, আমিও কী এক নেশায় পড়ে গেলাম, সারাক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে থাকতাম; কী করব, কী করব করে অস্থির হয়ে কত কী যে করেছি, কত কী যে খেয়েছি; এক সময় আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলাম; কী বিস্ময়কর জীবন! লাস্ট যাকে খতম করার অর্ডার পাই, সে ছিল বিগ ফিশ, কিন্তু বিগ ফিশকে খতম করার পরে যে আমার খেইলও খতম হয়ে যাবে কে জানত।

আমি যেদিন মারা যাই সেদিন সেইফ হোমেই ছিলাম, একটার পর একটা সিগারেট টানছিলাম আর ক্রাইম-থ্রিলার দেখছিলাম, কিন্তু মিড নাইটের দিকে কে বা কারা আমার দরজায় নক করে, আমি দরজা খুলি না, তারপর দরজায় সে কী লাত্থি, আমি কে কে বলে চিৎকার করি, মেশিনটা রেডি করি, লাইট অন করি, ততক্ষণে রুমে ঢুকে গেল ওরা, দেখি কালো কালো মুখোশ, কয়েক মিনিট ধস্তাধস্তির পরে ওরা আমার হাত-মুখ-চোখ বেঁধে ফেলে, তারপর একটা কারে তোলে, সম্ভবত মাইক্রোবাস হবে, অনেকক্ষণ চলে মাইক্রোবাস, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, কোথা থেকে যেন আজানের সুর কানে আসে; হঠাৎ মাইক্রোবাস থেমে যায়, আমি বুঝতে পারি কিছু একটা হতে যাচ্ছে; আব্বা-আম্মার কথা খুব মনে পড়ছে, বোনগুলোর কথাও; আব্বা কি এখনো ইটের ভাটায় কাজ করে? অথচ সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর আমার কথা-বার্তা, চাল-চলন বদলে গেল, বাড়ির সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম; কত কথা যে মনে পড়ে; তখন একজন ধমক দিয়ে বলে ‘বাঁচতে চাইলে দৌড়া’, আমি দৌড় দেই না, ওদের পায়ে পড়তে যাই, কিন্তু কিছুই খুঁজে পাই না; আবারো বলে, ‘দৌড় দিবি নাকি গুলি করব?’ আমার দিনমজুর আব্বা বলতেন জান বাঁচানো ফরজ, আমি ফরজ আদায় করার জন্য দৌড়াই, আর...; একবার মাত্র ‘মাগো’ বলে চিৎকার দিতে পারি।

এখন আমি টাউন হলের দেয়ালের ফাটলে থাকি, এই কয়দিনে মাত্র একজনের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, যে লোকের সাথে পরিচয় হয়েছে সে লোক সারারাত সিন্দুক খোঁজে; যাই, লোকটার সাথে একটু কথা বলে আসি, ফেরার সময় আব্বার হাতে বানানো ঠল্লই-গুলাইও খুঁজে দেখা যাবে, যাই :
: কেমন আছেন? কী করছেন?
: ভালা নাই, তুমি কেমন আছো?
: ভালো আছি, কী করেন?
: কী আর করুম, তুমি আমার সিন্দুকটা দেখছোনি?
: না, সিন্দুক দেখিনি তো, আপনি আমার ঠল্লই-গুলাই দেখছেন?
: সিন্দুক দেখছো নাতো কী দেখছো মিয়া? আবার ঠল্লই-মল্লইয়ের কথা জিগাও।
: আস্তে কথা বলেন, এখানে বাহাদুরি চলে না, এখানে সবাই সমান, আপনি মেজাজ ঠান্ডা করেন আগে।
: ধুর মিয়া, মেজাজ মারাইতে আইসো না, যাও, ঠল্লই না মল্লই খুঁইজ্জা বেড়াইতাছো হেইডা খুঁজো গিয়া, এইখানে বাল পাকনাকি কইরো না।
: আশ্চর্য, আপনার সমস্যা কী? আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?
: কীভাবে কথা কইতাম তোমার লগে? সিন্দুক দেখছো নাকি কও।
: বললাম তো দেখিনি, আপনি আপনার মেজাজ ঠিক করেন আগে।
: আচ্ছা, ঠিক করুম নে, যাও চোখ্যের সামনে থেইকা মিয়া।

বেকুব একটা, ধমকের লগে লগে কেমনে চইল্যা গেল; অবশ্য আরেকটা লোকের সাথে আমার পরিচয় হইছে, ওরেও বইল্যা রাখছি, সিন্দুক পাইলে যেন খবর দেয়, ওর সাথে পরিচয় করায়া দিমু নে, তার আগে অবশ্য আমার পরিচয়টা দেওয়া দরকার, মরার পরে আমি থাকি একটা আন্ধার টয়লেটে, ওই দিকে কেউ যায় না; আর গেলেও লাভ নাই, আমি কাউরে ডরাই না, কোনোকালে কাউরে ডরাই নাই, এই অক্টোবরে আমার মৃত্যু হইলেও কত জনরে যে মারছি নিজেও জানি না; ওহ্, যা কইতেছিলাম আমি যেইদিন মারা যাই সেইদিন জনগণের মইধ্যে যাকাতের কাপড় বিলি করতেছিলাম, শালার কপাল এত খারাপ, আধা ঘণ্টার মইধ্যেই ফুটুস, যদিও আমার পাশে ছিল গানম্যান, পুলিশ-টুলিশেরও অভাব ছিল না, সকাল বেলা ডক স্কোয়াডও পরীক্ষা কইরা গেছে, সবি ঠিক ছিল, কোত্থে যে এত মানুষ আইলো, বাঁশের বেড়া ভাইঙ্গা হুমড়ি খায়া পড়ল, মারামারি লাইজ্ঞা গেল, এই সুযোগে ফুটুস, এক্কেবারে কপাল বরাবর, মানুষের পায়ের তলায় পইড়া একুইশ জন মানুষ মইরা গেল, কিন্তু এই কাজটা কে করাইল? নিজের লোকেরা? নাকি বিরোধীরা? নাকি জঙ্গি-টঙ্গিরা? আজও কোনো কূল-কিনারা করতে পারল না কেউ, শুনছি মামলা চলতাছে, বন্দুক যুদ্ধে কয়েকজন মইরাও গেছে, কিন্তু রহস্য আর উদঘাটন হইল না, এইসব কথা মনে হইলে কইলজ্যাটা ফালা ফালা হইয়া যায়, এই হাতের ইশারায় কত শ্রমিক-কৃষক, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক, কত ফেউ-টেউ শেষ কইরা দিলাম, গত মে মাসেও ঘাঘু মালটারে খায়া দিছি, আমার চেয়ারের দিকে লোভ হইছিল শালার, তুই বেটা এইটা সেইটা কইরা কোটি কোটি টেকা কামাই করছোস, আরো কর, না করছে ক্যাডা; তুই লোভ করলি ক্যায়া শালা? তাই দিছি ভইরা; কিন্তু এর পরে আমি নিজেই কিনা নাই হইয়া গেলাম; উফ, আর ভাল্লাগতাছে না, যাই, সিন্দুকটা খুইজ্জা দেখি, আর ওই লোকটার সাথে আলাপও কইরা আসি—
: এইভাবে উল্টা হইয়া গাছে ঝুইল্লা আছেন যে, কী ব্যাপার?
: কে কথা বলে? কে আপনি?
: আমারে চিনতে পারতাছেন না? উল্টা হইয়া ঝুইল্লা আছেন তো, তাই চিনতে পারতাছেন না, একটু সোজা হন, চিনতে পারবেন, আমার সিন্দুকটা দেখছেন?
: এই সোজা হলাম, ওহ আপনি? সিন্দুক খুঁজছেন নাকি?
: হ, আমার সিন্দুকটা দেখছেন?
: সবখানেই তো সিন্দুক, কেউ দেখতে পায়, কেউ পায় না, আপনি আগে দেখতে পেতেন, এখন পান না।
: আপনের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারি না, তা আপনি এইভাবে উল্টা হইয়া ঝুইল্লা ছিলেন ক্যান?
: আমার জিনিসগুলো খুঁজে পাচ্ছি না, কোথায় রেখেছি তা মনে করার চেষ্টা করছিলাম।
: তা তো বুঝলাম, কিন্তু আপনের ঝুইল্লা থাকার কারণ কী? উল্টা হইয়া ঝুইল্লা কী খুঁজতাছেন?
: সব উল্টো মানুষ, উল্টো মানুষকে বোঝার জন্যই উল্টো হয়েই ঝুলে ছিলাম, আর উল্টো হয়ে জিনিস খোঁজা যায় না, স্মরণ করা যায়।
: আপনে কী খুঁজেন? ওইগুলা খুঁজার সময় আমার সিন্দুকটাও একটু দেইখেন।
: আমি খুঁজি চেয়ার, সাইন পেন, বই; কোথায় যে রেখেছি কিছুই মনে পড়ে না।
: এইগুলা কি খুঁজার জিনিস হইল? আমার সিন্দুকটা দেখছেন?
: বললাম তো আপনার সিন্দুক আপনার আশেপাশেই আছে।
: ধুর মিয়া, পাগলামি ছাড়েন, আজাইরা কথা, আপনি ঝুইল্লা থাকেন, বালের বই না চেয়ার খুঁজতাছেন, ওইটা খুঁজতে থাকেন, আমি গেলাম।

আহ্, কী শান্তি, লোকটা তবে চলে গেছে, ওহ্, আমি যেন কোন বইটা খুঁজছি? Das Kapital? না, না, আমি এই বই খুঁজতে যাব কেন? আমি যেটা লিখেছি সেটা খুঁজছি, সেটার নাম কি ‘মাইক্রো ব্যাংক’? এমন কিছুই হবে, আমি নিশ্চিত ‘মাইক্রো’ শব্দটা ছিল; এই বইটা আমি নিজেই লিখেছি, যদিও বাকিগুলো নিজে লিখিনি, কাকে দিয়ে যেন লিখিয়েছি, অবশ্য মোটা অংকের অর্থ নিয়েছে লোকটা, আমার বইয়ের কোন লাইনটা যেন বিখ্যাত হয়েছে? Dream is not that which you see while sleeping, it is something that does not let you sleep, এটা? না, না, এই স্বপ্ন-টপ্ন না; আমার কোটেশনে poverty, poor এই শব্দগুলো ছিল; থাক, কষ্ট করে আর মনে করতে চাচ্ছি না, আমি বরং সাইন পেন ও চেয়ার খুঁজতে বের হই, যদিও রাস্তাঘাট তেমন চিনি না, এই অগাস্টে আমার মৃত্যু হয়েছে; অবশ্য আমিও কম কী, এই জুনে একটা ফেউকে যমের ঘরে পাঠিয়েছি, কিন্তু কাজটা আমার করতে হয়নি, বেটা আমার বিরুদ্ধে নিউজ করে, আমার বইয়ের আসল লেখক কে, দেশি-বিদেশি কোন কোন সংস্থার সাথে আমার যোগাযোগ আছে, আমি কার হয়ে কাজ করি; কে কার এজেন্ট, ঋণ খেলাপি, রিজার্ভ চুরি, শেয়ার বাজার, অর্থ পাচার, এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে, কিন্তু আমার এই সুখ-স্বাছন্দ্য, এই ভালোমানুষি, এই জনপ্রিয়তাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারি না; তাই বেটাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছি; কিন্তু আমিও টিকতে পারিনি; ওই দিনের ব্যাপারটা আজও বুঝতে পারি না; লেট নাইট পার্টি শেষ করে বাসায় ফিরছি; রাস্তায় লোকজন নেই, পাঁচ নম্বর রোডের মোড়ে আমার গাড়ি থেমে গেল, একটা মাইক্রোবাস রাস্তার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে, আমার ড্রাইভার একটা হর্ন দিয়েছে কী দেয়নি, অমনি দৌড়ে এলো ওরা, আমি শুধু কালো কালো মুখোশ দেখতে পেয়েছি, সে কী কোপ, আমার ঘাড় থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত...;

উফ, আর মনে করতে চাই না, আর ভালো লাগছে না, এই ম্যানহোলে থাকতে থাকতে মনটা কেমন হয়ে যাচ্ছে; যাই, বাহির থেকে ঘুরে আসি; দেখি জিনিসগুলো খুঁজে পাই কিনা; ফেরার পথে পুরনো জাদুঘরে যে লোকটা থাকে তার সাথে আলাপ করে আসব নে; লোকটা সারাদিন লেখালেখি করে; যাই, দেখি আসি একটু—
: কেমন আছেন আপনি?
: ওহ্, আপনি, আমি ভালো আছি, আপনি?
: ভালো আছি, কিন্তু জিনিসগুলো খুঁজে পাচ্ছি না, বইয়ের নামটাও মনে করতে পারছি না।
: আমিও লিখতে পারছি না, সাদা মেঘের সাক্ষাৎ পাচ্ছি না, কালো মেঘে লিস্ট করে লাভ নেই, কারো চোখে পড়ে না।
: কেন চোখে পড়ে না? কেন?
: খুব সোজা, কালো কালোকে খেয়ে ফেলে, তাই কেউ দেখতে পায় না, আপনারা সাদা মেঘে যা দেখেন তা কালো মেঘের তুলনায় এক আনাও না।
: কী বলেন, সাংঘাতিক ব্যাপার, আচ্ছা আর বিরক্ত না করি, আপনি সাদা মেঘ খুঁজতে থাকেন, আমি তবে চলি।

এই লোকটা সারাদিন উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে, সাইন পেন খুঁজে, চেয়ার খুঁজে, কী এক বই খুঁজে, কিন্তু বইয়ের নাম জানে না; পাগল ছাগল সব, অবশ্য এই লোকটা জানে না যে, এখানে আমার বউও থাকে; আমরা বউ-জামাই ভালোই আছি; অহ্, আমাদের পরিচয় তো দেওয়া হয়নি; এই জুনে আমাদের মৃত্যু হয়েছে, যদিও অন্য একজনের মৃত্যুর সাথে আমি জড়িত ছিলাম; অবশ্য আমি নিজে কিছুই করিনি, ওপর থেকে আমাকে মোটা অংক দিয়ে বলে, ‘আমরা যেইভাবে বলি সেইভাবে শুধু রিপোর্টটা করবেন।’ আমিও বুদ্ধি-পরামর্শ দেই আর রিপোর্ট করি অনেক দিন; থাক, এসব আর মনে করে লাভ নেই; যা বলছিলাম, সেদিন গভীর রাতে...; না, আর মনে করতে চাই না, বউ পারলে বাকিটুকু তুমি বলো, দেখি সাদা মেঘের সন্ধান পাই কিনা।
: তুমি যে কিনা, এসব রক্তারক্তির কথা বলতে আমারও ভালো লাগে না।
: আরে বলো, তুমি আমার চেয়ে সাহসী, আমি তো মুরগি কাটা দেখলেও ভয় পেতাম।
: কী যে বলো, তোমার চেয়ে সাহসী কে ছিল শুনি?
: আমি যাচ্ছি কিন্তু।
: আচ্ছা যাও।

আমার জামাই বড্ড ছেলে মানুষ, উন্মাদও বলতে পারেন; যে কথা বলছিলাম, সেদিন রাতে কী হয়েছিল ঠিকঠাক বলতে পারব না; শুধু এটুকু মনে পড়ে, আমার চোখের সামনে আমার জামাইকে জবাই করে ফেলে; সে কী রক্ত, রক্তের সমুদ্র, ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে ল্যাপটপ কোথায়; ওই ল্যাপটপেই ছিল মুখোশ আর ছায়াদের লিস্ট, তারপর আমার গলায়ও; উফ, কালো কালো মুখোশ, আর বলতে পারব না, কিন্তু আমাদের চার বছরের বাবুটা কোথায়? যাই, একটু খুঁজে আসি, ফেরার পথে ওই মহিলার বাবুর গল্প শুনে আসব, ওই মহিলার বাবুও নাকি হারিয়ে গেছে, যাই তবে।
: আপা, কেমন আছেন? আপনার বাবুকে খুঁজে পেয়েছেন?
: খুঁজে পাইলে তো দেখতেনই, আপনে পাইছেন সাদা মেঘ? আপনার বাবুরে পাইছেন?
: মেঘ খুঁজে পেলে কি আপনার কাছে এসেছি, এতক্ষণে লিস্ট করতে বসে যেতাম।
: এইসব বাদ দিয়া ভালো করে বাবুরে খুঁজেন, এইসব মেঘটেক খুঁজে লাভ নাই।
: এই কারণেই আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, আপনি থাকেন, আমি গেলাম।
: এত গরম দেখায়েন না, বাবুরে খুঁজতাছি, আপনার বাবুরে পাইলে জানাব নে।
: তার আর দরকার নেই, আপনি নিজেরটাকে খুঁজেন, যত্তসব।

এই মহিলার কথার ধরন ভালো না, একটু যে আলাপ করব সেই সুযোগ নাই, খালি সাদা মেঘ খুঁজে; বাবুরে খুঁজলেও তো পারে, আমার বাবুটা যে কোথায় আছে, এই এপ্রিলে আমরা জামাই-বউ মারা যাই, সেই দিনের কথা মনে হলে... না, আমি বলতে পারব না, কলিজা ফেটে যায়; এই যে জামাই, পারলে আপনি বলেন।
: বউ, তুমিই কও, আমি বস্তাগুলা খুঁইজা পাইতাছি না।
: সারাদিন বস্তা খুঁজার দরকার নাই।
: তাইলে কী তোমার গহনার বাক্স খুঁজতাম?
: সব খুঁজবা, আমার গহনার বাক্স খুঁজবা, তোমার বস্তা খুঁজবা, আমাদের বাবুরেও খুঁজবা।

আমার বউ পাগল কিসিমের হইলেও দিলটা সাচ্চা, সে যেহেতু কইতাছে তাইলে ওই দিনের ঘটনাটা কই; তার আগে আমাদের পরিচয়টা দিয়া লই; আমি তরুণ চেয়ারম্যান, প্রথম ইলেকশনেই বিপুল ভোটে পাস করছি, আর আমার বউ হেড মাস্টারনি; আমাদের কথা শোনার আগে আমি যে কাজটা করছি তার কথা একটু কই; এই কথাটা কেউ জানে না, আমার বাড়িতে যে মেয়েটা কাজ করত, একদিন...; থাক, কইয়া কী লাভ, জীবনে ইট-বালু-টিন-চাইল-গম কম খাই নাই; যা কইতেছিলাম, ওইদিন রাতের বেলা আমার দরজায় আইসা কে জানি ফিসফিস কইরা কয়, ‘চেয়ারম্যান সাব, ও চেয়ারম্যান সাব, দরজাটা খুলেন, কথা আছে, দরজাটা খুলেন।’ বউ না করে, কিন্তু আমি যন্ত্রটা হাতে নিয়া দরজাটা খুলি; সাথে সাথে আমারে জাপ্টায়া ধরে, খালি কালা কালা মুখোশ; ওরা ঘরের চালে, ঘরের ভিতরে, আমগোর গায়ে, বিছানায় কেরোসিন ঢাইল্যা দেয়, তারপর...
: বউ, আর পারতেছি না, বাকিটুকু তুমি কও।

এই জামাই নিয়া আর পারতেছি না, তারপর আমাদের হাত-পাও-মুখ বেঁধে আগুন লাগায়া দেয়, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে, আমরা পুড়ে কয়লা হয়ে যাই; পরে মামলা হয়, কিন্তু সবচেয়ে বড় পত্রিকায় খবর আসতে থাকে, এটা নাকি দুর্ঘটনা।

এখন আমরা চুঙ্গির ভিতরে থাকি, অন্ধকার হলে বাবুরে খুঁজি, আগুন লাগার সময় বাবুর কথা মনে ছিল না, কোথায় যে আছে বাবুটা; অবশ্য এখানেও একটা মেয়ে আছে, ওকে দেখলে মনটা ভালো হয়ে যায়, মেয়েটা সারাদিন ‘বাবু, বাবু’ করে, যাই, ওকে দেখে আসি।
: এই যে, এই মেয়ে, কী করতেছো?
: আপনে, এই অসময়ে, একটু পরেই তো আজান দিয়া দিব, রাইত তো বেশি নাই।
: তুমি চিন্তা করো না, এখনো কিছুটা সময় বাকি আছে, তুমি কী করছিলা?
: জানেন কী হইছে; এইদিক দিয়া একটা বাবু গেছে, আপনে যুদি দেখতাইন, সাদা ফকফকা, তুলতুলা।
: কী বলো, আমার বাবু নাতো?
: না, আপনের বাবু আইবো কইথ্যে; মনে হইছে এইটা আমার বাবু।
: কী বলো, তোমার বাবু হবে কেমনে? তোমার তো বিয়েই হয় নাই, বিয়ে না হলে বাবু হয় না।
: হ, মইরা গিয়া কী যে বিপদে পড়ছি, বাবুর সখ আর মিটল না।
: সবই কপাল, বুঝছো; আচ্ছা বাদ দেও, এখন তোমার কথা বলো, তুমি না তোমার কথা বলতে চাইছিলা।
: কিন্তু আইজকা তো সময় নাই, এট্টু পরেই তো আজান দিয়া দিব।
: তুমি তাড়াতাড়ি বলবা, এখনো সময় বাকি আছে।
: আইচ্ছা, তাইলে হুনেন, ছুডু কইরা কইতাছি।

চেয়ারম্যান সাবের লগে কাম করতে গিয়া আব্বা গেছে মইরা, ইটের ভাটায় পুইড়া কয়লা হইয়া গেছে; ছুডু ভাইডাও শহরে যাওনের এক বছরের মইধ্যে উধাও হইয়া গেছে; বাজারের মাইনষে কয়, পত্রিকায়, টিভিতে নাকি ভাইরে দেখাইছে; সোনার টুকরার ভাই আমার কী জানি করছে, এর কয়দিন পর থেইকা ভাইডার কুনু খবর পাই নাই; আব্বা কত কষ্ট কইরা বাজার থেইকা চান্দা তুইল্লা ভাইডারে এঞ্জিনেয়ার বানানোর লাইগ্যা...; বা, আর কইতে পারতাম না গো; কইল্যাডা পুইড়া যা; আব্বা মরার পরে আমরা তিন বোইন রোগা মারে লইয়া ভরা গাঙে পইড়া গেলাম, আমি সবার বড়, ছুডু বোইনগুলা খালি কান্দে, ঘরে খাওন-পানি কিচ্ছু নাই, না খায়া মইরা যাবার অবস্থা, তহন চেয়ারম্যান সাব আমারে তার বাড়িতে কামের ব্যবস্থা কইরা দিল, সুখে-শান্তিতে যাইতাছিল, চেয়ারম্যান সাব ও তার বউ আমারে ভাত-কাপড়ের কষ্ট দেয় নাই কুনুদিন; তাগোর একটা বাবু, চাইর বছর বয়স, হেরে নিয়াই আমার সময় চইল্লা যাইত, একদিন চেয়ারম্যান সাবের বউ বাসায় নাই, হেড মাস্টারনি আছিল তো, টেডিং করতে নাকি বাপের বাড়ি গেছিল মনে নাই; ম্যাডাম আমারে সব বোঝায়া দিয়া গেছে, আমি ঘরদোর পরিষ্কার করি, রান্নাবান্না করি, বাবুরে গোসল করাই, খাওয়াই, চেয়ারম্যান সাবও তাড়াতাড়ি বাড়িতে আইয়ে; কুনু অসুবিধা হয় না, আমি এটা-সেটা করে দেই, চা বানায়া দেই, লোকজন আইলে সমাদর করি, চেয়ারম্যান সাব আমারে কয় মাংস ভুনা কর, আমি বাটা মরিচ দিয়া ঝাল ঝাল কইরা মাংস ভুনা করি, কী যে মজা, জীবনে এত মাংস খাই নাই, কিন্তু শরমের কথা কী কইতাম, আর এখন তো আমার লাজ-সরম কিচ্ছু নাই, ওইদিন রাতের বেলা বাবু ঘুমাইয়া গেলে চেয়ারম্যান সাব আমারে কয় ‘আমার মাথা ব্যথা করতাছে, একটু টিইপ্পা দে;’ চেয়ারম্যান সাবেরে আমি পিরের মতো মানি, উনি কত কী কিইন্না দেয় আমারে, পরে ওনার মাথা টিইপ্পা দেই, পরে, চেয়ারম্যান সাব...;
: এই মেয়ে তোমার গল্প বন্ধ করো, ভালো লাগতাছে না আমার।
: ক্যান? কী হইছে? আর শুনবেন না? আপনেই তো শুনতে চাইলেন।
: না, আজ আর না, আজান দিয়ে দিবে, আমি এখন যাই।

বুঝলাম না কিচ্ছু, বেডি এত চেইত্তা গেল ক্যান, নিজেই হুনতে চাইলো আবার নিজেই ছ্যাং ছ্যাং শুরু করল; তয় আমিও হার মানুইন্না ছেড়ি না, আজ আমি কইয়ামই, আজান দেয়ার আগ পর্যন্ত কইয়াম; পরে, হুনেন, কী হইল, দুই তিনের মইধ্যে আমি যেন চেয়ারম্যান বাড়ির ম্যাডাম হইয়া গেলাম, ম্যাডাম যেইদিন বাসায় ফিইরা আইলো তার আগের রাইতে চেয়ারম্যান সাব আমারে কইলো, ‘কন্ডম দিয়া মজা পাই নারে, তোর মাসিক হইব কবে?’ আমি কই, ‘স্যার, কয়েকদিনের মইধ্যে হইব।’ আমার স্পষ্ট মনে আছে উনি বিরাট খুশি হইয়া কইছিলেন, ‘যা শালা, তাইলে তো সেইফ পিরিয়ড’, পরে কন্ডম ছাড়াই সব হইল, কিন্তু দুই মাস যাবত আমার মাসিক বন্ধ থাকলে একদিন সুযোগ বুইজ্জা চেয়াম্যান সাবেরে কথাটা কই, উনি কন, হাসপাতালে নিয়া যাইব, কিন্তু আমি হাসপাতালে যাইতাম ক্যায়া, আমি কান্দাকাটি করি, উনি আমার পায়ে পড়ে, কয় ‘আমারে বাঁচা, পুরা দেশের মানুষ জাইন্না যাইব’; কিন্তু গরিবের মাইয়া হইলেও আমার জেদ কম না, আমি মানতে চাই না, আমার পেটে বাচ্চা, তারে আমি খুন করতে পারি না, আমি কই ম্যাডামরে কইয়া দিমু, পরে আমার জীবনে আইলো ওইদিন; ম্যাডাম বাসায় আছিল না; খালি এইটুকুন মনে পড়ে, কালা মুখোশ, কালা, বাতরুম রক্তে জ্বলিতলি হইয়া গেল, আষাঢ় মাসের গাঙের মতো হইয়া গেল, আমার পনেরো বছরের শরীলডা হাজার হাজার টুকরো হইয়া গেল, হেই টুকরাগুলো টয়লেটে ফালায়া পানির পর পানি দিলো, পানির ধাক্কাতে এক সময় আমার ছুডু শরীরডা নাই হইয়া গেল; আরো মনে করতে পারি, কে জানি আমার নাকেমুখে বালিশ দিয়া চাপা দিয়া ধরছিল।

ওই যে আজান দিয়া দিল; কিছুক্ষণের মইধ্যে ফকফকা হইয়া যাইব সব; কিন্তু যাইবার আগে কইয়া যাই, যতটুকুন মনে পড়ে, জানুয়ারি নাকি ফেব্রুয়ারিতে আমার মৃত্যু হইছে; অহন আমি একটা ভাঙা কব্বরে থাকি, হেই কব্বরে হুইয়াও শব্দ পাই; ওই যে শব্দ হইতাছে; ক্যাডা যায়? কারা যায়? কিসের গন্ধ আইতাছে? কালা কালা মুখোশের নাকি? দেহি তো এট্টু, হ, ওই তো কালা কালা মুখোশ যাইতাছে, ওরা কারে ধইরা লইয়া যাইতাছে? আমার বাবুরে? নাকি ছুডু ভাইডারে লইয়া যাইতেছে?

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;