“বেশি সতর্কতা, অসতর্কতা লেখার শিল্পগুণ নষ্ট করে” - নাসরীন জাহান



সাক্ষাৎকার: ইশরাত তানিয়া
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

গল্পকার ও গদ্যকার ইশরাত তানিয়া সম্পাদিত সাক্ষাৎকারগ্রন্থ ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ স্থান পেয়েছে বাংলা কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দশজন নারী লেখকের সাক্ষাৎকার। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ত্রিপুরার স্বতন্ত্র নারীস্বরকে দুইমলাটে চিহ্নিত করার এই প্রয়াস লক্ষণীয়। বিশেষ করে সাক্ষাৎকার প্রদানকারী প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। কথাও বলেছেন ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে, উত্তর দিয়েছেন নারীবাদ, রাজনীতি, সমাজ-রাষ্ট্র, লেখালেখির দায় এবং প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি বহুবিদ গভীর ও অত্যাবশ্যকীয় প্রশ্নের। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নাসরীন জাহান, পাপড়ি রহমান, আনোয়ারা সৈয়দ হক, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃপ্তি সান্ত্রা, ঝুমুর পাণ্ডে, রাশিদা সুলতানা, মঞ্জু দাসসহ বাংলার চারটি ভূখণ্ডের প্রতিনিধিত্বশীল সব নাম।

সমসাময়িক বাংলার নারী লেখকদের শক্তিমত্তা ও বহুবিচিত্রতার সাক্ষ্যদলিল—ব্যতিক্রমী এই সংকলনটির গুরুত্ব বিবেচনায় এখানকার দুটি আংশিক ও একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশ করছে বার্তা২৪। এতে নারী লেখকদের ভাবনাবলয়ের পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে তাদের কাজ সম্পর্কে আরো সিরিয়াস এবং নতুন পাঠকদের বিস্তারিতভাবে জানার আগ্রহ তৈরি হবে। এখন থেকে প্রকাশিত কোনো গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের ‘অনলাইন কনটেন্ট শেয়ারিং প্লাটফর্ম’ হিসেবেও কাজ করবে বার্তা। আজ থাকছে কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহানের সাক্ষাৎকার।

নাসরীন জাহান

নাসরীন জাহানের জন্ম ৫ মার্চ ৫, ১৯৬৪। একজন বাংলাদেশী লেখক, ঔপন্যাসিক এবং সাহিত্য সম্পাদক। আশির দশকের শুরু থেকে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। এক দিকে ধ্রুপদী অন্য দিকে আধুনিকতা তাঁর সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। তাঁর গদ্য বাংলা সাহিত্যের বিস্তীর্ণ ভূমিতে বিশিষ্টতার দাবি জানায়। বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে লাভ করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ‘উড়ুক্কু’ উপন্যাসের জন্য লাভ করেন ফিলিপ্স সাহিত্য পুরস্কার। ‘পাগলাটে এক গাছ বুড়ো’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন আলাওল সাহিত্য পুরস্কার। খুলনা রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ-সাহিত্য সম্মাননাসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

প্রকাশিত ১৪টি গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে স্থবির যৌবন, বিচূর্ণ ছায়া, সারারাত বিড়ালের শব্দ, পুরুষ রাজকুমারীসহ অন্যান্য। প্রকাশিত উপন্যাস ২৪টি। উপন্যাসের মধ্যে উড়ুক্কু, সোনালি মুখোশ, চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার, নিকুন্তিলা, ক্রুশকাঠে কন্যা, ঈশ্বরের বাম হাত, সেই সাপ জ্যান্ত উল্লেখযোগ্য। নাসরীন জাহান পাক্ষিক পত্রিকা অন্যদিনের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন।


ইশরাত তানিয়া: সাহিত্যে আবেগ, নীতিবোধের প্রকাশ আপনার কাছে কেমন মনে হয়? অতি সতর্কতা কিংবা অসচেতনা কি সাহিত্যের শিল্পগুণ ক্ষুণ্ণ করে?
নাসরীন জাহান: সাহিত্যে আবেগের গুরুত্ব আছে বৈকি, নীতিবোধেরও, কিন্ত এটা লেখক যেন আরোপিতভাবে লেখার ওপর না চাপান। বিষয়, চরিত্র যদি ডিমান্ড করে তখনই এর কার্যকারিতা সম্পর্কে বোঝা যাবে। অবশ্যই বেশি সতর্কতা, অসতর্কতা লেখার শিল্পগুণ নষ্ট করে। লেখার শাদা পাতা যদি হয় নদী, লেখক সেখানে দক্ষ সাঁতারু। সাহিত্যে শুরু থেকে একটা পোক্ত ধারণা নিয়েই লেখক বই বের করার প্রস্তুতি নিয়ে লিখতে বসবে। সেই সাঁতারুর মতোই নদী-কাগজ তাঁকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। কাগজকে যদি নদী ভাবি, আমি দক্ষ সাঁতারুর মতো সেখানে কলমের সাঁতার কাটব। নদীতে ঢেউ এসে মাঝে মাঝে সাঁতারকে আটকে দেয়। তেমনই লেখকের কলমও পরে কী লিখব, এমন ভাবনায় লেখককেও থামিয়ে দেয়। ভেবে লেখক যেভাবে ফের কলম চালায় সাঁতারুও একটু থামার পর ফের ঢেউ উপেক্ষা করে ফের সাঁতারে ছুটতে থাকে। সচেতন, অসচেতনতাকে উপেক্ষা করে কাজ করে স্বতঃস্ফুর্ততা।

ইশরাত তানিয়া: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির আর হাসান আজিজুল হকের পর একটি শূন্যতার কথা বলেন অনেকে। এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আপনার মতামত জানতে চাই।
নাসরীন জাহান: এই প্রশ্নের উত্তরের সাথে আগের উত্তরের মিল আছে। কিভাবে বিচ্ছিন্ন সময়ের বিচ্ছিন্ন এই তিনজনকেই বাংলাদেশের ভালো লেখক হিসেবে এক করে পেল, বিস্মিত হচ্ছি। আর আমি নিশ্চিত এখানে দুজন অনেক সিনিয়র লেখকের পরে এক লাফে আশির দশকের শহীদুল জহিরের নাম আসতই না, তিনি যদি মারা না যেতেন। জীবদ্দশায় কতটা অবহেলিত ছিলেন তিনি, আমি কাছ থেকে দেখেছি। আর এটা কার বানানো তালিকা? আরো অনেক ভালো লেখক আছেন, আমি নাম নিচ্ছি না। কারণ শিল্পের ব্যাপারে আমি তুমুল আপোসহীন। দেখা গেল কেউ অনেক প্রাণের মানুষ কিন্তু তার লেখা আমার ভালো লাগে না বলে তার নাম নিলাম না। সাথে সাথে তার সাথে আমার বন্ধুত্বে জীবনের জন্য চিড় ধরে গেল। লেখালেখির প্রথম জীবনে আমি এমন অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি। যা হোক এ লেখাটা যাঁরা পড়বেন, প্রত্যাশা করি, তাঁরাও ওই তিন লেখককেই শুধুমাত্র বাংলাদেশের লেখক মেনে ক্ষান্ত হবেন না। আমরাও তো নিশ্চয়ই ঘাস কাটছি না, হা হা। এই প্রথম নিজের কথা বললাম। প্রশ্ন শুনে ক্ষোভ থেকে এটা বললাম।

ইশরাত তানিয়া: নারীবাদ দর্শনটিকে কিভাবে দেখছেন? আপনার গল্পে, উপন্যাসে বোঝা যায় নারীবাদে সামগ্রিকভাবে আস্থা রাখেন। আপনার লেখায় নারীবাদ পরিস্ফূট হয়েছে। এই প্রবণতা আপনার ভেতরে এবং লেখায় কী করে সঞ্চারিত হলো বিশ্লেষণ করে বলবেন কি?
নাসরীন জাহান: আমাদের বেশিরভাগ নারী পুরুষের মধ্যে নারীবাদের ভুল ব্যাখ্যা হয়। কিছু পুরুষের মতো নারী, পুরুষদের গালাগাল করে, ব্রা উড়িয়ে নিজেকে নারীবাদী প্রমাণ করতে চাইতেন।
আমার একটা নিবন্ধের বই আছে ‘নারীর প্রেম ও তার বিচিত্র অনুভব’, ওই বইয়ে এ বিষয়ে আমার বোধ ঢেলে দিয়েছি। বলেছি, নারীবাদ মানে এই নয় যে পুরুষ ইট মারল তো নারী পাটকেল মারবে। জার্মানিতে এক ইন্টারভিউতে বলেছিলাম, নারীবাদ মানে সন্ধায় কর্মক্লান্ত স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে একগ্লাস পানি। প্রশ্ন এলো, মানে? বললাম, হাসব্যান্ড ওয়াইফ ঘরে ফিরে একজন আরেকজনের দিকে তাকাবে, যার মুখ বেশি ক্লান্ত, তার দিকেই আরেকজন গ্লাস এগিয়ে দেবে। শুধু নারী এ কাজ করবে এ ঠিক না। বিভ্রান্ত সৃষ্টিকামী নারীবাদীদের জন্য প্রচুর নারী তোতলায়, বলে, আমি সেই অর্থে নারীবাদী... তোতলানোর কী আছে? অনেক পুরুষকে আমি প্রশ্ন করেছি, এই পৃথিবীটা পুরুষ শাসিত, এ নিয়ে দ্বিধা আছে? তাঁরা বলেছেন, না। আমি বলেছি এই পৃথিবীতে নারী পুরুষের সমান যোগ্যতা যেখানে, সেখানেও যদি নারীকে শোষিত হতে হয়, তবে তাকে নারীবাদী হতেই হবে। এক্ষেত্রে যেমন শ্রমিকরা শ্রমিকবাদী, নারীরা নারীবাদী। আমি জানালা দিয়ে দেখেছি স্বামী স্ত্রী ইট ভাঙছিল। স্ত্রীর কোলে একটা বাচ্চা। ঘরে গিয়ে রাঁধতে হবে বলে স্ত্রী ইটে তিনবার হাতুড়ি বসালে, স্বামী বসাচ্ছিল এক বার। অথচ স্ত্রীর চাইতে স্বামী মুজুরি পাচ্ছিল ডাবল। এক্ষেত্রে স্ত্রীর অবশ্যই নারীবাদী হওয়া উচিত। আমি বেগম রোকেয়ার নারীবাদকে ব্যাপক সম্মানীয় মনে করি।

ইশরাত তানিয়া: পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান আমরা জানি, লেখক সমাজ কি এর বাইরে? একজন নারীর লেখক হতে চাওয়াটা কতটুকু চ্যালেঞ্জিং? এর সমাধানই বা কী?
নাসরীন জাহান: অবশ্যই আমাদের পৃথিবী পুরুষ শাসিত এ অমোঘ এক সত্য। লেখক সমাজ এর বাইরের কেউ না। আমাদের লেখার শুরুতে প্রায় সব পত্রিকায় মহিলা আর সাহিত্য আলাদা পাতা ছিল। কিন্তু সেই সাহিত্য পাতার নাম পুরুষ পাতা ছিল না। নারী পাতাকে পুরুষরা বড় অবহেলার চোখে দেখত। সাহিত্য পাতায় মহিলাদের লেখা ছাপা দুর্লভ এক ব্যাপার ছিল। তখন তিনজন শক্তিশালী লেখকের লেখা সাহিত্য পাতায় মাঝে মাঝে ছাপা হতে দেখতাম। তাঁরা হলেন রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন। আমি ব্রত নিয়েছিলাম, বছরে একটা গল্প ছাপা হলেও সাহিত্য পাতায় দেব। মরলেও মহিলা পাতায় লিখব না। এ জন্য অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে আমাকে। অবশ্যই আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল তা। কিন্ত সুখের বিষয়, দারুণ পজেটিভলি সময় বদলেছে। এখন নারী পাতায় নারীর সাহিত্য ছাপা হয় না। সেখানে নারী বিষয়ক নানা ফিচার যায়। আর সাহিত্য পাতায় লেখা ভালো হলে সমানভাবেই নারী পুরুষের লেখা যায়।
আবার বিভ্রান্তিতে পড়া নারীবাদীরাও আছেন। তাদের জন্য এমনটা হয়েছে যে, অনেক পুরুষ কোনো মেয়ে নিজেকে নারীবাদী বললে, তার সাথে নিজেকে জড়াতে ভয় পায়।

ইশরাত তানিয়া: এবার একটি অন্য প্রসঙ্গে আসি। প্রকাশনা শিল্প সাহিত্যচর্চা ও বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ লেখক-প্রকাশকের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের বিষয়টি খুব প্রকট হয়ে উঠেছে। আপনার অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষন কী বলে? সমাধান সম্ভব?
নাসরীন জাহান: লেখক-প্রকাশকের মূল সংঘাতের জায়গা হলো, একজন লেখক কিছুতেই জানতে পারে না তার ক’ কপি বই বেরোচ্ছে। বাণিজ্যের সব ক্ষেত্রে রসিদ, ডক্যুমেন্ট থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রকাশককে বিশ্বাস করা ছাড়া লেখকের আর পথ থাকে না। ক’জন অসহায়ভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, কিভাবে পেতে পারি, আপা?
প্রকাশক তো একজন ব্যবসায়ীও। লেখকের সাথে তিনি যদি এই ব্যাপারটা ক্লিয়ার করতে পারেন, তবে খুব ভালো হয়। লেখকেরা পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে এক কিস্তি, এরপর ছ’মাস পর পর আরেক কিস্তি, যা-ই সম্মানী হোক, যদি পান, বিষয়টা সুন্দর হয়। কিছু প্রকাশনা সেটা করে। অনেক প্রকাশনীতে লেখক ধর্ণার পর ধর্ণা দিয়েও সম্মানী পায় না।

ইশরাত তানিয়া: লিটল ম্যাগাজিন। বলা হয় এটি একটি আন্দোলন। লিটল ম্যাগের লড়াই ও টিকে থাকা প্রসঙ্গে আপনার চিন্তা ভাবনা শোনা যাক।
নাসরীন জাহান: লেখালেখির শুরু ক্লাস টেনে থাকতেই। কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত সাহিত্য পাতায় আমার লেখা ছাপা হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে সংবাদ, ইত্তেফাক। এর মধ্যেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে লিটিলম্যাগে যুক্ত পারভেজ হোসেন, সেলিম মোরশেদ, মামুন হুসাইন, শহীদুল আলম, কাজল শাহনেওয়াজ এদের সাথে নারী পুরুষ সমান্তরাল বন্ধুত্বে মিশে যাই। প্রতি সপ্তাহে হয় ওখানে, নয় আমার বাসায় আড্ডা হতো। ওদের মাধ্যমেই বিশ্বসাহিত্য পাঠ। আমি আর শহীদুলই বেশি পরাবাস্তব, জাদুবাস্তব নিয়ে লিখতাম। সেখানে প্রতি সপ্তাহে কে কী লিখল, তা পাঠ হতো। কিন্তু আমি যেহেতু বড় কাগজে লিখি, ওরা আমাকে নিয়ে মুশকিলে পড়ে গেল। ওদের সম্পাদিত সাহিত্য পাতায় কিছুতেই আমার লেখা ছাপাত না। একবার আমার একটা নিরীক্ষামূলক গল্প হুট করে পারভেজ তাঁর সম্পাদিত ‘সংবেদ’ পত্রিকায় ছাপল। গোলমাল শুরু হলো। কট্টর লিটিলম্যাগের গুরুই বলা যায়, সেই সেলিম মোরশেদ আমার পক্ষ নিল। বলল, আমাদের নিরীক্ষামূলক লেখা বড় কাগজ বের করে না বলেই আমরা লিটিলম্যাগ করি। নাসরীনের আপোসহীন লেখা ওরা প্রকাশ করে। আমরা কি লেখা দেখব না লেখক? যা হোক, আমার আদর্শবিরোধীরা অনেকে বিপরীত কাণ্ড করলেও, এক এক করে সেলিম মোরশেদ ছাড়া বাকি সকলেই বড় কাগজে চলে এলো। এখন বড় কাগজের লেখকদের নিয়ে যেসব ম্যাগাজিন বেরোয়, সেগুলোকে তখন লিটিলম্যাগ বলা হতো না।
পশ্চিমবঙ্গেও একই অবস্থা ছিল। আমি বছর বছর সেখানকার লিটিলম্যাগের সাথে যুক্ত ছিলাম বলেই আমার লেখার প্রকাশ্যভক্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষের সাথে প্রাণের সম্পর্ক থাকলেও ‘দেশ’ থেকে শুরু করে ওদের কোনো বড় কাগজে লেখা দিইনি।

ইশরাত তানিয়া: ছোটবেলায় কেমন ছিলেন? তখন থেকেই কি ঘোরের মধ্যে থাকতেন? নাকি চঞ্চলতা আর দুষ্টুমিটাও ভর করত?
নাসরীন জাহান: প্রশ্নটা যেন আমার জন্যই করা। কল্পনার ঘোরে যেমন থাকতাম, দুষ্টমিও করতাম। আমার জন্ম হয়েছিল ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট গ্রামে। আমার আব্বা ওখানে তখন বদলির চাকরি করতেন। আমরা নানা বাড়ির তেপান্তরে রাজকন্যার মতো উড়ে বেড়াতাম। মামারা বিয়ে করেনি, খালার বর শহরে পড়াশোনা করতেন। বাচ্চা বলতে আমরাই। আমি সর্ষে বনে শুয়ে আসমানের মেঘ দেখতাম। দেখতাম তার আশ্চর্য বদল, কখনো হাতি, কখনো অজগর, কখনো মানুষ এমন কত নানা রূপ আমাকে বিমূঢ় করে তুলত। দূরের নীল পাহাড় ছিল আমার প্রধান বিস্ময়। কতবার আমি ওটাকে কাছে পেতে চেয়েছি। যত হাঁটি ততই দূরে চলে যেতে দেখতাম। ব্যথা পা নিয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরতাম।
এরমধ্যে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। আমাদের পরিবার ভাগ হয়ে গেল। আমি আর আমার পিঠাপিঠি বড়ভাই আলোক দূর সম্পর্কের নানার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বাউশা নামের গ্রামে। যুদ্ধ তীব্রতর হলে অভাবের কারণে তারা আমাদের বাইরে রেখেই দরজা বন্ধ করে দেয়। ক্ষুধার্ত আমাকে ভাই শালুক এনে দিল। ভয়ে ভয়ে এক গাছতলায় রাত কাটালাম। রাজকন্যা থেকে ঘুঁটেকুড়ানী হলাম। আর্মিরাও এসেছিল, সে বিশাল গল্প। আমার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘সেই সাপ জ্যান্ত’ উপন্যাসে এসব ব্যাপার এনেছি। এই যুদ্ধ সারাজীবনের জন্য আমার আত্মাটাকে ফুটো করে দিল। শৈশব থেকেই তাই হয়তো সুখের গল্প তেমন লিখি না।
শহরে এসে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলাম। তখন ছেলেদের সাথে আমি আর আমার বান্ধবী রুবী (কথাসাহিত্যিক পারভীন সুলতানা) মাঠে দাবিয়ে খেলতাম। আজানের আগে ঘর থেকে বেরিয়ে ফুলগাছ চুরি করতাম। ঘরের কাজ সেরে রাজ্জাক কবরীর পোস্টার দেখতে যেতাম। এত গপ্পো আছে! বলে শেষ করা যাবে না।

ইশরাত তানিয়া: শুদ্ধতম অনুভূতির নাম প্রেম। আপনার চেতনায় প্রেমকে কী রূপে দেখেন? ঈশ্বরপ্রেম বলুন কিংবা নারী-নরের প্রেম বলুন, সৃষ্টিশীল মানুষের বোধে এর প্রভাব কতটুকু? মানে, সৃষ্টিশীলতাকে প্রভাবিত করে কি?
নাসরীন জাহান: প্রেম একটা স্বর্গীয় অনুভূতির নাম। নর-নারীর প্রেম আর ঈশ্বর প্রেমের ধরনটা আলাদা। প্রাণ থেকে যখন প্রগাঢ় প্রেম উৎসারিত হয়, তার মধ্যে অলৌকিক এক কামনা দুজনকে রোমাঞ্চকর প্রচ্ছায়ায় ঘিরে রাখে। নরনারীর প্রেমের স্পর্শে নতুন প্রজন্মেরও জন্ম হয়। যদি নর-নারীর প্রেমহীন তাও হয়। যে প্রেমে দুটি আত্মার মিলন ঘটে সেই প্রেমের মধ্যে শরীর এলেও আমি তাকে অশুদ্ধ বলব না। প্রেমময় দুটি দেহে অগ্নির প্রজ্জ্বলন ঘটে। যদি সত্যিকারের প্রেম হয়, তবে সৃষ্টিশীল মানুষের সাথে সাধারণ মানুষের প্রেমের পার্থক্য ঘটে না। যদিও সৃষ্টিশীল মানুষের প্রেম অনেক নান্দনিক হয় প্রায় ক্ষেত্রে। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রেমও যদি প্রগাঢ় হয়, তখন অলৌকিকভাবে তার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা ঢুকে যেতে পারে।
ঈশ্বরপ্রেমকে তথাকথিত মৌলবাদীরা যেভাবে দেখে, আমি সেভাবে দেখি না। ঈশ্বরকে মহান এক আর্টিস্ট মনে করি আমি। পুরো পৃথিবীকে পাহাড়, সমুদ্র থেকে শুরু করে গ্রীষ্ম, শীতে অপূর্ব করে নানা রঙে সাজিয়েছন। তারপর আছে সূর্য, চাঁদের ভিন্ন ভিন্ন রংধনুময় কোটি কোটি রহস্যময় অস্তিত্ব উজাড় করা সৌন্দর্যের রহস্য। শুনেছি, পৃথিবীর সব কিছুর মধ্যে ঈশ্বর পাওয়া যায়। চোখ বন্ধ ধ্যানে যেমন তার দেখা মেলে, তেমনই পৃথিবীর সব সুন্দরের মাঝে চোখ খুলেও বিমুগ্ধতার মধ্যে তার স্পর্শের স্বাদ মেলে। বর্ষার তীব্রতায় যেমন তছনছ হয়ে সব ভেসে যায়, এরপরই পলিমাটি এসে সেইসব ভাঙন সব বিন্যস্ত করে দেয়।

ইশরাত তানিয়া: উড়ুক্কুর জন্য ১৯৯৪ সালে ফিলিপ্স পুরস্কার পান। এই অর্জনের আগের ও পরের কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহানের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি?
নাসরীন জাহান: আমার পাঁচটা গল্পের বইয়ের পর আমি তড়পাতাম, কেন উপন্যাস লিখতে পারি না? একসময় ঠিক করলাম, মার্কেজ, সুবিমলকে টা টা করে আমার শৈশব থেকে জীবন যা দেখেছি, তার সাথে আমার গড গিফটেট ইমাজিনেশনের জলরঙ তেলরঙ মিশিয়ে যা হোক লিখে যাই। আমার বাড়ির কাছের অপার্থিব মেথর পট্টির দুর্গাপূজা থেকে শুরু করে একের পর এক কত কী দুর্বিষহ জীবন সে লেখায় এসেছে।
বইটি মোটা হয়ে গেল। বন্ধু পারভেজের সাহায্যে মাওলা ব্রাদার্স থেকে ‘উড়ুক্কু’ বইটা বেরোলো। দিন যায়, বই বিক্রির নাম নেই। প্রকাশকের মুখে ছায়া। একদিন মেলা থেকে ফিরতে গিয়ে কান্না আটকাতে পারিনি। চোখের জল মুছতে মুছতে সিদ্ধান্ত নিলাম, জীবনে আর বই করব না। লিখতে ইচ্ছে হলে লিখব। পাণ্ডলিপি ফেলে রাখব।
কিভাবে ‘উড়ুক্কু’ ফিলিপসে গেল, কিভাবে কী হলো সেই ইতিহাস থাক। একদিন রিং বেজে উঠল। রিসিভার কানে নিতেই ওরা জানাল, “এই বছর উড়ুক্কু উপন্যাসের জন্য আপনি...” আমার কথা বলছে? রিসিভার হাত থেকে খসে গেল। এরপরের বইমেলায় মনে হলো, এটা যে আগের মেলায় বেরিয়েছে কেউ জানেই না। বিক্রি...বিক্রি... অটোগ্রাফ... অটোগ্রাফ... বিদেশে আমন্ত্রণ... প্রায় এক বছর বিখ্যাত হওয়ার কী সুখ, কী অস্বস্তি বুঝেছি। কিন্তু আজীবন আপোসহীন আমি নিজের কানে শুনিয়েছি, পুরস্কার যদি লেখকের দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়, তবে লেখকের চাইতে সেই পুরস্কার বড়। পুরস্কার প্রেরণা হয়েছে, কিন্ত আমার লেখার ভালো মন্দের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তখন ফিলিপস পুরস্কার এত নিরপেক্ষ ছিল, বলা যায় আমার আগে যাঁরা পেয়েছেন, তাদের তুলনায় আমি পিচ্চিই ছিলাম। কিন্তু এই পুরস্কার দিয়েই আমি জীবনকে আরেকভাবে চিনলাম। যেহেতু মরলেও কোনো দলবাজি করিনি, বড় জায়গা থেকে বড় বড় অফার পেয়েও, ক্রমশ জাগতিক পৃথিবীতে কোনঠাসা হয়ে যেতে থাকলাম। কারণ পৃথিবীতে আমি লিখতে এসেছি।
খুব কমই প্রোগ্রামে যাই। আরেকটা ভয়ঙ্কর নেগেটিভ দিক আছে আমার, আমি মহা মহা অলস। এইজন্যই আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান সাহিত্য। এটার ওপর উপুর হয়ে থাকি। মরণপণ চেষ্টা থাকে, এই বইটা যেন আগের বইটার মতো না হয়।

ইশরাত তানিয়া: প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্বরাজনীতি কি আপনার লেখাকে প্রভাবিত করে? ‘সেই সাপ জ্যান্ত’ উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট তেমনটিই বলে।
নাসরীন জাহান: প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষভাবে আমার লেখায় বিশ্বরাজনীতি প্রচ্ছন্ন প্রভাব ফেলে মনে করি। আমার উড়ুক্কু উপন্যাসের পরতে পরতে মূল চরিত্র নীনার চলা একদিকে, অন্যদিকে উপসাগরীয় যুদ্ধের বর্ণনা পাশাপাশি চলেছে। যুদ্ধ শেষে বুশ ব্যাপক লাভবান হয়েছে, আমার উপন্যাসও শেষ হয়েছে। না, রাজনীতি প্রকট হয়নি।
নীনার জীবনটা ডিটেইলে এগিয়ে গেছে আর যুদ্ধের বর্ণনা এসেছে পত্রিকার টাইটেল হয়ে হয়ে। এখন বিশ্বায়নের যুগ। আগেই বলেছি পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক লেখক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। তাঁদের অনেকের লেখার প্রচ্ছন্ন রাজনীতিবোধ আমাকেও প্রভাবিত করেছে। ‘সেই সাপ জ্যান্ত’ উপন্যাসটা মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে, একটা দেশের যুদ্ধ বাতাসে উড়ে উড়ে আরেক দেশের যুদ্ধের সাথে একীভূত হয়।
আমার কষ্ট, এই বইটার নাম কেউ নেয় না। তুমি নিলে, অনেক ধন্যবাদ। আরেকজন, কর্ণেল তাহেরের ভাই ড. আনোয়ার হোসেন। উনি এত অভিভূত হয়েছিলেন, আমি রীতিমতো স্থবির হয়ে পড়েছিলাম।
কাফকার উপন্যাস ‘মেটামরফোসিস’-এর কথাই ধরা যাক, যে বই পড়ে মার্কেজ প্রথম উপন্যাস লেখার তাগদা পান। এই উপন্যাসটার মূল চরিত্র গ্রেগর, যে ছেলে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখে, সে পোকা হয়ে গেছে। এরপর গ্রেগরের স্ট্রাগল, ধীরে ধীরে তার প্রতি পরিবারের অবহেলা। বহু বহু আগে পড়েছি, কোথাও রাজনীতির ছিটেফোঁটা পাইনি। একসময় শুনি, এই উপন্যাসটা ওদেশের বুর্জোয়া শ্রেণি, পলিটিক্সের মধ্যে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। পরে ফের উপন্যাসটা পড়ে এর রূপকের আড়ালে সত্যটা বুঝতে পারি।
আমার মতে আমার নিজের সবচাইতে জোরাল রাজনৈতিক উপন্যাস ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’। রূপকের আড়ালে ঢাকা রূপকথার আদলে লেখা উপন্যাসটি বোদ্ধামহলের অনেক জায়গা থেকে জাদুবস্তবতা ঘেরা পলিটিকাল উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;