ফেনীর ট্রাংক রোড; যেখানে ভোরবেলা চলে শ্রমিক বিকিকিনি
দেশব্যাপী চলছে তীব্র তাপদাহ। এর মধ্যে কাক ডাকা ভোরে বাঁশের ঝাকা আর কোঁদাল হাতে ফেনীর ট্রাংক রোডে শ্রম বিক্রির হাটে হাজির দেশের দূর-দূরান্তের প্রায় ৭ শতাধিক খেটে খাওয়া মানুষ। কাজের আশায় শ্রম বিক্রি করতে এ বাজারে ওঠেন তারা। তীব্র গরমে যখন মানুষের হাসফাঁস অবস্থা ঠিক ওই সময় ক্ষুধা আর দারিদ্রের কষাঘাতে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো দুবেলা দু’ মুঠো অন্নের জন্য শ্রমিক হিসেবে নিজেকে বিক্রি করেন ফেনীর এই শ্রম বিক্রির হাটে।
প্রত্যেকদিন ভোরে রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী, রংমিস্ত্রী ও দিনমজুরসহ বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষের সরগম হয়ে ওঠে এ হাট। শ্রমিক কিনতে আসেন অনেক প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার ও মালিকরা। শ্রমের হাটে আসা অনেকে বিক্রি হলেও কিছু থেকে যান অবিক্রিত। দামদর শেষে যারা বিক্রি হন তারা রওনা হন মালিকের গন্তব্যে। অবিক্রিতদের দিনব্যাপী কাটাতে হয় অলস সময়। কাজ না পেলে নিজের গন্তব্যে ফিরে যান তারা।
জানা গেছে, প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে ফেনী শহরের জিরো পয়েন্টে, বরিশাল, রংপুর,কুড়িগ্রাম, রামগতি, লক্ষীপুর, নেত্রকোনা, খুলনা, বাগেরহাট, সিলেট, ময়মংসিংসহ নানান জেলার শ্রমজীবী মানুষ আসে এ শ্রম হাটে। নিয়মিত হাট বসলেও এ হাটে নেই কোনো খাজনা বা হাট কমিটির ঝামেলা। আপন গতিতেই চলছে এই হাট, এদিক থেকে কিছুটা শান্তিতে থাকলেও কাজের নিশ্চয়তা ও জীবনের নিরাপত্তা একদম অনিশ্চিত।
শ্রমজীবীরা জানান, মাঝে মাঝে কাজ পেলেও বেশির ভাগ সময় নিজেকে বিক্রি করতে পারেন না। কাজভেদে ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা মজুরিতে জেলার বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে যান তারা। কাজ না পেলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয় তাদের। রোদ, বৃষ্টি কিংবা ঝড় সবসময় এ হাটে বিক্রির আশায় উপস্থিত হন বলে জানান তারা।
দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতির বর্তমান বাজারে শ্রমের পর্যাপ্ত মূল্যে পাওয়া যায়না উল্লেখ করে তারা বলেন, সবকিছুর যে দাম। যত টাকা পাই তা দিয়ে একদিন চলাও কষ্টের। দূর থেকে আসি স্টেশন কিংবা ফুটপাতে রাত কাটাই। সকালে কাজ পেলে সন্ধায় আবার কোথাও মাথা গোজার ঠাঁই খুঁজি। এরমধ্যে তীব্র গরমে কাজ করতে হয়, আমাদের দুঃখ দুর্দশা দেখার যেন কেউ নেই।
বরিশালের আবু মিয়া। বিগত ১০ বছর ধরে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন ফেনীতে। আগে সারাদিনের জন্য নিজেকে ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি করতেন যেকোনো কাজের জন্য। তবে এখন তা বেড়ে ৭০০-৮০০ টাকা হলেও বাজারদর অনুযায়ী চলতে কষ্ট হয় বল জানান তিনি। তিনি বলেন, কাজ পেলে মুখে হাসি ফুটে আমাদের, না পেলে মলিন মুখে পরদিনের জন্য অপেক্ষা করি। তবে ফেনীর মানুষ ভালো, পেট ভরে খাবার দেয়, আবার কাজ শেষে বকশিস দেয়।
লক্ষীপুরের নূরে আলম। যিনি নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়ে ফেনীতে দিনমজুরের কাজ করতে আসেন। নিজের দুঃখের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে বাজারে উঠে বিক্রি হই। ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা বিনিময়ে আমরা কাজে যাই। বৃষ্টি হলে আবার কাজ নেই তখন কপালে ভাত জোটেনা। কেউ আমাদের কাজে নিলে গৃহস্থ ভালো হলে একটু আপ্যায়ন পাই। আর খারাপ হলে আমাদের উপর নির্মম কাজের অত্যাচার চলে।
তিনি বলেন, কেউ ৩ বেলার খাবার এক বেলায় দেয় অনেকে আবার দেয় না। যে টাকা পাই সেটা দিয়ে খেলে আর কিছুই বাকি থাকেনা। কষ্ট করে চলতে হয় আমাদের। আমরা গরীব মানুষ, আমাদের কথার গুরুত্ব নেই। পেটের দায়ে নিজের শ্রম বিক্রি করে খেতে নিজ জেলা থেকে এখানে এসেছি।
সিলেটের মোবারক আলীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ফেনীর এ হাটে ভালো কাজ পাওয়া যায়। যার জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ আসে কাজের খোঁজে। আমরা এখানে কৃষিকাজ, রাজমিস্ত্রীর কাজ করি। ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার বিনিময়ে কাজ করি। এ টাকা দিয়ে সংসার চালানো যায়না। যে শ্রম দিই সে অনুযায়ী টাকা পাইনা। কর্ম করায় আমাদের দিয়ে কিন্তু সে অনুপাতে টাকা দেয় না। আমাদের এসব বিষয়ে যদি সবাই খেয়াল রাখে আমরা আরও বেশি ভালো থাকতে পারব।
চাঁদপুরের আবুল হোসেন বলেন, ফেনীতে কাজ ভালো পাওয়া যায় বিধায় আমরা ফেনীতে আসি। টাকা খারাপ পাইনা তবে কাজের তুলনায় তা অনেক কম।আমরা পারিশ্রমিক অনুযায়ী আরও বেশি টাকা পেতে পারি। তারপরও পরিবারের জন্য কাজ করতে হয়। যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাই। সরকার যদি আমাদের জন্য কিছু সহযোগীতা করে আমরা আরও ভালো থাকতে পারব।
হাটে শ্রমিক নিতে আসা ফেনীর মো. হানিফ জানান, এখানে আসা শ্রমিকরা খুব ভালো । কথাও শুনে তারা। বাড়ির কাজের জন্য তিন জন শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছি। তবে আগের তুলনায় কিছুটা দাম বেড়েছে। শ্রমিকদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, মানুষগুলো বেশ কাজের। তাদের কাজের বরকত বেশি। ফেনীতে তাদের বেশ সুনাম রয়েছে।
রফিকুল হায়দার নামে এক ঠিকাদার বলেন, ঠিকাদারি কাজ করি। লোক প্রয়োজন হয়। ফেনীর এ হাটে এসে লোক নিয়ে যাই। আগে ৬০০ টাকা দিয়ে নিয়ে লোক পাওয়া যেত। এখন ১ হাজার টাকার নিচে পাওয়া যায়না। মাটি কাটার জন্য আরও বেশি চায়। গরমের কারণে লোকবলের সংকট পাশাপাশি ধান কাটার মৌসুম হওয়াতে পর্যাপ্ত লোক নেই। ফলে দিনমজুরদের বাড়তি টাকার নিতে হচ্ছে। এদের বেশিরভাগ বাইরের জেলা থেকে আসে। ফেনীর লোকরা গ্রাম অঞ্চলে কাজ করে। টাউনে যারা থাকে সবাই বাইরের।
তবে এসকল শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেয়াসহ এ রোদের মৌসুমে রোদে বেশিক্ষণ কাজ না করানোর জন্য মালিকদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন ফেনীর সচেতন মানুষরা।
নূর করিম মুন্না নামে ফেনীর এক সংগঠক বলেন, রোজ সকালে এ মানুষগুলোকে ট্রাংক রোড় এ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। রোদ কিংবা বৃষ্টি অথবা তীব্র শীত। কাজের জন্য তারা সবসময় এখানে আসেন। তাদের শ্রমের যোগ্য মূল্যায়ন হওয়া উচিত। প্রশাসন কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উচিত তাদের খোঁজ নেয়া, তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা। এ যে এখন তীব্র তাপদাহ এর মধ্যে তাদের হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা রয়েছে। শ্রমিক দিবসের আন্দোলন শ্রমিক ন্যায্য অধিকারের আদায়ের জন্য। এসব বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকা উচিত।
মঞ্জিলা মিমি নামে ফেনীর আরেকজন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠক বলেন, শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সবার ভূমিকা রাখতে হবে। শুধুমাত্র দিনমজুর নয়, ফেনীতে অনেক শ্রমিক আছে যারা অনেক কষ্টে দিন যাপন করে। শ্রমিক দিবসে দায়িত্বশীলদের তাদের বিষয়ে আরও যত্নবান হতে হবে তবেই শ্রম যোগ্য মূল্যায়ন পাবে।