দেশের প্রান্তিক জনপদে সাধারণ মানুষের সেবা নিশ্চিতে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানদের সরকারি কর্মকর্তাদের মতো নিয়মিত অফিস করার জন্য পরিপত্র জারি করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ।
পরিপত্র জারির পর দেশের বিভিন্ন জেলার ইউপি চেয়ারম্যানেরা এরকম সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছেন।
স্থানীয় সরকারের এই জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের মতো তাদের নিয়মিত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিস করতে হলে জনগণের ভোগান্তি বাড়বে। কারণ, হিসেবে তারা বলছেন, একটি ইউনিয়ন পরিষদে নয়টি ওয়ার্ড থাকে। প্রতিদিন প্রতি ওয়ার্ডে জায়গা জমিসহ একাধিক বিষয় নিয়ে অভিযোগের মীমাংসা করতে হয় তাদের। এসব অভিযোগ সমাধানের জন্য সালিশি বৈঠকের প্রয়োজন হয়। এখন যদি সকাল-সন্ধ্যা অফিস করতে হয়, তাহলে জনগণের ভোগান্তি কমার বদলে আরো বাড়বে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ইউনিয়ন বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার জানান, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সেবা সহজীকরণ এবং জনগণের দোরগোড়ায় তা পৌঁছে দেওয়া সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। ফলে, পরিষদের চেয়ারম্যানেরা জন্ম–মৃত্যু নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে অন্যান্য সেবা প্রদান, গ্রাম আদালত পরিচালনাসহ নানাবিধ সেবা দিয়ে থাকেন। জনগণ সাধারণত অফিস সময়ে (সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা) ইউনিয়ন পরিষদের সেবা গ্রহণ করে থাকেন। ইউনিয়ন পরিষদের সেবা সহজে এবং যথাসময়ে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে চেয়ারম্যানদের সরকার নির্ধারিত অফিস সময়ে পরিষদে উপস্থিত থাকা প্রয়োজন।
সরকারের এই কর্মকর্তা আরো জানান, কোনো কারণে ইউপি জনপ্রতিনিধিরা বাইরে অবস্থান করলে বা অফিসে উপস্থিত থাকতে না পারলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) অথবা প্রয়োজনে জেলা প্রশাসককে জানাবেন।
এ বিষয়ে দিনাজপুর জেলার সুন্দরবন ২ নম্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল লতিফ বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমরা তো সরকারি কর্মকর্তা নই যে, সকাল-বিকেল অফিস করতে হবে। সাধারণ মানুষের ঝামেলা সমাধান করতে বাড়ি বাড়ি যেতে হয় আমাদের। তাছাড়া সরকার থেকে আমাদের নামে মাত্র অসম্মানজনক সম্মানী ভাতা দেওয়া হয়। তা দিয়ে কি কোনো পরিবার চলে!
ফলে, সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা অফিস কীভাবে করবো বলে পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি।
একই রকম অভিযোগ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ১৮ নম্বর সলিমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আশিকুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, সরকার আমাদের যে সিদ্ধান্ত দেয়, সেটা আমাদের অবশ্যই মেনে চলতে হবে। কিন্তু দেখেন, আমাদের ৪ হাজার টাকা সম্মানীভাতা দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা সার্ভিস দেওয়া কতটুকু সম্ভব, সেটা ভাবতে হবে! আমরা চেষ্টা করবো, সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে চলার। তবে মনে হয় না, সরকারের এই সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখবে।
একই জেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউপি চেয়ারম্যান বার্তা২৪.কমকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের মতো আমাদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দিক, তাহলে আমরা সকাল-বিকেল অফিস করবো। আমাদের ইউনিয়নের অনেক নারী-পুরুষ আছেন, যারা তাদের অভিযোগ নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে আসতে পারেন না। বিভিন্ন সময় আমাদের সেবা নিয়ে এই মানুষগুলোর বাড়িতে যাওয়া লাগে। আমরা চাইলেই তো সরকারি কর্মকর্তাদের মতো অফিস করতে পারি না।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ইউপি পরিষদের চেয়ারম্যানেরা জনগণকে সেবা দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। আমি মন্ত্রী, আমি নিয়মিত অফিস করি। অফিস না করার কোনো সুযোগ নেই। তেমনি চেয়ারম্যান সাহেবদেরও নিয়মিত অফিস করতে হবে। যদি তাদের অন্য কোথাও কাজ থাকে, তাহলে তারা ইউএনও-কে ফোনে জানিয়ে দেবেন। তবে তারা যে একবারে অফিসে আসবেন না, এটা হতে পারে না।
এ সিদ্ধান্তে ‘ইউপি চেয়ারম্যানেরা নাখোশ’ বিষয়ে এমন মন্তব্যে মন্ত্রী বলেন, এখানে নাখোশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি তো জনপ্রতিনিধি। আমি রাত ১০টা পর্যন্ত অনেক সময় অফিস করি। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, জনগণের সেবা নিশ্চিত করা। চেয়ারম্যানদের নানা সময়ে সাইট ভিজিট থাকতে পারে অথবা জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় সভা থাকতে পারে। যে সময়টা তিনি বাইরে থাকবেন, তখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ফোনে জানিয়ে যাবেন।