বছর না পেরুতেই ফেনী হাসপাতালে বন্ধের পথে 'বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা'
সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে সরকারের উদ্যোগে দেশব্যাপী সরকারি হাসপাতালগুলোতে চালু করা হয়েছিল ‘‘বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’’। তারই অংশ হিসেবে গেল বছরে এপ্রিলে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে চালু হয় ‘বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’ কার্যক্রম। তবে যথাযথ প্রচার-প্রচারণার অভাবে শুরু থেকেই আলোর মুখ দেখেনি ফেনী জেনারেল হাসপাতালের এ সেবা কার্যক্রমটি।
তবে এবার চিকিৎসকদের পরামর্শ ফি নিয়ে কর্তৃপক্ষের গড়িমসি, চিকিৎসক সংকট ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে ‘বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’। গত ৫ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে সেবা কার্যক্রম। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবা নিতে আসা রোগীরা। গেল বছরের এপ্রিল মাসে চালু হওয়া এ সেবা কার্যক্রমটি এক বছর না পেরুতেই বন্ধের পথে রয়েছে।
নিয়মানুযায়ী সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ‘বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’ কেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়ার কথা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের। এতে একজন সিনিয়র কনসালটেন্টের পরামর্শ ফি ৪০০ টাকা, জুনিয়র কনসালটেন্টের ৩০০ টাকা, এমবিবিএস-বিডিএসের ফি ২০০ টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এ সেবা কার্যক্রমে সরকার নির্ধারিত পরামর্শ ফি থেকে একটি অংশ সম্মানী হিসেবে চিকিৎসকরা পাওয়ার কথা থাকলেও গত ৬ মাস ধরে চিকিৎসকরা ওই টাকা পাচ্ছেন না। এতে ‘বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’ নিয়ে চিকিৎসকদের মাঝে দেখা দিয়েছে অনীহা। গত পাঁচদিন ধরে বন্ধ রয়েছে হাসপাতালের ‘বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’।
হাসপাতালে ভর্তি রোগীর পাশাপাশি বৈকালিক সেবায় উপকৃত হতো সাধারণ মানুষ। স্বল্প টাকায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে এ কার্যক্রম বন্ধ থাকাতে ভোগান্তিতে সেবা নিতে আসা রোগীরা।
মকবুল আহমেদ নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষজন এতো টাকা খরচ করে বাইরের প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে পারি না। জেলার একমাত্র সরকারি হাসপাতাল হওয়ায় সকালে অনেক রোগীর চাপ থাকে। সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় অনেক রোগীকে ডাক্তার দেখতে পারেন না। ‘বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’ চালু থাকাকালীন এসব রোগীরা সেখানে চিকিৎসা নিতে পারতো। এমন কার্যক্রম বন্ধ হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।
মঞ্জুরুল ইসলাম নামে আরেকজন বলেন, কর্তৃপক্ষের গুরুত্ব থাকলে এ সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয় না। ‘বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’ চালু হওয়ার পর বাইরের ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকগুলোর আয় কমে গেছে। গরিবরা উপকার পেলেও সমাজের কিছু সুবিধাভোগী তাদের স্বার্থ হাসিল করতে পারছিল না। এটি বন্ধের পেছনে ভিন্ন কারণও থাকতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের শিশু বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, সকাল থেকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে ও ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী দেখতে হয়। সরকারি হাসপাতাল হওয়ায় বহির্বিভাগে সবসময় রোগীর অনেক চাপ থাকে। বিকেলে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে রোগী দেখলে যে টাকা পাওয়া যায় তার অনেক কম টাকা পাওয়া যায় ‘বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’য়। কিন্তু ছয়মাস ধরে সেই টাকাও পাচ্ছি না। এটি যেহেতু চাকরির অংশ নয়, টাকা না পেলে কেন আমরা বাড়তি কাজ করব।
ফেনী জেনারেল হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থো.সার্জারি) জামাল উদ্দিন বলেন, প্রথম কয়েকমাস পরামর্শ ফি থেকে টাকা পেলেও বেশ কয়েক মাস টাকা দেওয়া হচ্ছে না। টাকা না পাওয়ায় চিকিৎসকরাও মনের বিরুদ্ধে চেম্বার করেন। পারিশ্রমিক ছাড়া কেউই পরিশ্রম করতে চাইবে না।
হাসপাতালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. ব্রজ গোপাল পাল বলেন, ‘বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’য় আমাকে মাসে একদিন চেম্বার করতে হয়। সরকার নির্ধারিত ফি থেকে একটি অংশ সম্মানী হিসেবে চিকিৎসকরা পেয়ে থাকেন। গত ৩-৪ মাস ওই টাকা পাইনি। টাকা কেন দেওয়া হচ্ছে না সেটিও আমাদের অজানা। এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক বা আরএমও ভালো বলতে পারবেন।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. আসিফ ইকবাল বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট রয়েছে। এরমধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ৬-৭ জন চিকিৎসক বদলি হয়েছে। যার কারণে ‘বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’ বন্ধ রাখা হয়েছে। নতুন করে চিকিৎসক পদায়ন না হলে ‘বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’ বন্ধ থাকবে।
ফেনী জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল খায়ের মিয়াজি বলেন, ‘বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা’ বন্ধ কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের কারণে এটি আপাতত বন্ধ বা ধীরগতিতে চলছে। যে নির্দেশনার ভিত্তিতে এতদিন সেবা কার্যক্রম চলেছে সেটি পরিবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে। এইজন্য সেবা কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে।
চিকিৎসকদের পরামর্শ ফি’র ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে যে প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল আমরা সেই অনুযায়ী চিকিৎসকদের টাকা দিয়েছি। ওই আদেশের বিরুদ্ধে এখন আবার আমাদের নিষেধ করা হয়েছে। তাই বন্ধ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কে কত টাকা পাবে সেটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের মাধ্যমে নতুন আরেকটি প্রজ্ঞাপন হবে। সে অনুযায়ী টাকা দেওয়া হবে। এখন সব টাকাই সংরক্ষিত আছে। আদেশ পেলে সবাইকে টাকা দেওয়া হবে।