আপনি যা ভাবেন একটা গানের অর্থ সে রকম নাও হতে পারে - পিট সিগার



অনুবাদ | রহমান রাহিম
পিট সিগার (১৯১৯-২০১৪)

পিট সিগার (১৯১৯-২০১৪)

  • Font increase
  • Font Decrease

পিট সিগার ছিলেন একজন বিখ্যাত মার্কিন লোকসংগীত শিল্পী। শুধু আমেরিকান লোকসংগীত নয়, বিশ্ব লোকসংগীতের সাথেই তাঁর ছিল এক নিবিড় সংযোগ। গীতিকার এবং বাদক হিসেবেও তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ১৯৬৩ সালে লোকসংগীত নিয়ে রেডিও নিউইয়র্কে এ্যালান ওয়াসারকে দেওয়া তাঁর বিখ্যাত ইন্টারভিউটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন রায়হান রহমান রাহি

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jan/03/1546508180161.jpg

এ্যালান ওয়াসার : অবশ্যই যে প্রশ্নটা প্রথমে করব, সেটি হলো আপনার কাছে লোকসংগীতের সংজ্ঞা কী?

পিট সিগার : সংজ্ঞা বিষয়টাই এমন যে এটি ব্যক্তি বিশেষে আলাদা আলাদা রকম হয়। একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় দুজন মানুষ একমত হবে না সম্ভবত এই ব্যাপারটিই সবচেয়ে স্বাভাবিক।
একটা সময় ছিল, যখন ঔপনিবেশিক প্রাচুর্য চারদিকে গম গম করত। ইউরোপীয় মধ্যযুগের দিকেই তাকালে দেখবেন সংগীত ছিল সেই প্রাচুর্যের ঘেরাটোপে আবৃত এক শিল্প-বিশেষ। সম্রাট-সম্রাজ্ঞীরা নিজ খরচে রাজপ্রাসাদে একদল সংগীতজ্ঞকে ভরণপোষণ করছেন আর তাঁরা সিম্ফোনি অর্কেষ্ট্রা সহযোগে সংগীতকে দিচ্ছেন নতুন এক মাত্রা । ধ্রুপদী সংগীত বলতে আমরা যে বিষয়টি বুঝি, রাজ দরবারগুলোতে মূলত সেটির চর্চাই হতো।
এ তো গেল রাজা রাজরাদের আলাপ, কিন্তু সাধারণ দাস শ্রেণীর মানুষদের এমন প্রাচুর্য ছিল না যে তারা সংগীত সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য আর্থিকভাবে কাউকে কিছু দিতে পারবে। ফলে, নিজেদের মনের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেরাই নিজেদের জন্য গান বাঁধত। সেই সকল দাস শ্রেণীর মানুষদের নিজস্ব যে গান, আমার ধারণা সেটিই ‘লোকসংগীত’।
একটা কথা খুব চালু জানেন কিনা জানি না। কেউ কেউ বলেন আমেরিকায় কোনো লোকসংগীত নাকি পাবেন না, কারণ ওই সাধারণ দাস শ্রেণীর লোক আমেরিকায় ছিল না কোনোদিন।
কিন্তু, মজার বিষয় হলো হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ কিন্তু এখানে রয়েছেন যারা ওই পুরনো ঘরানার বেহালার সুর, ব্যালাড, ব্যাঞ্জোর সুর, গিটারে ব্লুজ বাজনা, আধ্যাত্মিক বন্দনাগীতিগুলো দারুন পছন্দ করেন এবং এখনো অবধি ওইগুলোকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন। তারা ওই গান, সুরগুলোকে না পারলেন কোনো শৈল্পিক সংগীত স্তরে স্থান দিতে, না এগুলো জ্যাজ বা অন্যান্য জনপ্রিয় ধারার মতো জনপ্রিয় কোনো ধারা। শেষমেষ তারা বললেন কী—‘চলো ভাই এর তো একটা নাম দেওয়া চাই। এর নাম আজ থেকে লোকসংগীত। ব্যস!

কিন্তু যা বললাম, সংজ্ঞায় দুজন মানুষ কখনো সব মিলিয়ে একমত হবেন না সেটিই স্বাভাবিক। সুতরাং আমি ব্যক্তিগতভাবে এ নিয়ে বিতর্কের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এটা আমার কাছে অনেকটা বিয়ারের সংজ্ঞায়ন করার মতোই। আমেরিকানদের কাছে ব্রিটিশ বিয়ার এবং ব্রিটিশদের কাছে আমেরিকান বিয়ার বিস্বাদ লাগবে এটাই চিরায়ত। এ নিয়ে ন্যূনতম কোনো বিতর্কিত পরিস্থিতি তৈরি হোক, অন্তত আমি তা কখনোই চাইনি।

এ্যালান ওয়াসার : একেবারে প্রথম কবে, কেমন করে লোকসংগীতের প্রতি আপনার উৎসাহ সৃষ্টি হয়?

পিট সিগার : ১৯৩৫ সালের দিকে আমার বয়স ছিল ১৬ বছর। বাবা ছিলেন সংগীতত্ত্বের একজন অধ্যাপক, তিনি আমাকে নর্থ ক্যারোলিনার একটা স্কয়ার ডান্স ফেস্টিভলে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তখনই আমি প্রথম আবিষ্কার করি আমার দেশেরই এমন এক সংগীত-ভাণ্ডার রয়েছে যা কখনো রেডিওতে কিংবা থিয়েটারে বাজানো হয় না। মনে আছে সেবারই আমি সেই সঙ্গীতের প্রেমে পড়ি। আর উঁচু ঘাড়ওয়ালা ব্যাঞ্জোর প্রতি ভালো লাগাও ঠিক তখন থেকেই। ব্যাঞ্জো মূলত আফ্রিকান একটি যন্ত্র। পরে দক্ষিণ ঔপনিবেশিক অঞ্চলের দাসেরা ব্যাঞ্জো বাজানোর নতুন কৌশল আবিষ্কার করে যেটা ছিল অনেকটা অর্ধেক ইউরোপীয়, অর্ধেক আফ্রিকান ধাঁচের।
১৮৩০ সালের দিকে সাদা মানুষেরা ব্যাঞ্জোর প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং আমেরিকায় ব্যাঞ্জো এমনভাবে সাড়া তৈরি করেছিল যেটা একশো বছর পর রক এন্ড রোল মিউজিক করেছে।
ব্যাঞ্জো ছিল না কোথায়? সবখানেই এর দারুণ জয়জয়কার! কেউ চাইলে নিজেই নিজের জন্য ব্যাঞ্জো বানাতে পারত। জনপ্রিয়তার এমনই অবস্থা, ততদিনে পশ্চিমের লোকজনের হাতেও ব্যাঞ্জো পৌঁছে গিয়েছিল।

এরপরই জনপ্রিয় সংগীত ধারার স্বাভাবিক পরিবর্তনের রীতি অনুসারে ব্যাঞ্জোর চল চলে যায়। ১৯৩০ সালে আমার তখন কৈশোর, মন চাইল আমি ব্যাঞ্জো বাজানো শিখব। কিন্তু শিখব কই? শেখা তো যায় একমাত্র পাহাড়ে। মনে আছে, স্কুলে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে আমি দু’বছর কেবল ইতিউতি ঘুরে ফিরেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম। সে সময়টায় ব্যাঞ্জো বাজাতে পারে এমন কৃষকের দেখা পেলেই হলো, আমি তার কাছে ব্যাঞ্জো বাজানোর একটা দুটো কৌশল শিখে নিতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছি। এমন করেই আস্তে ধীরে একদিন ব্যাঞ্জো বাজানো শিখে গিয়েছিলাম।

এ্যালান ওয়াসার : তারপর? সেখান থেকে?

পিট সিগার : মজার বিষয় হলো, এটা যে আমার জীবিকা নির্বাহের উপায় হবে আমি কখনোই তা ভেবে চিন্তে ঠিক করে রাখিনি। ছোটবেলায় আমি একজন সাংবাদিক হতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু এ ধরনের কোনো কাজই পেলাম না। এক সম্পাদকের কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু এ জাতীয় কাজ করবার কোনো সাধারণ অভিজ্ঞতাটুকুও আমার ছিল না।
তাই চিন্তাধারায় একটা পরিবর্তন আনলাম। তখুনি বিভিন্ন স্কুল, সামার ক্যাম্প ধরনের জায়গাগুলোতে আমি গান গাইতে শুরু করি। ধীরে ধীরে সেই স্কুলের বাচ্চাগুলি কলেজে যেতে শুরু করে। এরপর কলেজ থেকেও গান গাইবার জন্য ডাক আসতে শুরু হয়।
দেখছিলাম, কেমন করে চোখের সামনেই এই বিষয়টার একটা কমার্শিয়াল ফিল্ড ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। অদেত্তা, বেনেট-রিচার্ড ডায়ার, কিংস্টন ট্রায়োসহ শত শত পারফর্মার ছিলেন, যারা অনেক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আয়োজিত কনসার্টে ডাক পেয়ে সেখানে গান শুনিয়ে দর্শকের মন জিতে নিয়েছেন।

শেষম্যাশ কলেজের শিক্ষার্থীরাও বুঝতে পেরেছিলেন যে—আমাদেক কান্ট্রি পিপলরা লোকসংগীত বিষয়টি ভালোমতো মনে ধারণ করেন, গাইতে পারেন। আমার জন্য এটিই ছিল সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।

এ্যালান ওয়াসার : বিখ্যাত লোকসংগীত গায়ক লিড বেল্লি-র সাথেও তো আপনার পরিচয় ছিল।

পিট সিগার : হ্যাঁ। পেশাদার হিসেবে নিজেকে চিন্তা করবার সময়টায় আমি তাঁকে আমার শিক্ষক হিসেবেই ভেবেছি, যদিও তিনি এ বিষয়টি সম্পর্কে জানতেন না। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, আমি কত মনোযোগ দিয়ে তাঁর বাজানো দেখতাম!
একবার একজন আমাকে বললেন—‘পিট, তোমার তো গলার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া উচিত। একজন শিক্ষকের কাছে যাও , যিনি তোমাকে কণ্ঠ অনুশীলনে তালিম দিতে পারবেন।’ আমি তাকে বলেছিলাম—‘যদি কেউ লিড বেল্লির মতো গাইতে শেখাতে পারেন আমি তার জন্য জীবনের শেষ সঞ্চয় পর্যন্ত দিয়ে শিখতে রাজি আছি।’
বিষয়টা হলো কী জানেন তো, যখনি আপনি কণ্ঠের অনুশীলনের জন্যে কোনো শিক্ষকের কাছে যাবেন, তিনি আপনাকে গতানুগতিক রেওয়াজের তালিম দিতে শুরু করে দিবেন। যেন আপনাকে অপেরা শিল্পী হিসেবে প্রস্তুত করাই তার কাজ। মূলত সে কারণেই আমি আর ওমুখো হইনি।

লিড বেল্লি ১৯৪৯ সালে মারা গিয়েছিলেন। যেসব গান আমরা উনার থেকে শিখেছিলাম, আমার ধারণা সেগুলো আমাদের সারাজীবনই মনে থাকবে। গান করে বিরাট টাকা পয়সা কামাই করবেন এমন চিন্তা এই মানুষটার কখনোই ছিল না। আজকে যেসব তরুণ তাঁর—‘লাইক রক আইল্যান্ড লাইন’, ‘ওল্ড কটন ফিল্ডস এট হোম’, ‘মিডনাইট স্পেশাল’, ‘ব্রিং মি লিটল ওয়াটার সিলভি’—গাইছেন অন্তত তাঁদের হৃদয়ের মণিকোঠায় লিড বেল্লি চির অমর থাকবেন।
দ্য ওয়েভার্সের সাথে আমার প্রথম যে হিট রেকর্ডটি বের হয়েছিল সেটি ছিল তাঁরই গান—‘গুড নাইট আইরিন’। লোকে এখনো নিয়ম করে গানটি শুনতে চায়।

এ্যালান ওয়াসার : আপনার ওই বিখ্যাত রেকর্ডটি তবে দ্য ওয়েভার্সের সাথে?

পিট সিগার : এটা ১৯৫৫ সালের কার্নেগি হল কনসার্টের সময়কার। দ্য ওয়েভার্সের মেম্বারদের মাঝে দুজন ছিল নিউইয়র্কের একেবারে স্থানীয়। ভাইব্র্যান্ট এ্যাল্টো ভয়েস সেক্টরে ছিলেন রনি গিলবার্ট আর ফ্রেড হলারম্যান ছিলেন লো ব্যারিটোনে। আরকানসাসের যাজক লি হায়েস ছিল বেজ-এ। আমি ওদের সাথে স্প্লিট টেনর হিসেবে কাজ করতাম।

এ্যালান ওয়াসার : ‘স্প্লিট টেনর’— এই বিষয়টা কী?

পিট সিগার : আমি মাঝে মাঝে ফ্যালসেটো ধরনের সুরে, মাঝে মাঝে চড়া সুরে, সময়ে সময়ে গ্রাউলিংসহ তাঁদের সাথে গাইতাম। এখনকার যে কণ্ঠের কথা আপনারা সবাই বলেন, তখন কিন্তু আমার কণ্ঠ এমন ছিল না। গাইতে গাইতে আস্তে ধীরে কণ্ঠকে পরিণত করেছি।
দ্য ওয়েভার্সরাই প্রাথমিক অবস্থায় দেখিয়ে দিয়েছিলেন কেমন করে লোকসংগীতও শহুরে বিনোদনে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। মূলত তাঁদের দেখানো পথ ধরেই পরবর্তীতে কিংস্টন ট্রায়ো, দ্য গেটওয়ে সিংগারস-সহ বাকিরা হেঁটে গেছেন। বর্তমান সময়ে পিটার, পল-ম্যারী ওরা আছেন। তাঁরা সকলেই আমাদের বন্ধু বান্ধব। আমি যখন থেকে ওদের চিনতাম তখন ওদের বয়সই বা কত? কেবল হাইস্কুলে পড়ত সম্ভবত!

এ্যালান ওয়াসার : সত্যি! এ কারণেই সম্ভবত তাঁরা আপনাকে গুরুর মতন মান্য করেন।

পিট সিগার : গুরু! নাহ। এই সম্বোধনটা আসলে বেশ বিব্রতকর। গুরু হতে হলে সম্ভবত বেশ বুড়ো হতে হয়। আমার দাড়ি দেখুন, এখনো সব ঠিকঠাক, একটাও পাকেনি। তবে, এ কথা সত্য ইদানীং অনেকেই আমার কাছে পরামর্শ নিতে আসছেন।
আমি কোনো হোমড়া-চোমড়া ধরনের কেউ নই—চেষ্টা করি সে কথাই মানুষকে বোঝাতে। জানেন, আমি পারতপক্ষে, ছেলে মেয়েদেরও উপদেশ দিতে পছন্দ করি না যদি না তাদের সেটা দরকার লাগে। সে যাই হোক, তবুও আমার মাঝে মাঝে মোড়ল, গুরু ইত্যাদিসূচক সম্বোধন শুনতে হয়। এরচেয়ে বাজে আর কী বা হতে পারে বলুন?

এ্যালান ওয়াসার : পরিবারের কথা যেহেতু এলো, একটা কথা জিজ্ঞেস করি বরং। আপনাদের গোটা পরিবারটাই তো সম্ভবত লোকসংগীতের চর্চা করছে, তাই না?

পিট সিগার : আমার বাবা দুই বিয়ে করেছিলেন। আমি প্রথম পক্ষের সবচেয়ে ছোট সন্তান। মাইকেল সিগার এবং পিগি সিগার ছিলেন দ্বিতীয় পক্ষের বড় দুই সন্তান। তাঁরা দুজনই অসম্ভব গুণী সংগীতজ্ঞ। আমি আমার জীবনে যে কয়জন সেরা বাদক দেখেছি মাইক তাঁদের অন্যতম। পিগির কথা নতুন করে কী আর বলব? ব্যালাডে ওর মতন দক্ষ গায়িকা খুব কমই দেখেছি।
পিগি সদ্যই বিয়ে করেছে ইবান ম্যাককলকে। তিনিও একজন ব্রিটিশ লোকসংগীত গায়ক।
আমার তিনটি সন্তান আছে। আমি, আমার স্ত্রী এবং বাচ্চারা মিলে পরিকল্পনা করেছি এই গ্রীষ্মে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াব। হয়তো কোনো দেশে আমাদের গান শুনেছে এমন কাউকে পেলেও পেয়ে যেতে পারি।

এ্যালান ওয়াসার : কোন কোন দেশে ঘুরবার পরিকল্পনা আছে যদি একটু জানাতেন।

পিট সিগার : সেপ্টেম্বর মাসটা অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে কাটাব। অক্টোবর নভেম্বরের দিকে জাপানে থাকার কথা। এর মাঝে বিরতি কোথায় নেব তা এখনো ঠিক হয়নি। তবে ডিসেম্বরের দিকে ভারতের দিকে যাব এ সমন্ধে নিশ্চিত। জানুয়ারিতে আফ্রিকার বেশ ক’টা দেশে এবং ফেব্রুয়ারিতে ইতালির দিকে যাত্রা করব। এরপর মার্চ, এপ্রিল, মে-র দিকে ইউরোপের বাকি দেশগুলো ঘোরার ইচ্ছে আছে। দেখি কী হয়!

এ্যালান ওয়াসার : এই ভ্রমণ সমন্ধে একটা কৌতূহলসূচক প্রশ্ন ছিল। মূলত আপনাদের এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য কী? বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকগান সংগ্রহের একটা চেষ্টা কি সেখানে থাকে না এমনি বায়ু পরিবর্তনের জন্যই?

পিট সিগার : ‘আমাকে সবসময়ই কিছু না কিছু শেখার মধ্যেই থাকতে হবে’—এমন ধরনের লোভ থেকে আমি নিজেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করি। আপনি সবসময় এমন করে শেখার মধ্যে মগ্ন থেকে পারবেনও না আসলে। নিজেকে অবশ্যই মাঝে মাঝে একটু আধটু বিশ্রাম দিতে হবে। তা না হলে দেখা যায় শেখাটা একটা সময় পর তার মান হারাচ্ছে। ‘জ্ঞান অর্জন’—এই বিষয়টির মধ্যে হয়তো একটা ভারি বোধ রয়েছে। সেটি যদি আর ভারি না থাকে তবে শেখার কী মানে?
একটা দুটো জাপানি লোকগান গাইতে চেষ্টা করব। ব্যাঞ্জোটাকে ভারতীয় সেতারের মতো বাজানো যায় কিনা দেখি। ইসরায়েলি কিছু গান এবং পূর্ব ইউরোপের বিখ্যাত লোকনৃত্য করবে সে সমন্ধেও ছোটখাটো পরিকল্পনা রয়েছে।

দ্য ওয়েভার্সের প্রথম দিককার হিটগান ‘জেনা’, এটা কিন্তু একটা ইসরায়েলি লোকগান। আমার সবচেয়ে প্রিয় গান যেগুলো ওগুলোর মধ্যে একটা গান সাউথ আফ্রিকার। বার-তের বছর আগে একটা ফোনোগ্রাফ রেকর্ড শুনে শুনে আমি গানটা শিখেছিলাম। প্রচণ্ড সর্দিতে বিছানায় শুয়ে আছি, হঠাৎ গানটা সামনে এলো। তারপর এক নাগাড়ে শুনতে শুনতে একটা সময় আবিষ্কার করলাম গানটা এত কঠিন না। বেজ, টেনর একই রকমভাবে বারবার বাজছে আর তার সাথে চড়া সুরের কাজটা আমাকে বলতে গেলে মুগ্ধতায় ফেলে দিয়েছিল। তারপরই গানটা শিখতে শুরু করে দিই। চড়া সুরটাও এক পর্যায়ে আমার আয়ত্তে এসে যায়।
এই গানটা একটা নতুনত্বের কথা ভেবে তৈরি করতে বসেছিলাম, কিন্তু শেষ করার সময় একধরনের তুমুল ভালো লাগার ভেতর দিয়ে শেষ করেছি। শুধু আমার একার না, শ্রোতাদের হৃদয়েও এই গান দারুণ স্পর্শ করেছে বলে আমার ধারণা।
দ্য ওয়েভার্স গানটা বের করতে অনেক সাহায্য করেছে। গানটার নাম ‘উইমোওয়েহ’। সাউথ আফ্রিকার স্থানীয় ভাষায় এটিকে বলা হয় ‘বুবাহ’, যার অর্থ ‘সিংহ’।

এ্যালান ওয়াসার : পুরো গানটার মানে কী সেটি যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন।

পিট সিগার : মানুষজন প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে অমুক-তমুক গানের কী মানে। এটা সত্যিই একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রত্যেকটা ব্যালাড, শ্রমসংগীত কিংবা ছড়াগানেরই কোনো না কোনো সুনির্দিষ্ট মানে রয়েছে। কিছু গানের প্রেক্ষাপট বেশ চিত্তাকর্ষক, কোনো কোনোটা হয়তো স্বাধীনতা নিয়ে, আবার কিছু গান নিজস্ব পৃথিবীতে টিকে থাকবার সংগ্রাম গাঁথা হিসেবে রচিত হয়েছে।

আমি কখনো আফ্রিকায় যাইনি, কিন্তু এই গানটার অর্থ অনুসন্ধান করে দেখলাম, এ গানে বলছে—‘সিংহটা ঘুমিয়ে আছে’।
জুলুদের শেষ রাজা চাকা দ্য লায়ন ছিলেন দুর্দান্ত একজন সেনানায়ক। ইউরোপীয়রা তাঁকে হত্যা করে সাম্রাজ্যবাদের সূচনা করেছিল। কিন্তু কেউ কেউ ধারণা করতেন চাকা দ্য লায়ন আসলে মরেনি। তিনি হয়তো ঘুমিয়ে আছেন বা বিশ্রাম নিচ্ছেন কোথাও। সময় হলে ঠিকই জেগে উঠে হারানো স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করবেন। সম্ভবত, এই চিন্তা থেকেই গানটা রচিত। আমি জানি না, কারণ আমি আগেই বলেছি আফ্রিকায় আমি কখনোই যাইনি।
দক্ষিণ আফ্রিকার এখনকার দৃশ্যপট কল্পনা করে একবার ভাবুন তো ঠিক সেই সময়ে এই গানটা তাদের কাছে কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। আশা করি, ইতোমধ্যেই উত্তর পেয়ে গেছেন।

এ্যালান ওয়াসার : ঠিক একরকমই একটা কাহিনী নিয়ে আরেকটা গান আছে । নাম সম্ভবত—‘ফলো দ্য ড্রিংকিং গউর্ড’।

পিট সিগার : ১৮৫০ সালের দিকে স্বাধীনতাকামী দাসেরা যখন দক্ষিণ থেকে কানাডায় পালিয়ে গিয়েছিল, কিছু সাহসী আমেরিকান জীবন বাজি রেখে তাদের সাহায্য করেছিলেন। এ গানটা সে প্রেক্ষাপটেই তৈরি।
ওই সময়ে ধর্মীয় গানগুলো ‘ফলো দ্য রাইসেন লর্ড’ নামে পরিচিত ছিল। গানটা এই ধাঁচের হলেও এতে স্পষ্ট রকমভাবে কিছু নতুনত্বের আভাস লক্ষ্য করা যায়।
গান গাওয়ার সময় অনেকেই শব্দের এদিক সেদিক করেছেন। বিষয় সেটি নয়, বিষয় যেটি সেটি হলো একবার ভাবুন সমবেত স্বরে সকল দাসেরা শস্যক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে এই গানটা গাইছে।
ওভারসিয়ার মাঝে মাঝে তার চাবুক নিয়ে এসে দেখতেন সকল দাসেরা একসঙ্গে গান গাইছে। ওভারসিয়ার ভাবতেন দাসেরা আনন্দে গান করছে এবং তা দেখেই তিনি চলে যেতেন। কিন্তু এ তো শুধু গান নয়। এটি ছিল দাসেদের দক্ষিণে পালিয়ে যাবার গুপ্ত নির্দেশনা।

‘ড্রিংকিং গউর্ড’ দ্বারা ঋক্ষমণ্ডলকে ইশারা করা হতো, যা শুধুমাত্র দক্ষিণের আকাশেই উদিত হতো।
সবসময়ই আপনি যা ভাবেন একটা গানের অর্থ সেরকম নাও হতে পারে। তবুও অর্থকে খোঁজার চেষ্টাটা আমার কাছে দারুণ লাগে।
সুনির্দিষ্ট অর্থের বিষয়ে মতবিরোধের বিষয়টি যে স্বাভাবিক, তা আমি প্রথম টের পেয়েছিলাম যখন পুরনো ব্রিটিশ ব্যালাড ‘বারবারা অ্যালেন’-এর অর্থ খুঁজতে গিয়ে অনেক তাবড় তাবড় বিশারদরা দীর্ঘস্থায়ী মিটিং করছিলেন।

এই ব্যালাড শুনলে দেখা যায় একজন পুরুষ তার প্রেয়সীকে নিঠুর সাব্যস্ত করতে চেষ্টা করছেন। কারণ কী? কারণ হলো প্রেমিকের চাই একটি চুমু। প্রেয়সী তা দেবে না। ফলে প্রেমিক তার প্রেমের সে বিরহ বুকে নিয়ে মরনের কোলে ঢলে পড়ছে। আপনার কী মনে হয়? শুধুমাত্র এই কাহিনীর জন্য ব্যালাডটি বিখ্যাত? না। আপনি যে এর মেলডি বা কথার বিন্যাস দেখে একে বিচার করতে যাবেন এমনটিও সম্ভব নয়। কারণ সুরটি সাধারণই আর কথা যেহেতু লোকে ইচ্ছেমতো গাইতে পারে একটা সুনির্দিষ্ট ফর্ম তৈরি করে একে বিচারের জো নেই। তবে? ভালো লাগার কোনো কারণ থাকে না আসলে।
গানের শেষ স্তবকে দেখা যায় বারবারা অ্যালেন, সেই নিষ্ঠুর যুবতী যার কবরে কাঁটাঝোপ ছড়িয়ে যাচ্ছে, উইলিয়াম যে প্রেমের দায়ে মরেছিল তার কবরে ফুটেছে সুন্দর এক গোলাপ—তা আরেকবার সমালোচকদের গানের অর্থ ব্যাখ্যা করতে হিমশিম খাওয়ায়।

পৃথিবীতে সবাইকেই একধরনের নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমার ধারণা এই গানটিতে এমন একধরনের উচ্চাশার বিষয় আছে যেটি সেই নিষ্ঠুরতাকে দূরে সরিয়ে নিখাঁদ সৌন্দর্যেরই গল্প বলে। যেটা এই পৃথিবীতেই হোক কিংবা পৃথিবীর বাইরে কোথাও!

এ্যালান ওয়াসার : ধন্যবাদ পিট সিগার। আমাদের অনুষ্ঠানে আপনার পদধূলি পড়েছে এতে আমরা আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

পিট সিগার : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;