অদৃশ্য মানচিত্র



মূল: মাজা মেনজিস্ট, অনুবাদ: ফজল হাসান
প্রতীকী

প্রতীকী

  • Font increase
  • Font Decrease

অদৃশ্য মানচিত্র
মূল: মাজা মেনজিস্ট
অনুবাদ: ফজল হাসান

দিন
লিবিয়ার চোরাচালানিরা কারাগারের সংকীর্ণ যে কক্ষটি অফিস হিসাবে ব্যবহার করে, টাইজিস্ট সেখানে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। কক্ষটি কংক্রিটের তৈরি এবং সেখানে শুধু একটা টেবিল এবং দু’টি চেয়ার আছে। সাহারা মরুভূমির মাঝে একটা বিশাল কারাগারে সে আটকে আছে। কারাগারের চতুর্দিকে অস্ত্রবাহী লোকজন পাহারা দিচ্ছে। তাদের হাবভাব দেখে মনে হয় তারা যেন শিকারি।

‘ফোন করো’, টাইজিস্টের মুখের সামনে সেলফোন নাড়তে নাড়তে একজন বলল, ‘বলে দাও, তুমি এখন কুফরাতে আছো এবং তারা যখনই তারবার্তায় টাকা পাঠাবে, তখনই আমরা তোমাকে ত্রিপোলিতে নিয়ে যাব এবং সেখান থেকে ইতালির জাহাজে তুলে দেব।’ লোকটি চাচ্ছে টাইজিস্ট যেন তার বাবা-মাকে ফোন করে মুক্তিপণ দেওয়ার কথা বলে। তার বাবা-মা বছরে যা আয়-রোজগার করেন, মুক্তিপণের অংক তার দ্বিগুণ পরিমাণে।

মানচিত্রের উপর কুফরার দিকে টাইজিস্ট বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এবং মানচিত্রের অস্পষ্ট সীমারেখা ভালো করে দেখার জন্য মাথা ঝাকায়। কতক্ষণ ধরে সে এই জায়গায় আছে? সে মনে করতে পারে না কখন সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার তরল অন্ধকার নেমে আসে। মনে হয় দীর্ঘ ঘণ্টা যেন একাকীত্বের নিজস্ব কক্ষপথে রূপান্তরিত হয়েছে। শুধু মরুভূমির ঊষর বুকে তেজদীপ্ত সূর্যের ওঠা-নামা দেখে একটা সীমাহীন ঘূর্ণন যাত্রার ছবি ঠাহর করা যায়।

টাইজিস্ট বুঝতে পারছে না, সে কেমন করে বাবা-মার কাছে মুক্তিপণের টাকা চাইবে। কেননা সে আসার সময় তাদের বিদায় জানায়নি। তখন বেকার জীবনের অসহায়ত্বের কথা বলার ভয় ছিল, কঠোর পরিশ্রম করা ও কোথাও না যাওয়া, অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি কিছু করার এবং আরো অনেক কিছু চাওয়ার অনুতাপ প্রকাশ করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। তার চেয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলাটা সহজ ছিল, ‘কোথাও পৌঁছে আমি তাদের টেলিফোন করবো, যেন তারা বুঝতে পারেন।’

‘এক্ষুনি করো’, ধমকের সুরে চোরাচালানি বললো।
টাইজিস্ট আদ্দিস আবাবায় তার বাবা-মাকে ফোন করে। রিং হতে থাকে। টাইজিস্টের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবা বিকলাঙ্গ পা নিয়ে তার প্রিয় চেয়ারে বসে আছেন, খবরের কাগজ পড়ায় মশগুল এবং চোখেমুখে অসন্তোষের চিহ্ন ফুটিয়ে বিড়বিড় করছেন। রান্নাঘরে তার মা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে গুনগুন করছেন এবং কফির দানা ভাজছেন। বসার ঘরে পর্দা খোলা যায়। টাইজিস্টের বিগত ঊনত্রিশ বছরের জীবনে প্রতিদিন ঘরের ভিতর উজ্জ্বল মেজেন্টা রঙ বিবর্ণ হয়ে নিস্তেজ গোলাপি রঙের ফুলতোলা সোফার কোণায় যে জায়গায় সূর্যের নরম রোদ এসে পড়তো, সেই একই জায়গায় এসে রোদ পড়েছে। হয়তো তার মা অপরিসর রান্নাঘর থেকে তাকিয়ে আছেন, মুখমণ্ডল থেকে গন্ধযুক্ত ধোঁয়া মুছছেন এবং বলছেন, যা তিনি রৌদ্রজ্জ্বল দিনে সচারচর বলে থাকেন: ‘কবে আমাদের নতুন সোফা হবে?’ এবং তার বাবা, যিনি সবসময় মিতব্যয়ী, মাথা নেড়ে বলবেন, ‘ফিকির, আদরের বউ, এগুলো এখনো ভালো আছে।’ হয়তো কুয়াশাচ্ছন্ন দূরে কোথাও কোনো এক সন্নাসীর সুরেলা কণ্ঠস্বর জনস্রোতের একটানা উঁচু শব্দকে আলতো করে ঠেলে এগিয়ে যাবে এবং সরু সুতার মতো প্রার্থনার সুর তাদের বাড়িতে প্রবেশ করবে। তার মা ‘ক্রশ’ চিহ্ন আঁকবেন এবং বাবা-মা দু’জনেই মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা ও ধন্যবাদ জানাবেন। অথবা তার অনুপস্থিতে হয়তো দৈনন্দিন কাজের ধারা বদলে গেছে এবং মা-বাবা তার সুস্থতার জন্য কান্নাকাটি করে প্রার্থনা করছেন, হয়তো টেলিফোনের তীক্ষ্ণ আওয়াজে একে অপরের বাহুবন্ধন থেকে আচমকা ঝাঁকি দিয়ে নড়েচড়ে উঠেছেন। টেলিফোনের রিসিভার তুলে নেওয়ার আগে তার বাবা তিনবার রিং-এর জন্য অপেক্ষা করেন।

টাইজিস্ট কারাগারের কক্ষে বন্দি আছে, যা আয়তনে চোরাচালানিদের অফিস কক্ষের সমান। এই কক্ষটিতে রয়েছে পঁয়তাল্লিশজন বিধ্বস্ত মহিলা, ছয়টি শিশু এবং একটা ভাঙা শৌচাগার। টাইজিস্ট টেলিফোনের কর্কশ আওয়াজ হজম করার চেষ্টা করে। বাবা-মায়ের কথা সে সামান্য মনে করতে পারে। তার শুধু মনে পড়ে বাবার অনিমেষ অসহায়তার কথা এবং মায়ের চাপা কান্নার সুর। সে জিজ্ঞাসা করেনি কোথা থেকে তারা টাকা সংগ্রহ করবে, কিন্তু মনে মনে এরকম কল্পনা করেছে: ‘তার বাবা একজন খুঁতখুঁতে পুরকৌশলী, সবচেয়ে ভালো স্যুট পড়েন, পায়ে থাকে চকচকে জুতা কিন্তু পেট্রোল বাঁচানোর জন্য হেঁটে যান, বাড়তি অথবা অন্য প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য চীনা বসকে অনুনয়-বিনয় করে অনুরোধ করেন। ‘আমি ছুটি না নিয়ে প্রজেক্টে প্রতিদিন কাজ করবো,’ তিনি হয়তো বলবেন। তার মা প্রত্যেক প্রতিবেশীর ঘরের দরজায় টোকা দিবেন এবং লিবিয়ার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলবেন, ‘মন যা চায়, তা-ই দিতে পারেন। যা করতে বলবেন, আমি তা করে ঋণ পরিশোধ করবো।’ তার বাবা ব্যাঙ্কে যাবেন এবং জমানো সব টাকাকড়ি তুলে আনবেন । দু’জনেই ঘরে ফিরবেন এবং যৎসামান্য টাকার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবেন। তারা টাকা সংগ্রহ করার জন্য প্রতিদিন সংগ্রাম করবেন এবং টাইজিস্ট জানে, তারা তা পারবেন না।

যা হোক, যাত্রা সহজ হতে পারতো। কয়েকটি বিন্দুকে সংযোগ করে তাকে এবং তার বান্ধবী হেলিনাকে লোকগুলো পথ দেখিয়ে ইথিওপিয়া থেকে সুদান এবং তারপর লিবিয়া নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু তারা দু’জন সুদানি পুলিশের হাতে বন্দি হয়। খার্তুমের এক বাড়ি থেকে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে তাদের পাকড়াও করে। চোরাচালানিদের সঙ্গে পুলিশের টাকা-পয়সার লেনদেন হয়। তারপর তাদের জোরপূর্বক অন্যান্য বেপরোয়া পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের সঙ্গে সংকীর্ণ লৌহ নির্মিত কন্টেইনারের মধ্যে তোলা হয়। এসব লোকজন পানি এবং আলো-বাতাসের জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি করেছিল। সাহারা মরুভূমির উপর দিয়ে ট্রাক এদিক-ওদিক দুলতে দুলতে যাচ্ছিল। একসময় ট্রাক থামে। ট্রাকের ভেতর যারা বেঁচেছিল তারা প্রথমে মৃতদেহগুলিকে নিচে নামায়। ‘এখানে বসে থাক’, হেলিনা বললো। একসময় একজন বলেছিল, ‘সুন্দর জীবনের পথ আমি জানি।’ অথচ সে এখন সুর পাল্টিয়ে বলে, ‘ভালো কিছুর চিন্তা করো এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো।’ সে হেলিনাকে দূরে সরাতে চায়, কিন্তু বুঝতে পারে যে, আগের দিন হেলিনাও একই কারণে ফোন করেছিল। সে-ও অপেক্ষা করছে। টাইজিস্ট রীতিমতো লজ্জিত।

একসময় টাইজিস্ট হেলিনার হাত চেপে ধরে। সাধারণত এই প্রকাশ ভঙ্গি তাকে মনে করিয়ে দেয় তাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সমাবর্তন দিনের কথা। সেই অনুষ্ঠানে তাদের থেকে এক সারি সামনে বসেছিল লাজুক হাসি মুখের একটি ছেলে। টাইজিস্ট নিজের টুপি এবং গাউনের জন্য অত্যন্ত গর্বিত ছিল। তার কাছে মনে হয়েছে গাউনের কারুকাজ যেন সবচেয়ে উজ্জ্বল দিনের স্বচ্ছ আকাশের মতো। সেদিন ছেলেগুলির পুরুষ হয়ে যাওয়ায় তার কোনো ভয় ছিল না। সেই সময় সে বলতে পারতো, ‘না’। তারা শুধু স্মিত হেসে হাত ধরে কালদি ক্যাফেতে কফি খাওয়ার জন্য যেতে বলেছিল, অথবা কোনো ক্লাবে গিয়ে নাচতে আহ্বান করেছিল, কিংবা মেসকেল স্কয়্যারে গিয়ে বিশাল পর্দায় ফুটবল খেলা দেখতে বলেছিল।

কিন্তু তখন তা ছিল না এবং এটা ইথিওপিয়াও নয়। সে এমন এক জায়গায় আছে যেখানে স্বাভাবিকতা হচ্ছে অপরিচিত কোনো পুরুষকে দেখে বলা যায়, ‘হ্যাঁ, সে আমার স্বামী’ এবং আশা করা যেতে পারে যে, অন্য মহিলাদের কাছে যেই ধরনের ঘটনা ঘটে, তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে। সে এমন এক জায়গায় আছে যেখানে নারীদের ধীরে ধীরে আলাদা করা হয়। একসময় তারা ময়লা ও নোংরা হয়ে যায় এবং নিজেদের অন্ধকারের মধ্যে অবশ্যম্ভাবী চামড়ার আড়ালে গুটিয়ে নেয়। সে এমন এক জায়গায় আছে, যে জায়গার নাম লিবিয়া। পাহারাদার বলেছে, লিবিয়া হলো লিবিয়াবাসীদের জন্য, তার মতো কৃষ্ণ সারমেয়দের জন্য নয়। কয়েকজন প্রহরী বলেছে যে, বন্দিরা ইহুদি। যদিও তারা তাদের ‘ক্রশ’ চিহ্ন দেখিয়েছে এবং অনেকে স্বীকারোক্তি করেছে: তোমাদের মতো আমরা মুসলমান। কিন্তু পাহারাদার জোর গলায় বলেছে যে, তোমরা সবাই ইহুদি গুপ্তচর এবং তোমরা কালো চামড়া ও ‘ক্রশ’ চিহ্নের ছদ্মবেশে এখানে এসেছ। মাঝে মাঝে টাইজিস্ট জানে না বিনয়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে, বিশেষ করে তার পিতা-মাতা যাদের একমাত্র অপরাধ তারা তাকে জন্ম দিয়েছে, অর্থকড়ি আদায় করার অজুহাত।

রাত
অপেক্ষা করার ফাঁকে টাইজিস্ট বাবা-মাকে চিঠি লেখে। তার কাছে যখন কাগজ ও কলম কেনার টাকাপয়সা থাকে, তখন সে সময়কে বাস্তব শব্দে লিপিবদ্ধ করে চিঠি লেখে। লেখার সময় সে আনুষ্ঠানিকতা এড়িয়ে যায় এবং প্রতিটি লেখা হৃদয় থেকে শুরু করে। এমামা, সেইন্ট গাব্রিয়েল গির্জার, যেখানে একসময় জিদ এবং একগুঁয়েমি একসঙ্গে মিশে থাকতো, পাশে বস্তির কথা কী তোমার মনে আছে? প্রত্যেক বড়দিনের সময় তুমি যে ধূপবাতি জ্বালাতে, তার সুঘ্রাণ কি তোমার মনে পড়ে? আবাবা, আমার ইচ্ছে হয়, পুনরায় তোমার সঙ্গে মিলে আবাবায় আমাদের বাড়ির চালে বৃষ্টির ফোঁটা গুণি। স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে সকালবেলায় ছোটখাটো ঘটনার জন্য মন খারাপের ধূসর সময়, সারাদিনের গেরস্থালির নীরস কাজ, কাজের পথে যাওয়া শ্রমিকদের ধূলি-ধূসরিত রাস্তায় ভিড় – সেই ভিড়ের মাঝে একজন তার সুদর্শন ও গৌরবান্বিত বাবা। তার ইচ্ছে হয় সে এনটোটো পাহাড় থেকে নিচের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এদিক-ওদিকে খনন করা জমিন দেখে এবং সদ্যনির্মিত বাড়িগুলোর একটিতে বাস করার স্বপ্ন বোনে মনের ভেতর। বিশাল কোকাকোলা বোতল আকৃতির কিয়স্কে সাজানো সেলফ থেকে ক্যান্ডি কিনতে চায়। এছাড়া সে বাসে যাত্রী ওঠানোর জন্য ছেলেদের লাগাতার ডাকাডাকির অনুপস্থিতি দারুণভাবে অনুভব করে। সে বন্দি জীবনের বিস্তারিত বিবরণ মনে রেখেছে, যেমন মানুষের মলের দুর্গন্ধ ছাড়া কারাগারের মধ্যে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। তার মনে আছে মানুষের মাংসের মতো পুরো ও ভরাট বিরাজমান একধরনের আতঙ্ক এবং প্রায় প্রতিদিন ট্রাক ভর্তি নতুন বন্দির আগমন ও পুরনো অনেক বন্দির গায়েব হওয়ার ঘটনা। তার কাছে মনে হয় মানুষের যাওয়া-আসার জন্য এই জায়গাটিতে ঘূর্ণায়মান কোনো দরজা আছে। সত্যিকার অর্থে সে মনে করে যে, তাদের প্রকোষ্ঠের দরজা প্রায়ই খোলা হয়। তখন উপুড় হয়ে থাকা মহিলাদের গায়ের উপর বাইরের একঝলক আলো এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। পরবর্তী সম্ভাব্য ঘটনার কথা সে পরোক্ষভাবে বলতে পারে। সে বলে, ঘুমানোর আগে মহিলারা প্রায়ই প্রার্থনা করে। সে আরো বলে, মহিলারা একে অন্যের দেখভাল করে এবং নির্দিষ্ট দিনে এক বা দু’জনের চারপাশে সবাই জড়ো হয়। তখন তারা একে অন্যের মা হিসাবে আবির্ভূত হয়। এমামার অনুপস্থিতিতে সে বলে, অনেক মহিলাই তার প্রতি সহানুভূতিশীল। চিঠির শেষে বাবা-মায়ের সঙ্গে শিগগিরই দেখা হওয়ার কথা এবং ঋণ পরিশোধ করার জন্য টাকা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে লেখা সমাপ্ত করে।

দিন
যদিও টাইজিস্ট কারাগারে বন্দিনী এবং বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকাপয়সা আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, তবুও এসব কথা বলার কারণ সে জানে না। কিন্তু সে বলে, ‘হেলিনা, আমি বাড়ি যাবো। আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই।’

টাইজিস্ট ভাবে, সে সাহারা মরুভূমির মধ্যে নিঃশ্বাস বন্ধ করা যাত্রার জন্য ঝুঁকি নিতে পারবে। সে জানে, সেই যাত্রা পথে রয়েছে চোরাচালানিদের তৎপরতা এবং এলোপাথারি হত্যাকাণ্ড। লৌহ নির্মিত তপ্ত কন্টেইনারের মধ্যে সে হয়তো নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে, এমনকি বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনে নিজের মুখের লালা গিলতে কোনো দ্বিধা করবে না। বাড়ি ফিরে দু’হাতে বাবাকে জড়িয়ে ধরা এবং মাকে আদর করার জন্য এসব কাজ সে অনায়াসে করতে পারবে। এছাড়া তার ইচ্ছে সে কমলা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কচি সবুজ পাতা স্পর্শ করবে এবং সকালের শিশির ভেজা হলুদ রঙের ডেইজি ফুল তুলবে। তাই সে পুনরায় চোরাচালানিদের মানচিত্র দেখতে চায় এবং তার দেশে ফিরে যাওয়ার প্রতিটি রাস্তা, যা শরীরের শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে আছে, মুখস্ত করতে চায়।

‘টাইজিস্ট, সম্মুখে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই’, বলেই হেলিনা তার বুড়ি মায়ের মতো, যার নামে তার নাম রাখা হয়েছে, প্রচণ্ড ঝাকুনির সঙ্গে মাথা দোলায়। তারপর সে আরো বলে, ‘অতিক্রম করার পরপরই সব পথ অদৃশ্য হয়ে যায়। আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানে পথের মাঝে যারা মারা গেছে, তাদের হাঁড় ছাড়া এমন কিছু নেই যা চিহ্নিত করে রাখা যায়। এটা একটা অদৃশ্য মানচিত্র। যা হোক, টাকাকড়ি না আসা পর্যন্ত আমাদের শক্ত থাকতে হবে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আমরা প্রার্থনা করবো।’

টাইজিস্ট হেলিনাকে ভালো করেই চেনে। হেলিনা যখন বলে, ‘সম্মুখে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই,’ আসলে সে বলতে চায়, ‘আমরা আটকে আছি।’

রাত
টাইজিস্ট স্বপ্ন দেখে। সে টেলিফোনের শব্দ শুনতে পায় এবং তার বাবা ফোন করেছে। বাবা হ্যালো বলেননি, বরং তার পরিবর্তে তিনি টাইজিস্টকে স্মরণ করিয়ে দেন, ‘বাড়িতে তোর জন্য ঘর খালি আছে। তুই কি ওখানে গাদাগাদি করে আছিস না?’ অন্য সময় তার মা হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ছড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুই তো ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস না। আরো দু’মুঠো ভাত চেয়ে নিস।’ অন্য একসময় ক্লাসের শান্ত ছেলেটি একবার তার উরুর দিকে এক পলক দৃষ্টি ফেলে বলেছিল, ‘তুমি আর নতুন নও’। কখনও সে সকাল হওয়ার একটু আগে ঘুম থেকে জেগে যায় এবং জবুথবু হয়ে শুয়ে থাকা অন্য মহিলাদের ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনে। সে সূর্য কল্পনা করে। মেঘহীন আকাশের গায়ে সূর্য যেন তার নিজের আলোক রশ্মির তীব্রতায় জ্বলছে। সে স্বপ্ন দেখে হেলিনা হাঁড় দিয়ে তার জন্য একটা মই বানিয়েছে। সেই মই বেয়ে সে সূর্যের বাড়ি পৌঁছে গেছে এবং সূর্যকে উদ্দেশ্য করে বলেছে, ‘ইথিওপিয়ায় ঠিক সকাল ছ’টায় তুমি প্রতিবার উদয় হও। কিন্তু লিবিয়ায় মাঝরাতের অন্ধকার খানাখন্দের মধ্যে একটা নতুন দিনের সূচনা করো। আমার পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে তুমি কি বলো?’

দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন, দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন, দিনের পরে রাত, রাতের পরে...
তারপর একদিন ঘটনা ঘটে। আলোর ঝলক টইজিস্টকে খুঁজে পায়। সে জানে, এই সেই অপেক্ষার রাত, যে রাতে তার পালা। সে চোখের পাতা বন্ধ করে এবং হেলিনার হাত চেপে ধরে। কিন্তু হেলিনা তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। ‘উঠে দাঁড়াও, টাইজিস্ট’, হেলিনা বললো, ‘উঠে পড়ো। যাও। তুমি কী বুঝতে পারছো না?’

এবার লিবিয়ার চোরাচালানি এসেছে, পাহারাদার কেউ আসেনি। ‘জলদি করো’, চোরাচালানি লোকটি তাড়া দিয়ে বললো।

হেলিনাকে তুলে টাইজিস্ট দরজা পর্যন্ত নিয়ে যায় এবং দু’জনে একই সঙ্গে সজোরে ঝাড়া দিয়ে চোরাচালানির হাত সরিয়ে দেয়। তখন মনে হয় যেন উভয়ের ধুকপুকানির হৃদয় একটাই। তারা যদি কথা বলার জন্য কোনো কণ্ঠস্বর খুঁজে পায়, তাহলে দু’জনেই চোরাচালানি লোকটিকে বলবে, ‘আমরা শপথ করেছি, কখনও কেউ কাউকে ছেড়ে যাবো না। আমার হাত হেলিনার হাতকে শক্ত করে ধরে রাখে। সে যেন ঘুমিয়ে যায়, সেজন্য আমি গুনগুন সুরে গান করি। ত্রিপোলিতে পৌঁছে ইউরোপে যাওয়ার জন্য কোনো বাহন না পাওয়া পর্যন্ত আমরা একজন অন্যজনকে সহযোগিতা করবো। শুধু তাই নয়। ইউরোপে পৌঁছে আমরা যতদিন পর্যন্ত আমাদের ঋণ পরিশোধ করতে না পারি, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা প্রেমে পড়ি এবং বিয়েশাদি করে থিতু হই, এমনকি যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা মন খুলে গান গাইতে না পারি, ততদিন আমরা এক হয়ে থাকবো। হেলিনাকে আমি একা রেখে যেতে পারি না। হ্যাঁ, সত্যি, আমি তা পারি না।’ চোরাচালানি লোকটি ধাক্কা দিয়ে হেলিনাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে টাইজিস্টকে টেনে সামনে আনে। তখন টাইজিস্ট নিজের ভেতর শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই অনুভব করতে পারে না।

পরবর্তীতে লোহার কন্টেইনারের দু’টি দরজা ভীষণ শব্দ করে বন্ধ হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই কন্টেইনারের ভেতর অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে। কন্টেইনার লোকজনে ঠাসা এবং তারা বিলাপ করছে। ট্রাকের ঘড়ঘড় আওয়াজ, পানির জন্য নারী-পুরুষ ও শিশুদের চিৎকার-চেঁচামেচি, ঈশ্বরের কৃপা পাওয়ার জন্য বিনয়ী কন্ঠস্বর – সবকিছু ছাপিয়ে টাইজিস্ট শুধু দুর্বল বাতাসে ভাসমান একজনের নামই শুনতে পায় এবং সেই নাম তার বান্ধবী এবং বোনের, যে কিনা অতিসত্ত্বর স্মৃতি হয়ে যাবে।

২৮ জুন ২০১৬
টাইজিস্ট প্রতিটি চিঠি একইভাবে আরম্ভ করে:
সমুদ্র হলো একধরনের নীল, যা তুমি জীবনে কখনই দেখনি, হেলিনা। আমি রোমে আছি। তুমি কোথায়? কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যারা এসেছে, তারা সবাই বলেছে তুমি সেখানে নেই। বোন আমার, এমন একটা দেশে, যেখানে চারপাশের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে, তোমাকে একা ফেলে আসার জন্য আমাকে ক্ষমা করো। এখানে আমার একাংশ বাস করে। অদৃশ্য মানচিত্রের যেখানে তুমি আছো, সেখানে আমার বাকিটুকু রয়ে গেছে এবং বাদবাকি হাঁড় সংগ্রহ করে পূর্ণাঙ্গ অবয়ব দেওয়ার কাজে সেখানে ব্যস্ত আছে। তোমার কণ্ঠস্বর আমি রাতের আঁধারে শুনতে পাই। তুমি বলেছো, আমি যেন চিৎকার-চেঁচামেচি না করি। কিন্তু নিস্তব্ধতার মাঝে আমার কাছে এসে লিবিয়া হাজির হয়। হয়তো কোলাহলই মানুষ হিসাবে আমাদের চিহ্নিত করে। হয়তো তার জন্যই আমরা কাঁদি। আমি তোমাকে খুঁজবো, খুঁজতে থাকবো। কখনই হাল ছেড়ে দেব না।

লেখক পরিচিতি:
ইথিওপিয়ার সমকালীন কথাসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য লেখক ও লেখিকাদের মধ্যে মাজা মেনজিস্ট অন্যতম। তার জন্ম আদ্দিস আবাবায়, ১৯৭৪ সালে। মাত্র চার বছর বয়সে বিপ্লবের ভয়ে সপরিবারে নাইজেরিয়ায় অভিবাসী হন। তার শৈশব কাটে নাইজরিয়া, কেনিয়া এবং আমেরিকায়। তিনি ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে ইতালিতে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এ মাস্টার্স অব ফাইন আর্টস ডিগ্রি অর্জন করেন। তার লেখা ফিকশন এবং নন-ফিকশন বিখ্যাত পত্র-পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে, যেমন ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’, ‘গ্রান্টা’, ‘দ্য গার্ডিয়ান’, ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ এবং ‘এনকারে রিভিউ’-এ নিয়মিত প্রকাশিত হয়।

এছাড়া মাজা মেনজিস্টের ছোটগল্প ‘দ্য গ্রান্টা অ্যান্থোলজি অব দ্য আফ্রিকান শর্ট স্টোরিজ’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং বিবিসি রেডিওতে প্রচারিত হয়েছে। তার লেখালেখির মূল বিষয় যুদ্ধ-সংঘাত, বিপ্লব, অভিবাসন এবং ফটোগ্রাফির সঙ্গে হিংস্রতার সম্পর্ক। প্রথম উপন্যাস “বিনিথ দ্য লায়ন’স গেইজ” ২০১০ সালে প্রকাশের পরপরই তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। এই উপন্যাসে তিনি ইথিওপিয়ার বিপ্লবের সময় একটি পরিবারের বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামী জীবনের করুণ কাহিনী তুলে ধরেন। উপন্যাসটি লন্ডনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা সমকালীন আফ্রিকার দশটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম হিসাবে নির্বাচিত করেছে। এছাড়া উপন্যাসটি ‘ফ্লাহার্টি-ডুন্নান ফার্স্ট নোবেল প্রাইজ’-এর চূড়ান্ত তালিকায় নির্বাচিত হয় এবং ‘ক্রিস্টিয়ান সায়েন্স মনিটর’ ও ‘বোস্টন গ্লোব’ ম্যাগাজিন ২০১০ সালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আফ্রিকার উপন্যাস হিসাবে আখ্যায়িত করে। ইতোমধ্যে উপন্যাসটি ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

মাজা মেনজিস্ট ‘ওয়ার্ডস উইথআউট বর্ডার্স’ এবং ‘ওয়ারস্কেপস’ অনলাইন ম্যাগাজিনের পরিচালনা পরিষদের একজন সদস্য হিসাবে নিয়জিত আছেন। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক এবং সেখানেই বসবাস করেন।

গল্পসূত্র:
‘অদৃশ্য মানচিত্র’ গল্পটি মাজা মেনজিস্টের ইংরেজিতে ‘দ্য ইনভিজিবল ম্যাপ’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি ‘এনকারে রিভিউ’ ম্যাগাজিনের ২০১৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;