একদা এক ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তি



লিডিয়া ডেভিস
ছবি নিউইয়র্কার থেকে। গ্রাফিক বার্তা২৪

ছবি নিউইয়র্কার থেকে। গ্রাফিক বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

অনুবাদ মেহেদী হাসান

লিডিয়া ডেভিস ১৯৪৭ সালের ১৫ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের নরদাম্পটনে জন্মগ্রহণ করেন। অনুগল্প (Flash fiction) কথিত অত্যন্ত স্বল্প পরিসরের সাহিত্য আঙ্গিকের জন্য তিনি অধিক পরিচিত। পাশাপাশি তিনি একজন ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক। তিনি মার্সেল প্রুস্তের সোয়ান’স ওয়ে এবং গুস্তাব ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারিসহ ফরাসি ও অন্যান্য ভাষার বেশ কিছু চিরায়ত সাহিত্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

লিডিয়া ডেভিসের বাবা রবার্ট গরহ্যাম ডেভিস (Robert Gorham Davis) ছিলেন একজন সাহিত্য সমালোচক ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক এবং মা হোপ হেল ভেভিস (Hope Hale Davis) ছিলেন একজন ছোটগল্পকার, স্কুল শিক্ষিকা এবং স্মৃতিকথা লেখক। গোড়ার দিকে তিনি সঙ্গীতের ওপর শিক্ষা গ্রহণ করেন—প্রথমে পিয়ানো, তারপর ভায়োলিন। সঙ্গীত ছিল তার প্রথম প্রেম। লেখক হওয়ার বিষয়ে লিডিয়া ডেভিস জানান, “আমি সম্ভবত সবসময় লেখক হওয়ার পথেই এগিয়ে গিয়েছি, এমনকি যদিও এটা আমার প্রথম প্রেম নয়।” 

লিডিয়া ডেভিস দ্য থারটিন উম্যান এন্ড আদার স্টোরিজ (১৯৭৬) এবং ব্রেক ইট ডাউন (১৯৮৬) সহ মোট ছয়টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেন। ব্রেক ইট ডাউন গল্প গ্রন্থটি পেন/ হেমিংওয়ে অ্যাওয়ার্ড-এর (PEN/Hemingway Award) চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এবং তার সাম্প্রতিক প্রকাশিত ভ্যারাইটিজ অব ডিস্টারবেন্স (২০০৭) গল্পগ্রন্থটি স্থান লাভ করে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড (National Book Award) চূড়ান্ত তালিকায়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত লেখা তার সকল গল্পের সমন্বয়ে প্রকাশিত হয়েছে দ্য কালেক্টডে স্টরিজ অব লিডিয়া ডেভিস (২০০৯)।

অনেকে তাকে অনেকাংশে তার নির্মিত সাহিত্য আঙ্গিকের গুরু হিসেবে অভিহিত করেন। তার অনেক অনুগল্প (Flash fiction) মাত্র একটি বা দুটি বাক্যেই সম্পূর্ণ। ডেভিস এইসব গল্পকে আকাশচুম্বী ভবনের সাথে তুলনা করেন এই অর্থে যে তারা আরোপিত শূন্যতা দ্বারা পরিব্যাপ্ত।

লিডিয়া ডেভিস ৬৫ বছর বয়সে ২০১৩ ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। ডেভিসকে পুরস্কার দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় ম্যান বুকার প্রাইজ ওয়েবসাইটে তার সাহিত্য কর্মকে কাব্যের পরিমিতিবোধ এবং যথাযথতা সম্বলিত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/01/1561953332191.jpg
তরুণ বয়সে লিডিয়া ডেভিস / প্যারিস ১৯৭৩

 

একদা এক ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তি 

মেয়েটি ক্লান্ত ও হালকা অসুস্থ এবং খুব পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারছে না। পোশাক পরার সময় মেয়েটি লোকটিকে জিজ্ঞেস করতে থাকে তার কাপড়-চোপড় সব কোথায় এবং লোকটি খুব ধৈর্য সহকারে মেয়েটির কাপড়-চোপড়ের অবস্থান জানায়—প্রথমে তার প্যান্ট, তারপর তার শার্ট, তারপর তার মোজা, তারপর তার চশমা। লোকটি মেয়েটিকে চশমা পরতে বলে এবং মেয়েটি চশমা পরে, তবে এতে তেমন কোনো লাভ হয় বলে মনে হয় না। রুমে খুব একটা আলো ঢুকছে না। এই খোঁজাখুঁজি এবং পোশাক পরার চেষ্টার সময় মেয়েটি প্রায় সকল পোশাক পরা অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থাকে। বিড়ালটাকে খাওয়াতে খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার এবং খাবারের টিন খোলার পর লোকটি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে। খাবারের টিন খোলার সময় এমন শব্দ হয় যা মেয়েটিকে হতবিহ্বল করে তোলে কারণ শব্দটি গাভীর বান থেকে স্টিলের বালতিতে দুধ পড়ার মতো শোনায়। প্রায় সকল পোশাক পরা অবস্থায় মেয়েটি লোকটির পাশে শুয়ে থাকার সময় লোকটি বিভিন্ন বিষয়ে একনাগাড়ে মেয়েটিকে বলে যায়। মেয়েটি লোকটির কথা শোনার সময় বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে, প্রথমে বিরক্তি, তারপর ব্যাপক উৎসাহ, এরপর আহ্লাদ, তারপর চিত্ত বিক্ষেপ, তারপর আবার বিরক্তি, এরপর আবার আহ্লাদ। লোকটি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে তার বাচালতায় সে কিছু মনে করছে কিনা এবং সে কথা বলা বন্ধ করবে নাকি চালিয়ে যাবে। এখন তার প্রস্তুত হওয়ার সময়—এই বলে মেয়েটি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে।

মেয়েটি আবার তার পোশাক খুঁজতে শুরু করে এবং লোকটি এবারও তাকে পোশাক খুঁজতে সাহায্য করে। মেয়েটি জানতে চায় তার আংটি কোথায়, জুতা কোথায়, জ্যাকেট কোথায় এবং পার্স কোথায়। লোকটি মেয়েটির জিনিসপত্রের অবস্থান জানিয়ে দেয়। এরপর লোকটি বিছানা ছাড়ে এবং মেয়েটি জানতে চাওয়ার আগেই কিছু জিনিস এগিয়ে দেয়। মেয়েটি যখন সকল পোশাক পরে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, তখন মেয়েটি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে যে তার পরিস্থিতি অনেকটা সেই হাসিডিক গল্পের মতো যা সে আগের দিন সাবওয়েতে পড়েছে। বইটি এখনো তার পার্সের মধ্যে আছে। মেয়েটি লোকটিকে জিজ্ঞেস করে মেয়েটি তাকে একটি গল্প পড়ে শোনাতে পারে কিনা, লোকটি ইতস্তত করে। মেয়েটি ভাবে লোকটি সম্ভবত চায় না সে তাকে গল্প পড়ে শোনাক, এমনকি যদিও লোকটি মেয়েটিকে পড়ে শোনাতে পছন্দ করে। মেয়েটি বলে একটি মাত্র অনুচ্ছেদ তাকে পড়ে শোনাবে, লোকটি রাজি হয় এবং তারা রান্নাঘরের টেবিলের সামনে বসে। ইতোমধ্যে লোকটিও পোশাক পরে নিয়েছে—একটি সাদা টি-শার্ট এবং একটি প্যান্ট যাতে তাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। পাতলা বাদামী রঙের বইটি থেকে মেয়েটি তাকে নিম্নোক্ত গল্পটি পড়ে শোনায়।

“একদা এক লোক ছিল—লোকটি ছিল ভীষণ নির্বোধ। সকাল বেলায় বিছানা ছাড়ার সময় পোশাক খুঁজে পাওয়া তার জন্য এতই দুষ্কর হয়ে উঠত যে, এই ঝামেলার কথা ভেবে সে রাতে বিছানায় যেতে ইতস্তত বোধ করত। একরাতে সে হাতে কাগজ ও পেন্সিল তুলে নেয় এবং তার পরনের পোশাক খুলে কোথায় রাখছে তা যথাযথভাবে লিখে রাখে। পরের দিন সকালে সে তার কাগজটি হাতে নিয়ে খুশি মনে পড়তে শুরু করে: টুপি—এখানে ছিল, তখন সে এটা মাথায় পরে; প্যান্ট—এখানে পড়ে আছে, সে প্যান্ট পরে নেয়; এবং সকল পোশাক পরা পর্যন্ত এভাবে চলে। এখন তার আতঙ্ক দূর হয় এবং সে নিজেকে বলে: ‘আমি আমার পোশাক খুঁজে পেয়েছি এবং গায়ে চাপিয়েছি, তবে আমি নিজে এখন কোথায় আছি? এই পৃথিবীর কোথায় আমি? সে চারদিকে খুঁজতে থাকে, তবে এতে কোনো লাভ হয় না; সে নিজেকে খুঁজে পায় না। ইহুদি যাজকটি বলে, আমাদের ব্যাপার-স্যাপারই এরকম।”

মেয়েটি পড়া থামায়। লোকটি গল্পটি পছন্দ করে, তবে শুরুর দিকটা, লোকটির সমস্যা এবং সমাধান, যেমন পছন্দ করে শেষের অংশটুকু—‘আমি কোথায়?’—তেমনটা পছন্দ করে বলে মনে হয় না।

মেয়েটি ভাবে সে ওই ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তিটির মতো, শুধু এই কারণে নয় যে, সে তার পোশাক খুঁজে পায় না, একারণেও নয় যে মাঝে মাঝে পোশাক পরা বাদেও অন্যান্য সাধারণ জিনিসপত্র তার নাগালের বাইরে চলে যায়। তবে বেশিরভাগ এই কারণে যে, সে প্রায়ই বুঝতে পারে না সে কোথায় এবং বিশেষ করে এই লোকটির প্রেক্ষিত থেকে মেয়েটি জানে না মেয়েটি কোথায়। মেয়েটি ভাবে এই লোকটির জীবনে সম্ভবত তার কোনো জায়গা নেই, লোকটি অবশ্য শুধু তার নিজের বাড়িতেই নেই, ঠিক তেমনিভাবে মেয়েটিও তার নিজের বাড়িতে নেই যখন সে লোকটির সাথে দেখা করতে যায় এবং সে আসলে জানে না কোথায় তার বাড়ি তবে ঠিকই সে রাস্তায় হোঁচট খেতে খেতে এবং পড়ে যেতে যেতে সেখানে পৌঁছায় যেন বাস্তবে নয় স্বপ্নে, তবে লোকটি মোটেই লোকটির নিজের জীবনে আর নেই এবং নিজেকে জিজ্ঞেস করে,‘আমি কোথায়?’

মেয়েটি আসলে নিজেকে একজন ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তি মনে করতে চায়। মেয়েটি কি বলতে পারে না, এই মেয়েটি একজন ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তি, ঠিক যেমনভাবে কয়েক সপ্তাহ আগে সে ভেবেছিল সে নিজেকে একজন দাঁড়িওয়ালা লোক মনে করেছে? কারণ এই গল্পের ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তি যে আচরণ করে মেয়েটি ঠিক তেমন আচরণই করত অথবা ঠিক এই মুহূর্তে তেমন আচরণ করছে, সে কি নিজেকে ভীষণ নির্বোধ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে পারে না, ঠিক যেমনভাবে কয়েক সপ্তাহ আগে সে ভেবেছিল একটি ক্যাফেতে পাশের টেবিলে বসে লিখতে থাকা কেউ দাড়িওয়ালা লোক হিসেবে পরিগণিত হবে? মেয়েটি একটি ক্যাফেতে বসেছিল এবং একজন দাড়িওয়ালা লোক তার থেকে দুই টেবিল পরে বসে লিখছিল এবং উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকা দুইজন মহিলা লাঞ্চ করতে আসে এবং দাড়িওয়ালা লোকটিকে বিরক্ত করে এবং মেয়েটি তার নোটবুকে লিখে রাখে যে তারা পাশের টেবিলে বসে লিখতে থাকা দাড়িওয়ালা লোকটিকে বিরক্ত করেছে এবং এরপর দেখে যদিও সে নিজে, যখন সে এটা লিখছিল, পাশের টেবিলে বসে লিখছে, সে সম্ভবত নিজেকে একজন দাড়িওয়ালা লোক মনে করে। ব্যাপারটা এরকম নয় যে সে কোনোভাবে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে, তবে দাড়িওয়ালা লোক এই শব্দটি এখন তার ওপর প্রয়োগ করা যায়। অথবা সম্ভবত সে পরিবর্তিত হয়ে গেছে।

মেয়েটি উচ্চস্বরে লোকটিকে গল্পটি পড়ে শোনায় কারণ এটা ঠিক তেমনই যেমনটা তার ক্ষেত্রে ঘটেছে, তবে এরপর সে ভাবে বিপরীতটাও তো হতে পারে এবং গল্পটি আগের দিন তার মনের ভেতরে কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারে এবং তার সকল পোশাক কোথায় আছে তা ভুলে যাওয়া এবং পোশাক পরার সময়কার এসব ঝামেলা সম্ভব করে তুলতে পারে। সেইদিন সকালে, অথবা সম্ভবত অন্য এক সকালে, লোকটিকে ছেড়ে আসার সময় একই ধরনের নির্বুদ্ধিতা অনুভব করা, যে তার নিজের জীবনে আর নেই, যখন মেয়েটি আবার নিজেকে লোকটির জীবনে খোঁজ করে এবং নিজেকে কোথাও খুঁজে পায় না, তখন আরো বিভ্রান্তি তৈরি হয়। মেয়েটি কাঁদে এবং সম্ভবত কাঁদে শুধুমাত্র এই কারণে যে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে এবং সে জানালার শার্শিতে পড়তে থাকা বৃষ্টির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে এবং এরপর সে ভাবে সে বেশি বেশি কাঁদে কারণ বৃষ্টি হচ্ছে অথবা এই বৃষ্টি প্রথমেই তার জন্য কান্না সম্ভব করে তোলে, যেহেতু সে ঘন ঘন কাঁদে না, এবং অবশেষে ভাবে এই দুইটি, বৃষ্টি এবং অশ্রু, আসলে একই। এরপর রাস্তায় একটা বিশাল হঠাৎ হট্টগোল বিভিন্ন জায়গা থেকে একই সময় আসতে থাকে—কিছু গাড়ি হর্ন বাজাচ্ছে, একটি ট্রাকের ইঞ্জিন ঘরঘর শব্দ করছে, অন্য একটি লক্করঝক্কর ট্রাক একটি ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে ঝনঝন করে চলছে, একটি রোড মেন্ডার রাস্তা পিটাচ্ছে—এবং হট্টগোলটি মনে হচ্ছে যেন তার ঠিক ভেতরে ঘটছে যেন তার ক্রোধ এবং দ্বিধা তাকে শূন্য করে দিয়ে গেছে এবং তার বুকের ঠিক মাঝখানে একটি জায়গা তৈরি করেছে এই উচ্চ ধাতব সংঘর্ষ তৈরি হওয়ার জন্য, অথবা যেন সে নিজে এই শরীর ত্যাগ করেছে এবং এই হট্টগোলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে গেছে, এবং এরপর সে ভাবে, আসলেই কি শব্দটি আমার ভেতরে ঢুকছে, অথবা আমার ভেতরের কিছু রাস্তায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে এরকম একটা বিশাল হট্টগোল তৈরি করার জন্য।

 

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;