বেদখল বাড়ি



হুলিও কোর্তাসার
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

অনুবাদ আফসানা বেগম

পুরনো আর বিশাল হলেও, আমাদের বাড়িটা আমরা পছন্দ করতাম (সেরকম সময়ের কথা বলছি যখন পুরনো বাড়ি আর বাড়ি বানানোর জিনিসগুলো নিলামে বেশ ভালো দামে বিক্রি হতো)। দাদার বাবা, দাদা, বাবা-মা আর আমাদের শৈশবের হাজার স্মৃতি নিয়ে বাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল।

ইরিন আর আমি এমনিতেই বাসাটায় থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, যেটা আসলে ছিল একটা পাগলামো। বাড়িটা এতই বড়ো যে অন্তত আটজন মানুষ ওই বাড়িতে একসঙ্গে থাকলেও কারো সামনে কারো পড়ার সম্ভাবনা নেই। আমরা সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠতাম আর বাড়ি পরিষ্কার করার কাজ শুরু করে ফেলতাম। তারপর এগারোটার দিকে ঘরগুলোয় বাকি যা কাজ থাকে সেসব করতে করতে আমি ইরিনকে রান্নাঘরের দিকে যাবার জন্য ছেড়ে দিতাম। দুপুরে দুজনে ঠিক সময়মতো খেয়ে নিতাম। আর তারপর এঁটো কয়েকটা বাসন ধোয়া ছাড়া কাজ বলতে আর কিছু থাকত না। ওই শূন্য আর নিস্তব্ধ বাসায় বসে টুকটাক আলাপ করতে করতে খাওয়া খুব আনন্দদায়ক মনে হতো। সত্যি বলতে কী, বাসাটা শুধু পরিষ্কার রাখতে পারলেই আমরা শান্তি পেতাম। মাঝেমধ্যে এ নিয়ে ভাবলে দেখতাম যে এটাই একটা বিষয় যা কিনা আমাদেরকে বিয়েও করতে দিচ্ছে না। কোনো কারণ ছাড়াই ইরিন পরপর দুটো ভালো পাত্রকে নাকচ করল আর ওদিকে মারিয়া ইসথার তো আমার বাগদত্তা হবার আশায় আশায় প্রায় মারাই যাচ্ছিল! আমাদের পূর্বপুরুষেরা বাড়িটাতে যেমন নিজের ভাই বোনদের বিয়েশাদির ব্যাপারে উদাসীন ছিল, সেই অব্যক্ত আদেশের ভার মাথায় চাপিয়ে আমরা অবধারিতভাবে চল্লিশের কোঠায় পৌঁছে গেলাম। জানতাম, আমরা ওই বাড়িতেই কোনোদিন মারা যাব, আমাদের দূর সম্পর্কের অচেনা আত্মীয়-স্বজন এসে বাড়িটা দখল করবে, হয়তো প্রথমেই ভেঙে ফেলবে, ইটগুলো খুলে খুলে বিক্রি করবে আর তারপর জায়গাটার মালিক হয়ে বড়োলোক হয়ে যাবে; আর তার চেয়ে ভালো আর সুবিবেচিত কিছু যদি করতে হয় তবে অনেক দেরি হয়ে যাবার আগে আমাদেরই এই বাড়িটার একটা গতি করা দরকার।

ইরিন কখনো কোথাও যেত না। সকাল সকাল ঘরের কাজ শেষ হয়ে গেলে সে তার শোবার ঘরের সোফায় বসে উল বুনে বাকি দিনটা কাটিয়ে দিত। আমার মাথায় ঢুকত না সে কেন এত সোয়েটার বুনত। আমার কাছে মনে হতো মেয়েরা আসলে কাজ না করার অজুহাত হিসেবে দিনভর উল বুনতে থাকে। তবে ইরিন ঠিক সেরকম ছিল না। সে বরাবর দরকারি জিনিসই বুনত। যেমন, শীতের জন্য সোয়েটার, এমনিতে পরার জন্য আমার মোজা, সকালে পরার জন্য হালকা লম্বা জামা, আর তার নিজের রাতের পোশাক। কখনো আবার হুট করে একটা জ্যাকেট বানিয়ে ফেলত আর পরমুহূর্তেই সেটা উল টেনে টেনে খুলতে থাকত, কারণ ওটার নকশায় কি বানানোতে কিছু একটা হয়তো তার মনমতো হয়নি। তার সেলাইয়ের বাকসে তখন যুদ্ধে হেরে যাওয়া কোঁকড়ানো উলের স্তূপ দেখতে ভালোই লাগত যা কিনা থাকত নিজের আগের আকৃতিতে যাবার প্রতীক্ষায়। প্রতি শনিবার আমি উল কিনতে শহরে যেতাম। আমার পছন্দের ব্যাপারে ইরিনের আস্থা ছিল। আমার কেনা রঙগুলো সে পছন্দ করত, তাই একটা উলের গোল্লাও দোকানে কখনো ফেরত দিতে হয়নি। উল কেনার ছলে বাজারে গিয়ে আমি বইয়ের দোকানে খানিক ঢুঁ মারতাম। খামোখাই তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতাম ফরাসি সাহিত্যের নতুন কোনো বই এসেছে কি না। সত্যি কথা বলতে কী, ১৯৩৯ সালের আগপর্যন্ত আর্জেন্টিনায় পড়ার মতো কোনো বই-ই আসেনি।

তবে সে যাই হোক, আমি বলছিলাম আমাদের বাড়িটার কথা। বাড়ি আর ইরিনের কথা, এখানে আমার কাহিনী মুখ্য নয়। আমার জানা নেই উল না বুনলে ইরিন বেচারা সারাদিন কী করত। মানুষ একটা বই পড়ে ফেলার পরে আবারও নতুন করে পড়তে আরম্ভ করতে পারে। কিন্তু একটা সোয়েটার বানিয়ে ফেলার পরে তাকে বারবার নতুন করে বানানো সাজে না। এটা একরকমের অপমান। একদিন ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ার টেনে দেখি ন্যাপথলিন দিয়ে ঠাসা। সেখানে ভাঁজ করা সাদা, সবুজ, বেগুনি চাদর স্তূপ করে রাখা। চাদরের বিশাল স্তূপ থেকে কর্পূরের গন্ধ বাতাসে ছড়াচ্ছে—যেন একটা দোকান। আমার কেন যেন তাকে জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না, উলের এতগুলো চাদর দিয়ে সে আসলে করবেটা কী। আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য কোনো পয়সা রোজগার করতে হতো না। খামারগুলো থেকে প্রতিমাসে প্রচুর আয় হতো, যা আমাদের খরচের পরেও জমতে থাকত। কিন্তু ইরিনের একমাত্র পছন্দের কাজ ছিল উল বোনা। বুনতে বুনতে তাতে সে অদ্ভুত এক দক্ষতা অর্জন করেছিল। আর আমার কথা যদি বলি, তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমার ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যেত। ইরিনের হাতগুলোকে মনে হতো সাগরের রুপালি রঙা শুশুক। কাঁটাগুলো তার মধ্যে থেকে থেকে দপ দপ করে জ্বলে উঠত। মেঝেতে ছড়ানো একটা কি দুটো উলের ঝুড়ি, উলের গোল্লাগুলো তার ভেতরে লাফাত আর লাফাত। সব মিলিয়ে দেখতে দারুণ।

পুরো বাড়ির নকশাটা ভোলা কখনো সম্ভব নয়। খাবার ঘর আর বসার ঘরের জানালাগুলোয় বিশাল পরদা, আর ওই অংশের চারদিকে বড়ো বড়ো তিনটা শোবার ঘর। তাদের মধ্যে একটা রদ্রিগুয়েজ পেনিয়ার দিকে মুখ করা। বিশাল ওক কাঠের দরজায় গিয়ে মেশা একটা করিডোর ওদিকটাকে বাড়ির সামনের অংশ থেকে আলাদা করেছিল। সামনের অংশটায় ছিল গোসলের জায়গা, রান্নাঘর, আমাদের শোবার ঘর আর বড়ো হল রুম। বাড়িটাতে এলে প্রথমে চকচকে টাইলসের বিস্তৃত লবিতে এসে দাঁড়াতে হতো। তারপর রট আয়রনের কারুকাজ করা বিরাট দরজাটা পেরিয়ে বসার ঘরে ঢুকতে হতো। মানে, বসার ঘরের দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে হলে ওই বড়ো লবিটা পার হয়ে বড়োসড়ো দরজাটা খুলতেই হতো। বসার ঘরের পরে করিডোর আর আমাদের দুজনের দুটো শোবার ঘরের দরজা সেখান থেকে দুদিকে। উলটোদিকের করিডোরটা গেছে বাড়ির পেছনের অংশে। সেই করিডোর ধরে এগোলে সামনে বিশাল ওকের দরজা। আর সেটা খুললেই বাড়ির বাকি অংশটা দেখা যাবে। কিংবা ওই দরজার ঠিক আগেআগেই কেউ যদি বাম দিকে ঘুরে যায় আর সরু একটা করিডোর ধরে কিছুটা নিচে নামে তাবে গোসলখানা আর রান্নাঘরটা পেয়ে যাবে। ওক কাঠের ওই বড়ো দরজাটা খুললেই কেবল বাড়িটার সত্যিকারের আকৃতি সম্পর্কে ধারণা করা যেত। তবে ওই দরজাটা বন্ধ থাকলে সামনের দিকটা দেখতে অনেকটা লাগত অ্যাপার্টমেন্টের মতো, আজকাল মানুষ যেমন বানায় আর কী, যেখানে ভালোমতো হাঁটাচলার জায়গাও থাকে না। ইরিন আর আমি থাকতাম বাড়িটার সামনের দিকের অংশে। পরিষ্কার করা ছাড়া করিডোরের শেষ মাথায় ওকের দরজাটা খুলে বাড়ির পেছনের অংশে আমাদের তেমন যাওয়াই হতো না। জিনিসপত্রের ওপরে প্রতিদিন যে পরিমাণ ধূলা পড়ে থাকত তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। বুয়েনস আয়ারস যদিও খুব পরিষ্কার শহর কিন্তু মানুষ যেহেতু বেশি তাই ধূলা হবারই কথা। বাতাসে বরাবর প্রচুর ধূলা উড়ে বেড়াত আর সামান্য বাতাস বয়ে গেলেই উপরে মার্বেল বসানো দেয়ালে ঠেকানো সরু টেবিলগুলোতে, কিংবা চামড়া কেটে হীরার নকশার মতো করে বসানো গান বাজানোর যন্ত্রগুলোয় পুরু হয়ে পড়ে থাকত। পালকের একটা ঝাড়—দিয়ে ওসব পরিষ্কার করা বলতে গেলে ছিল বিরাট ঝক্কি। ধুলোর কণাগুলো তখন উড়ে যেত ঠিকই কিন্তু সামান্য পরেই বাতাসে ঝুলে ঝুলে দুলে দুলে পিয়ানো আর অন্যান্য আসবাবের ওপরে আবারও স্তর হয়ে পড়ে থাকত।

আর এই সমস্ত বাদ দিলে, সেদিনের সেই ঘটনাটার কথা আমার স্মৃতিতে খুব স্পষ্ট কারণ সেটা এত দ্রুত আর এমন অবলীলায় হয়ে গিয়েছিল যে ভোলা সম্ভব না। ইরিন তার শোবার ঘরে বসে উল বুনছিল, রাত তখন আটটা বাজে। আমার হঠাৎ মেইট পানীয়টা বানানোর জন্য গরম পানি উপরে আনার কথা মনে হলো। নিচের করিডোরটা ধরে ওক কাঠের দরজা পর্যন্ত চলে গেলাম। দরজাটা ভেজানো ছিল, তারপর হলের ভিতরে ঢুকে রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগলাম। আর তখনই আমি লাইব্রেরি কিংবা খাবার ঘরের দিক থেকে কিছু একটা শুনতে পেলাম। শব্দটা আছে কি নেই ধরা যাচ্ছিল না। আবার চট করে অন্য শব্দ থেকে আলাদাও করা যাচ্ছিল না। একটা চেয়ার কার্পেটের ওপরে উলটে পড়ে গেল নাকি গুনগুন করে একই লয়ে কেউ কিছু কথা বলল, কিছুই স্পষ্ট নয়। একই সময়ে, কিংবা মাত্র এক সেকেন্ড আগে-পরে আমি করিডোরের এদিককার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে, যেখান থেকে দুদিকে দুটো শোবার ঘরের দরজা, ঠিক সেখান থেকে শব্দটা শুনতে পেলাম। দেরি হয়ে যাবার আগেই আমি ছুটে গিয়ে তাড়াতাড়ি ওকের দরজাটা চেপে ধরলাম, তারপর আটকে দিলাম। আমার শরীরের পুরোটা ওজন নিয়ে দরজাটার ওপরে চাপ দিয়ে রাখলাম। ভাগ্য ভালো দরজার চাবিটা আমাদের দিকেই ছিল। আরো বেশি নিরাপদ থাকার জন্য ঠিক তখনই দরজার বড়ো খিলটা দ্রুত জায়গামতো বসিয়ে দিলাম।

আমি নিচের করিডোর ধরে রান্নাঘরে গেলাম। কেতলিতে পানি চড়ালাম। আর যখন গরম পানি দিয়ে মেইট বানিয়ে ট্রে-তে নিয়ে ফিরছি, ইরিনকে বললাম, “ওদিকের করিডোরের দরজাটা আমাকে আটকে দিতে হলো। ওরা আমাদের বাড়ির পেছনের অংশটা দখল করে ফেলেছে।”
তার হাত থেকে উল আর কাটা ধুপ করে পড়ে গেল। ক্লান্ত আর চিন্তিত চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।
“সত্যি বলছো?”
আমি উপর-নিচ মাথা নাড়লাম।
“তাহলে তো,” বলতে বলতে সে তার কোল থেকে কাঁটাদুটো আবারও হাতে তুলে নিল, ‘মানে, এখন থেকে তাহলে আমাদেরকে কেবল এই দিকটাতেই থাকতে হবে।”

গরম মেইটে আমি সাবধানে চুমুক দিলাম। তবে ইরিনের আবারও উল বোনা শুরু করতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। আমার মনে আছে সে তখন ছাইরঙা হাফ হাতা একটা সোয়েটার বুনছিল। ওই সোয়েটারটা আমার খুব প্রিয় ছিল।
* * *
প্রথম কয়েকটা দিন আমাদের বেশ অসুবিধা হয়েছিল, কারণ, বাড়ির বন্ধ করে রাখা দিকটায় আমাদের দুজনেরই কিছু জিনিসপত্র রয়ে গিয়েছিল যে দিকটা ওরা দখল করে ফেলেছে। যেমন, আমার ফ্রেঞ্চ সাহিত্যের ভাণ্ডার তখনও ওদিকের লাইব্রেরিতে পড়ে ছিল। ইরিনের দরকারি কিছু কাগজপত্র আর তার খুব প্রিয় একজোড়া বাড়িতে পরার স্যান্ডেল যা সে শীতকালে সবসময় পরে থাকত। আমি আমার তামাক খাওয়ার পাইপটার অভাব বোধ করছিলাম, আর ইরিন সম্ভবত লেবু আর কমলায় ঠাসা একটা ক্রিস্টালের বোতলের জন্য মন খারাপ করে ছিল। বলতে গেলে প্রায়ই এটা-সেটা নিয়ে আমাদের আফসোস লেগেই থাকত। (তবে সেটা ওই প্রথম কয়েক দিনের জন্যই।) দেখা যেত আমরা প্রায়ই কোনো না কোনো ড্রয়ার বা আলমারি খুলছি আর একে অন্যের দিকে দুঃখী দুঃখী চেহারা করে দু’একবার তাকাচ্ছি।
“উফ্, ওটা এখানে নেই!”

তার মানে যা যা হারিয়েছে বলে ভাবছিলাম তার সঙ্গে আরো একটা কিছু যোগ হলো।

তবে তাতে কিছু সুবিধাও হয়েছিল। বাড়ি পরিষ্কার করার কাজ এতটাই কমে গিয়েছিল যে আমরা যদি বেশ দেরি করেও ঘুম থেকে উঠি, ধরা যাক, সাড়ে নয়টা, তখন শুরু করে হেলে দুলে পরিষ্কার করলেও এগারোটা নাগাদ আমাদের কাজকর্ম শেষ। তারপর দেখা যেত আমরা দুজনেই হাত গুটিয়ে বসে আছি। দুপুরের খাবার বানানোর সময়ে ইরিন আমাকে সাহায্য করার জন্য রান্নাঘরে আসত। আমরা নিজেরাই আলাপ করে ওটা ঠিক করেছিলাম যে আমি যখন দুপুরের খাবার রাঁধব তখন ইরিন একই সময়ে রাতের জন্য কিছু খাবার বানিয়ে ফেলবে, যে খাবার রাতে আমরা ঠান্ডাই খেয়ে ফেলতে পারি। এই ব্যবস্থায় আমরা দুজনেই বেশ স্বস্তি পেয়েছিলাম, কারণ সন্ধেবেলা রাতের রান্নার ঝামেলা আর সে কারণে শোবার ঘর থেকে আরেকবার বেরোনো আমাদের কারোরই ভালো লাগত না। তাই ইরিনের শোবার ঘরে একটা টেবিলেই আমরা রাতের ঠান্ডা খাবারের আয়োজনটা সেরে নিতাম।

এই নিয়মে যেহেতু ইরিন উল বোনার জন্য আরো কিছু বাড়তি সময় পেত তাই সে খুশিই হয়েছিল। আমি অবশ্য আমার বইগুলোর অভাবে ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছিলাম কিন্তু তাই বলে সেটা মনে করিয়ে আমার বোনের কষ্ট বাড়াতে চাইনি। আমি তখন বসে বসে বাবার সংগ্রহ করা ডাকটিকেটের অ্যালবামগুলো দেখতাম। এই কাজে বেশ খানিকটা সময় চলে যেত। আমরা নিজেদেরকে যতটুকু পারা যায় আনন্দে রাখতাম। নিজেদের কাছে তৃপ্ত হবার মতো সামান্য যা ছিল, তাই দিয়েই খুশি থাকতাম আমরা। বেশিরভাগ সময় ইরিনের শোবার ঘরেই কেটে যেত। ওই ঘরটাই ছিল বেশি আরামদায়ক। খানিক পরে পরে ইরিন হয়তো বলত, ‘দেখ দেখ, এই নতুন নকশাটা দেখতে তিন পাতাওলা গাছটার মতো না?’

তার কিছু পরে হয়তো আমি শুরু করতাম, বর্গক্ষেত্রাকার কোনো একটা কাগজ তার সামনে মেলে ধরতাম, তাকে অসাধারণ কিছু ডাকটিকেট দেখাতাম। সে যেন বুঝতে পারে সেগুলো কত অসামান্য কিংবা দেখে অবাক হয় যে ইউপেন-ইটি-মালমেজির একটা ডাকটিকেট কত চমৎকার হতে পারে। আমরা আসলে ভালোই ছিলাম। আর ধীরে ধীরে আমরা ভাবতেও ভুলে যাচ্ছিলাম। মানুষ ভাবনা-চিন্তা ছাড়াও বেশ থাকতে পারে।

(ইরিন যখনই ঘুমের মধ্যে কথা বলত, আমি সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠতাম। তারপর আর ঘুমাতাম না। আমি কেন যেন কখনোই ওরকম আওয়াজ যা কোনো মূর্তি বা কাকাতুয়ার গলা থেকে বেরিয়ে আসে কিংবা কোনো স্বপ্নের আলাপন যা কল্পনার অবদান, যা হয়তো ঠিক কণ্ঠ থেকে ইচ্ছাকৃত তৈরি করা আওয়াজ নয়, তার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি। ইরিন বলেছিল আমি নাকি ঘুমের মধ্যে নিজেকে প্রচণ্ড ঝাঁকাই আর মাঝেমধ্যে শরীর থেকে কম্বলও ছুঁড়ে ফেলে দিই। আমাদের দুজনের শোবার ঘরের মাঝখান দিয়ে বিস্তৃত বসার ঘরটা বয়ে যায় কিন্তু রাতের নির্জনতায় এক ঘরের শব্দ আরেক ঘরে স্পষ্ট শোনা যায়। আমরা একজন আরেকজনের নিঃশ্বাসের বা কাশির শব্দ তো পেতামই, এমনকি কখনো বাতির সুইচের দিকে নিঃশব্দ হাত বাড়ানোর আকুতিও টের পেতাম। আর সেসব শব্দে ঘুম ভাঙলে তারপর যা হতো, আমাদের মধ্যে কেউই আর ঘুমাতে পারতাম না।

রাতে আমাদের দুজনের নিশাচরের মতো উশখুশ করার শব্দ ছাড়া বাকি বাড়িটা ছিল একেবারেই চুপচাপ। দিনের বেলা অবশ্য বাড়ির কাজকর্মের নানানরকম আওয়াজ শোনা যেত। শোনা যেত ধাতব উল বোনার কাঁটার একটার সঙ্গে আরেকটা টোকার শব্দ, আর শোনা যেত ডাকটিকেটের অ্যালবামের পাতা ওলটানোর ফরফর আওয়াজ। বাড়ির ওই ওক কাঠের দরজাটা যে বিশাল ছিল তা হয়তো আমি আগেই বলেছি। রান্নাঘর আর ঘোসলের ঘর, যে দুটো আমাদের বাড়ির দখলকৃত অংশের ঠিক পাশে সেখানে আমরা বেশ উঁচু স্বরে কথা বলতাম। ইরিন মাঝেমাঝে সেখানে গুনগুনিয়ে গানও গাইত। রান্নাঘরে বরাবর জোরে শব্দ হতে থাকত, গ্লাসের শব্দ, থালা-বাটির শব্দ, সামান্য বিরতিতে সেখানে শোরগোল লেগেই থাকত। রান্নাঘরে থাকলে আমরা কখনোই তেমন চুপচাপ থাকতাম না। কিন্তু ওখানকার কাজ শেষে আমরা যখন শোবার ঘরে চলে আসতাম কিংবা বসার ঘরে কিছুক্ষণ সময় কাটাতাম, বাড়িটা তখন একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যেত। কখনো অল্পস্বল্প মাতাল হলে আমরা বুঝেশুনে আরো সাবধানে পা ফেলতাম যেন একে অন্যের বিরক্তির কারণ হয়ে না দাঁড়াই। আমার মনে হয় আমি এতটা সাবধান হয়ে চলতাম তার কারণ ইরিন যখন ঘুমের মধ্যে কথা বলা শুরু করত আমার ঘুম অবধারিতভাবে ভাঙত আর আমার খারাপ লাগত।)

সামান্য আগুপিছু ছাড়া বাকি সমস্তকিছুই আসলে দিনের পর দিন ছিল একই কাজের পুনরাবৃত্তি। এক রাতে আমার খুব পিপাসা পেল। আর ঘুমানোর আগে আমি ইরিনকে বলেছিলাম যে এক গ্লাস পানির জন্য আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। ইরিন যথারীতি তখন উল বুনছিল। তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমি রান্নাঘরের দিক থেকে কিছু শব্দ শুনলাম। শব্দটা যদি রান্নাঘরে না হয়ে থাকে তবে নিশ্চয় গোসলের ঘরে। রান্নাঘর আর গোসলের ঘরের মাঝখান থেকে আসা লম্বা করিডোরটা শব্দটাকে ধীরে ধীরে ক্ষীণ করে দিচ্ছিল। ইরিন লক্ষ করেছিল যে সেদিকে এগোতে গিয়েই কেমন হুট করে আমি থেমে গিয়েছিলাম। তাই উল রেখে কোনো কথা না বলে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমরা দুজন স্তব্ধ দাঁড়িয়ে শব্দ শুনতে লাগলাম। শব্দের তীব্রতা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। শুনতে শুনতে আমরা নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে তারা ওক কাঠের ভারী দরজাটা পেরিয়ে আমাদের এদিকটাতে এসে পড়েছে। হয় রান্নাঘরে, না হলে গোসলখানায় নিশ্চিতভাবে আস্তানা গেড়েছে। আর সেসবের কোনোটাতে না হলে তার পাশের বড়ো হল রুমে, যেটা বলতে গেলে আমাদের শোবার ঘরের পরপরই।

একজন আরেকজনের দিকে তাকানোর জন্য আমরা আর এতটুকু সময় ব্যয় করিনি। আমি ইরিনের হাতটা টেনে ধরে তাকে আমার সঙ্গে দৌড়োতে বাধ্য করলাম। রট আয়রনের দরজা পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার আগপর্যন্ত আমরা আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। তখনও আমাদের ঠিক পেছনে গুনগুনানো আওয়াজটা শোনা যাচ্ছিল, ধীরে ধীরে সেটা তীব্র চিৎকারে পরিণত হচ্ছিল। দরজাটা আমি চেপে আটকে দিলাম আর বাইরের লবিতে এসে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে আর কিছু শুনতে পাওয়া গেল না।

“আমাদের এদিকটাও ওরা নিয়ে নিল!” ইরিন বলল। তার হাতে ধরে রাখা উলের বোনা অংশের মাথা থেকে উল চলে গেছে দরজার নিচে দিয়ে অদৃশ্য উৎসের দিকে। সে যখন বুঝতে পারল যে উলের গোল্লাটা দরজার ভিতরের দিকে, বোনা অংশের দিকে দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে সে সেটা মাটিতে ছুঁড়ে দিলো।
হতাশাগ্রস্ত গলায় আমি জানতে চাইলাম, “তুমি কি সঙ্গে কিছু আনতে পেরেছিলে?”
“নাহ্, কিছুই আনিনি।”

আমাদের কাছে নিজেদের হাত-পা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। শোবার ঘরের আলমারির মধ্যে রাখা পনের হাজার পেসোর কথা আমার তখন হুট করে মনে পড়ে গেল।

আমার হাতে অবশ্য ঘড়িটা ছিল আর তাকিয়ে দেখলাম তাতে এগারোটা বাজে। আমি ইরিনের কোমর জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম (আমার মনে হয় সে তখন কাঁদছিল) আর ওভাবেই আমরা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বাড়িটা থেকে বেরিয়ে যাবার আগমুহূর্তে আমার ভয়ানক খারাপ লাগছিল। বাইরের বিশাল দরজাটায় তালা লাগিয়ে চাবিটা ম্যানহোলে ফেলে দিলাম। আমি কিছুতেই চাইনি যে ফালতু কোনো বদমাশ বাসাটার মধ্যে ঢুকে আমাদের প্রিয় জিনিসগুলো চুরি করে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে। তবে ঠিক ওই মুহূর্তে আস্ত বাড়িটা আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

হুলিও কোর্তাসার

হুলিও ফ্লোরেন্সিও কোর্তাসার (২৬ আগস্ট, ১৯১৪-১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪) লাতিন সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, কবি ও প্রাবন্ধিক। সাহিত্যের জগতে তিনি হুলিও কোর্তাসার নামে পরিচিত। আর্জেন্টিনার নাগরিক হলেও লেখার মাধ্যমে সমগ্র আমেরিকা ও ইউরোপের স্প্যানিশ ভাষাভাষী পাঠক তথা লেখকের ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কোর্তাসারকে লাতিন আমেরিকান জাগরণের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। তার বহু সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য— হপস্কচ (উপন্যাস), ব্লো আপ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ (গল্প), উই লাভ গ্লেন্ডা সো মাচ অ্যান্ড আদার টেলস (গল্প)। গল্পের ক্ষেত্রে নতুন পথের দিশারী হওয়াতে কোর্তাসারকে বলা হয় ‘আধুনিক ছোটগল্পের রূপকার’।

কোর্তাসারের জন্ম ব্রাসেলসে। যুদ্ধের পরে তার পরিবার আর্জেন্টিনায় ফিরে এসেছিল বলে তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে বুয়েনস আয়ারসের অদূরে ব্যানফিল্ডে। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি স্কুল শিক্ষক ছিলেন। প্রথম দিকে প্রকাশিত গল্পগুলোর মধ্যে ‘বেদখল বাড়ি’ অন্যতম যা তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন বলে পরে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে হোর্হে লুই বোর্হেসের সম্পাদনায় গল্পটি পত্রিকায় ছাপানো হয়। পরবর্তী কালে হুলিও কোর্তাসার ক্রমাগত গল্প উপন্যাস লিখে যেতে থাকেন এবং একাধারে ইউনেসকোর অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘হপস্কচ’ বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে তার নাম প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।

১৯৫১ সাল থেকে হুলিও কোর্তাসার প্যারিস এবং তার আশেপাশের এলাকায় বসবাস করেন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায়ই আর্জেন্টিনায় গিয়ে সময় কাটাতেন। কিন্তু ১৯৭০ সালে আর্জেন্টিনার তৎকালীন সরকার নিজ ভূমিতে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। হুলিও কোর্তাসার ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ সালে ৬৯ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;