আমাদের ঘরের টিনের নিচ্ছিদ্র বেড়ায় কোথাও কোথাও কাঁটাতারের ছিদ্র ছিল। ফলে বন্ধ ঘরে সেইসব ছিদ্র গলিয়ে পুব আকাশের ভোরের অনেকগুলো দীর্ঘ রশ্মি আমার ঘরে এসে পড়ত। অনেকগুলো আলোর রশ্মির তীরের মতো দীর্ঘ ফলা ভেসে উঠল অতিবেগুনী রশ্মির আলোর উপাদান। আলোর রশ্মির সাথে যেন ঘরময় বেজে উঠত সেতারের মিষ্টি মধুর সুরধ্বনি। আর তার সাথে সাথেই আলোর রশ্মিতে দেখা নৃত্যরত ক্ষুদ্রতর কণা। বিছানায় উপুড় হয়ে অন্ধকার ঘরে বালিশে থুতনি দিয়ে আমি এইসকল ক্ষুদ্রতম কণার নৃত্যরত উল্লাস দেখতাম। যা কোনোভাবেই খালি চোখে দেখা যায় না। আপাত আলোর ধাঁধিয়ে যাওয়া রোশনিতে যাদের অস্তিত্ব আমাদের কাছে গণ্য হয় না। অন্ধকার ঘরের বেড়ার কাঁটাতারের ফাঁক গলিয়ে আলোর রেখায় নেচে ওঠা সেই ক্ষুদ্রতম কণাই আমার অপলক তাকিয়ে থাকা চোখে বিস্ময় জাগিয়ে দেয়। কী নাম এইসব ক্ষুদ্রতম কণার?
অনেক পরে শিল্পী মুর্তজা বশীরের কল্যাণে জেনেছি বাংলায় এগুলোকে ত্রসরেণু বলে। ত্রসরেণু নামে তাঁর একখানি কবিতার বই আছে। ঠিক তখন থেকেই মুর্তজা বশীর আমার কাছে এক বিস্ময়। এই বিস্ময়ের যেন শেষ নেই। বাঙালির অহংকার করার মতো মনীষী পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-র ছেলে হয়েও নামের শেষে তিনি পিতার উল্লাহ্ পদবি ছেটে ফেলে দিয়ে নিজে নাম রেখেছেন মুর্তজা বশীর। তাঁর মা তাঁকে একবার এ নিয়ে ভর্ৎসনা করেছিলেন, ‘তোমার কত বড় কলিজা, পিতার নামের পদবিকে ছেটে ফেলে দিয়েছো! কত বড় বেয়াদব তুমি!’ ছোট্ট করে মুর্তজা বশীর বলেছিলেন, ‘আমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ -র ছেলে এটা ঠিক আছে। কিন্তু মানুষ আমাকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-র ছেলে হিসেবে গণ্য করবে, এটা আমি চাই না। আমি চাই আমার নামে পরিচিত হতে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যেমন একটা অধ্যায়। মুর্তজা বশীরও আরেকটি অধ্যায় হিসেবে আমি প্রতিষ্ঠা করতে চাই।’ এক জীবনে কত কী করেছেন মুর্তজা বশীর। কবিতা লিখেছেন। গল্প উপন্যাস লিখেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। বন্ধুদের কাব্য আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙার মিছিলে পুলিশের লাঠির আঘাতে মুর্তজার মাথা ফেটে গিয়েছিল। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আঘাতপ্রাপ্ত ছেলের রক্তঝরা মাথা নিজের গলার রুমাল দিয়ে বেন্ডেজ করে দিয়েছিলেন। ছেলের কপালে চুমো দিয়ে দোয়া করেছিলেন গর্বিত পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্।
মুর্তজা বশীরের আঁকা কিছু কিছু স্কেচ অনবদ্য। পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সাহেবকে বহুভাবে তিনি স্বল্পতম রেখায় শিল্পীত করে এঁকেছেন। আরেকটি স্কেচের কথা আজ বলি। আমাদের দেশের প্রখ্যাত কবি দিলওয়ারকে মুর্তজা বশীর এমনভাবে কয়েকটি রেখার সমন্বয়ে এঁকেছিলেন যে, স্কেচটিতে দিলওয়ার নামের সঙ্গে ফুটে উঠেছিল কবির শিল্পীত অবয়ব। অর্থাৎ স্কেচটি পাঠ করলে হবে দিলওয়ার আবার তাকালে দেখা যাবে কবি দিলওয়ারের অবয়ব।
মনে পড়ে ১৯৯৪ সালে ঢাকার সেন্ট্রাল রোডে যোজন আর্ট গ্যালারিতে শিল্পী ও লেখক সৈয়দ ইকবালের প্রথম চিত্র প্রদর্শনীতে শিল্পী মুর্তজা বশীরকে দেখেছিলাম। শিল্পী মুর্তজা বশীরকে এত কাছে থেকে জীবনে সেই একবারই দেখেছিলাম।
মুর্তজা বশীরও আগস্টের করাল গ্রাস নক্ষত্র প্রতিম বাঙালিদের মৃত্যুর মাসে চলে গিয়েছেন। যে জীবনকে মুর্তজা বশীর যাপন করেছেন, তা বাঙালি হয়েও ছিল বিশ্বনাগরিকের। না, তা সাহেবিয়ানায় নয়। বরং শিল্প সৃষ্টির কাজের প্রকরণকে তিনি আধুনিক শিল্পধারার সাথে সমান্তরালভাবে চর্চা করেছেন।
আমার ঘরে বেড়ার কাঁটাতারের ছিদ্র গলে সূর্য ওঠা ভোরের আলোর রশ্মিতে বহুবর্ণ রেখায় ভেসে চলেছিল হাজার হাজার ক্ষুদ্রতম কণা। বিজ্ঞান বলে এক মহাজাগতিক মহাবিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি হয় এই মহা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। মহাবিস্ফোরণে সৃষ্ট ধুলিকণা এখনো উড়ে বেড়াচ্ছে মহাবিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। সেই ক্ষুদ্রতম ধূলিকণার স্বজনেরা আমার ঘরে কাঁটাতারের ছিদ্র দিয়ে আশা আলোর রশ্মিতে উড়ে উড়ে নৃত্য করেছে। মুর্তজা বশীর আমাকে জানিয়েছেন এগুলো ত্রসরেণু। আজ তিনি চলে গেলেও ত্রসরেণুর সঙ্গে তিনি থাকবেন আমারই চারপাশে আলোর রশ্মির সাথে ভেসে ভেসে।