বাংলাদেশের বৈশাখি মেলা

  ‘এসো হে বৈশাখ’
  • সাইমন জাকারিয়া
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

বাংলাদেশ হাজারো মেলার দেশ। এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রাম-শহর জুড়ে প্রতি বছর এখনও প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত প্রতিটি মেলা আয়োজনের পিছনে কোনো না কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। সেটি হয় ধর্মীয়, নয় ব্রত-পালা-পার্বন অথবা যে কোনো একটি নির্ধারিত বিষয় বা ঐতিহ্যকে স্মরণ করে।

মেলার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে- নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত তারিখ বা তিথি-লগ্নে এক একটি মেলাতে নর-নারী, শিশু-কিশোর এমনকি আবাল বৃদ্ধরাও সমাগম ও সমাবেশ করে থাকে। উল্লেখ্য, একটি জায়গায় অনেক লোকের সমাবেশ ও সমাগম মানেই সাধারণ বাংলা অর্থে মেলা বলা হয়। তবে, মেলার বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে- ব্যবহার্য পণ্য ও গৃহ সামগ্রীর বিরাট সমাবেশ এবং চিত্তবিনোদনের জন্যে যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ ইত্যাদির আসর।

বিজ্ঞাপন

আধুনিক এই যুগের খেয়ালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাসমূহ এখন অনেকটাই তার চরিত্র বদলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এরমাঝে তাকে নানা উত্থানপতন ও অবক্ষয়ের ধকল সইতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের মেলাগুলো কিছুতেই তার ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে পুরোপুরি যেতে নারাজ। বাংলাদেশের মেলাগুলো এখন আগের সনাতন চেহারা থেকে রূপান্তরিত হয়ে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও অতিমারি কালে বাংলাদেশের বহু ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির মতো মেলাগুলোও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি। তবে, মানুষের জীবিকার চাহিদা ও মননশীল মনের তাগিদে ঐতিহ্যগত মেলাগুলো আয়োজনে সাময়িক বাধাপ্রাপ্ত হলেও কোভিড-১৯ উত্তরকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যগত মেলাগুলো আবার আগের মতো অনুষ্ঠিত হতে শুরু করেছে।

বিজ্ঞাপন

উল্লেখ্য, এদেশের প্রচলিত মেলাগুলির প্রকৃতি বহুবিধ ধরনের। এক বাক্যে তার প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণী করণ দুঃসাধ্য। আলোচনার সুবিধার্থে এখানে এদেশে প্রচলিত মেলাগুলির একটি সরল শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশের মেলা প্রায় সর্বাংশই ছিল গ্রামকেন্দ্রিক, যুগের পরিবর্তনে ধীরে ধীরে সেই চিত্র পাল্টে গিয়ে এদেশের মেলা বর্তমানে গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই ছড়িয়ে পড়েছে।

চারিত্র্য বিচারে এদেশে প্রচলিত মেলাসমূহকে মোটামুটি সাতটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যেতে পারে, যথা- ১. ধর্মীয় উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ২. কৃষি উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ৩. ঋতুভিত্তিক মেলা, ৪. সাধু-সন্তের ওরশ উপলক্ষে ফকিরী মেলা ৫. জাতীয় জীবনের বিভিন্ন বরেণ্য ব্যক্তি যেমন, কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ইত্যাদির স্মরণোৎসব উপলক্ষে স্মারক মেলা, ৬. জাতীয় দিবসসমূহ উদ্যাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃৃতিক মেলা, ৭. বাণিজ্যিক সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় মেলা। উল্লেখ্য, যেসকল মেলার ঐতিহ্য বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচলিত আছে এই শ্রেণীবিন্যাসে কেবল সেসকল মেলাগুলিকেই বিবেচনায় আনা হয়েছে। তবে, ভিন্ন বিবেচনায় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মেলাসমূহের এমন সরলকৃত শ্রেণীবিভাগকে যে কেউ নতুনভাবেও পুনর্বিন্যস্ত করতে পারেন।

এক

উপলক্ষই বাংলাদেশের মেলা উদ্যাপনের স্বাভাবিক উৎস কথা। কিন্তু উপলক্ষ যা-ই থাকুক বাংলাদেশের মেলার একটা সার্বজনীন রূপ কিন্তু আছেই। এদেশের মেলায় অংশগ্রহণে সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিন্নতা কোনো দিনই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বাংলাদেশের সবগুলো মেলাই আর্থ-সাংস্কৃৃতিক বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে মানুষের মধ্যে মিলন কথাকেই প্রকাশ করে থাকে। সে কারণে এদেশের মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল ধর্ম ও শ্রেণীর মানুষের আনাগোনা ঘটে। অতএব, বাংলাদেশের মেলা মানে মৈত্রী সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র। নারী-পুরুষ, শিশু -কিশোর সকলেই আসে এই মেলাতে।

এখানে সকলের অভিন্ন আকাক্সক্ষা একটিই, আর তা হলো- মেলা বা আড়ৎ দেখা। যার সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে আরেকটি বিষয় জড়িয়ে থাকে, তা হচ্ছে-বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। মেলাতে গাঁয়ের বধুর ঝোঁক থাকে আলতা-সিঁদুর-স্নো-পাউডার-সাবান আর ঘর-গৃহস্থালির টুকিটাকি সামগ্রীর প্রতি। আরেকটি আকর্ষণ থাকে বিনোদনের প্রতি, আর তা হচ্ছে- যাত্রা, পুতুল নাচ বা সার্কাস প্রদর্শনী দেখা।

তবে, শিশু-কিশোরদের টান থাকে মূলত খেলনার দিকে, যেমন- মাটির পুতুল, কাঠের ঘোড়া, টিনের জাহাজ। শিশু-কিশোরদের আরেক আকর্ষণের বস্তু হচ্ছে- খই, বাতাসা, রসগোল্লা, চমচম, কদমা, খাগড়াই, মুড়ি-মুড়কি, জিলিপি আর দানাদার। তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের খেলনা বাঁশির কথাও বলা যায়। মেলার প্রাঙ্গণে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু-কিশোরই বাঁশি কিনে থাকে।

বাংলাদেশের মেলার একটি দিকে থাকে অনিবার্যভাবেই বিনোদনের ব্যবস্থা। যেমন- নাগরদোলা, পুতুলনাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, যাত্রা, বাউল-ফকির বা কবি গান, বায়োস্কোপ, লাঠিখেলা, কুস্তি, জারিগান ইত্যাদি। কিছু কিছু মেলাকে মাতিয়ে রাখে সঙ-এর কৌতুক ও মশকরা, তারা স্বাধীনভাবে মেলাতে ঘুরে ঘুরে রঙ্গ করে থাকে। এছাড়া, মেলায় বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাড়ি-মদ আর জুয়ার আসর বসে থাকে। নেশায় এমন ডুবে এবং জুয়ার খেলায় সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে অনেকেই। এটা বাংলাদেশের মেলার একটি প্রাত্যহিক চিত্র।

তবে, বাংলাদেশে বর্তমানে চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। এদেশের মেলায় এখন হর-হামেশাই মাইকে বা সাউন্ড বক্সে উচ্চ আওয়াজে গান বাজে। মেলায় পসরা সাজিয়ে বসা দোকানে দোকানে এখন মোবাইল বা ল্যাপটপের মাধ্যমে ইউটিউব থেকে পছন্দমতো গান বেছে নিয়ে তা সাউন্ডবক্সে বাজানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো করা হয়।

সময় বদলের সঙ্গে এদেশের মেলার চিত্র-চরিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ মেলার রূপ ও মেজাজ অনেকখানিই বদলে গেছে। সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষে এইদেশে যে সকল মেলার আয়োজন হতো তার মধ্যে অনেক মেলার আয়োজন এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এবং অনেক মেলা এখন বিলুপ্তির পথে, কিছু মেলা এরই মাঝে রূপান্তরিত হয়ে নতুন রূপ গ্রহণ করে বেঁচে আছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামীণ মেলাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এদেশের গ্রামীণ মেলার স্বাভাবিক ও সাধারণ চিত্র কুটির শিল্পজাত গ্রামীণ পণ্যের বদলে দেশী-বিদেশী চোখ ধাঁধানো বাহারি পণ্যের জৌলূস ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি চ্যানেলে প্রচলিত কাটুনের চরিত্রের মুখ ও নকশা এখন প্লাস্টিক ও বাতাস দিয়ে ফোলানো বেলুনের উপর শহর থেকে গ্রামের মেলায় বাতাসে উড়তে দেখা যায়। বিশেষ করে জনপ্রিয় কাটুন চরিত্র মটু-পাতলু সারা বাংলাদেশের মেলাগুলোতে প্রত্যক্ষ করা যায়। এগুলোই এখন শিশুদের প্রধান আকর্ষণের বস্তু হয়ে গেছে।

এদেশের বহু নাগরিক প্রয়াসের সঙ্গেই বাংলায় প্রচলিত মেলার লৌকিক ধারা এসে মিশেছে। যেমন- বৈশাখীমেলা, ঈদমেলা, বইমেলা, বিজয় মেলা ইত্যাদি মূলত এদেশে প্রচলিত মেলার লোকধারার প্রেরণা নিয়ে নতুন আঙ্গিক ও মাত্রায় আজ নগরজীবনে প্রতিষ্ঠিত এবং তা এর মধ্যেই ঐতিহ্যে পরিণতি লাভ করেছে। এমত ধারায় সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে বিজয়মালা, যা যথার্থ অর্থেই ‘ঐতিহ্য ও আধুনিক চেতনার.. অপূর্ব সমন্বয়’।

দুই

বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর শুরু উপলক্ষে এখানে এদেশের বৈশাখি মেলার অতীত ও বর্তমান চালচিত্র সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই।
বৈশাখ হচ্ছে বাংলা সনের প্রথম মাস। ঐতিহাসিকদের তথ্যমতে, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল থেকে যখন বাংলা সনের গণনা শুরু হয় তখন বছর সূচনার মাস হিসেবে বৈশাখকেই প্রথমে রাখা হয়। অনেকের ধারণা, সম্ভবত তখন থেকেই নববর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে বৈশাখী মেলার সূচনা। বৈশাখী মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এ মেলা ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাঙালির মেলা।

বৈশাখি মেলার অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যকে কোনো দিনই কোনো ধর্মের গোঁড়ামী খর্ব করতে পারেনি। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এই বৈশাখী মেলারও রয়েছে অন্যান্য মেলার মতো দুটো দিক। একটি বাণিজ্যিক আর একটি সাংস্কৃতিক। বাংলার ব্যবসায়ীরা চৈত্রের শেষ দিন বা ‘চৈত্রসংক্রান্তি’তে এবং বৈশাখের প্রথম দিনে ‘হালখাতা’ করে থাকে। আসলে ‘চৈত্রসংক্রান্তি’র দিনটা পালন করে বাংলাদেশের মানুষেরা পুরনো বছরকে বিদায় দেওয়ার উৎসব করে থাকে।

এতে মেলা, গান-বাজনা ও খাওয়া-দাওয়ার মধ্য দিয়ে এক আনন্দঘন পরিবেশে বাংলার একটা বছর বিদায় নেয় এবং নতুন একটা বছরের সূচনা হয়। এই দেশে তাই বৈশাখি মেলার সূচনা হয় বৈশাখের আগে থেকেই মানে চৈত্রের শেষ দিক থেকে। তবে, বৈশাখের প্রথম দিনটিই আসলে উৎসবের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সবাই পরিষ্কার ও সুন্দর জামা-কাপড় পরে। ঘরে ঘরে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। আর ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ছোটে মেলাতে।

বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে কৃষক, কামার, কুমোর, তাঁতি, ময়রা এবং অন্যান্য শিল্পী-কারিগরেরা যে সব সামগ্রী তৈরি করে, বৈশাখী মেলায় তা প্রদর্শন ও বিক্রি করার সুযোগ এনে দেয়। গ্রামীণ কৃষিজাত পণ্য, মিষ্টান্ন দ্রব্য, কুটির শিল্পজাত পণ্য, মাটি ও বেতের তৈরি শিল্পসামগ্রী প্রভৃতি নিয়ে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা দোকান সাজায় এই মেলায়। বাঁশ ও তালপাতার রঙিন বাঁশি, ভেঁপু, একতারা, দোতারা, ডুগডুগি, বেলুন, লাটিম, মার্বেল, ঘুড়ি-লাটাই, চরকি, পুতুল, মাটির ঘোড়া, কাঠের ঘোড়া, কাঠ, কাগজ ও বাঁশের পাখি, মাটির হাড়ি-বাসন, কলস, কাচের চুরি, পুঁতির মালা ইত্যাদি জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে ছোট ছোট দোকানিরা।

এছাড়া আছে কাঠের আসবাবপত্র, খাট, পালঙ্ক, চৌকি, চেয়ার-টেবিল, আলনা, আলমারি, ঢেঁকি, পিঁড়ি, গাড়ির চাকা প্রভৃতি। মেলায় আরও পাওয়া যায় পিতলের হাড়ি, কলস, বাসন-কোসন, লাঙল-জোয়াল, লোহার দা, বটি, কুড়–ল, খন্তা, কাচি, নিড়ানি, গরুর গলার ঘুঙুর। ময়রারা তৈরী করে নানা রকমের মিষ্টান্নদ্রব্যÑ কদমা, জিলিপি, বাতাসা, খাজা, ছাঁচের মিঠাই, খাগড়াই আরো কতো কি। বলে রাখা ভালো এসব মিষ্টান্নদ্রব্য মেলাতে আগেও যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে মেলার প্রচলিত রীতিকে ধরে। মুড়ি, মুড়কি, খই, চিড়ে, ছাচ খাজা, মোয়া, নারিকেলের নাড়–, বুট, চানাচুর, বাদাম ভাজা আর দিল্লির লাড্ডু, মটরভাজা, তিলের খাজা আজও মেলা আগত মানুষের প্রিয় খাবার।

বৈশাখি মেলার আরেক আকর্ষণ হচ্ছে তাঁতবস্ত্র। এই মেলাতে তাঁতিরা নিয়ে আসে নক্সীপাড়ের শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি, গামছা, বিছানের চাদর প্রভৃতি। মেলার একপাশে ছেলেমেয়েদের জন্য তৈরি জামা-কাপড়ও পাওয়া যায়। স্যাকরার দোকানে মেয়েরা ভীড় জমায় রূপা, তামা ও পিতলের গহনা কিনতে। বৈশাখী মেলায় গ্রামের কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের উন্নত জীবন গঠনের উপযোগী কিছু শিক্ষামূলক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকে।

এরমধ্যে রয়েছেÑ পশু প্রদর্শনী, চরকায় সুতা কাটা, গালার কারিগরি, গাছের চারা বা নার্সারি এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক প্রদর্শনী। গ্রামের মেয়েদের তৈরি নানাপ্রকার পাখা, মাদুর, কাঁথা, শিকে, বেত ও বাঁশের তৈরি হরেক রকম জিনিসপত্র সাজানো হয়। আর থাকে উন্নত ধরনের শাক-সবজি,উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, শস্যের বীজ প্রদর্শনী ও কেনার ব্যবস্থা।

যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মেলার যে রীতি ও ধরন আমাদের দেশে চালু রয়েছে, বৈশাখি মেলা তার সবটাই ধারণ করে আছে। যেমনÑ ১. বহু মানুষের সমাবেশ, ২. গানবাজনাসহ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, ৩. গ্রামীণ ব্যবহারিক শিল্পসামগ্রীর প্রদর্শনী ও বিক্রয়, ৪. বিভিন্ন রকমের খেলার আয়োজন।

মেলায় এসে মানুষ আনন্দের উপকরণ খোঁজে। তাই এখানে থাকে আনন্দলাভের নানা আয়োজন। পালাগান, বাউলগান, যাত্রা, কবিগান, গম্ভীরা, আলকাপ, জারিগান, পুতুলনাচ, সার্কাস প্রভৃতি বৈশাখি মেলার প্রধানতম সাংস্কৃতিক দিক। দেশজ খেলাধূলাও যে মানুষকে আনন্দ দিতে পারে তার প্রমাণ মেলে আমাদের বৈশাখি মেলায়। লাঠিখেলা, কুস্তি, হা-ডু-ডু, ঘুড়ি ওড়ানো, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড়, মোরগের লড়াই, বানেরর খেলা ইত্যাদি দেশজ মজার খেলা সবাইকে মাতিয়ে রাখে।

গ্রামই ছিল একসময় বৈশাখি মেলার প্রধান ক্ষেত্র। সাধারণত পথের তেমাথায়, তিন নদীর মিলনস্থানে, ফাঁকা মাঠে, কিংবা বিশাল অশ্বত্থ বা বট গাছের নিচে এই মেলা বসত। যেখানে নানান দিক থেকে অনেক লোক এসে জড়ো হতে পারত। কালক্রমে মেলার স্থান গ্রাম থেকে শহরে বি¯তৃত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

এখন তাই পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ সারাদেশের সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তবে, রাজধানী ঢাকা থাকে এই উৎসবের কেন্দ্রস্থলে। ছায়ানট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ঢাকায় নববর্ষের উৎসব উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা (বিসিক) বৈশাখি মেলার আয়োজন করে আসছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত বিসিকের বৈশাখি মেলা দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগিয়েছে। কয়েকটি লক্ষ্য সামনে রেখে বিসিক বৈশাখী মেলার আয়োজন করে, যেমন- ১. কুটির ও হস্তশিল্পজাত পন্যের বাজার সৃষ্টি,

২. গ্রামীণ কারুপণ্য শহুরে মানুষ ও বিদেশীদের সামনে তুলে ধরা, ৩. ক্রেতার চাহিদা সম্বন্ধে উৎপাদকদের অবহিত করা, ৪. কারুশিল্পীদের বিভিন্ন পণ্য, নক্সা ও নমুনার সঙ্গে মানুষের পরিচিতি ঘটানো। এবছর ঈদের ছুটির পর পরই পহেলা বৈশাখ পড়ে গেছে বিধায় বিসিক বৈশাখী মেলা ঈদের পর সুবিধাজনক সময়ে করবে বলে আশা করা যায়।

মনে রাখা দরকার, বৈশাখি মেলা কেবল একদিনেই শেষ হয় না। একদিন, তিনদিন, সাতদিন, পক্ষকাল, পুরো মাস আবার কোথাও-বা দুই মাসব্যাপীও বৈশাখি মেলা চলে। সারা বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই কোনো না কোনো স্থানে বৈশাখি মেলা বসে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, যশোর, বরিশালসহ আরো অনেক জেলায় পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে মাসব্যাপী বৈশাখি মেলা চলতে থাকে।

উত্তরবঙ্গের উল্লেখযোগ্য বৈশাখি মেলার মধ্যে দিনাজপুরের আমবাড়ির মেলা, বগুড়ার গাঙনগরমেলা, যশোরের নিশিনাথ তলার মেলা, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা-বিত্তিপাড়ার ঘোড়াপীরের মেলা এবং বরিশালের বাকালের মেলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ।

কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়ার চান্দনা গ্রামের বৈশাখি মেলা ছিল বিখ্যাত। এই মেলার আড়ম্বর, জাঁকজমক অন্যান্য মেলার চেয়ে বেশি হতো। এছাড়া, কুমিল্লা জেলার সিদলাই, কান্দুঘর, ময়নামতিসহ বিভিন্ন স্থানে বৈশাখি মেলার ঐতিহ্যের সুখ্যাতি রয়েছে। এ অঞ্চলে বৈশাখি মেলায় বিক্রির জন্য বাঁশের বাঁশি তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘর, গোকর্ণঘাট, নবীনগর, খড়মপুর প্রভৃতি স্থানে বৈশাখি মেলা বসে।

চট্টগ্রামে বৈশাখী মেলার অন্যতম পর্ব ‘জব্বারের বলীখেলা’। একদিনের এই বলীখেলা উপভোগ করতে সমবেত হয় অসংখ্য মানুষ। চৈত্রের শেষে চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা আয়োজন করে ‘মহামুনির মেলা’। এই মেলা বর্ষবরণেরই অংশ। চট্টগ্রামের আদিবাসী মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসব পরিচিত সাংগ্রাই, বিঝু বা বিষু নামে। এই উৎসব উপলক্ষেও মেলা জমে ওঠে।

বর্তমানে প্রচলিত বৈশাখিমেলার তালিকা প্রণয়ন ও তার সম্পূর্ণ বিবরণসহ আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্রে নথিভুক্ত করা জরুরি। ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিম-লে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এই বৈচিত্র্যময় রূপ তুলে ধরতে পারলে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের সময় এদেশে যেমন প্রচুর বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটতো, তেমনি নতুন প্রজন্ম বৈশাখি মেলার ঐতিহ্য সুরক্ষায় সচেতন হতো।

বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতো এবং বৈশাখি মেলায় অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা উদ্ধুদ্ধ হতেন ঐতিহ্যপ্রেমে। এমনকি এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির সাধনা বিস্তার ঘটতো এবং বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তো।

লেখক: বিশিষ্ট লোক-ঐতিহ্য গবেষক, নাট্যকার ও উপ-পরিচালক, সংস্কৃতি উপবিভাগ, বাংলা একাডেমি।