সুমন রহমানের গুচ্ছকবিতা

কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

সুমন রহমান | 2023-08-31 23:44:20

বিলবোর্ড-নিবাসিনী

চিরকাল দূরে থেকে-থেকে তুমি সুদূরের প্রণয়ভাগী হয়ে গেছো
চিত্রার্পিতা, বিলবোর্ড-নিবাসিনী, তোমার গমনোদ্যত পা
মুড়িয়ে দেয়ার জন্য আমি জমাচ্ছি আমার সকল অপরিণামদর্শিতা
সর্বব্যাপী প্রেমোক্র্যাসির ধোঁয়ায় তোমার যতোটুকু শ্বাসকষ্ট
আমি তার ততোধিক নীল নেবুলাইজার
তুমি আসছো মোরগের বিষ্ঠাভরা জংলা পার হয়ে
                             মিডিয়াগাছের ছায়াফাঁদ বাঁচিয়ে
আমার ডাকবাক্সের ধূলায়, আমার নিখিল বিজ্ঞাপনহীনতায়!

আমি তো তোমার অপলকময়তা দেখে-দেখে
                                  কাঁথামুড়ি দিয়ে পাশ ফিরতাম
নয়তো তোমার গল্পঘরের বারান্দায় বসে দেখতাম
নৈশকোচগুলো গ্যারেজে ফিরছে একে-একে
ঠান্ডা চা আর পোঁতানো পপকর্ন গিলছে টহল পুলিশ—
একটা সিএনজি স্কুটার আরেকটাকে পেছনে-বেঁধে
চলে যাচ্ছে দূরে, কোনো সমকামী অভীপ্সার দিকে
এতসব দেখে-দেখে, তোমার নম্র উপেক্ষার ধ্যানে এ জীবন কাটিয়ে দিতাম
                                                 ফুটপাতে, শেষরাত্রির প্রিজনভ্যানে!

তোমার চুলে নিরুত্তাপ স্মরণসভার গন্ধ, যেন তুমি
কখনো মানুষ ছিলে, এখন কুঠুরি, দরজা-জানালা বন্ধ
কলতাবাজার কবরস্থান থেকে পালিয়ে আসা লম্বা-লম্বা সিপাহীদের ছায়া
                                                          তোমাকে পাহারা দেয়
তোমার বামচোখের ভেতর একটি ঘুরানো সিঁড়ি
                    উপরে উঠতে-উঠতে হারিয়ে গিয়েছে মহাশূন্যে
তোমার ডানচোখে অতীতকালের একটি চিৎকার জমে বরফ হয়ে আছে

আমি সেই রাত্রেই কসাইটুলি থেকে কুড়াল চুরি করে আনলাম
দেহপসারিনীদের ছেঁড়াখোঁড়া অভিলাষকে চিরদিনের মতো বিদায় জানালাম
তখনো অনেক বাকি ভোর, মফস্বলগামী নিউজপেপার
                            স্তূপাকার হয়ে আছে জনশূন্য বাস টার্মিনালে
এদের ভাঁজে-ভাঁজে আমি বিছিয়ে দিলাম আমার না-লেখা প্রেমপত্রগুলোকে
ছোট আর একান্নবর্তী শহরগুলোর আলোবাতাসে ওরা
                                           বড় হয়ে উঠবে একদিন!

এসে দেখি, তোমার গল্প থেকে এমন মোহময় সাবানের গন্ধ ছড়াচ্ছে
                             আর তা তন্ময় হয়ে গিলছে কয়েকটি নির্ঘুম কাক
তুমি কি ওদের সাথেই উড়বে নাকি, বিলবোর্ডবাসিনী!
ওরা কিন্তু সত্যি-সত্যি কাক নয়—কর্পোরেট মেটাফিজিক্স—
তোমাকে তোমারই স্মৃতির ভেতর কয়েদ করতে এসেছে, তারপর
বাসি মেট্রোপলিটনের পিঁপড়াগুলোকে ছেড়ে দেবে ওরা
                                 তোমার সবুজ শাকসবজির আকাঙ্ক্ষার ভেতর

তবু, কোনোদিন ভোরবেলা জেগে আমি অবাক দেখব শাদা বিলবোর্ড
অচেনা রূপসী, নতুন কমোডিটি—তোমার শ্রান্ত ডানাজোড়া আর
                                                           খুঁজেও পাব না
যাদের আমি চোখের জলে এতকাল লুকিয়ে রেখেছিলাম!

মধ্যরাতের নদী

খুব ক্যাজুয়াল, কোনো জলদি নাই, যেন নিরবধি—
যেন কারো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাচ্ছে মধ্যরাতের নদী
পাঁচমিশালী ধারাস্রোতের দোটানা-সহ।

আলোকসজ্জার নৈশ অনুরোধ ঠেলে যেতে মন কি তার একদম সরছে না?
নাকি ভুলে গেছে, পাহাড়ের বেণী খুলবার দিনে সেও ক্রন্দনশীলা পথ—

আর জয়দ্রথ
কিংবা আমি
এসে বসলাম পা ডুবিয়ে—ইউরিয়া ফ্যাক্টরির সবুজ বিষ্ঠা মিশছে
ঘুমন্ত ইলিশের ফুলকায়
তবু গুনগুনিয়ে যাচ্ছে নদী, যেন ওর গানের ভেতর ইলিশের
বোকা-বোকা শ্বাসকষ্ট আছে। সহজ মরণ আছে।

নদীকে বললাম আমার নানাবিধ পদ্যসম্ভাবনার কথা
এক বালিকার খেয়ালখুশির ভেতর তীব্র বেদনারাশিসমেত
লতিয়ে উঠত ওরা—
যাকে আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম ওর সহচরীদের কাছ থেকে
আগলে রেখেছিলাম পৃথিবীর সবাইকে তস্কর ভেবে—

বলতে ইচ্ছা করছে: তাকে হারিয়ে ফেলেছি, অথবা তাকে
কোনোদিনই পাই নি
তাকে আমি একদম বুঝি নি, সেও আমাকে নয়
আমি হয়তো তাকে একদিন বুঝে উঠতে পারব, কিন্তু সে আমাকে
কোনোদিনও বুঝবে না

একটি নিঃসঙ্গ জেলেনৌকার আলোয় আমার চোখ
ঝাপসা হয়ে আসছে

নদী বইছে ধীরে, সপ্রতিভ উপেক্ষার অল্প-অল্প ঘূর্ণি ওর গায়ে
যেন আমি যে গল্পটি বলছি সেটি বহুবার তার বহুজন থেকে শোনা
যেন তার তীরে তীরে পুনরাবৃত্তি বোনা

যেন কোনো উচ্চাভিলাষী শহরের পাশ দিয়ে
একবারও বয়ে না-গিয়ে
আমার বুঝবারই কথা নয় দাম্পত্য কাকে বলে
যেন আমার সম্ভাব্য কবিতা
ঐ উঠতি শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের মতোই
একপেশে একটি বধির ব্যবস্থামাত্র!

সমবেত স্নান শেষে শ্রমিকদের হল্লা মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে
ছুটি চেয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলছে ঘাটগুলো, যেন আমি উঠে গেলেই
একযোগে নাইতে নামবে—
সারাদিনের ক্লান্তি আর লোহার অ্যাংকরের খামচিগুলোতে ব্যান্ডেজ বেঁধে
ঘুমাতে যাবে তারা।

ছোটখালার যাওয়া

ছোটখালার মনে নেই, ওকে আমি পালিয়ে যেতে বলেছিলাম
বলেছিলাম, এসো, লুকিয়ে থাকি শূন্য ফুলদানীর
অন্তহীন রহস্যের ভেতর,
মরণশীল দুটো মাছরাঙার সাথে জীবন বদলাই আর
হাওড়ের মধ্যে ডাকাতের মতো তাড়া করি ঘূর্ণায়মান প্রপেলারকে

এ-কথা শুনে ওর সূঁচ-ধরা হাত গেল থেমে। ওর চোখ
হয়ে উঠল মেঘাচ্ছন্ন দিনের জোড়াপুকুরের চেয়েও সন্ত্রস্ত
সূচিকর্ম ওর প্রিয়। মাছরাঙাদের সমাজে সেলাইয়ের প্রচলন নেই জেনে
কী হাসি তার!
যেন আমার প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেছে
সুপারি গাছদের বিশেষ বর্ধিত সভায়

ওর ব্যস্ততা ছিল। ভিনদেশী এক রাজকুমারের ঘুমের জন্য
বালিশের ওয়াড়গুলোকে কথা বলতে শেখানোর কাজ, তাই সারাদিন
নিজ আঙুলের সৌন্দর্যে নিজেই সে মুগ্ধ হয়ে থাকত
আমার কথা শুনত কি শুনত না—বৃষ্টি ধরে এলে
আমি শূন্য ফুলদানীর ভেতর একা ঘুমিয়ে পড়তাম
ঘুমিয়ে ভাবতাম
প্রপেলার-পাখার অন্তহীন হিমেল নৈঃসঙ্গ্যের কথা

সেই রাজকুমারের ওপর আমার ছিল অসামান্য ক্রোধ
তাকে আমি খুঁজে বেড়াতাম সত্যিকারের টিনের তলোয়ার নিয়ে
ধসিয়ে দিতাম যাবতীয় উঁইয়ের ঢিবি, তার ঘোড়াটিকে
ধাওয়া করবার জন্য
ভাব রাখতাম দ্রুতগামী বাছুরদের সাথে

একদিন আমার আয়ত্তে এলো রূপকের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা
অনুনয় করে বললাম, খালা, চলো বোয়ালমারির বিলে
নিশুতি রাতে তুমি জেলেডিঙি হয়ে ঘুরে বেড়াবে, আর আমি
হ্যাজাক-হারিকেন
কিংবা চলো দূরে, যেখানে তুমি এক বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, আমি এক
উলুঝুলু কাকতাড়ুয়া
নয় আরো দূরে, তুমি পোড়োবাড়ি আর আমি টিনের সেপাই!

সূঁচের কাজ শেষ হলে ছোটখালার জন্য পালকি এলো
এলো অঘোর শ্রাবণ, আমার চোখ পোড়োবাড়ির জানালা
আমি কাকতাড়ুয়া, আমি টিনের সেপাই, আমি হ্যাজাক-হারিকেন
বর্ষণসিক্ত বাঁধে ওঠে অনেকক্ষণ ধরে হাত নাড়লাম
ছোটখালার যাওয়া তবু ফুরাল না, চলে যাচ্ছে সে
নিসর্গের সেলাই খুলে হারিয়ে যাওয়া জেলেডিঙির মতো।

নিহত থাকার অধিকার

পাখি উড়ে চলে গেছে; পাখির পালকসম দেহ
সিমেন্টের বস্তার ভারে ডুবে আছে অথৈ নদীতে
মাথার ভেতর আজ সাঁতরায় অলস বুলেট
          আর কৌতূহলী ডানকিনা মাছ
একদিন খোয়াজ খিজির বেড়াতে আসে এই জলজ কবরে

এসে সে অবাক। ধলেশ্বরীর ঘোলা জল
ব্যথিত বদনে গোপনে বইছে স্থলজ লাশের ভার!
প্রেমিক মিলছে প্রেমিকার সাথে ঠিকই, কেন
নিহত হারালো নিহত থাকার অধিকার?

অতএব পুশব্যাক। দৃষ্টিসীমায় ফিরে এলো
বস্তামুক্ত দেহ। জলের উপরিতলে। অচেনা।
ফুলে ঢোল। সংশয়ী পরিবার ফিরে গেলে
শেষে ডাক পেল আঞ্জুমানে মফিদুল।

এত উদ্বেগ, এত বিবৃতি, জলে স্থলে পতাকা বৈঠক
সাহারা-খিজিরে সমঝোতা হয়ে গেল। তবু নিহত পেল না
নিহত থাকার অধিকার; সমব্যথী পাখি এলো ফিরে
অনামা কবরে শুয়ে থাকা দেহটাকে খুঁজে পেল না সেও!

এ সম্পর্কিত আরও খবর