বাংলার, বাঙালির, একজন হুমায়ূন আহমেদ

, শিল্প-সাহিত্য

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 23:31:49

বাংলার চিরায়ত প্রকৃতির শাশ্বত আলো, ছায়া, মেঘ, বৃষ্টি আর জ্যোৎস্নার মতোই বাংলার, বাঙালির একজন হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮-১৯ জুলাই ২০১২) আছেন। মৃত্যুর ৯ বছর পরেও তিনি অতীত কাল ছুঁয়ে 'ছিলেন' হয়ে যাননি। ঘটমান বর্তমানের নিরিখে 'আছেন' হয়েই আছেন বহুমাত্রিক অনন্যতায়।

কালের সীমানা অতিক্রম করে অনিবার্য উপস্থিতিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয়তার এক নজিরবিহীন প্রতীক। জীবন ও মৃত্যুতে নিমগ্ন সাহিত্য সাধনার দৃষ্টান্ত। মৃত্যুর পরেও পাঠকের নন্দিত ভালোবাসায় জীবন্ত তিনি বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষীদের কাছে। তিনি সার্বভৌম অস্তিত্বে বিরাজমান বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যের প্রবহমানতার মূলস্রোতে।

হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর বৃহত্তম ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার কেন্দুয়া থানার কুতুবপুর গ্রামে। পিতা পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ। মাতা আয়েশা ফয়েজ। ছোট বেলায় বাবা তার নাম রাখেন শামসুর রহমান কাজল। পরবর্তীতে তিনি তার নাম পরিবর্তন করে হন হুমায়ূন আহমেদ।

পুলিশ বিভাগে চাকরি করলেও হুমায়ূন আহমেদের পিতা ফয়জুর রহমান একজন লেখক ছিলেন। যখন তিনি বগুড়া চাকরি করতেন, তখন তার ‘দ্বীপ-নেভা যার ঘরে’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় হানাদার বাহিনী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বাবা সরকাররি চাকরির কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গার প্রকৃতি ও পরিবেশের রূপরস তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। ১৯৬৫ সালে তিনি বগুড়া জেলা স্কুলে থেকে রাজশাহী বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে মাধ্যমিক পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৬৭ সালে মেধাতালিকায় স্থান লাভ করে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের পর ১৯৮২ সালে পলিমার রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। মা আয়েশা ফয়েজও একজন ভাল লেখিকা। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘জীবন যে রকম’ পাঠক সমাজে সমাদৃত।

২০১২ সালে ১৯শে জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহার্টনের বেলভ্যু হাসপাতালে হুমায়ূন আহমদ ক্যানসারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে সারা বাংলাদেশে এবং বিশ্বের সকল স্থানের বাঙালির মধ্যে যে শোকাবহ আবেগ সঞ্চারিত হয়, তা অভূতপূর্ব। তাঁর মৃত্যু বাংলা সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিদায়ের করুণ ধ্বনিতে মুখরিত।

হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখির স্ফুরণ তার ছাত্রজীবনেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকালে তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাস রচনা করেন। প্রথম উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’ তাঁকে সুধীমহলে পরিচিতি দেয়।

তারপর তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয় নি। ঈর্ষণীয় পাঠকপ্রিয়তা তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হয়। লেখক জীবনে হুমায়ূন আহমেদ প্রায় তিনশটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার অধিকাংশই উপন্যাস। মন্ত্র সপ্তক, দূরে কোথাও, সৌরভ, নি, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, গৌরিপুর জংশন, লীনাবতী, বহুব্রীহি, ছবি, নৃপতি, অমানুষ, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথা কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, বৃষ্টিও মেঘমালা, মেঘ বলেছে যাব যাব, আজ আমি কোথাও যাব না, আমার আছে জল, আকাশ ভরা মেঘ, মহাপুরুষ, শূন্য, ওমেগা পয়েন্ট, ইমা, আমি ও আমরা, কে কথা কয়, অপেক্ষা, পেন্সিল আঁকা পরী, হিমু, আজ হিমুর বিয়ে, আমিই মিসির আলি, বৃষ্টি বিলাস, , আমার মেয়ের সংসার, দেয়াল তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাস।

হুমায়ূন আহমেদের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ হলো: বল পয়েন্ট, রঙ পেন্সিল, কাঠ পেন্সিল, ফাউন্টেন পেন, নিউইয়র্কের নীল আকাশে ঝকঝকে রোদ প্রভৃতি।

চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মাণে হুমায়ূন আহমেদ অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর হলো: আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, নয় নম্বর বিপদ সংকেত, চন্দ্রকথা, সর্বশেষে ঘেটুপুত্র কমলা।

তাঁর জনপ্রিয় নাটকসমূহ হলো: এই সব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত অয়োময়, নিমফুল আজ রবিবার ইত্যাদি।

হুমায়ূন আহমেদ গান লিখতেন, সুর দিতেন, গান গাইতেন। গান শোনতেও খুব ভালবাসতেন। মরমী কবি গিয়াসউদ্দিনের একটি গান হুমায়ূন আহমেদের খুবই প্রিয়: ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায় ও যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়।'

হুমায়ূন আহমেদ হলেন গল্পের, প্রেমের, বিষাদের জাদুকর। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো কলমের জাদু নিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করতে পেরেছেন তিনি। তিনি পাঠক তৈরির প্রকৃত কারিগর। হিমু, মিসির আলী, রূপা, পরী ইত্যাদি অসংখ্য মায়াবী চরিত্রের নির্মাতা। অতলান্ত সাহিত্য-সম্ভারে তিনি পাঠকের চিত্তে বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন চিরকাল: বাংলার, বাঙালির হৃদয়ে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর