ঐতিহাসিক সঙ্কুলতার বিচিত্র আফগানিস্তান

, শিল্প-সাহিত্য

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 05:23:32

ভূ-কৌশলগত কারণে আফগানিস্তানকে চিহ্নিত করা যায় সঙ্কুলতম এক বিচিত্র দেশ রূপে, যেখানে আজকের মতোই ইতিহাসের নানা পর্বে সংঘটিত হয়েছে উত্থান-পতন, সংঘর্ষ ও রক্তপাত। দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক সঙ্গমস্থলে বহু মানুষের অভিবাসনের মতোই বিভিন্ন রাজা ও শাসক মুখোমুখি হয়েছেন।

অতীতে বার বার রণক্ষেত্রে রূপ পরিগ্রহকারী আফগানিস্তানে প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক-স্থান খনন করে দেখা গেছে উত্তর আফগানিস্তানে প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে মনুষ্যবসতি ছিল। ধারণা করা হয়, আফগানিস্তানের কৃষি খামার সম্প্রদায় বিশ্বের প্রাচীনতম খামারগুলোর একটি। আর সেখানে অনেক সাম্রাজ্য ও রাজ্য ক্ষমতায় এসেছে, যেমন গ্রেকো-বারট্রিয়ান, কুশান, হেফথালিটিস, কাবুল শাহী, সাফারি, সামানি, গজনবী, ঘুরি, খিলজি, কারতি, মুঘল, ও সবশেষে হুতাক ও দুররানি সাম্রাজ্য। 

আফগানিস্তান প্রাচীনকাল থেকেই এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। বহু প্রাচীন বাণিজ্য ও বহিরাক্রমণ এই দেশের মধ্য দিয়েই সংঘটিত হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু লোক আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে চলাচল করেছেন এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ এখানে বসতিও স্থাপন করেছেন। দেশটির বর্তমান জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্র্য এই ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়।

আফগানিস্তানে বসবাসরত সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী হল পশতু জাতি। এরা আগে আফগান নামেও পরিচিত ছিল। তবে বর্তমানে আফগান বলতে কেবল পশতু নয়, বরং জাতি নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিককেই বোঝায়, যাদের মধ্যে পাঠান, কাজিক, তাজিক, হাজারা অন্যতম। বস্তুতপক্ষে আফগানিস্তানে বহু বিচিত্র জাতির বসবাস। এদের প্রায়-সবাই ধর্মীয় দিক থেকে মুসলমান। তবে নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে মধ্য এশিয়ান, চীনা, পারসিয়ান-ইরানি এবং ভারতীয় উপমহাদেশ, এই চার সাংস্কৃতিক/জাতিতাত্ত্বিক অঞ্চলের মিলন ঘটেছে এখানে। ফলে দেশটিতে সৃষ্টি হয়েছে বিপুল ভাষাগত ও জাতিগত বৈচিত্র্য।

বলা হয়, সিল্ক রোড ও প্রাচীন বাণিজ্য পথগুলোর সঙ্গে সুপ্রাচীনকাল থেকেই সংযুক্ত থাকায় আফগানিস্তানে বসবাসকারী মানুষদের পূর্বপুরুষগণ ইরান, পাকিস্তান, ভারতবর্ষ, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান,  উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, মঙ্গোলিয়া, চীন, আরব উপদ্বীপ, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং আরও বহু জায়গা থেকে এসেছেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের চলাচল, রাজনৈতিক বিপ্লব, আক্রমণ, রাজ্যবিজয় ও যুদ্ধ বহু মানুষকে এই অঞ্চলে নিয়ে আসে। এদেরই কেউ কেউ আফগানিস্তানকে নিজের মাতৃভূমি বানিয়ে নেয়। রাজনৈতিক দল ও জাতিসত্তার ধারণা বহু পরে এই বিচিত্র জাতি-সমাহারের ওপর অনেকটা চাপিয়ে দেয়া হয়।

আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক এলাকার উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ২,০০০ মিটার বা তার চেয়ে উঁচুতে অবস্থিত। ছোট ছোট হিমবাহ ও বছরব্যাপী তুষারক্ষেত্র প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত ২৪,৫৮০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট নওশাক আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ও সর্বোচ্চ বিন্দু। এটি পাকিস্তানের তিরিচ মির পর্বতশৃঙ্গের একটি নিচু পার্শ্বশাখা। পর্বতটি আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বে হিন্দুকুশ পর্বতমালার অংশ, যেটি আবার 'পৃথিবীর ছাদ' বলে প্রসিদ্ধ 'পামির মালভূমি'র দক্ষিণে অবস্থিত। হিন্দুকুশ থেকে অন্যান্য নিচু পর্বতসারি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে প্রধান শাখাটি দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রসারিত হয়ে পশ্চিমের ইরান সীমান্ত অবধি চলে গেছে।

আফগানিস্তানের বর্তমান সীমারেখা ১৮শ শতকের শেষ দিকে দেশটিকে জার-শাসিত রুশ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী 'বাফার' অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে নির্ধারণ করা হয়। এই কৃত্রিম সীমান্ত বহু জাতির ঐতিহ্যবাহী বাসস্থলকে ভাগ করে ফেলে, যাদের মধ্যে আছে পশতু, তাজিক, কাজাক, তুর্কি, হাজারা ও উজবেক। এইসব বিভাজিতরা বহু যুদ্ধের মাধ্যমে আফগানিস্তানে জাতিগত বিদ্বেষ জিইয়ে রাখে। এমনকি, এখনও আফগানিস্তানের কোথাও কোথাও জাতি ও আত্মীয়তার বন্ধনকে রাষ্ট্রীয় বন্ধনের চেয়ে বড় হিসেবে গণ্য করা হয়।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, আফগানিস্তানে এ পর্যন্ত একটিমাত্র সরকারি আদমশুমারি সম্পন্ন হয়েছে, ১৯৭৯ সালে। সেটি অনুযায়ী আফগানিস্তানের জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি। ২০০৬ সালে এই জনসংখ্যা ৩ কোটি ১০ লক্ষে গিয়ে পৌঁছেছে বলে ধারণা করে হয়। বর্তমানে জনসংখ্যা চার কোটির কম-বেশি বলে ধারণা করা হয়। তবে এদের বিরাট অংশ শরণার্থী বা রিফিউজি।

১৯৭৯ সালের সোভিয়েত আক্রমণের ফলে অনেক আফগান দেশের বাইরে উদ্বাস্তু হিসেবে পাড়ি জমান। এদের মধ্যে ৩০ লক্ষ যান পাকিস্তানে, এবং প্রায় ১৫ লক্ষ চলে যান ইরানে। এছাড়া প্রায় দেড় লাখ আফগান স্থায়ীভাবে বিদেশে পাড়ি জমান এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে বসতি স্থাপন করেন।

২০০১ সালে তালেবান সরকারের পতনের পর অনেক উদ্বাস্তু দেশে ফেরত আসতে থাকেন। ২০০২ সাল নাগাদ প্রায় ১৫ লক্ষ উদ্বাস্তু পাকিস্তান থেকে এবং প্রায় ৪ লক্ষ উদ্বাস্তু ইরান থেকে ফেরত আসেন। তবে এদের সঠিক পুনর্বাসন আফগান সরকারের জন্য সংকটের সৃষ্টি করেছে। বহু উদ্বাস্তু স্থলমাইন-সঙ্কুল, বিমান-আক্রমণে বিধ্বস্ত ও পানির অভাবগ্রস্ত খরা এলাকায় বাস করছেন। তদুপরি, দীর্ঘ ও লাগাতার সংঘাতের কারণে আফগানিস্তানে উদ্বাস্তুকরণ অব্যাহত গতিতে চলছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ এবং এশিয়ার সর্ববৃহৎ শরণার্থী হলো আফগানরা। 

আফগানিস্তানের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধরা হয় ২.৬৭%। আফগানিস্তানের শিশু মৃত্যুর হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। হাজারে ১৬০ টি শিশু জন্মেই মারা যায় সেখানে। মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ৪৩ বছর। আফগানিস্তানের প্রায় ৭৭ শতাংশ লোক গ্রামে বসবাস করেন। শহরবাসীর অর্ধেক থাকেন রাজধানী কাবুলে।

১৯৭৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং প্রজাতন্ত্র হিসেবে আফগানিস্তানের আবির্ভাব ঘটে। ১৯৭৮ সালে আরেকটি অভ্যুত্থানে নিষিদ্ধ বামপন্থী দল (পিডিপিএ) ক্ষমতায় আসে। এই দলের সাম্যবাদী শাসন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আফগানিস্তানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে। তবে ইসলামী বিদ্রোহী মুজাহেদিনেরা এই শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে।

পিডিপিএ-কে সমর্থন করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে একটি পূর্ণমাত্রার আক্রমণ পরিচালনা করে। কিন্তু আফগানদের সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে কিছুদিন পরে একজন মধ্যপন্থী পিডিপিএ নেতাকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়, যাতে মুজাহেদিনেরা শান্ত হয়। কিন্তু মুজাহেদিনেরা সোভিয়েত অধিকৃতির বিরুদ্ধে গেরিলা হামলা অব্যাহত রাখে। পিডিপিএ সরকার সোভিয়েত সরকারের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পেত, অন্যদিকে মুজাহেদিনেরা যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও কয়েকটি মুসলিম দেশ থেকে সাহায্য পেত।

১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানের পার্বত্য কান্দাহারে গঠিত তালেবান গোষ্ঠী সোভিয়েত বিরোধী মুজাহেদিনেরা মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে এবং পাঁচ বছর পর ২০০১ সালে আমেরিকানদের দ্বারা অপসারিত হয়। তারপর বিগত কুড়ি বছর প্রতিরোধের পর ২০২১ সালে পুনর্বার তালেবানগণ আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে, যা সেখানে নতুন সঙ্কট ও সঙ্কুলতার সূচনা ঘটিয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর