আমার শশুর আবু বকর চৌধুরী ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান, সত্যবাদি ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। পরোপকারকে যিনি কর্তব্য মনে করতেন। মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সাদা মনের মানুষ ছিলেন। অন্যের আনন্দে আনন্দিত হতেন এবং অন্যের ব্যথায় ছিলেন ব্যথিত। আত্মমর্যাদাগত দিক দিয়ে অভিজাত শ্রেণির হলেও খোলামনে সবাইকে ভালোবেসে, সবার ভালোবাসায় ধন্য ছিলেন। গতকাল রাতে (০৯.১১.২০২১) তিনি চলে গেছেন মহান মাবুদের দরবারে। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না- ইলাইহি রা-জিউ-ন। মরহুমের রুহের মাগফেরাত ও জান্নাতুল ফেরদৌস কামনা করছি। সেই সাথে শোক সন্তপ্ত পরিবার ও স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ যেন সবাইকে ধৈর্য ধারণের তৌফিক দান করেন।
আবুবকর চৌধুরী কেন জানি আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসার নজির স্থাপন করেছেন। সিলেট শহরে প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল, সেদিন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তা অটুট ছিল। তাঁর মেয়ের জন্য আমাকে যখন পছন্দ করে বিয়ের কার্ড ছাপতে দেন, তখন আমি বিনীত ভাবে বারণ করেছিলাম, মেয়ের পছন্দ নিশ্চিত হবার জন্য। সেদিন আমার কথা তিনি রেখেছেন। এরপর এই পরিবারের সব কিছুতে শশুর মহোদয় আমাকে যে অগ্রাধিকার দিতেন তাতে মাঝে মধ্যে আমি বিব্রত বোধ করতাম। কারণ তাঁর একমাত্র ছেলে ও তিন মেয়ের সকলেই উচ্চ শিক্ষিত এবং অত্যন্ত যোগ্যতা সম্পন্ন পদস্থ কর্মকর্তা। দুই মেয়ের স্বামী তথা আমার ভায়রা দুজনই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
২০০০ সালের ২৬ জানুয়ারী আমি লন্ডন এসে পৌছি। দিনটি ছিল বুধবার। আকাশ ছিল খুবই পরিচ্ছন্ন। রোদেলা বিকেল। প্রিয়তমা স্ত্রী সহ আমার শশুর বিমান বন্দরে আমাকে স্বাগত জানালেন। হিথ্রো থেকে ইস্ট লন্ডন। পথের দুপাশে সারি সারি বাড়িঘর। মাঝে মাঝে ছায়াঘন বৃক্ষরাজি। দুষ্প্রাপ্য শ্যামলিমা। গোধুলী বেলায় নদী তীর হয়ে আসার পথে ঠান্ডার আমেজ অনুভব করেছি। তিনি আমার গায়ে শীতের কাপড় জড়িয়ে দিলেন।
সূর্য তখন মালদহি আমের রঙ ধরেছে। আগের দিন নাকি কনকনে ঠান্ডা ছিল। গন্তব্যে পৌছে মাগরিবের সালাত আদায় করলাম। দেশ থেকে নিয়ে আসা হালকা উপহার সামগ্রী বের করতে গেলে উপস্থিত সকলে তাজ্জুব! তাদের চক্ষু যেন চড়ক গাছ! ব্যাগেজে সিলেট শহরের সাহিত্যিক-সাংবাদিক, রাজনীতিক ও সমাজসেবিদের শত শত ছবি! উপস্থিত অনেকে রহস্য না বুঝলেও আমার শশুর বিষয়টি ঠিকই বুঝেছেন। তিনি আমাকে ভাল সাংবাদিক জেনে প্রথম দেখাতেই জামাতা হিসেবে পছন্দ করেছিলেন। ছবিগুলো মনে হল তার পছন্দ হয়েছে। তিনি বললেন, আমি যেন আমার এই পেশায় সম্পৃক্ত থাকি।
এখানে আমার প্রথম ঠিকানা ছিল ইস্ট লন্ডনের পিয়ারট্রি লেন। শ্যাডওয়েল বেসিনের পার্শ্ববর্তী সুবিশাল লেক সংলগ্ন বাসা। বৃহদাকার বাউন্ডারি সমৃদ্ধ। চমৎকার নৈসর্গিক পরিবেশ। বাসার নীচ তলায় বৈঠকখানা। দু’তলায় থাকেন আমার শশুর। আমি ৩য় তলায়। ঘরে বসে মনে হত সমুদ্রবর্তী কোথাও অবস্থান করছি।
আবুবকর চৌধুরী সুনামগঞ্জ দরগাপাশার পুরাতন জমিদার পরিবারের সদস্য। সিলেট শহরের কুমারপাড়ায় স্থায়ী বসবাস। বিলেত এসেছেন স্বাধীনতার আগে। এখানকার বাঙ্গালি কমিউনিটির সমৃদ্ধির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী মরহুম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ডা. হারিছ আলী প্রমুখ বেশ ঘনিষ্ট ছিলেন।
আমাকে ভালোবেসে বাড়ি কেনার পূর্ব পর্যন্ত কোন ভাড়া বাসায় যেতে দেননি। একসাথে থাকতে বাধ্য করেছেন। আমার সহধর্মিনী পেশায় একাউন্টেন্ট। তার একান্ত প্রয়াসে ২০০৩ সালে আমরা নিজস্ব বাসায় চলে আসি।
পিয়ারট্রি লেনে থাকাবস্থায় বাসার ঠিক সামনে শ্যাডওয়েল বেসিনের সবুজ মাঠে প্রায় প্রতিদিন তাঁকে নিয়ে ব্যায়াম ও পায়চারি করতাম। রোদেলা দিন হলে মাঠের শেষ প্রান্তে টেমস নদীর তীরে বসে সাহিত্য রচনা করতাম। যে স্থানটিতে বসে আমি লেখি, সেটিও এক ঐতিহাসিক জায়গা। ম্যাড্জ ডার্বি (MADGE DARBY) তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ ওয়্যাপা’স পিপল্স (WAEPPA’S PEOPLE) লিখেছিলেন ঠিক এই জায়গায় বসে। আমার অনেকগুলো ভালো কবিতা ও গল্প টেমস তীরে এই নান্দনিক পরিবেশে লেখা হয়েছে।
শ্যাডওয়েল বেসিন ঘনিষ্ঠভাবে ওয়াপিংয়ের সাথে এবং বৃহত্তর অর্থে লন্ডনের ইতিহাসের সাথে আবদ্ধ। জো স্পেন্সার তার ব্রিফ হিস্ট্রি অফ ওয়াপিং গ্রন্থে (ZOE SPENCER’S BRIEF HISTORY OF WAPPING) লিখেছেন, ওয়াপিং মূলত একটি স্যাকসন বন্দোবস্ত ছিল। এটি ছিল টেমস নদীর পার্শ্ববর্তী একটি জলাশয়। ওয়াপল অর্থ বুদবুদ বা ফেনা (‘WAPOL’ MEANING ‘BUBBLE’)। এর থেকেই ওয়াপিং নামকরণ হয়েছে। ১৬শ শতাব্দী পর্যন্ত এটি বাগান সমৃদ্ধ নৌঘাট ছিল। ওয়াপিংয়ে সমুদ্র সংশ্লিষ্ট দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ১৫৪৬ সালে লাইমহাউস থেকে যাত্রা করার আগে স্যার ওয়াল্টার রেলিহের (SIR WALTER RALEIGH) জাহাজটি ওয়াপিংয়ে সজ্জিত হয়েছিল। তরুণ জেমস কুক ওয়াপিংয়ের বাসিন্দা ছিলেন। ক্যাপ্টেন ব্লাইও ওয়াপিংয়ে বহু বছর বসবাস করেছেন।
নদী পথে মালামাল পরিবহনের ঘাট হিসেবে এটি ব্যবহৃত হত। আমার জন্মভূমি সিলেট সদর উপজেলার বাদঘাটের সাথে একটা অদ্ভুত মিল আমি খুঁজে পাই। ভারত থেকে নদীপথে সিঙ্গেরখাল নদী দিয়ে মালবাহী স্টিমার এসে বাদাঘাট এলাকায় থামত। আর এখানে এশীয় অঞ্চল থেকে চাল, তামাক ইত্যাদি পণ্য নিয়ে লন্ডনে আগত জাহাজগুলী আনডাউন হয়। কেন জানি ইতিহাসের চোরাবালিতে আমাদের জাহাজি শ্রমিকদের ছোঁয়া আমি অনুভব করি।
প্রায় ৪০০ বছর ধরে টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালির বসবাস। জাহাজের নাবিক কিংবা শ্রমিক হিসেবে তারা প্রথম এসেছিলেন। বিভিন্ন দেশ হয়ে এক সময় ইস্ট ইন্ডিয়া ডক কোম্পানিতে কাজ নিয়ে এসে ওঠেন পূর্ব লন্ডনের ওয়াপিং ও শ্যাডওয়েল এলাকায়। এদের মাধ্যমেই টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালির বসতি শুরু। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে সীমিত সংখ্যক উচ্চ শিক্ষার জন্য এসেছেন। তবে ভাওচার ভিসায় ব্যাপকভাবে ব্রিটেনে আসা শুরু হয়। আমার শশুর তাদের অন্যতম।
আবুবকর চৌধুরীর বর্ণনা মোতাবেক, শ্রমিক ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের স্বার্থ রক্ষা আন্দোনের সূতিকাগার ছিল এই এলাকা। ১৬৬৬ সালে নাবিক ও শ্রমিকদের স্বল্প বেতনের বিরুদ্ধে ডিউক অব অ্যালবামার (DUKE OF ALBEMARLE) নিরাপত্তা কর্মিদের সাথে ভয়াবহ দাঙ্গার ঘটনা এখানেই ঘটেছে। ১৮০০ সালে ডক আইন (LONDON DOCK ACT) পাস হয় এবং এখানে লন্ডন ডক স্থাপিত হয়। তখন দরিদ্র জনগনকে ন্যূনতম মূল্য দিয়ে বিনা ক্ষতিপূরণে তাড়িয়ে দেয়া হয়। আজকের এই অভিজাত ভবন সমূহের নিচে চাপা পড়ে আছে অনেক গরীব মানুষের বাড়িঘর ও ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ভাবতে কষ্ট হয়!
সে যাক, একসময় ওয়াপিংয়ে নৌবাহিনীর সৈনিকদের বসবাস ছিল। এখান থেকেই জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা হত। নদীপথে নাবিকদের সাথে প্রায়ই জলদস্যুদের রক্তাক্ত লড়াই সংঘটিত হয়। নিরাপত্তার জন্য চোর-ডাকাত প্রতিরোধে তখন প্রতিবছর ব্যয় ছিল প্রায় অর্ধ মিলিয়ন পাউন্ড। দণ্ডপ্রাপ্ত বিদ্রোহী ও জলদস্যুদের সাউথওয়ার্কের মার্শালিয়া জেলখানা থেকে ওয়াপিংয়ে এক্সিকিউশন ডকে নিয়ে আসা হয়। এখানে তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। তাদের দেহগুলি তখন খাঁচায় ফেলে রাখা হয়।
১৭৯৮ সালে লন্ডনে নদী পুলিশ বাহিনী (RIVER POLICE FORCE) প্রতিষ্ঠা করা হয়। থেমস পুলিশ সদর দফতরটি (THAMES POLICE HEADQUARTERS) আজও ওয়াপিংয়ে অবস্থিত। বিভিন্ন দেশ থেকে ট্রেনিংয়ে আশা চৌকস পুলিশ অফিসারগন এখানে এসে অভিজ্ঞতা নিয়ে যান।
শ্যাডওয়েল বেসিনের উভয় প্রান্তে স্টিলের সেতুগুলি বেশ চমৎকার। ব্রিজগুলি ওয়াপিংয়ের ভিতর এবং বাইরে অ্যাক্সেসের একমাত্র মাধ্যম। শ্যাডওয়েল বেসিনটি ওয়াপিং ডকগুলির সর্বশেষ স্থাপনা। ডার্টমুর কারাগারের (DARTMOOR PRISON) স্থপতি ড্যানিয়েল আলেকজান্ডার (DANIEL ALEXANDER) লন্ডন ডক ডিজাইন করেছিলেন। তার ক্লাসিকাল নকশা এখনো প্রশংসিত। এখানে হাউজবোট এবং লিভ-ইন ইয়টও পাওয়া যায়।
শ্যাডওয়েল অঞ্চল উন্নয়নের প্রাণপুরুষ টমাস নেল (THOMAS NEALE) ১৬৫৬ সালে শ্যাডওয়েল বেসিনের সেন্ট পলস চ্যাপেলটি তৈরি করেছিলেন। এটি ১৮২১ সালে পুন:নির্মাণ করা হয়। এখানকার প্রায় আবাসস্থল ছোট কাঠের ফ্রেমে ইট দিয়ে পূর্ণ ছিল। পেলিকান সিঁড়ির দিকে যাওয়ার জন্য একটি ছোট্ট এলি রয়েছে। যখন নদীর জোয়ার কম হয় তখন নীচের দিকে যাওয়া যায়। হাইওয়ে এবং নদীর মধ্যবর্তী এ জায়গাটি ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনের অন্যতম সংযোগস্থল।
১৯৮৬ সালে রূপার্ট মারডোকের নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (RUPERT MURDOCH’S NEWS INTERNATIONAL) এর মুদ্রণ কাজ এখান থেকে শুরু হয়। অবশ্য ২০০৮ সালে নিউজ ইন্টারন্যাশনাল এর প্রিন্টিং অপারেশন হার্টফোর্ডশায়ার চেশান্টে স্থানান্তরিত হয়েছে।
শ্যাডওয়েল বেসিনের সাথে ভাল পরিবহণ সুবিধা রয়েছে। ওয়াপিং ওভারগ্রাউন্ড স্টেশন এবং শ্যাডওয়েল ডিএলআর ও শ্যাডওয়েল আন্ডারগ্রাউন্ড সহজে ইস্ট লন্ডন এবং সাউথ লন্ডনের সাথে সংযুক্ত। এছাড়া নিকটবর্তী টাওয়ার হিল আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ডিস্ট্রিক এবং সার্কেল উভয় লাইন যাতায়াত করে।
বর্তমানে এই এলাকায় বাংলাদেশী সহ বহু জাতিক মানুষ বাস করেন। শ্যাডওয়েল বেসিন আউটডোর একটিভিটিজ সেন্টার এখানে বেশ সক্রিয়। তারা দক্ষতার সাথে জল ভিত্তিক দুঃসাহসিক ক্রিয়াকলাপ পরিচালনা করে। সুযোগ সুবিধা এবং সরঞ্জামের ব্যবহার সাশ্রয়ী রাখতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সমস্ত ক্রিয়াকলাপ জাতীয়ভাবে স্বীকৃত যোগ্যতর কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। কেন্দ্রটি আরওয়াইএ এবং বিসিইউ দ্বারা অনুমোদিত শিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃত। অ্যাডভেঞ্চার ক্রিয়াকলাপ লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত।
লন্ডনে যাপিত জীবনের প্রথম ঠিকানা পিয়ারট্রি লেন। আমার শশুরের প্রিয় পছন্দের জায়গা। এটি লন্ডনের সমস্ত নদীর তীরবর্তী একটি জায়গা। ওয়াপিং চেলসির বিলাসবহুল বাঁধ, লন্ডন ব্রিজের চকচকে টাওয়ার এবং সাউথ ব্যাংকের সাংস্কৃতিক হাব বেষ্ঠিত অঞ্চল। আমার অনেক কবিতার জন্ম হয়েছে এই টেমস তীরে। স্পন্দিত এই পিয়ারট্রি লেন থেকে স্মৃতির ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে অনেক গল্পমালা।
আজ পিতৃতুল্য আবুবকর চৌধুরী চলে গেছেন না ফেরার দেশে। যিনি নিজের চিন্তা না করে আমাদের চিন্তা করতেন। সারাটা জীবন অন্যের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে ছিলেন। ভালো কাজ এবং মানুষের সেবা ও আতিথেয়তার মাঝে তিনি আনন্দ পেতেন। নিজের দেশটাকে আরো সুন্দর দেখতে ব্যাকুল ছিলেন। তাঁর অন্তর ছিল সদা দ্যূতিময়। কোন ভয় ভীতি ছিলনা। অনায়াসে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারেন। সকলকে সেবাদান ও সম্মান করেই হয়েছিলেন সম্মানিত। মহান আল্লাহ তাঁকে মমতার চাদরে আবৃত করুন।
লেখক: লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক