ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৬

, শিল্প-সাহিত্য

মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 21:45:59

[ষষ্ঠ কিস্তি]

"আমার নাম ক্যাভিন। আমি মার্কিন দেশের বাসিন্দা, যে দেশ এক সময় ছিল রাশিয়ার ঘোরতর শত্রু। আমার পূর্বপুরুষের ভিটা ভূমধ্যসাগরের তীরে, রুশ ও মার্কিন দেশের মাঝখানের একটি দেশে। কিন্তু আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা মার্কিন দেশে। জন্ম থেকেই জেনেছি রুশরা গণতন্ত্রের শত্রু, আমাদের মিত্র নয়। তবু আমি রুশ দেশকে ভালোবেসেছি প্রধানত তাদের সাহিত্যিকদের জন্য।"

মহান সাধক ও মরমী কবি জালালউদ্দিন বলখি রুমির একটি কথা ক্যাভিন সুযোগ পেলেই বলতো। কথাটি ম্যারি কানে এখনো বাজে, "What you seek is seeking you."

আসলেই তো, "আপনি যা খুঁজছেন তা আপনাকেই খুঁজছে", রুমির এই কথাটি ক্যাভিনের ক্ষেত্রে শতভাগ সত্য। ম্যারি নিশ্চিত, ক্যাভিন যেমন রুশ দেশের আত্মার অন্বেষণ করছে, সেদেশও ক্যাভিনকে খুঁজছে। সেইসব আত্মান্বেষী কথায় ভরপুর ক্যাভিনের বইটি।

ক্যাভিন লিখেছে আত্মজীবনীর শৈলীতে, বইয়ের সূচনার লাইনগুলো:

এক সময়ের বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়নের বড় অংশ আজকের রাশিয়ার মাত্র ছয় জন নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেলেও পুরস্কার পেতে পারতেন আরও অনেক সাহিত্যিক। রাজনৈতিক কারণে নোবেল পাওয়া ও না-পাওয়া রুশ সাহিত্যিকের তালিকাটি দীর্ঘ। এ কথা বলার কারণ হলো, 'রুশরা বিশ্বের সবচেয়ে পড়ুয়া জাতি' হিসেবে স্বীকৃত। আমি এই সত্যের স্বীকৃতি দিচ্ছি।

আমার বক্তব্যের দৃষ্টান্ত নিন। রুশ দেশের ইভান বুনিন (১৯৩৩), বরিস পাস্তারনাক (১৯৫৮), মিখাইল শলোখভ (১৯৬৫), আলেক্সান্দার সোলজেনিৎসিন (১৯৭০), জোসেফ ব্রডস্কি (১৯৮৭) এবং সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ (২০১৫) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

রুশ লেখকদের মধ্যে এমন আরও বহুজন আছেন, যারা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। অথচ তারা নোবেল পুরস্কার পাননি। যেমন তাদের মধ্যে লিও তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০) এবং ম্যাক্সিম গোর্কি ( ২৮ মার্চ ১৮৬৮-১৮ জুন ১৯৩৬) অন্যতম।

'মা' উপন্যাসের জন্য গোর্কি বিশ্ববিশ্রুত। রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অন্যতম সাহিত্য প্রতিভা গোর্কির অবস্থান রুশ ও বিশ্ব সাহিত্যে অসামান্য; অবদান অপরিসীম। গোর্কির প্রসঙ্গে আলোচনাকালে আমরা দেখতে পাব সুপ্রাচীন রুশ সাহিত্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ দিগন্তরেখা।

আধুনিক রুশ সাহিত্যের গোড়াপত্তন হয় মধ্যযুগে, যদিও রুশদের রয়েছে প্রাচীন মহাকাব্য, লোককথা, রূপকথা ও ইতিবৃত্ত।

রুশ আধুনিক সাহিত্যের আলোকিত যুগ বলে গণ্য করা হয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরবর্তীকালকে। বিশেষত ১৯৩০-এর দশকের শুরুর দিকে রুশ সাহিত্যের সুবর্ণ যুগ শুরু হয়। এ সময় কাব্যিক প্রতিভা ভাসিলি ঝুকভ্‌স্কি ও পরে তাঁর দ্বারা প্রভাবিত আলেক্সান্ডার পুশকিন কাব্যচর্চায় নেতৃত্ব দেন।

এ সময়ে গদ্যও বিকাশ লাভ করে, যার পুরোধা ছিলেন 'প্রথম মহান রুশ ঔপন্যাসিক' নামে প্রসিদ্ধ নিকোলাই গোগোল। পরবর্তীতে আসেন ইভান তুর্গেনেভ, যিনি ছোটগল্প ও উপন্যাসে আলোড়ন আনেন। তারপর গোর্কি, লেভ তলস্তয়, ফিওদর দস্তয়ভস্কি প্রমুখ লেখক রুশ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন।

আন্তন চেখভ উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ছোটগল্পে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে অন্যতম প্রধান নাট্যকার হয়ে ওঠেন। মায়াকভ্স্কি নব্য বাস্তবতা নিয়ে কাজ করেন। তার রচনা 'ওড টু দ্য রিভলূশন ও লেফট মার্চ' (১৯১৮) কাব্যে নতুনত্ব নিয়ে আসে।

নিকোলাই অস্ত্রভস্কি'র 'কাক' উপন্যাসে তাঁরই কষ্টদায়ক জীবনীচিত্র ধারণ করা হয়েছে। উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র পাভেল কর্চাগিন রুশ সাহিত্যের এই 'তরুণ বীর'-এর প্রতিচ্ছবি, যে রাজনীতিতে তার জীবন উৎসর্গ করে তার দুঃখগুলো অতিক্রম করে। উপন্যাসটিতে সারা বিশ্বের তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণা ছিল, যা রাশিয়ার স্বদেশপ্রেমী যুদ্ধে গতিশীল ভূমিকা পালন করে।

সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা যখন রুশ সাহিত্যের প্রধান উপজীব্যে পরিণত হয়, তখন তার নেতৃত্ব দেন গোর্কি। তিনি ছিলেন সে সময়ের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, যিনি তার কালজয়ী 'মাত' (মা) উপন্যাস এবং 'দ্য এনেমিস' নাটক দিয়ে এই ধারার ভিত্তি স্থাপন করেন।

গোর্কির আত্মজীবনীমূলক ত্রয়ীতে সমাজের দরিদ্রতর স্তর থেকে তাঁর রাজনৈতিক বিবেকের উন্নয়নের উত্থান বিবৃত হয়েছে। তাঁর উপন্যাস 'দ্য আর্তামানভ বিজনেস' (১৯২৫) ও নাটক 'এগর বুলিশভ' (১৯৩২) রুশ সামন্ত শ্রেণির পতনকে চিত্রায়িত করে।

গোর্কি সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাকে 'পৃথিবীর পুনঃগঠনরত জনগণের বাস্তবতা' বলে উল্লেখ করেন। গোর্কির সাহিত্যকর্ম রাশিয়ার সাহিত্যিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। তিনি পরিণত হন 'সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাহিত্যিক ভাষ্যকার'-এ।

গোর্কি নামে সমধিক পরিচিত হলেও এটি তার নাম ছিল না। তার মূল নাম আলেক্সেই ম্যাক্সিমোবিচ পেশকভ। তিনি নিজেই তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম রূপে নির্ধারণ করেন 'গোর্কি', যে রুশ শব্দটির অর্থ তিক্ত বা তিতা। সমাজের অন্যায় ও অসঙ্গতিকে তিক্ত ও কঠোরভাবে আঘাত করতেন বলেই তিনি নিজের এমন নাম ধারণ করেন।

অদ্ভুত জীবন ছিল গোর্কির। রুশ দেশের নিঞ্জি নভগরদ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি পিতৃমাতৃহীন হন। অথচ এই এতিম ছেলেটির ছিল অদম্য সাহস। ১৮৮০ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি তার দাদীমাকে খুঁজতে গৃহত্যাগ করেন। আবার তিনিই ১৮৮৭ সালে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, যখন তার বয়স ১৯ বছর।

এমন নানান ঘটনাবলির পর গোর্কি এক সময় পূর্ণ বাউণ্ডুলে ও সংসারত্যাগী মানুষের কাতারে নিজের নাম যুক্ত করেন। চিরকালের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে তিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে পায়ে হেঁটে সমগ্র রাশিয়া ভ্রমণ করেন। আহরণ করেন মানুষ, প্রকৃতি, সমাজ ও জনপদ সম্পর্কে সরাসরি আহরিত বাস্তব অভিজ্ঞতা। তাঁর লেখাগুলোতে রয়েছে সেইসব বাস্তবতা ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার বিচ্চুরণ।

একটুু দেরিতে সাহিত্যসাধনা শুরু করেন ম্যাক্সিম গোর্কি। তার সর্বপ্রথম রচনা 'মাকার চুদ্রা'। রুশ কথাসাহিত্যে তাঁর অমর উপন্যাস 'মা' ১৯০৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। রুশ ভাষায় লিখিত এই উপন্যাসটি পরবর্তী একশত বছরে পেরিয়েও সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও পঠিত হয়ে চলেছে।

উপন্যাসটি বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত এবং উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্র হল পাভেল ও তার মা। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের পাশাপাশি 'মা' উপন্যাসের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি সিনেমা নির্মিত হয়েছে।

কালজয়ী 'মা' উপন্যাসের জন্য গোর্কি রুশ সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যের অন্যতম আইকন আর বিশ্বসাহিত্যের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব রূপে চিহ্নিত হয়ে আছেন।

প্রথম অধ্যায় শেষ করার আগে আগে ক্যাভিনের লেখা সমাপ্তিজ্ঞাপক লাইনগুলো ম্যারির বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হয়। ক্যাভিন লিখেছে:

“আমি বলেছি, রুশ দেশে আমি আমার নায়িকা ম্যারিকে খুঁজবো। পাঠক, এতো কথা আমি এজন্যই লিখেছি। তার কারণ, আমার প্রেমিকা ম্যারি একজন সত্যিকারের মা। আমার সন্তান টমাসের মা। এবং তার বাবাও। স্বপ্নে আমি ম্যারির সঙ্গে প্রায়ই কথা বলি। আমি সব সময়ই তাকে একটি কথা বলি, বিশ্বজনীন মায়ের মতো আমার অভাব তুমি আমার সন্তানকে বুঝতে দিও না।”

পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার।

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘রংধনু’-৫

এ সম্পর্কিত আরও খবর