পৌষ আসার আগেই যৌবনবতী শীত জাপটে ধরেছে পৃথিবীকে। হেমন্তের বিষণ্ন জোছনা কুয়াশায় ভিজে ভিজে আরো ম্লান। স্তব্ধ রাতের আকাশ হয়ে গেছে একখণ্ড শীতার্ত চাদর। এমন প্রকৃতিতে চাঁদের চোখেও ঘুমের ছায়া।
স্মরণীয় শিল্পী তালাত মাহমুদ এমনই মায়াময় চিত্রকল্পের কথা বলেছেন প্রণব রায়ের লেখা ও কমল দাশগুপ্তের সুরে গাওয়া একটি গানে। প্রেম ও স্মৃতিকাতরতায় বোনা গানটি হিমেল পরশে নস্টালজিয়া জাগিয়ে গাইলেন ৯০ বছরস্পর্শী এক চির তরুণ, যার মৃত্যুর এক মাস পর গানটি অ্যালবাম থেকে ইউটিউবে প্রকাশ পেয়েছে। তার নাম সৈয়দ আব্দুল আহাদ মশকুর (১০ জানুয়ারি ১৯৩০-২৮ অক্টোবর ২০১৮), কিশোরগঞ্জের হয়বতনগর জমিদার বাড়ির উত্তরপুরুষ তিনি।
বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বের জানা-শোনা ইতিহাসে ৯০ বছরের দ্বার প্রান্তের কোনো শিল্পীর পক্ষে গান গাওয়া এবং সেই গানের অ্যালবাম প্রকাশ করার নজির সম্ভবত আর নেই। গভীর প্রেমাবেগে গানগুলো গেয়েছেন সৈয়দ আব্দুল আহাদ মশকুর। অতি বৃদ্ধ বয়সে কণ্ঠের ভারসাম্য ও আবেগ রক্ষা করে সঙ্গীত উপস্থাপনা তার পরিশীলিত শৈল্পিক কৃতিত্বের স্বাক্ষরবাহী। প্রতিটি শব্দের যথাযথ উচ্চারণ ও সুর-তাল-লয়ের বিচ্যুতি এড়িয়ে গান গাইবার সময় শিল্পী নিজেও জানতেন না যে, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি মৃত্যুর হাতে রাখি পড়াবেন। অথচ গানটির কোনো এক চরণে তিনি গেয়েছেন, ‘হিয়া যে চাহে, এ মধু রাতে, পড়াতে তোমায়, মিলন রাখি।’
প্রিয়ার হাতে রাখি পড়াবার অতৃপ্ত বাসনা জাগিয়ে তিনি নিজেই চলে গেছেন মৃত্যুর অচ্ছেদ্য রাখিবন্ধনে। রেখে গেছেন সঙ্গীতের ঐতিহাসিক স্মারকচিহ্ন আর সাংস্কৃতিক পরম্পরার যোগসূত্র। ঐতিহ্যভাবেই যা তিনি অর্জন করেন পুরুষানুক্রমে এবং বারো ভূইয়া-প্রধান, বীর মসনদে আলা দেওয়ান ঈসা খাঁ আর হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর সঙ্গী বৃহত্তর সিলেট বিজয়ী সৈয়দ নাসিরউদ্দিন সিপাহসালাহের ঐতিহ্যসূত্রে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এসবই তিনি পেয়েছেন দেওয়ান ও সৈয়দ বংশের আত্মীয়তা ও রক্তধারার নাভিমূল কিশোরগঞ্জের হয়বতনগর জমিদার বাড়ির জন্মস্থান থেকে।
শিল্পী সৈয়দ আব্দুল আহাদ মশকুর-এর সঙ্গে আমার কখনো সাক্ষাত-পরিচয় ঘটে নি। কিন্তু তার জেষ্ঠ্যপুত্র সৈয়দ শাকিল আহাদ ৪৬ বছর আগে কিশোরগঞ্জ শহরে আমার শৈশবের সহপাঠী ছিল। জানতাম, তার পিতা সরকারী চাকরির সুবাদে ঢাকায় কর্মরত রয়েছেন।
স্কুলের মেলামেশার বাইরে শহরের উপান্তে নরসুন্দা নদী পেরিয়ে হয়বতনগর গেলে জমিদার বাড়ির হাভেলিতে দেখা হয়েছে বড় বোনের বান্ধবী জুঁই আপা, সিনিয়র বন্ধু বাশার ভাই, বন্ধু এনাম, আজিম এবং শাকিলের সঙ্গে। সেই সত্তর দশকে ক্ষয়িষ্ণু হয়বতনগনের জৌলুস ও জেল্লার খানিকটা অবশিষ্ট ছিল। আভিজাত্য ও রক্ষণশীলতার মিশেলে সেখানে পুঞ্জিভূত ঐতিহ্যগত আদব-লেহাজ, আচার-আচরণ, তাহজিব-তমুদ্দুন, রীতি-রেওয়াজ মুগ্ধ করেছে আমাদের। সুশ্রী, পর্দানশীল, খানদানি মহিলাদের স্নেহ আর রাজসিক পোষাকের সুঠাম পুরুষদের উপস্থিতিতে ছমছম করতো যে জমিদার বাড়ি, একদা সেখানে নূপুরের নিক্কণ, এস্রাজ আর পাখোয়াজের আওয়াজের সন্ধ্যা নামতো। ভোর হতো শেহনাই ও নহবতের সুরে।
দূরাগত অতীতের পাটাতনে স্মৃতির মমি হয়ে সেইসব ঔপনিবেশিক-সামন্তগন্ধী দিনগুলো হারিয়ে গেছে আমাদের শৈশবের স্মৃতি-বিস্মৃতির নদীতে। দিগন্ত বিস্তারী মহাবৃক্ষের শাখা-প্রশাখার মতো হয়বতনগরের বিভিন্ন খান্দানের বাসিন্দারাও ছড়িয়ে গেছেন দেশে-বিদেশে। এখন বিশাল জমিদার বাড়ি বহু শরিকের মধ্যে বিভক্ত ও ছিন্ন-বিছিন্ন আকারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ইতিহাসের কঙ্কাল হয়ে। নান্দনিক সাংস্কৃতির সুষমা কিশোরগঞ্জের সমাজ ও মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে প্রাগৈতিহাসিক কম্পনে ইতিহাসের বিবর্ণ পাতায় শুধুমাত্র লেপ্টে আছে হয়বতনগর নামটি।
কর্মসূত্রে চট্টগ্রাম থাকায় কিশোরগঞ্জ যাওয়া হয় কম। গেলেও হয়বতনগরে যাওয়ার সুযোগ কিংবা পরিবেশ পাওয়া যায় না। ফলে বিগত চার দশকে সৈয়দ শাকিলের সঙ্গে আর দেখা বা যোগাযোগ হয় নি। আমাদের কিশোরগঞ্জের বাসায় আব্বার সঙ্গে দেখা করে সে আমার খোঁজ-খবর-ঠিকানা জেনে কদিন আগে ফোনে যোগাযোগ করে। ফোনে সে জানালো তার পিতার মৃত্যু সংবাদ এবং শেষ বয়সে পিতার গানের অ্যালবাম বের হওয়ার খবর। আনন্দ ও বেদনার ধ্বনির মিশেলে কথাগুলো উচ্চারিত হয়েছিল তার কণ্ঠে।
শাকিলের পিতাকে আমরা জানতাম অন্য রকম একজন মানুষ হিসাবে। জাগতিক লাভ ও লোভের বাইরের একজন শুদ্ধতম ব্যক্তিত্ব হিসাবে তার ছিল উজ্জ্বল ইমেজ। সারা জীবন সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, অভিনয় নিয়ে মেতে ছিলেন তিনি। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী হিসাবে অর্থ-বিত্ত-সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে অতীতের শক্তি ও দাপট পুনরুদ্ধারের পথে চলেন নি তিনি। সাধক প্রকৃতির এই মানুষটি মোটেও হিসাবী-সংসারী ছিলেন না। স্বর্ণালী পূর্বপুরুষদের নন্দন ঐতিহ্য ধরে রাখার মানসে তিনি চলেছেন সঙ্গীত, শিল্প ও সাহিত্যের জগতে। কর্মসুত্রে জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ ফিল্ম ইনসটিটিউট অ্যান্ড আর্কাইভ-এর সঙ্গে। সে সুবাদে চলচ্চিত্র বিষয়ক চর্চা ও গবেষণায় ছিল তার পেশাগত দক্ষতা। সময়ে-অবসরে মেতে থাকতেন গান নিয়ে। আর ছিল লেখালেখির প্রবল ঝোঁক। তার রচিত গ্রন্থ ‘ফেলে আসা দিনগুলো’ এবং ‘স্মৃতির পাতা থেকে’ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।
মূলত ভক্ত, অনুরাগী, আত্মীয়-পরিজন ও সন্তানদের চাপে একেবারেই শেষ বয়সে সৈয়দ আব্দুল আহাদ মশকুর তার সঙ্গীত প্রতিভার স্মারকচিহ্ন রাখতে সম্মত হন। মৃত্যু অল্পদিন আগে ‘তুমি জানো প্রিয়া’ নামে একটি মিউজিক্যাল অ্যালবাম প্রকাশ করা হয় তার গানগুলোকে নিয়ে। আটটি একক গানে তিনি দরদী কণ্ঠে মন-প্রাণ উজাড় করে গেয়েছেন। অ্যালবামটি তত্ত্বাবধান করেন তার জেষ্ঠ্যপুত্র সৈয়দ শাকিল আহাদ। সঙ্গীত পরিচালনা ও কম্পোজিশন করেন ইবনে রাজন। আরও জড়িত ছিলেন পুলক বড়ুয়া, মুজাহিদুল হক লেনিন এবং শিল্পীর কনিষ্ঠপুত্র ২০১৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সঙ্গীত শিল্পী সৈয়দ ওয়াকিল আহাদ।
অ্যালবামের সবগুলো গানই হৃদয়গ্রাহী। বিশেষত ‘ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে এ মধু রাত নাহি বাকি’ গানটিতে তিনি সুরের মুর্চ্ছনার সঙ্গে কণ্ঠমাধুয্যের অনন্য মিলন ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশের সর্বজেষ্ঠ্য কণ্ঠশিল্পী হিসাবে তার আত্মপ্রকাশ সঙ্গীতের ইতিহাসে যেমন দাগ কেটেছে, তেমনি একজন ভরাট গলার প্রবীণ পুরুষের প্রেমময় আর্তি শ্রোতাদের হৃদয়ে দোলা জাগিয়েছে। এই শীতে গানটি প্রকাশ পাওয়ার সময় তিনিও ঘুমের দেশে চলে গেছেন। তথাপি ঘুমের ছায়া চোখে নিয়ে এক ফালি চাঁদের মতো তিনি সুরের আকাশে জেগে আছেন।
কিশোরগঞ্জের প্রাচীন হয়বতনগর পরগণার আকাশে কোনো কোনো জোছনা-প্লাবিত রাতে হয়ত আর ভেসে আসবে না শান-শওকতে ভরা জমিদার বাড়ির আবছায়া। কালের গর্ভে অনেক কিছুর মতোই হারিয়ে গিয়েছে সেই প্রাঙ্গণ, প্রাচীন ইমরাত, সাংস্কৃতিক দ্যোতনা। মানুষগুলোও চলে গেছেন জীবনের চেয়ে বহুদূরের ঠিকানায় কিংবা দেশ-দেশান্তরের অভিবাসনে। কিন্তু সেই জোছনায় হয়বতনগরের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের নক্ষত্রতুল্য জ্যোতিতে ঠিকই জ্বলজ্বল করবেন বর্ষীয়ান শিল্পী সৈয়দ আব্দুল আহাদ মশকুর। কণ্ঠের লালিত্যে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভূগোলে তিনি থাকবেন একটি মরমী গানের পাখির আদলে।