সৈয়দ শামসুল হকের লেখালেখি শুরু তাঁর ১২ বছর বয়স থেকে। পঞ্চাশের দশকের অন্যতম প্রধান কবি তিনি, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সক্রিয় লেখক। লিখেছেন কবিতা, উপন্যাস, নাটক। করেছেন বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের অনুবাদ।
১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কুড়িগ্রামে। বাবা পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। বাবা-মায়ের আট সন্তানের ভেতর বড় ছিলেন তিনি।
কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে ভর্তি হন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে। ম্যাট্রিকের পাট চুকিয়ে পিতার ডাক্তারি পড়ানোর ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে ১৯৫১ সালে বম্বেতে পালিয়ে যান। সেখানে সহকারী হিসেবে কাজ করেন ওখানকার এক সিনেমা প্রডাকশন হাউজে। মন ঘুরে গেল এরপর। দেশে ফিরে আসেন ১৯৫২ সালে। নিজের মনমতোই ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজের মানবিক শাখায়। সব ঠিকঠিক চলছিল। ১৯৫৪ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। পড়াশোনা সমাপ্ত না করেই ১৯৫৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন আর তার কিছুদিন পরেই তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ প্রকাশিত হয়।
১৯৪৯-৫০ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে ২০০টির মতো কবিতা রচনা করেন তিনি। ১৯৬১ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, নাম ‘একদা এক রাজ্যে’। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের মে মাসে, ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায়।
সৈয়দ শামসুল হকের পরিচয় সব্যসাচী লেখক হিসেবে। তাঁর লেখার বাঁকেবাঁকে চিত্রিত হয়েছে বাঙালির একনিষ্ঠ জীবনের গল্প, মধ্যবিত্তের চড়াই-উৎরাই। ‘দেয়ালের দেশ’-এর পর আরো অনেক উপন্যাস লিখেছেন তিনি। ‘এক মহিলার ছবি’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’—তার জনপ্রিয় উপন্যাস। অন্যধারার ও অন্য আঙ্গিকে লেখা উপন্যাস ‘খেলারাম খেলে যা’। এই উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি এদেশের সবচেয়ে ভুল বোঝা উপন্যাস হিসেবে এটিকে অভিহিত করেন। যৌনতাকে আশ্রয় করে লেখা এই উপন্যাসের জন্য তিনি ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত হন। বস্তুত নতুন ধারার এই সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যের অগ্রযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ লাভ করে আদমজী পুরস্কার। পরে লিখেছেন আরেক বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পরানের গহীন ভেতর’। ভাষায় নতুনত্ব, আঞ্চলিক ভাষাকে কবিতায় এনে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।
বাবার মৃত্যুর পর অর্থকষ্টে পড়ে সৈয়দ শামসুল হক চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ও ‘পুরস্কার’ চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লিখে শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বিভাগে পান জাতীয় পুরস্কার। চলচ্চিত্রের জন্য গানও লিখেছেন এই সব্যসাচী। তাঁর লেখা ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’ গানটি এখনো মানুষের মুখে মুখে।
ক্লাসিক নাটক অনুবাদে তার আগ্রহ ছিল। নাট্যকার হিসেবেও পেয়েছেন সফলতা। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ তাঁর অনন্য সৃষ্টি।
ভাষার ব্যবহার নিয়ে বই লিখেছেন। লিখেছেন ‘প্রণীত জীবন’ নামে আত্মজীবনী। লেখার গহীনে দেখিয়েছেন মানুষের অজ্ঞতা, কুসংস্কার, বুঝিয়েছেন নাগরিক জীবনের ভেসে থাকা যাপন।
তরুণ লেখকদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘হক ভাই’ নামে।
আমি কে তা নাইবা জানলে।
আমাকে মনে রাখবার দরকার কি আছে?
আমাকে মনে রাখবার?
সাহিত্যের ঝুলিতে নিজেকে উজাড় করে সৈয়দ শামসুল হক ওপারে পাড়ি জমান ২০১৬ সালে। বাংলা সাহিত্য নিজের দরকারেই তাঁকে মনে রেখে যাবে সবসময়।