মানুষের জন্য শিল্প ছিল তার আরাধ্য। জাত, পাত, ধর্ম, বর্ণ নিয়ে রাজনীতি, হিংসা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়েছেন জীবনভর। ঘৃণা করেছেন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে। ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবতাবাদের সাহসী সিপাহশালার ছিলেন তিনি।
ভারতের প্রেক্ষাপটে কাজ করলেও এই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের অধিকারী মানুষটি পরিণত হয়েছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার 'সেকুলার ভয়েস'-এ। আধুনিক মনন ও সৃজনশীলতার আগুনে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন আদিম-মধ্যযুগীয় অন্ধত্ব, কূপমণ্ডূকতা ও ধর্মীয় গোড়ামী।
সোমবার (১০ জুন) ৮১ বছর বয়সে দক্ষিণ ভারতের বেঙ্গালুরুতে মৃত্যুর অমোঘ স্পর্শে তার কণ্ঠ থেমে গেলেও সেই প্রতিবাদী কণ্ঠের প্রতিধ্বনি রয়ে গেছে জগতময়। চলচ্চিত্রের পর্দায়, নাটকের মঞ্চে, টিভির স্ক্রিনে, সাহিত্যের পাতায় অম্লান হয়ে আছেন তিনি এবং তার যাবতীয় প্রচেষ্টা।
গিরিশ রঘুনাথ কারনাড (১৯ মে ১৯৩৮ - ১০ জুন ২০১৯) নামের অন্যরকম শৈল্পিক মানুষটিকে আরও অনেক গুণের পাশাপাশি ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং থিয়েটারের কিংবদন্তি অভিনেতা ও প্রবাদপ্রতীম নাট্যব্যক্তিত্ব রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
গিরিশ কারনাডের মৃত্যুতে ভারতের থিয়েটার জগতে একটা গৌরবময় যুগের অবসান ঘটল। চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নাটকে তিনি এনেছিলেন আধুনিকতা, রূপান্তর ও আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রপঞ্চ।
কন্নড় ভাষায় লেখালেখির কাজ শুরু করেন ১৯৬০ সালে। তার লেখা নাটকগুলো মানুষকে নতুন করে চিন্তার খোরাক জোগাত। ১৯৭০-এ কন্নড় ছবি ‘সংস্কার’ তার প্রথম অভিনীত ছবি। পরের বছর কন্নড় ছবি ‘বংশবৃক্ষ’-এর হাত ধরে পরিচালনার জগতেও পা রাখেন গিরিশ কারনাড।
অভিনয় করেছেন হিন্দিসহ নানা ভাষার চলচ্চিত্রে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ১৯৭৪ সালে পদ্মশ্রী এবং ১৯৯২ সালে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করা হয় তাকে। একাধিক বার পেয়েছেন 'ফিল্ম ফেয়ার' পুরস্কার।
সাহিত্যকর্মের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। পরিসংখ্যানে পড়াশোনা করলেও উচ্চতর ডিগ্রি করেছেন দর্শন ও রাজনীতি নিয়ে অক্সফোর্ডে। আমেরিকাতে অতিথি অধ্যাপক হিসাবে পড়িয়েছেন। ভারতের নাট্য ও চলচ্চিত্র বিষয়ক নানা গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি।
পেশাগত কাজের জায়গা ছাড়াও তিনি ছিলেন সামাজিক বঞ্চনা ও রাজনৈতিক পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার অ্যাক্টিভিস্ট। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বারবার নিজের সাহসী কণ্ঠস্বর তুলে ধরেছেন এই কিংবদন্তী নাট্যব্যক্তিত্ব।
তার নাটকগুলোতে উঠে এসেছে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের বয়ান। বাংলা থিয়েটারে তার ‘রক্তকল্যাণ’, ‘হয়বদন’, ‘তুঘলক’-এর মতো নাটকগুলো খুব সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়েছে, যাতে ধ্বনিত হয়েছে ফ্যাসিবাদ এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ।
প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য মৃত্যুর হুমকিও এসেছে তার কাছে। ভারতে লঙ্কেশের হত্যাকাণ্ডের পর তদন্তকারীরা অভিযুক্তদের কাছ থেকে একটি ডায়রি উদ্ধার করেন। সেখানে একটি তালিকায় গিরিশ কারনাডের নাম ছিল একেবারে প্রথমে। দু’নম্বরে ছিল গৌরী লঙ্কেশের নাম। বিটি ললিতা নায়েক, বীরভদ্র চান্নামাল্লা, সি এস দ্বারকানাথের নামও সেখানে ছিল।
যাদেরকে ধর্মীয় মৌলবাদীরা হত্যা করার পরিকল্পনা করছিল, তাদের নামেরই তালিকা ছিল সেটা। এরা সবাই ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং উগ্র সাম্প্রদায়িকতা-জাতীয়তাবাদের কঠোর সমালোচক ছিলেন।
এত কিছু সত্ত্বেও গিরিশ কারনাডের প্রতিবাদী স্বর দমিয়ে রাখা যায়নি। গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকাণ্ডে তিনি গর্জে উঠেছিলেন। সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীদের ‘আরবান নকশাল’ নাম দিয়ে গ্রেপ্তার করা শুরু হলে নিজেকেও ‘আরবান নকশাল’ বলে ঘোষণা করেছিলেন গিরিশ কারনাড। বাবরি মসজিদ ভাঙা এবং ভি.এস. নায়পল কর্তৃক সংখ্যালঘুদের বিরোধিতামূলক লেখার নিন্দা করেছেন তিনি প্রকাশ্যে জনসমাবেশে।
গিরিশের মধ্যে বহুত্ববাদ, আন্তঃধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন মজ্জাগত। তার দক্ষিণী পিতা বিয়ে করেছিলেন এক মারাঠি বিধবাকে, যে মহিলার মা ছিলেন পার্শি। তিনি নিজেও বিয়ে করেছেন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য মেনে। সবার মধ্যে ঐক্য আর সকলকে নিয়ে শান্তি খোঁজার মানুষ ছিলেন তিনি। ফলে উগ্রবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপস করতে পারেননি গিরিশ কারনাড।
তার কয়েকটি নাটক বাংলাদেশেও অভিনীত হয়েছে। গিরিশ কারনাড রচিত নাটকের বাংলা রূপান্তর কলকাতার থিয়েটার জগতেও নতুন দিশা এনেছিল। নাটকের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি আঙ্গিক, শৈলী, বক্তব্য, বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনার দক্ষতার নিরিখে।
সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতেই তার চিন্তার প্রভাব, কাজের বিস্তার ও মতাদর্শিক ছায়া পড়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবতা ও সহনশীলাতার পক্ষে। আর উচ্চকিত হয়েছিল তার কণ্ঠ মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে।
সঙ্কুল পরিস্থিতি ও ত্রাসের সংস্কৃতিতে তার সাহসিকতা দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। মৃত্যুর পরেও তিনি আছেন সামাজিক-রাজনৈতিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অনুপ্রেরণা রূপে।