অন্য আমি

গল্প, শিল্প-সাহিত্য

আফসানা বেগম | 2023-08-31 04:27:40

আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই আমার নিজেকে।
মানুষ কতকিছুই না ভয় পায়—সাপখোপ, ভূতপ্রেত এমনকি মানুষ! মা নাকি বর্ষার রাতে সারারাত ঘুমাতে পারত না। মা ঝড়-বৃষ্টি ভয় পেত। আর বড়ো আপা তো ঘরে অন্ধকার দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ে। আমাকে বলে, ‘ঝুনু, যা তো, আগে গিয়ে লাইটের সুইচটা একটু দে।’ আলো ছড়িয়ে পড়ার পরেও মাথা বাড়িয়ে পুরো ঘরটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে তারপর আপা ঘরে ঢোকে। আপা কী যে ভয় না-পায়! চোর-ডাকাত, কুকুর, শুঁয়োপোকা—আপার কাছে ভীতিকর জিনিসের এমন লম্বা লিস্ট আছে যে শেষই হতে চায় না। আপার সাথে দিনরাত থেকে থেকেও অবশ্য তার মতো দুনিয়ার সমস্ত কিছুকে আমি ভয় পেতে শিখিনি। আপা আমাকে ‘তোর সারা পেটে কলিজা’ বলে বহুবার বকাবকি করেছে। আমার খারাপ লাগেনি। এই তো বছর দুয়েক আগের ঘটনা—সন্ধ্যার দিকে লোডশেডিং হলে আমরা কলোনির রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। কাঁঠালিচাঁপার কড়া গন্ধে মাঝখানের মাঠটা তখন মাখামাখি কিন্তু গরমে সারা শরীর জ্বলছিল। আপা তার সামান্য ভেজা লম্বা চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে খোঁপা করতে করতে বলছিল, ‘ইস্ যদি কয়েকটা ফুল কেউ পেড়ে দিত তাহলে খোঁপায় লাগাতাম!’ যেই কথা সেই কাজ, আমি লাফিয়ে কাঁঠালিচাঁপা গাছে উঠে গেলাম। উত্তেজনায় স্যান্ডেল খুলতেও ভুলে গেলাম। প্রায় দশফুট উঁচুতে মাটির সমান্তরালে মোটা ডাল কলোনির পাঁচিলের উপর দিয়ে আমবাগানের দিকে চলে গেছে, সেই ডালের উপর দিয়ে তরতর করে এগিয়ে গেলাম। আপার হতভম্ব অবস্থা কেটে গেলে তার চিৎকার শুনতে পেয়েছিলাম, ‘অ্যাই ঝুনু, নেমে আয়, এই অন্ধকারে গাছে উঠছিস, মাথা খারাপ নাকি রে তোর?’ আমি ততক্ষণে হাতভরে ফুল নিয়ে নেমে আসায় ব্যস্ত, ‘আপা এই নাও, খোঁপায় লাগাও।’ আপা আমার কান মলে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে খোঁপায় কাঁঠালচাঁপাও লাগিয়েছিল। আপার জন্য আমি সব করতে পারি। এসব করার জন্য আমার সাহসের কোনো অভাব হয় না। কিন্তু আসলে ভেতরে ভেতরে আমি খুব ভীতু। সবসময় আমি আমার নিজেকে ভয় পাই।

মাঝে মাঝে আমার শোবার ঘরে, যেটা আসলে আগে আমার আর আপার শোবার ঘর ছিল, তার বিয়ে হয়ে যাবার পর এখন শুধু আমার একার, ফাঁকা ঘরটিতে ঢুকতে গেলেই আমি আমাকে দেখতে পাই। হয়ত রাতে ভাত খেয়ে এসে ঘরে ঢুকতে যাব, অথবা স্কুল থেকে এসে ব্যাগটা পড়ার টেবিলে রাখব, তার আগে আমাকে থমকে দরজায় দাঁড়াতে হয়; তাকিয়ে দেখি ঘরের ভেতরে আমি পা নাচিয়ে নাচিয়ে পড়ার টেবিলে বসে পড়ছি। আপা বারবার আমাকে বসে থাকলে পা নাচাতে মানা করে, মনে পড়তেই আমি দুলতে থাকা পা দুটো পাথরের মতো স্থির করে ফেলি। আবার হয়তো দেখি আমি গোসল সেরে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছি। অথবা গল্পের বই নিয়ে বিছানার এক ধারে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে পড়ছি। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘরের ভেতরের আকাশটা দখল করে নিচ্ছে অথচ আমার উঠে গিয়ে আলো জ্বালতে ইচ্ছে করছে না। কখনো আবার দেখি কেউ আমাকে জাপটে ধরছে; পশুর মতো লোমশ কালো হাতগুলো আমি কিছুতেই ছাড়িয়ে নিতে পারছি না— আবার কোনো শব্দও করছি না। শুধু নিজের সমস্ত শক্তি লাগিয়ে লড়ে যাচ্ছি। তারপর একসময় আর কোনো শক্তি যখন অবশিষ্ট থাকে না, তখন আমি হার মানি। এভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে কখনো চমকে উঠি। সেই আমিটাও এই আমার দিকে চমকে তাকায়! তারপর কখনো মিলিয়ে যায়, আবার কোনো সময় আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। সেই উপহাসের হাসি দেখে আমার খুব রাগ হয়। সে যেন আমাকে দেখিয়ে দেয়, এই যে এটা তুমি করতে পারো, কেন করো না? কখনোই যে করি না তা নয়। হয়তো স্কুল থেকে এসে দেখলাম, সেই আমিটা আলমারি খুলে কাপড় বদলে আকাশি রঙের স্কার্টটা পরছে। তারপর গোসলের পরে আমিও দেখাদেখি ওই স্কার্টটাই পরি। আজকাল বেশিরভাগই এমন হচ্ছে, ওই আমিটা যা যা করে দেখিয়ে দেয় আমি অন্ধের মতো তাই তাই করতে থাকি।

মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়, সে যদি বরাবরের মতো একদিন আর মিলিয়ে না যায়, ধীরে ধীরে সে যদি সত্যি আমি হয়ে যায়! আর তারপর সে বাবার সামনে গিয়ে বলে যে সে-ই ঝুনু, আমি কেউ নই; তখন আমি কোথায় যাব? কী করে প্রমাণ করব যে আমিই আমি?

প্রায়ই মন খারাপ করে ভাবতে থাকি কিভাবে সবাইকে বিশ্বাস করানো যায় যে আমিই ঝুনু, সে কেউ নয়। আমাদের পারিবারিক জীবনের সবচেয়ে গোপন কোনো কথা অথবা অনেক ছোটবেলার কোনো ঘটনা যা হয়ত কেউ জানে না বা ভুলেই গেছে, আমি ধরিয়ে দিলে মনে পড়বে, সেসব মনে মনে জড়ো করতে থাকি। আপাকে যেদিন ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছিল, সেদিন আপার রান্না কত ভালো তা বোঝানোর জন্য বাবা বলেছিল যে গরুর মাংস ভুনা আপাই রান্না করেছে। শুনে আমি চমকে ওঠাতে বাবা আমার দিকে চোখ বড়ো করে এক ঝলক তাকিয়েছিল। সেখানে বাবা আর আপা ছাড়া একমাত্র আমিই তো জানতাম যে মাংসটা রান্না করেছে পাশের বাড়ির খালা। ওই ঘটনাটা বললেই বাবা বুঝবে যে আমিই ঝুনু। কারণ এটা তো আর কারো জানার কথা নয়! আবার সেই কোন ছোটবেলার শীতকালের কথা। আপা ভেতরের উঠোনের দিকে উঁচু বারান্দার ধার ঘেঁষে সারি করে গাঁদা ফুলের চারা লাগিয়েছিল। বার্ষিক পরীক্ষার পর একমাস আমরা দাদাবাড়িতে থেকে এলাম সেবার। ফিরে এসে দরজা খুলে ভিতরের বারান্দায় যেতেই দেখি অসংখ্য বড় বড় গাঁদা ফুলে উঠোনের দিকে ঢলে যাওয়া বারান্দার ধার ঢেকে গেছে। সবসময়ের শুকনো বাদামি উঠোনে ওরকম কমলাটে হলুদের বাড়াবাড়ি আমাদের তিনজোড়া চোখকে ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। বিস্মিত বাবা বারান্দার সিঁড়িতে ধপ করে বসে পড়েছিল। আপা প্রজাপতির মতো ওড়না উড়িয়ে উড়িয়ে উঠোনের চারদিকে ঘুরানো বারান্দায় ছুটোছুটি করছিল; বলছিল, ‘বাবা দেখেছো, দেখেছো, আমি গাছ লাগিয়ে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম মরেই যাবে।’ বলতে গিয়ে আপা হাঁপাতে হাঁপাতে বড় বড় নিশ্বাস ফেলছিল। তারপর পুরু মখমলের মতো শ্যাওলা ধরা কালচে সবুজ দেয়ালটার পাশে সে বসেই ছিল ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে। ছোটোকালে ওই দেয়ালটা দেখলে আমি বুঝতাম যে ওটা পশ্চিম দিক। কেউ জানতে চাইলে দৌড়ে গিয়ে দেয়ালের অবস্থানটা দেখে এসে বলে দিতাম। ডাসা ডাসা ফুলের দৃশ্যের বিস্ময় কমলে ধীরে ধীরে বাবা বলেছিল, ‘কিন্তু পানি কে দিল বল তো, রুনু?’ আপা হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘এবার কী ঘন কুয়াশা পড়ল দেখোনি, বাবা? তাতেই পানি দেয়া হয়ে গেছে।’ এই যে সেদিনের প্রতিটি কথা আমার মনে আছে, এটা বললেও কি বাবা বিশ্বাস করবে না যে আমিই ঝুনু?

কিন্তু মুশকিল হলো আমি জানি যে বাবা আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করে না। বাবা আপাকে কত আদর করে! অথচ আমাকে সেভাবে কখনো ভালোবাসেনি। এটা আমরা তিনজনই জানি। বাবা আমাকে চায় না, শুধু সহ্য করে। আচ্ছা, আমার জন্মের সময় মা যে টুপ করে মরে গেল সেটা কি আমার দোষ? আপা হওয়ার বারো বছর পরে আমি জন্মালাম। ডাক্তার বলে দিয়েছিল, হয় আমি না-হয় মা যে কোনো একজনকে বাঁচানো যাবে। মাকে বাঁচানোর রায় দিতে বাবার একফোঁটাও কষ্ট হয়নি। আমার কাছেও এটাই স্বাভাবিক লাগে। মা সে সময় এই সংসারের জন্য অনেক দরকারি; তার একটা উঠতি বয়সের মেয়ে ছিল আর আমাকে তো বাবা তখন চেনেই না। শুধু শুধু মাকে হারিয়ে আমাকে বাঁচাতে চাইবে কেন? মা বোধ হয় ডাক্তার আর বাবার ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরেছিল তাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখে নিজেই মরে গেল। এটাই ছিল আমার প্রতি মায়ের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা।

মায়ের সেই ভালোবাসার অপরাধে সারাজীবন আমি বাবার ভালোবাসা পেলাম না। আমি কখনো বাবার অবাধ্য হইনি। আমার মতো স্কুলের পনেরো-ষোলো বছর বয়সী অনেক মেয়েরা বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে কোথায় কোথায় চলে যায় কেউ খবরই রাখে না। জানতে চাইলে বানিয়ে বানিয়ে কত্ত কিছু বলে! বন্ধুবান্ধব তেমন নেই বলে আমাকে সেরকম কিছুও করতে হয় না। তবু বাবা আমার কাজকর্মে খুশি না। আবার আমি খুব ভালো কিছু করলেও বাবা আমাকে দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে পারে না বরং একটু এড়িয়ে চলে। এই যেমন ক’দিন আগে আমি স্পোর্টসে জিতে দুম করে একটা ট্রফি হাতে করে বাসায় ঢুকলাম, বাবা কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বাবাকে দেখে তখন রাগ হওয়ার বদলে আমার মায়াই হলো। তার খানিক পরে আমার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আমি দেখি নকল ঝুনু বালিশে মুখ ডুবিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাকে আমার যতই ভয় লাগুক, দরজা বন্ধ করে আমি তখন ভেতরে এসে দাঁড়াই যেন তার এই ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদার শব্দ বাবা শুনতে না পায়। অবশ্য আমি জানি তার যাবতীয় শব্দ কেবল আমিই শুনতে পাই; আমি ছাড়া অন্য কেউ তার কথা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে না। তা না হলে দুলাভাই চলে যাবার পরে সেদিন যখন সে তারস্বরে চেঁচিয়ে কাঁদছিল তখন পাশের ঘরে বাবা মনোযোগ দিয়ে পেপার পড়ছিল কেমন করে?

বাবার সাথে সাথে দাদিও আমাকে সহ্য করতে পারে না। বছরের যেটুকু সময় আমাকে বাবা আর আপার সাথে দাদিবাড়িতে কাটাতে হয়, আমি সবসময় চেষ্টা করি দাদির নজর থেকে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে। আমাকে সামনে পেলে শুধু শুধু বকাবকি শুরু করে দেয় দাদি। হঠাৎ করে আমার জন্ম হওয়ার আগে সবকিছু নাকি ঠিকঠকমতোই চলছিল। আমি এসেই সব আনন্দ পণ্ড করে দিয়েছি। আমার জন্ম হওয়াতে মা মারা গেছে। তার পরপরই বাবার চাকরি চলে গিয়েছিল। যদিও মাস ছয়েক পরে বাবাকে আবারও চাকরিতে বহাল করা হয়েছে কিন্তু সেই ছয় মাসে দাদি আমার উপরে দোষ চাপিয়ে, তাদের সব দুর্ভাগ্যের একমাত্র কারণ হিসেবে আমাকে আবিষ্কার করে ফেলেছে। এই সবকিছুর থেকে দূরে আমাকে আগলে আগলে রেখেছে বড় আপা। তার প্রথম প্রাণবন্ত খেলনা ছিলাম আমি। তার বুকের ওমে মুখ ডুবিয়ে, তার চুলের গন্ধ শুঁকে আমি বড় হয়েছি। সবরকম ঝড় থেকে স্নেহের পালক বিছিয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকা আমাকে সে বারবার আশ্রয় দিয়েছে। সমস্ত অশুভ থেকে আড়াল করে রেখেছে। আর সেজন্যই তো তার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি। আপার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে আমি খুব একা হয়ে গেলাম। কেবলই মনে হয় আমি মাঝসমুদ্রে ঘুরেফিরে বৃত্তাকারে ওড়া একটা দলছুট গাংচিল। আত্মীয়, সম্পর্ক সবকিছু থেকে একটু দূরত্ব রেখে কেবল উড়ে বেড়াচ্ছি, কোথাও বসে সামান্য জিরিয়ে নেবার কোনো জায়গা সেই। তবে এটা ঠিক যে আপা যেন কষ্ট না পায় তাই অনেক ভয়ঙ্কর সত্যও তার কাছ থেকে আমি লুকিয়ে রাখতে পারি। আমি প্রায়ই বাইরে থেকে এসে দেখি নকল ঝুনু বসে বসে ফন্দি আঁটছে কখন, কী করে সে আপাকে সব গোপন কথা বলে দেবে। তার ইচ্ছেমতো অনেক কিছু করলেও এই কাজটা আমি কিছুতেই করি না। বিয়ের পরে আপার এই হাসিখুশি মুখটা নকল ঝুনুকে আমি কিছুতেই নষ্ট করতে দেব না।

বাবার কাছে আমাকে ভালো দেখানোর চেষ্টা করতে করতে আপা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, আমি জানি। বিয়ের পরও সে তার স্কুলে পড়ানোর কাজ শেষে প্রতিদিন এ বাড়ি হয়ে যায়। স্কুল থেকে এসে অনেক সময় আপাকে বাসায় দেখলে আমি দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরি। বাসায় ঢুকতে ঢুকতে আমি স্কুলড্রেসের বেল্টটা খুলি, আর আমার ঘরের দিকে যেতে যেতে বেল্ট দিয়ে বাঁধা ওড়না। তারপর আপার দিকে পেছন ফিরে বলি, আপা, কামিজের জিপারটা খুলে দাও তো—কখনো জিপার খুলতে খুলতে আপা মাথায় হাত বুলিয়ে একটু আদর করে দেয়, তখন আমার কী যে ভালো লাগে! তারপর বাবার খোঁজখবর নিয়ে আপা তার বাসায় চলে যায়। সেদিনও এমনই একটা সাদামাটা দিন ছিল। আপার সাথে যে দুলাভাইও এসেছিল আমি জানতাম না। আমার ঘর থেকে যথারীতি ওড়না খুলে যেই মাথা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে জামার জিপার খুলে চাইতে বেরিয়েছি, দেখি ডাইনিং স্পেসে আপার জায়গায় দাঁড়িয়ে দুলাভাই। আপা মনে হয় তখন বাবার ঘরে। দুলাভাইকে দেখে ঘুরে দাঁড়াতেই মনে হলো আমার পিঠে একটা হাত। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই হাত আমার জিপার খুলে বগলের নিচে দিয়ে বুকের ওপরে। আমার মুখে শব্দ বের হতে গিয়েই বাধা পায় একই মানুষের আরেকটি হাতের চাপে। তারপর সেভাবেই কখন আমি ঠেলা খেয়ে আমার ঘরে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি, কিছুতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারিনি, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল হাতের চাপে। হাত সরাতেই শ্বাস নিয়ে ঘুরে দেখি দুলাভাইয়ের লাল টকটকে চোখ। সেদিন সেই চোখ ইশারায় আমাকে বলে দিয়ে গিয়েছিল যে এ কথা কিছুতেই কাউকে বলা যাবে না, আপাকে তো নয়ই। অনেক রাত পর্যন্ত সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি আমাকে ঘুমুতে দেয়নি। আর সেদিনই প্রথম মাঝরাতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে আমার বিছানায় আমাকে দেখলাম। দেখি ফোন হাতে নিয়ে রাতদুপুরে বসে আমি কাঁদছি। ক্রমাগত কাঁদছি আর ভাবছি, আপাকে কি ফোন করে জানাব? আমি কাঠ হয়ে বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলাম, এ কে? এ এমন করছে কেন? আপাকে সব জানিয়ে দেবে না তো! আমার ইচ্ছে হলো পাগলের মতো তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমার জন্য এ বাড়িতে অনেক কিছুই তো হয়েছে, এবার কি আমার জন্য আপার সংসারটাও তছনছ হয়ে যাবে? আমি দরজার ধারে চৌকাঠের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে তার কাণ্ডকীর্তি দেখতে লাগলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই, সকালে ঘুম ভেঙে দেখলাম আমি পাপোশের উপরে ঘুমিয়ে আছি।

দুলাভাই প্রায়ই অফিস শেষে আপাকে নিয়ে যাওয়ার নাম করে আসতে লাগল। কোনো এক সুযোগে এ ঘরে ঢুকে আমার শরীর হাতড়ে চলে যেত। মাঝে মাঝে এমনও হতো যে সবাই এক ঘরে থাকা অবস্থায় আপা একটু অন্য দিকে তাকালেই একবার ছুঁয়ে দিল কোমর তো আর একবার বুক। আমি নির্জীব হয়ে যেতাম, আমার মুখ সাদা হয়ে যেত। আপা হঠাৎ ফিরে তাকিয়ে বলত, ‘কী রে, ঝুনু, তোর পরীক্ষা সামনে, খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করিস তো? তোকে কেমন ফ্যাকাশে দেখায় আজকাল।’ কোনোভাবে আমাকে ধরার সুযোগ না পেলে দুলাভাই বাবা আর আপার সামনেই হাসতে হাসতে বলত, ‘টেস্ট পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন, ঝুনু? আসো তো তোমার পাটিগণিতটা একটু টেস্ট করি’—আপা সাথে সাথে বলত, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি একটু দেখো তো, সারাদিন স্কুলে বাচ্চা পড়িয়ে বাসায় এসে এসব ভাবতে আমার আর ভালো লাগে না।’ সুড়সুড় করে দুলাভাইয়ের সাথে আমাকে ঘরে চলে যেতে হতো। আর আমি জানতাম এরপর কী হবে।

টেস্ট পরীক্ষার পরে আমার ক্লাস শেষ হয়ে গেল। সারাদিন ঘুরেফিরে পড়াশোনা করাই তখন আমার কাজ। দুপুরে কলিং বেল শুনে ভাবলাম বাবা নিশ্চয়ই আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে এসেছে। দরজা খুলে দেখি দুলাভাই। কিছু বলার আগেই সে আমাকে ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর আর কিছুই বলার সুযোগ হয়নি। একটা দানব আমাকে আমার বিছানার সাথে চেপে ধরেছিল। আমার দুই হাত অসহায় যীশুর মতো দুদিকে দুলাভাইয়ের গজালের মতো হাত দিয়ে আটকানো ছিল। অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু প্রতিবাদ করার শক্তি ছিল না। দাদিবাড়িতে যাওয়ার সময় লঞ্চের জানালা দিয়ে ধবধবে দুধসাদা ফেনাগুলোকে যেমন ফুলেফেঁপে উঠতে দেখি, তখন আমি তেমনি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু আমি জানি পরমুহূর্তে ফেনা নিজেই আবার ছড়িয়ে গিয়ে লঞ্চের ছায়া পড়া কালো কুচকুচে পানির কাছে আত্মসমর্পণ করে। কালো পানির সাথে মিশে যাওয়ার পরে তার সেই ভয়ঙ্কর অস্তিত্ব আর আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন কোথায় কালো পানিকে ছাড়িয়ে ওঠার সেই উত্তেজনা? কেবলই নতি স্বীকার! আমার পাশে দাঁড়িয়ে নকল ঝুনু অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করেছিল, বারবার জানালার কাছে দৌড়ে গিয়ে পাশের বাসার খালাকে ডাকতে গিয়েছিল। কোনো লাভ হয়নি। তার বিকট আওয়াজ, তীব্র আর্তনাদ কেউ শুনতে পায়নি। দুলাভাইয়ের তাণ্ডব শেষ হলে নকল ঝুনু ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে উন্মাদের মতো ধমকে উঠেছিল, ‘বলে দাও যে তুমি আপাকে বলে দেবে, বলে দাও, বাবাকে বলে দেবে।’ তার কথা শুনে আমি খুব ভুল করেছিলাম সেদিন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড়গুলো কুড়িয়ে পরতে পরতে যেই দুলাভাইকে আপা আর বাবাকে বলে দেবার হুমকি দিয়েছিলাম, সে আমাকে বাথরুমে টেনে নিয়ে গিয়ে বালতির জমানো পানিতে আমার মাথা ডুবিয়ে রেখেছিল কিছুক্ষণ। কাশতে কাশতে নাক-মুখ দিয়ে যখন সমানে পানি ঢুকে যাচ্ছে, চুল টেনে আমার মাথা উঠিয়ে লাউডস্পিকারের মতো শব্দে সে জানতে চেয়েছিল, ‘কী বলবে?’ জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে আমি ভেবেছিলাম, তাই তো, কী বলব আপাকে! আমি জানি কয়েক মাস পরে আপার বাচ্চা হবে। আপা প্রতিদিন সেই বাচ্চার জন্য কত স্বপ্ন বোনে! স্কুল থেকে এসে ওইটুকু সময়ের মধ্যে চকচকে চোখে আমাকে সেসব শোনায়, ছেলে হবে না মেয়ে, কী নাম রাখবে—আপার স্বপ্নগুলো গুঁড়িয়ে দিতে মন কিছুতেই সায় দেয়নি।

গত এক মাসে এগারো দিন দুলাভাই ভর দুপুরে এসে হাজির হয়েছে। কিন্তু আজকের দিনটা কেন যেন অন্যরকম। আজ সকাল থেকেই নকল ঝুনু ক্রমাগত আমাকে একটাই দৃশ্য দেখাচ্ছে। একই কাজ সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করছে। দরজায় কলিং বেল বাজছে, নকল ঝুনু রান্নাঘর থেকে ছুরি নিয়ে দরজা খুলেই সামনে দুলাভাইকে পেয়ে যাচ্ছে। তারপর দুলাভাইয়ের বুকে ছুরিটা সেঁধিয়ে দিচ্ছে। একই ঘটনা চোখের সামনে বারবার ঘটতে দেখতে দেখতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তাই চুলের ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে টেবিলের ওপরে খোলা ভূগোল বইয়ে মাখা ঠেকিয়ে রেখেছি। নকল ঝুনু আমার চুল ধরে টেনে উঠিয়ে আবার একই কাজ করে দেখাচ্ছে। দরজার চারপাশটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে আর তার মাঝখানে দুলাভাইয়ের পলিশ করা দুটো জুতোর তলা দেখা যাচ্ছে।

হ্যাঁ, সত্যিই বেল বাজছে। আমি কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াই। রান্নাঘরে যাই, নিঃশব্দে ড্রয়ার খুলে বড় ছুরিটা হাতে নিই; ঘরে কোনো মানুষ নেই, তবু, এত ধীরে যেন কেউ কোনো শব্দ না পায়। বাবা কদিন আগে কোরবানি ঈদের সময় ছুরিটায় নতুন করে ধার দিয়ে রেখেছিল। এখনো তেমনই তীক্ষ্ন আছে। দরজা খুলতে দেরি দেখে বেল আবার বাজছে। আগের চেয়েও অল্প বিরতিতে বেজে চলেছে। আমি ছুরি নিয়ে দরজার দিকে এগোই—আমি আসল ঝুনু নাকি নকল? কিছুতেই বুঝতে পারছি না!

এ সম্পর্কিত আরও খবর