কাল্পনিক লিলিপুটদের বাস্তব আবাসভূমি

, শিল্প-সাহিত্য

ফজল হাসান | 2023-08-26 02:48:16

ছেলেবেলায় স্কুলে বিশ্বনন্দিত আইরিশ লেখক জোনাথন সুইফট-এর (১৬৬৭-১৭৪৫) উপন্যাস ‘গালিভার’স্ ট্রাভেলস্’ আমাদের পাঠ্য ছিল। ব্যঙ্গাত্মক এবং ফ্যান্টাসিমূলক এই উপন্যাসের কাহিনীর পুরোটাই কাল্পনিক। প্রায় তিনশো বছর আগে উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থটির ব্যাপ্তি নিয়ে প্রকাশক জন গ্রে ১৭২৬ সালে বলেছিলেন, ‘বইটি বিশ্বব্যাপী পড়ার মতো, ক্যাবিনেট কাউন্সিল থেকে শুরু করে নার্সারী লেভেল পর্যন্ত।’ আসলে জন গ্রের কথাটাই ধ্রুব। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা এতদিন পরে আজও এই আলোচিত এবং আলোড়িত গ্রন্থটির চাহিদা সারা বিশ্বজুড়ে।

স্কুলে বিনোদ বিহারী চক্রবর্তী স্যার আমাদের এত সহজ এবং সাবলীয় ভাষায় ‘গালিভার’স্ ট্রাভেলস্’ পড়িয়েছেন যে, আমরা ক্লাশে প্রায় সবাই একটা ঘোরের মধ্যে বুঁদ হয়ে থেকেছি। স্যারের পড়ানোর সময় আমাদের মধ্যে অনেকের এমন ভাব ছিল যেন আমরাও বুঝি লেম্যুয়েল গালিভারের সফরসঙ্গী এবং তার সঙ্গে সমস্ত পরিস্থিতির মোকাবেলা করে নানান ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। প্রায় আটচল্লিশ বছর পরেও আমার স্পষ্ট মনে আছে লিলিপুট এবং ব্রবডিংনাগের কাহিনী। দৈহিক গড়নে লিলিপুটের মানুষজন ছিল খর্ব এবং সেখানে গালিভার ছিল রীতিমতো দৈত্য। অন্যদিকে ব্রবডিংনাগের মানুষদের আকৃতি ছিল বিশাল এবং সেখানে গালিভার ছিল খর্বাকৃতির।

অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা শহরের অদূরে নির্মিত ‘ককিংটন গ্রিন গার্ডেনে’ গেলে প্রতিবারই আমার ‘গালিভার’স্ ট্রাভেলস্’-এর লিলিপুটবাসীদের কথা মনে পড়ে। পড়বেই না কেন? কারণ সেখানে দৈহিক গড়নের দিক থেকে আমি এবং আমার মতো দর্শনার্থী সবাই হলাম লেম্যুয়েল গালিভার এবং আশেপাশের সবকিছু লিলিপুট শহরের মতো ছোটখাটো আকৃতির। ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের ভেতরের রাস্তায় হাঁটলে তাই মনে হয়।

মানুষের তৈরি প্রত্যেক সৃষ্টি কিংবা আবিষ্কারের পেছনে কোনো না-কোনো ঘটনা বা কাহিনী জড়িয়ে থাকে। তবে ‘গালিভার’স্ ট্রাভেলস্’ রচনার আড়ালে সুইফট্ সাহেবের মতিগতি কী ছিল, অথবা কী অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল তার মনের মধ্যে, কিংবা কোথা থেকে তিনি উপন্যাসটি লেখার উৎসাহ পেয়েছিলেন, তা আমার জানা নেই এবং আমি কোথাও কোনো তথ্য খুঁজে পাইনি। তবে বর্তমান সময়ের কাল্পনিক লিলিপুটদের বাস্তব আবাসভূমি ‘ককিংটন গ্রিন গার্ডেন’ নির্মাণের নেপথ্যে যে ঘটনা বা কাহিনী জড়িয়ে আছে, তা আমার জানা।

ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৭২ সালের কোনো এক সময়ে। সেই সময় ডাগ (ডাগলাস-এর সংক্ষিপ্ত) এবং ব্র্যান্ডা সারাহ্ দম্পতি ইংল্যান্ড ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ভ্রমণের এক পর্যায়ে তারা ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ডেভন শহরের সামুদ্রিক এলাকা ট্যরকোয়ের কাছে বাবাকোম্বের আদর্শ গ্রাম (মডেল ভিলেজ) পরিদর্শন করেছিলেন। সেই আদর্শ গ্রাম দেখে তারা এত বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, ফিরে এসে অস্ট্রেলিয়ায়, বিশেষ করে ক্যানবেরার আশেপাশে, পর্যটকদের জন্য সেই আদলে একটি মিনি গ্রাম তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। পুরো এক বছর তাঁরা অর্থনৈতিক অবস্থা, সম্ভাব্য জায়গা, নির্মাণ ব্যবস্থা এবং স্থানীয় আবহাওয়া উপযোগী গাছ-গাছালি নিয়ে গবেষণা করেন। অবশেষে ১৯৭৬ সালের শেষের দিকে দুই একর জমির ওপর তারা ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের নির্মাণ কাজ শুরু করেন, বিশেষ করে মেইন এনট্র্যান্স বিল্ডিং, প্রদর্শন এবং বাগানের ল্যান্ডস্ক্যাপিং। ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৭৯ সালে এবং উদ্বোধনের পরে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, উদ্বোধনের পরে বিভিন্ন সময়ে প্রদর্শনীর জায়গার কলেবর বৃদ্ধি করা হয়েছে। বছরের দুটি বিশেষ দিনে (বাবা দিবস ও মা দিবস) পরিবারের সবার প্রবেশ করার জন্য টিকেট ক্রয় করলে বাবা দিবসে বাবাকে এবং মা দিবসে মাকে বিনিমূল্যে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়, এমনকি বাবা কিংবা মায়ের জন্য আলাদাভাবে চা-চক্রের ব্যবস্থাও করা হয় ।

মূলত ককিংটন গ্রিন গার্ডেন দুটি আলাদা এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। এগুলো হলো মূল প্রদর্শনী এলাকা বা মেইন ডিসপ্লে এরিয়া এবং আন্তর্জাতিক অংশ। তবে লাল সুড়কির পায়ে চলা পথের দুপাশে এবং ডিসপ্লের চতুর্দিকে বাহারি ফুলের গাছ আছে। শিশু-কিশোরদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় ডিসপ্লে হলো বাগান থেকে বেরিয়ে আসার আগের মুহূর্তের ‘রোজ রুম ইনডোর এক্সিবিশন’। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি ।

মেইন এনট্র্যান্স বিল্ডিং পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই প্রথমে পড়ে মূল প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনী গ্রেট ব্রিটেনকে উৎসর্গিত। শুরুতেই একপাশে আছে মেইন এনট্র্যান্স বিল্ডিংয়ের রেপ্লিকা। এখানে আছে হাতে কাটা টার্ফ মেইজ বা গোলকধাঁধা, গ্রামীন বাড়িঘর এবং জনমানব, ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলার মাঠ এবং মেষদের জন্য চারণভূমির মতো অনেক ডিসপ্লে আইটেম। টার্ফ গোলকধাঁধা তিনশো মিটার দীর্ঘ। মালি মোট নয়শো মিটার হেঁটে দশ মিনিটে ঘাস কাটে এবং আরো কুড়ি মিনিটে গোলকধাঁধার আশেপাশে ছেঁটে সুনশান করে। দর্শনার্থীরা অবাক হয়ে প্রতিটি ডিসপ্লে খুঁটিয়ে দেখে, বিশেষ করে দক্ষ হাতের অপূর্ব কারুকাজ। এছাড়া মূল প্রদর্শনী এলাকায় দর্শনার্থীদের, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মনোরঞ্জনের জন্য রয়েছে ট্রেন ভ্রমণের ব্যবস্থা। মাত্র কুড়িজন উৎসাহী পর্যটক নিয়ে ১৯৮৮ সালে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে তেরশো যাত্রী নিয়ে বছরে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পথ চলে। শুরুতে ট্রেনটি কয়লায় চলত, কিন্তু পরবর্তীতে গ্যাসে রূপান্তরিত করা হয়। চারপাশের নান্দনিক দৃশ্যাবলির মাঝে কুঁ ঝিক ঝিক শব্দ তুলে ধীর গতিতে চলা এই ট্রেন যাত্রা শিশু-কিশোরদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এছাড়াও প্রদর্শনের জন্য আছে মডেল ট্রেন।


ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের মূল অংশে টার্ফ মেইজ বা গোলকধাঁধা

মূল প্রদর্শনী থেকে খানিকটা জায়গা পেরুলেই দেখা যায় আন্তর্জাতিক অংশ। এই আন্তর্জাতিক অংশ ১৯৯৮ সালে উদ্বোধন করা হয়। উল্লেখযোগ্য ডিসপ্লের মধ্যে রয়েছে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত প্রাগ-ঐতিহাসিক আমলের স্টোনহেঞ্জ এবং লিনমাউথ ক্লিথ রেলওয়ে, জর্ডানের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক শহর পেট্রার ট্রেজারি বা ‘ট্রেজারি অফ পেট্রা’, উক্রেনের সেইন্ট এন্ড্রু চার্চ, নিউজিল্যান্ডের ফার্ম হাউজ, স্কটল্যান্ডের ব্রেইমার ক্যাসেল, পেরুর মাচ্চু পিচ্চু, ইরানের প্যালেস অফ দারিয়াস, ক্রোয়েশিয়ার সেইন্ট মার্ক’স চার্চ, ইসরাইলের মাসাদা নর্দান প্যালেস, অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া প্রদেশের বেনডিগোর সেন্ট্রাল ডেবোরাহ্ গোল্ড মাইন এবং ইন্দোনেশিয়ার আদিবাসীদের বিশেষ ধরনের ঘর ‘টোরোগান’। এখানে তিরিশটিরও অধিক দেশের প্রতিনিধিত্বমূলক ডিসপ্লে স্থান পেয়েছে। তবে ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দেশের নতুন আইটেম নিয়মিতভাবে যোগ করা হয় ।


ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের আন্তর্জাতিক অংশে উক্রেনের সেইন্ট এন্ড্রু চার্চ

উল্লেখ্য, ককিংটন গ্রিন গার্ডেনে যেসব দেশের প্রতিনিধিত্বমূলক ডিসপ্লে নেই, সেসব দেশ ইচ্ছে করলে নাম লিখিয়ে রাখতে পারে। পরবর্তীতে গার্ডেনের কর্তৃপক্ষ সুযোগ ও সুবিধা মতো সংযোজন করবে। অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটক বা ভ্রমণার্থীদের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরার জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি উত্তম পন্থা। আমি মনে করি প্রতিনিধিত্বমূলক ডিসপ্লে স্থাপনের ব্যাপারে ক্যানবেরায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস নিঃসন্দেহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।


ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের আন্তর্জাতিক অংশে নিউজিল্যান্ডের ফার্ম হাউজ

ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের ভেতরে প্রবেশ করার মুখেই রাস্তার দুপাশে সারি সারি সুসজ্জিত ফুলের গাছ। পুরো গার্ডেন এলাকায় পঁয়ত্রিশ হাজারেরও অধিক ধরনের ফুলের গাছ আছে। ঋতু অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ লাগানো হয়। তাই সারা বছরই রং-বেরঙের ফুল ফোটে। এছাড়া আছে ডোয়ার্ফ ম্যাপেল গাছ, কনিফার এবং অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় গাছগাছালি। অনেক দর্শনার্থী থেমে প্রস্ফুটিত ফুলের পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে ছবি তুলে ভ্রমণকে সাক্ষী হিসাবে ধরে রাখে। অনেকে হয়তো কোনো অলস মুহূর্তে স্মৃতির ঝাপি খুলে ছবিগুলো বের করবে এবং নস্টালজিয়ার ধূসর জগতে কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকবে।


ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের প্রস্ফুটিত পুষ্পরাজির একাংশ

আগেই উল্লেখ করেছি, ককিংটন গ্রিন গার্ডেন থেকে বেরিয়ে আসার আগের মুহূর্তের ‘রোজ রুম ইনডোর এক্সিবিশন’, যা শিশু-কিশোরদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। এখানে রয়েছে দুটি ‘ডল হাউজ’ (বা পুতুল বাড়ি)। বাড়ি দুটির বিশেষ তাৎপর্য হলো নিঁখুত কারিগরি দক্ষতায় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে প্রতিটি অংশ নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রেগরিয়ান স্টাইলে নির্মিত ওয়েভার্লি ডল হাউজের অভ্যন্তরে চৌত্রিশটি কক্ষ রয়েছে এবং প্রতিটি কক্ষই সুসজ্জিত। অন্যদিকে ‘মিসরুল’ বাড়িটি অস্ট্রেলিয়ার লেখিকা ইথেল টার্নার রচিত এবং ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত ‘সেভেন লিটল্ অস্ট্রেলিয়ানস্’ কিশোর উপন্যাসের কথিত বাড়ির আদলে নির্মিত। বহুল প্রশংসিত এই উপন্যাসের কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে ১৯৩৯ সালে চলচ্চিত্র এবং ১৯৭৩ সালে টিভি সিরিজ তৈরি করা হয়।


ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের রোজ রুম ইনডোর এক্সিবিশনে ওয়েভার্লি ডল হাউজ

হাঁটাহাঁটির ক্লান্তি কিছুটা নিরসন করার জন্য এবং শুকনো গলাটা ভিজানোর উদ্দেশ্যে ককিংটন গ্রিন গার্ডেনের শেষ প্রান্তে অবস্থিত ক্যাফেতে ঢোকা আমার পুরোনো অভ্যাস। ফেনায়িত কাপুচিনোর ভরা মগ সামনে নিয়ে ভাবতে থাকি। আসলে কারোর মধ্যে অদম্য উৎসাহ এবং ভালো কাজ করার নির্ভেজাল মন-মানসিকতা থাকলে তার পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব। হয়তো অপ্রত্যাশিত বাধা-বিপত্তি এসে সাময়িকভাবে কাজের গতি শ্লথ করে দিতে পারে, কিন্তু চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারে না। কয়েক প্রজন্ম ধরে পারিবারিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে আসা ককিংটন গ্রিন গার্ডেন তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

একসময় আমি ধূমায়িত কফির ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে জমা করে এবং জিহবায় কাপুচিনোর গাঢ় স্বাদ লাগিয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসি। চোখের অদৃশ্য অ্যালবামে ডাকটিকেটের মতো সেঁটে রাখি নান্দনিক দৃশ্যাবলি এবং ডিসপ্লে আইটেমগুলো। প্রতিবার ককিংটন গ্রিন গার্ডেন থেকে বেরোনোর সময় আমার মনে হয় এখন যদি সুইফট্ সাহেব বেঁচে থাকতেন, তাহলে কাল্পনিক লিলিপুটদের বাস্তব আবাসভূমি দেখে তিনি নিশ্চয়ই যারপরনাই খুশি হতেন।

[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ছবি তুলেছেন ক্যানবেরা নিবাসী বন্ধু মোহাম্মদ কুদ্দুস। তবে ‘প্রস্ফুটিত পুষ্পরাজির একাংশ’ ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া ।]

এ সম্পর্কিত আরও খবর