কুকুরগুলোর চলে যাওয়া দেখি

, শিল্প-সাহিত্য

দেবদুলাল মুন্না | 2023-08-23 23:56:27

সকালে রেলস্টেশনে এসে দেখি মারজানা ওয়েট করছে। যাব ইন্টারলেকেন। ট্রেনে জুরিখ থেকে কয়েক ঘণ্টার পথ। ট্রেন ছোট ছোট গাঁ পেরিয়ে যাচ্ছে। দুপাশে গাঁয়ের বাড়িগুলো সুইজারল্যান্ডের তৈরি ঘড়ি কুকুসনেস্টের মতো। বাড়িগুলোর সামনের বারান্দায় নানা রঙের ফুলের গাছ। আমাদের ট্রেনটি বরফের পাহাড়ের নিচে একটি ছোট স্টেশনে এসে থামল। সেখানে পাহাড়ের ওপর চড়বার জন্য আরেকটি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দুজনেই ওই ট্রেনে উঠে বসলাম।

ট্রেনটি বরফের রেলস্কাটার কেটে কেটে উপরে উঠতে লাগল। বরফ, বরফ, চারিদিকে শুধু বরফ। হিম হাওয়া। মারজানার চুল উড়ে এসে পড়ছিল আমার মুখে। সেই চুলে বুনো ঘ্রাণ। মনে হলো, আমরা দুজনে এই জগতে নেই, ভরা হিম হাওয়ায় দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে উঠে যাচ্ছি উপরে অনেক উপরে। উপরে উঠতে উঠতে চারিদিকে বরফের পাহাড়গুলো হারিয়ে গিয়ে ট্রেনটি একটি বরফের গুহায় ঢুকল। নীলাভ আলোময়।

মারজানা আরো কাছে এসে আমার বসল। ফিসফিস করে বলল, ‘খুব কুল।’ বললাম, ‘আমরা কি জগতে আছি?’ আমরা খুব আকাশের কাছে চইলা আইসি। আচমকা আলো। ট্রেনটি দাঁড়িয়ে গেল। এবার কেবল পাহাড় আর পাহাড়। সেই পাহাড়ের ওপর সূর্যের আলো পড়ে রুপার কুচি ঝিকঝিক করছে যেন। একটি রেস্তোরাঁতে বসলাম। ডানপাশে বড় জানালা। অনেকগুলো লোমশ কুকুরে টানা স্টেজ গাড়ি পাহাড়ের খাদে খাদে ঢুকে পড়ছে। মারজানা জানতে চায়, ‘তুমি কয়টা খুন করেছো?’ বলি, ‘গুনি নাই।’ সে বলে, ‘তোমার লগে আমি দেখা করতাম না। কিন্তু দেখা না কইরাও তো পারলাম না।’

আমি বাইরে পাহাড়ে কুকুরগুলো দেখি। একটা সিগারেট ধরাই। কুকুর দেখি। ওই কুকুরগুলোর মতোই আমার জীবন। ঢাকার যাত্রাবাড়ি আমার মা থাকত। বাবা কে জানি না। মা আমার ভালোর জন্য একটা সরকারি এতিমখানায় দিয়ে দিয়েছিল। সেখানে বড়। সেখান থেকে সতের বছর বয়সে একদিন বেরিয়ে পড়ি। তখন এরশাদ আমল। টিএসসির ক্যাফেতে এসে বসেছিলাম। গোলাগুলি। শুনি শামসুননাহার হলের পাশে বাদল নামের কোন নেতা মারা গিয়েছে। পুলিশ রেইড দিয়ে অনেকের সাথে ধরে নিয়ে যায় আমাকেও। জেল খাটি। সেখানেই পরিচয় জুল্লুর সাথে।

এরপর কিভাবে যে কীরকম একের পর এক বাংলা সিনেমার ঘটনা আমার জীবনে ঘটতে থাকে, সব গুলিয়ে ফেলি। শেষমেশ ঘুরতে ঘুরতে এখানে। মারজানার সাথে আমার পরিচয় সোবহানবাগের একটা শপিংমলের সামনে। বছর দুয়েক আগে। বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছিল। ঢাকার মেয়ে। সুইজারল্যান্ডে আছে বছর দশেক থেকে। কিভাবে পরিচয় তা না বলি। কিভাবে যোগাযোগ এটাও না বলি। সবই কি বলতে হবে? আমি তো আর গল্প, নবেল লিখছি না। ওসব লেখলে সব কথা বলতে হবে কেন? ধারাবাহিকতারও দরকার নেই। শুরু আর শেষ যে কোনো সময় আমার জীবনে ঘটে আমি দেখেছি। যেখানে আমি শেষ, সেখানেই প্রকৃতির শুরু। হাহাহাহাহাহাহাহাহা।

মারজানা কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে, ‘ওইখানে পাহাড়ের ভেতর একটি বড় খাদ আছে। যাবে সেখানে?’

‘কী আছে সেই খাদে?’

‘খুব বড় খাদ। একটি বড় হলরুম। যারা কেউ কাউকে না চিনে ওখানে একসাথে থাকতে চায়, তারা ওখানে গিয়ে থাকে। কিস্তু কারো ওপর কারো অধিকার বোধ কাজ করার উপায় নেই। কারণ ডার্কনেস। একদমই আলো নেই। খাবার দাবার নিয়ে যেতে হয়। শেষ হলে বেরিয়ে যেতে হয়।’

খুব অবাক হয়ে গেলাম এমন কথায়। জানতে চাইলাম, ‘কেন এই ব্যবস্থা?’

মারজানা বলে ‘হয়তো অ্যাডভেঞ্চার, আবার শুনেছি অনেকে মাসের পর মাসও থাকে। কেয়ারটেকারকে ম্যানেজ করতে পারলে নাকি খাবার পাওয়া যায় ফুরিয়ে গেলে। তবে আলো নেই। থাকতে হবে অন্ধকারেই। দেখা গেল তুমি অন্য কোনো মেয়েকে মারজানা ভেবে কিস করে বসলে বা আমিও তেমন। কেউ কারো না। আবার সবাই যেন সবার।’

জানতে চাই, ‘নাম কী?’

মারজানা বলে, ‘অ্যালেইন ক্যাম্প।’

আমি মারজানার হাত ধরি। বলি, ‘চলো।’

মারজানা হাসতে হাসতে বলে, ‘মাথা খারাপ, তুমি একটা খুনি। তোমার সাথে কাটাব, ভাবলে কী করে?’

আমিও বলি, ‘ঢং করলাম, যাব না, চলো সামনে হাঁটি।’

আমি আর মারজানা পাহাড়ী পথে হাঁটি। একথা সেকথা বলি। তার বেবিদের খবর নিই। বরের। জানতে চাই বাংলাদেশ কবে আর ফিরবে? ধানমণ্ডির লেকপাড়ে কতদিন বসা হয় না। এসব অহেতুক কথা, তবু বলি। বলতে বলতে এমন একটি খাদের পাশে এসে দাঁড়াই দুজনে যে, নিচে তাকিয়ে মারজানা বলে ওঠে, ‘This is the way the world ends This is the way the world ends This is the way the world ends Not with a bang but with a whimper…

—টিএস এলিয়টের কবিতা, নাম শোননি তাই তো?’

আমার জন্য আবার কবিতা! আমার মায়ের মুখ ভাসে। মুখে রংচং মেখে বাসায় বসে থাকে। সিগারেট ফুঁকছে। অপেক্ষা করছে। কেউ আসবে। বা একদল আসবে। কেউ নাও আসতে পারে। তাদের নিয়ে বেডরুমে ঢুকে দরজা লক করে দেয়। আমি ভাতের থালায় ভাতগুলোকে নিয়ে মেঝেতে ফেলে খেলি। ভাতের ঘ্রাণ নিই। ভাত মেঝেতে ঘষি। নিজের কথা লিখতে হলে শৈশবটাই আগে লিখতে হয়। আমার শৈশবের স্মৃতি খুব ধোঁয়াটে। মাঝেমধ্যে কিছু ঘটনা, কিছু ছবি মনে পড়ে, কিন্তু দীর্ঘ এবং সুললিত কোনো স্মৃতি নেই।

মনোবিজ্ঞান দিয়ে বিচার করতে গেলে এটাই বেরিয়ে আসবে যে, আমার শৈশব খুব আনন্দের ছিল না। তাই আমার অবচেতন সেই স্মৃতিকে সামনে আসতে দিচ্ছে না। এটা ঠিকই যে আমার শৈশব খুব স্বাভাবিক বা স্বাচ্ছন্দের ছিল না। সুখস্মৃতি থাকলেও তা ভয় এবং অশান্তির মাঝখানে খানিকটা কমার্শিয়াল ব্রেকের মতো গুঁজে দেওয়া আছে। এরপর, ওই যে আমার সামনে মুখ ভাসে শেয়ালের মতো কান খাড়াওয়ালা এক জেনারেলের, যিনি অনেক অনেক টাকা দিয়ে মিন্টো রোডের এক বাসায় বলেছিলেন, ‘যত লাশ ফেলবে তত টাকা।’

আমি কুকুরগুলোর চলে যাওয়া দেখি পাহাড়ী পথে আর একটু আদর করার ভঙ্গিতে কাছে টানতে গিয়ে যেন ভারসাম্য রাখতে পারিনি এমন ভঙ্গিতে মারজানার দিকে ঝুঁকে যাই। কাজ হয়। মারজানা গড়িয়ে পড়ে খাদ থেকে খাদে। আমি এবার অ্যালেইন ক্যাম্পের দিকে এগুই। আর ফিরব না। ওখানকার খোঁজেই হয়তো বেঁচে ছিলাম এতকাল। গল্পটা একটা ল্যুপে চলবে, সেটাই নিয়ম। আমার চুল, আমার চোখ পেয়ে যাবে আরেকজন। তার নাম হয়তো বশীর, অশির, শান্ত বা এটসেটরা। বেদনার উত্তরাধিকার। The inheritance of pain.  এবার পর্দা পড়ল।

 

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর