ভালোবাসো, মৃত্যুশয্যায়ও, মৃত্যুশয্যাকেও

, শিল্প-সাহিত্য

হেলাল মহিউদ্দীন | 2023-08-24 10:01:20

নামাজি নামাজ পড়ছিলেন। মজনু (কয়েস) নামাজির সামনেই হাঁটাহাঁটি করছিল। নামাজ ভেঙে লোকটি মজনুকে পাকড়াও করে দু’এক ঘা লাগাল। বলল—নামাজির সামনে হাঁটাহাঁটি করলে গুনাহ হয়, জানিস না। মজনু বলল—অপদার্থ, ভণ্ড নামাজি! আমি তো প্রতি নিশ্বাসে-ভাবনায়-অস্তিত্বে লাইলি ছাড়া আর কিছুই দেখি না! যদি আল্লাহতেই তোর মন পড়ে থাকবে, অভিনিবেশ থাকবে, তবে আমাকে হাঁটাহাঁটি করতে দেখলি কিভাবে?

বোস্তামি, মনসুর হাল্লাজ, নেজামি, রুমি ও তাব্রিজির চিন্তা ছিল এই যে নিবিষ্ট সমর্পণই প্রেমির ‘ভালোবাসা’ এবং বান্দার ‘ইবাদত’-এর চাবিকাঠি। তাঁদের দৃষ্টিতে ভালোবাসা এক গভীর ইবাদত, ইবাদতও গভীরতম ভালোবাসা মাত্র। ‘ভালোবাসা’ এবং ‘ইবাদত’ শব্দ দুইটি সমার্থক। দু’টিই নিবিষ্ট সমর্পণ ও আত্মার একাত্মতা।

শিশু কয়েসকে তার নাম জিজ্ঞেস করা হলো। সে উত্তরে বলল ‘লাইলি’। পেন্সিল কাটতে নামল কায়েস। ছুরিতে কেটে চলছিল নিজ আঙ্গুল। তবু ব্যথার অনুভব নাই কয়েসের। লাইলি যেন কয়েসের ইবাদত।

মসনবি ঘরানার দ্বৈতছন্দপ্রধান এইসব কাব্য-রূপকল্পগুলো কেন শক্তিশালী? কেনইবা হাজার বছর পরও ভোলা যায় না? কারণ, প্রতিরূপের মাঝে নিজের অস্ত্বিত্ব লীন করে নিজেকে চেনার দর্শনটি গল্পচ্ছলে এমন সহজ করে শুধুমাত্র সুফি দার্শনিকরাই বলতে পারেন।

তাব্রিজি বলতেন ‘প্রতিরূপের মাঝে নিজের অস্ত্বিত্ব লীন করে দিয়ে নিজেকে চেনো।’ সক্রেতিস যেমন বলেছিলেন ‘নৌ দাইস্যেলফ’—নিজেকে জানো। ‘প্রতিরূপ’কে ‘অপর’ বা ‘অন্য’ ভাবা ভুল। আয়না দেখার পদ্ধতির মতো। তবে আয়নায় ভেসে উঠবে ভিন্ন প্রতিচ্ছবি। সেই প্রতিচ্ছবিতে বিলীন হয়ে নিজেকে চেনার তরিকাও ‘নৌ দ্যাইস্যেলফ!’ যে কারণে শিশু কয়েস নিজের নামও বলল লাইলি। পেন্সিল ছাঁটতে বসে নিজের আঙুলটিই ছেঁটে চলছিল সে।

‘মগজমস্তিষ্ক হতে যদি কাউকে বা কোনো ভাবনাকে তাড়াতেই না পারো বুঝে নিও ওখানেই আসলে মানুষটির বা ভাবনাটির থাকার কথা। ওইটিই তার আসল আবাস। আসল ঠিকানা।’ নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ডরিস লেসিং-এর সুফি লেখক হয়ে ওঠার পেছনে এই সুফি দর্শনটি ছিল বড় অনুপ্রেরণা। অগ্রবর্তী কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানও আত্মস্থ অন্তর্গত করেছিলেন ‘প্যাশন’—সুফি দর্শনের শিকড় প্রপঞ্চটি।

লায়লা-মজনু সুফি কাব্য। সে কারণেই প্যাশন-রূপকল্পের এত ছড়াছড়ি। ‘পাঞ্জ’ বা পাঁচটি প্রেমগাঁথা, শাহনামা, ইউসুফ-জোলেখা কাব্য বা কারবালা সংক্রান্ত কাব্যগুলোর সহজ-অকপট হৃদয়াবেগের ও দর্শনের সীমাহীন শক্তির আকর্ষণেই ডরিস লেসিং সুফিবাদী সাহিত্যচিন্তা ও সাহিত্যকর্মে ঝুঁকেছিলেন বলে জানাতেন।

সুফি দর্শনে ‘ভালোবাসা’ কামজ অনুভূতি নয়, বরং হৃদয় ও আত্মার মিথস্ক্রিয়ার অনিঃশেষ আকুতি। প্রতিরূপের মঙ্গল কামনায় প্রেমির হৃদয়-আত্মায় সদা-সর্বদা জপতে থাকা অন্তর্গত ইবাদত। যে ইবাদত শুধু নিজেকেই চেনায় না, বরং আত্মাকে এবং অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে, কালিমামুক্ত করে। বোস্তামির দর্শনসূত্রটিই নিলেন রুমি ও তাব্রিজি। বোস্তামির দর্শনসূত্রের একটি মূল উদ্দীপক ছিল মহানবীর অবিস্মরণীয় উক্তিটি—‘নিজের অন্তরের ক্লেদ-কালো কুটিল শয়তানটিকে (নফস) পরাস্ত করার যুদ্ধই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জেহাদ।’

বায়েজিদ বোস্তামির দৃষ্টিতে ‘ভালোবাসা’ উম্মুক্ত-উদার সীমা-পরিসীমাহীন! এই নিয়ে তাব্রিজি ও রুমির হৃদয়গ্রাহী আলাপচারিতা হয়। তাব্রিজি বললেন—ভালোবাসা যেন মুখোমুখি দুইটি কপাটহীন খোলা দরজা। (যাতে আশেক-মাশুকের নিত্য আসা-যাওয়া চলতেই থাকে)। রুমি বললেন—না জনাব, যেখানে কোনো দেয়ালই নাই সেখানে দরোজার দরকারই বা কী!

বোস্তামির দর্শনে ভালোবাসা আসলে ‘কৃতজ্ঞতা’ স্বীকার! মায়ের তৃষ্ণা মেটাতে বোস্তামি কী করেছিলেন? গভীর অন্ধকারে লম্বা সময় হেঁটে বহুদূরের কুয়া হতে পানি তুললেন। তারপর সারারাত মায়ের সিথানের কাছে পানি হাতে নিয়েই জেগে দাঁড়িয়ে থাকলেন। মা কখন জেগে উঠবেন, পানি চাইবেন সেই জন্য। রুমি ও তাব্রিজি বোস্তামির এই দর্শনটিই নিলেন। মানব-মানবীর ভালোবাসা তো বটেই, স্রষ্টা ও সকল সৃষ্টির ভালোবাসাটুকুও কৃতজ্ঞতা স্বীকারেই বেঁচে থাকে। একাগ্র অন্তর সমর্পণের নামই ভালোবাসা। আসলে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের অন্য নাম! এখনো বেঁচে আছি, মুহূর্তমাত্র আগে নিঃশ্বাসটি নিলাম। শ্বাসটি নেবার আগেই তো মরে যেতে পারতাম! কিন্তু মরিনি! এই যে মুহূর্তটি, সেও তো একটি উপহারই। সেই উপহারের শোকর গোজারই ভালোবাসা। ইবাদত।

রুমি এবং শামস তাব্রিজির মধ্যে কেউ কারো গুরু ছিলেন না কেউ কারো শিষ্যও ছিলেন না। কোলম্যান বার্কসেরও একই সিদ্ধান্ত। দুজন ছিলেন যেন পরস্পর সংলাপরত একই আত্মার দুইটি খণ্ড। সক্রেতিস যে রকম সংলাপ করতেন সে রকম সংলাপই চলত দুজনের। সাঁর্ত্রে এবং ব্যুভ্যোঁয়া যেমন বাহাস-বিশ্লেষণে বসতেন সে রকম। [আমরা ভুল করে বলি প্লেটো শিষ্য ছিল; আরিস্তোতল প্লেটোর শিষ্য ছিল ইত্যাদি।] সুফি দর্শনে স্রষ্টা প্রেমি। তিনি নিজেই সৃষ্টির প্রেমে কাতর। সকল সৃষ্টিকেই প্রাণ উজাড় করে শর্তহীনভাবে ভালোবাসেন। সমান প্রাণ উজাড় করা নিঃস্বার্থ প্রতি-ভালোবাসাটিই প্রত্যাশা করেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানব-মানবী, প্রাণীজগত, ফুল-পাখি-লতাপাতা, আকাশ-বাতাস সকল সৃষ্টিকে ভালোবাসলেই স্রষ্টাকে ভালোবাসা হয়, কৃতজ্ঞতা জানানো হয়, ইবাদত হয়।

ইবাদতের একাগ্রচিত্ততা নিয়ে তাবরিজি-রুমির একটি ঘটনা আছে। কেউ একজন কোনোভাবেই ইবাদতে একাগ্রচিত্ত হতে পারছিল না। অস্থির মন এদিক-সেদিক ছুটে যাচ্ছিল। রুমি বললেন—কারণ, মহামহিমকে তুমি ভালোবাসো না। ভীষণ ভয় পাও। পরকালের কঠিন শাস্তির ভয়ে বাধ্যবাধকতার ইবাদত করছো। তোমার একাগ্রতা কখনোই আসবে না। যিনি নিঃশ্বাস দেন; প্রাণ বাঁচানোর পানি দেন, বাতাস দেন, কণ্ঠে সুমধুর সংগীত-সুর দেন, পাখির কুহু কুঞ্জন, বনের মর্মর শোনার শক্তি দেন; বায়ু, ফুল-পাখি-লতাপাতা-আকাশ সমুদ্র সব তোমার সেবায় উজাড় করে দিয়ে রেখেছেন—বলো তো তিনি অ্যাতো সব উপহার কেন দিয়ে রেখেছেন? অসীম ভালোবাসায় তোমাকে আঁকড়ে রেখেছেন বলেই করেছেন। তুমি কৃতজ্ঞ হও, তাঁকেও ভালোবাসো। যিনি এমনই ভালোবাসার আধার তিনি তোমাকে শাস্তি দেবার জন্য একাট্টা হয়ে আছেন—এমনটি তুমি ভাবলে কিভাবে?

লোকটি যখন তাব্রিজির কাছে গেল একই কথাগুলোই শোনালেন তাব্রিজি। যেন রুমির কথাগুলোই কোনো এক অদৃশ্য শক্তি হুবহু তাঁর কণ্ঠে তুলে দিয়ে গেছে। রুমি আর তাব্রিজির ভাবনাজগতের একাত্মতা ছিল এমনই অবিচ্ছেদ্য! তাব্রিজি আরো বললেন—একজন স্বৈরশাসক ভয় দেখিয়ে তোমাকে দিয়ে অনেক কিছুই করিয়ে নিতে পারেন। তুমি তাকে ঘৃণা করো বলে কাজগুলো করবে। ভালোবেসে তো করবে না। ধরো সেই শাসকটি প্রজাদের ভালোবাসতেন। যুদ্ধের মাঠে তিনি আহত হলে তুমিই দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে পানির সন্ধানে ছুটবে। আর তিনি নিষ্ঠুর শাসক হলে পানি পানি বলে চিৎকার করলেও তুমি এড়িয়ে যাবে। কারণ, তার জন্য তোমার মন আর্দ্র হবে না। ঘরও রাজ্যই। তোমার প্রাণাধিকাও যদি কর্তৃত্বপরায়ণ হন, তোমাকে দখল করে রাখাই তাঁর উদ্দেশ্য হয়, তার জন্যও তোমার মন আর্দ্র হবে না। তুমি কৃতজ্ঞ থাকতে পারবে না। সম্মানের বিপরীতে সম্মান, কৃতজ্ঞতার বিপরীতে কৃতজ্ঞতার নামই ভালোবাসা।

সুফিরা অনন্তের প্রেমি, অনন্ত প্রেমি। তাঁদের প্রেমের ব্যাপ্তি মানবপ্রেম হতে প্রকৃতিপ্রেমে। প্রকৃতিপ্রেম হতে স্রষ্টাপ্রেমে। সুফি দর্শনের মূলে-শিকড়ে ভালোবাসার ফল্গুধারা। তাঁরা জানান দেন—ভালোবাসায় আকণ্ঠ ডুবে থাকতে পারা সৃষ্টিজগতের এক চিরন্তন তৃষ্ণা। ভালোবাসায় আকণ্ঠ ডুবিয়ে রাখতে পারাও সৃষ্টিজগতের আরেক অনিশেষ তৃষ্ণা।

সুফি দর্শনমতে প্রতিরূপের ভালোবাসায় বিলীন হয়ে নিজেকে চেনা, আত্মাকে পরিশুদ্ধ করাই ইবাদত। তাব্রিজি এবং রুমি বোস্তামি হতেই ধারণাটি নিয়েছিলেন। গুঢ় দর্শনটি ধরতে লিখেছিলেন—

I love the messenger—the mailman,
alike the letter of my beloved
All of us made this family!
I loved God,
loved his messenger of death too, verily!

ভালোবাসি প্রিয়ার চিঠি, যে পত্রবাহক, ভালোবাসি তাকেও ভালোবাসি।
ভালোবাসি মৃত্যুশয্যায়ও,
ভালোবাসি মৃত্যুশয্যাকেও!

এ সম্পর্কিত আরও খবর