ব্রহ্মাণ্ডের গোধূলিকাল

, শিল্প-সাহিত্য

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী | 2023-08-28 12:23:07

আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার সূচনা গ্যালিলেও’র হাত ধরে, তাঁর দুরবিনে চোখ রেখে, শুরু হয় ১৬১০ সালে। কিন্তু তার আগেই আধুনিক চিন্তাধারার বীজ রোপিত হয়। বলতে গেলে সেই বীজ রোপণের সালটা ১৫৪৩ অব্দ এবং কাজটা শুরু করেছিলেন প্রুশিয়ার পোলিশ বংশে জন্ম নেওয়া নিকোলাস কোপার্নিকাস। ‘অন দ্য রেভোল্যুশনস অব দ্য সেলেশ্চিয়াল স্ফিয়ার্স’ গ্রন্থে কোপার্নিকাস এক যুগান্তকারী ধারণা প্রদান করেন। দীর্ঘদিন থেকে জানা ছিল পৃথিবী স্থির এবং সূর্যসহ অন্য সব কিছু একে ঘিরেই ঘুরছে। পৃথিবীকেন্দ্রিক এই ধারণা সুপ্রাচীন। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে এই ধারণার এক গাণিতিক মডেল দেন ক্লডিয়াস টলেমি (৯০-১৬৮ খ্রিস্টাব্দ)। পূর্বসূরীরা জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে যা কিছু জানতেন তার এক অনবদ্য সংশ্লেষণ টলেমি তার ‘আলমাজেস্ট’ গ্রন্থে উপস্থাপন করেন। তিনি এই পৃথিবীকেন্দ্রিক ধারণার একটি গাণিতিক মডেলও স্থাপন করেন। মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে টেলিস্কোপ ছিল না। খালি চোখে মনোযোগী পর্যবেক্ষকরা যা দেখেছেন তারই ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কাজেই তাঁদের খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু টলেমির বইটি একটানা চোদ্দশত বছর এই মডেলকে প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু টলেমির মডেলে সংশোধন প্রয়োজন ছিল। মুসলিম বিশ্বের অনেক জ্যোতির্বিদই সেটার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু কোপার্নিকাস একটা চমৎকার সহজ গাণিতিক মডেল উপস্থাপনের মাধ্যমে দেখালেন যে, ‘পৃথিবী কেন্দ্রে আছে’ এটা না ভেবে সূর্যকে কেন্দ্রে ভেবে নিলে গ্রহ-তারাদের গতি ব্যাখ্যা করা সহজ হয়। এই সহজ কল্পনাটি একদিকে যেমন যুগান্ত সৃষ্টি করে, অপরদিকে তেমনি প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হয়।

নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)

কোপার্নিকাসের এই কাজটি শুধু ওখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটা একটা নীতিতে পর্যবসিত হয়—কোপার্নিকাসের নীতি। এই নীতি অনুযায়ী পৃথিবী কোনো কিছুর কেন্দ্রে নেই, এমনকি কোনো বিশেষ অবস্থানেও নেই, কোনো বিশেষ গুণের অধিকারীও নয়। এই মাঝারিত্ব বা মিডিওক্রিটি বিজ্ঞানে অনেক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করেছে। এই নীতির সম্প্রসারণ মহাবিশ্বের সার্থক মডেল সৃষ্টিতেও কাজে লাগে। মহাবিশ্বকে দিকনিরপেক্ষ ও সমসত্ত্ব ধরে নেওয়া হয়। এভাবে ভাবা হয়— আমরা পৃথিবী থেকে গ্যালাক্সিকে যেভাবে দেখছি, গ্যালাক্সির অন্য জায়গা থেকেও গ্যালাক্সিকে প্রায় অনুরূপ দেখা যাবে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি থেকে মহাবিশ্বকে যেমন দেখায়, স্থানীয় পার্থক্য বাদ দিলে অন্য গ্যালাক্সি থেকেও মহাবিশ্বকে মোটের ওপর তেমনই দেখাবে। এটাই মহাজাগতিক নীতি বা কসমোলজিক্যাল প্রিন্সিপল। এই নীতির জন্যই আমরা পুরো মহাবিশ্ব নিয়ে মডেল তৈরি করতে পারি। কম্পিউটার সিমুলেশন করে মহাবিশ্বের নানান প্যারামিটার গণনা করতে পারি। পর্যবেক্ষণের সাথে মিলাতে পারি। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি করতে না পারলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ভাবনাচিন্তা পূর্ণাঙ্গ হতো না। আর এই কাজটির পেছেনে আছে ঐ নীতি—আমরা মাঝারি, অন্যরা যেমন আমরাও তেমন। অন্য যেকোনো জায়গায় গেলে, আমাদের মতো গ্রহ ও পরিবেশ ঠিক ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে।

কিন্তু ইদানীংকালের পর্যবেক্ষণ এটা ঠিক সমর্থন করছে না। আমরা জেনেছি, সূর্য বামন নক্ষত্র হলেও গ্যালাক্সির অধিকাংশ নক্ষত্র সূর্যের তুলনায় ছোট। গ্রহ পাথুরে হলেই তা প্রাণবান্ধব হয় না। বাহ্যগ্রহ (exoplanet) মানেই সেটাপ্রাণবান্ধব এবং পৃথিবীসদৃশ হবে, এমনটিও নয়। মূলত বেশিরভাগ বাহ্যগ্রহই ‘হট জুপিটার’। অর্থাৎ এইসব বাহ্যগ্রহের বেশিরভাগেরই ভর বৃহস্পতি গ্রহের মতো বিশাল (বা তারও বেশি) এবং এদের অবস্থিতি তাদের নক্ষত্রের অত্যন্ত কাছে (বুধগ্রহ যেমন সূর্যের খুব কাছে)। আগে মনে করা হতো, নক্ষত্রের অত্যন্ত নিকটে খুব বড় গ্রহ থাকতে পারে না। কিন্তু বাহ্যগ্রহদের ভর ও নক্ষত্র থেকে তাদের দূরত্ব পর্যালোচনা করে দেখা যায় ‘হট জুপিটার’দের সংখ্যাই বেশি। সৌরমণ্ডলের উৎপত্তি বিষয়ক তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার জন্য ‘হট জুপিটার’দের এই আধিক্য সমস্যাজনক। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই কাজে আজকাল শক্তিশালী কমপিউটার সিমুলেশনের সাহায্য নিচ্ছেন। এমনকি আমাদের নিজেদের সৌরজগতের বিষয়েও এইসব সিমুলেশন বেশ চমকপ্রদ সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছে। যেমন প্লুটোর কক্ষপথেরও বাইরে এক বা একাধিক বড় গ্রহ ঘুরপাক খাওয়ার একটা প্রকট সম্ভবনা আছে বলে গ্রহবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। এমনকি আমাদের সৌরজগতের সুস্থিতি এবং সূর্যের নিঃসঙ্গতাও (সূর্য কোনো তারাস্তবকের সদস্য নয়, কেন নয়?) প্রণিধানযোগ্য।

এইসব বিষয়ে সতর্ক থেকেও এটুকু বলা যায়, আমরা কোনো কিছুর কেন্দ্রে না থেকেও যথেষ্ট বিরল। অনন্যসাধারণ না হয়েও সাধারণের ঊর্ধ্বে—যা সুলভ নয়। বিশ্বজগতে আমাদের অবস্থান সবদিক দিয়েই একদম ঠিক। আমরা বিশেষ কিছু নই, আমরা কোনোকিছুর কেন্দ্রেও নেই। এরকম গোল্ডিলক্স জগৎ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখানে সবকিছুই একদম ঠিক ঠিক।

বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড যদি মহাজাগতিক ধ্রুবক শাসিত হয়, যদি এর স্থানিক জ্যামিতি সমতল হয়, যদি এর বস্তু-ঘনত্ব ২৫% এর কম হয়, তাহলে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এর পরিণতি উন্মুক্ত হবে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারিত হতেই থাকবে। এই প্রসারণ ত্বরিৎ-হারে হতে পারে। যেটা ১৯৯৮ সালের গবেষণায় একাধিক জ্যোতির্বিদ দেখিয়েছেন। এই ত্বরণ ধ্রুব থাকতে পারে, কমে যেতে পারে, বেড়ে যেতে পারে। কোনটা হবে সেটা এখনই আমরা জানি না।

উন্মুক্ত এবং ত্বরিৎ প্রসারমাণ বিশ্বে পর্যাপ্ত দীর্ঘকাল পর আর কোনো কাঠামোই থাকে না। গ্যালাক্সি বিলুপ্ত হয়ে যায়, সব তারা নিভে যায়, কৃষ্ণবিবরগুলি হকিং বিকিরণ দিয়ে উবে যায়। এ অবস্থায় মহাবিশ্বে থাকে শুধু কিছু ব্যাপ্ত গ্যাস আর মৌলিক কণার সমাহার। কোনো কাঠামো নেই, কোনো শক্তির উৎস নেই—শুধুই পরিব্যাপ্ত ও অত্যন্ত হাল্কা গ্যাস। এই অবস্থা গ্যাসের প্রচলিত গতিতত্ত্ব অনুযায়ী তাপীয় সুস্থিতির (থার্মাল ইকুইলিব্রিয়াম) সমতুল্য। তাপীয় সুস্থিতি বা ইকুইলিব্রিয়ামে থাকলে কোনো ব্যবস্থার আর কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়, কারণ ঐ অবস্থায় সিস্টেমের এনট্রপি বা বিশৃঙ্খলার মাত্রা সর্বোচ্চ থাকে। ‘তাপীয় সুস্থিতির’ অন্য অর্থ ‘মৃতবৎ অবস্থা’। কোনো সিস্টেমের সকল উপাংশ যদি পরস্পরের সাথে একই তাপমাত্রায় থাকে, অর্থাৎ থার্মাল ইকুইলিব্রিয়ামে থাকে, তাহলে তাপের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। কাজেই শক্তির রূপান্তরও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে ভৌত পরিবর্তন থেমে যায়। একটি জীবন্ত কোষ সবসময়েই তার বাইরের পরিবেশের সাথে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। এই নন-ইকুইলিব্রিয়ামই প্রাণের লক্ষণ। কোষ যখন মারা যায় তখন বাইরের সাথে তার ইকুইলিব্রিয়াম ফিরে আসে।

মহাবিশ্বের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার একটু এদিকওদিক হলেই এখানে প্রাণই সৃষ্টি হতো না, বুদ্ধিমত্তা তো দূর কি বাত! মহাবিশ্বের ক্রমপরিণতির এমন এক পর্যায়ে আমরা বাস করছি যখন বিশ্বময় নতুন নক্ষত্র সৃষ্টি কমে আসছে, মহাবিশ্বের ত্বরিৎ প্রসারণ হচ্ছে, ডার্ক এনার্জি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ১০০ বিলিয়ন বছর পর কোনো বুদ্ধিমান সত্তাই আর দূরাগত কোনো গ্যালাক্সির আলো দেখবে না। তার পক্ষে বিগ ব্যাং বোঝাটাই শক্ত হবে। মনে হচ্ছে, যেন আমরা মহাবিশ্বের এক গোধূলি সঙ্কটের একদম প্রারম্ভে অবস্থান করছি।

অনেক বিজ্ঞানীই বলছেন যে, আমরা মহাবিশ্বের সর্বোত্তম সময়ে বাস করছি। এটা এমন একটা সময় যখন মহাবিশ্ব একটা দীর্ঘ গোধূলিকালে প্রবেশ করছে। মহাবিশ্বের প্রায় সকল স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরক ক্রিয়াকলাপ থেমে গেছে। ডার্ক এনার্জির প্রভাব বাড়ছে। মহাবিশ্ব ত্বরিৎ হচ্ছে। এই ত্বরণের ফলে স্থানীয় সুপারক্লাস্টার বাদে আর সবকিছু দূরে সরে যাবে। স্থানীয় সুপারক্লাস্টারে যেসব গ্যালাক্সি আছে তারা নিজেদের মহাকর্ষীয় বাঁধনে বাঁধা। ফলে মহাজাগতিক ত্বরণ এদের ওপর ক্রিয়া করে না। কিন্তু অন্য গ্যালাকটিক সুপারক্লাস্টারেরা ক্রমশ দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে। আগামী ১০০ বিলিয়ন বছরে আমাদের গ্যালাক্সি এবং অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি মিলিত হয়ে এক সুপারগ্যালাক্সি তৈরি করবে। রাতের আকাশ তখনও তারা ঝলমলে থাকবে। কিন্তু দূরবর্তী জ্যোতিষ্ক আর দেখা যাবে না। এই সময়ের কোনো জ্যোতির্বিদের পক্ষে বিগ ব্যাং আদৌ হয়েছিল কিনা সেটা জানাই মুশকিল হবে।

এদিকে নতুন নক্ষত্র সৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ বিগ ব্যাঙের সময়ে যতটুকু হাইড্রোজেন সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা ফুরিয়ে যেতে থাকবে। আরো ১০০ ট্রিলিয়ন বছর পর থাকবে শুধু বাদামী ও ধূসর বামন তারা, কৃষ্ণ বিবর এবং পরিব্যাপ্ত গ্যাস।

ভলতেয়ারের ‘কাঁদিদ’ উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট কাঁদিদের প্রিয় দার্শনিক প্যানগ্লসের মতে আমরা সম্ভাব্য সকল বিশ্বের মধ্যে সর্বোত্তমটিতে বাস করছি। কিন্তু নিজের জীবনের ঘটনাবলি থেকে কাঁদিদ দেখতে পায় যে আসলে আমরা একটা ঘটমান জগতে বাস করি যেখানে যা কিছু ভালো সেটা নিজেদেরকেই তৈরি করে নিতে হয়। ‘সবকিছুই ভালোর জন্য’ এই লাইবনিৎসিয়ান আশাবাদ এক মরীচিকা মাত্র।

কিন্তু আজকের ব্রহ্মাণ্ডে কোপার্নিকাসের মিডিওক্রিটির নীতিকে ছুটি জানাতে হবে, পৃথিবীর বিরলত্ব স্বীকার করে নিতে হবে, এবং মনে রাখতে হবে প্যানগ্লসের মতো আমরা সম্ভাব্য সকল কালের মধ্যে সর্বোত্তম কালে বাস করছি। এটা এমন এক সময় যখন মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা তত্ত্ব নির্মাণ করতে পারি, এবং অতিদূর জ্যোতিষ্কের আলো পর্যবেক্ষণ করে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি। দূর ভবিষ্যতে সেটা আর সম্ভব হবে না। তখন যদি কোনো ধীমান সত্তা বেঁচে থাকে তাহলে তাকে হয়তো দর্শন ও সাহিত্যের সাহায্যেই জগতের রহস্যভেদ করতে হবে। কসমোলজি বলতে আমরা যেটা বুঝি, সেটা তখন আর সম্ভবপর হবে না।

অতএব, এখন যৌবন যার, কসমোলজি শেখার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়!

এ সম্পর্কিত আরও খবর