১২ ভাদ্র, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ ছিল ইংরেজি ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট। ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভা কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। যিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান ও বহুমুখী সৃষ্টিশীলতার প্রতীক। সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিপুল জোয়ার এনেছিলেন তিনি।
নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। নজরুল ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৪ মে ১৮৯৯) অবিভক্ত বঙ্গদেশের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রবল দারিদ্র্য ও সংগ্রামের মধ্যে যে নজরুলের জীবন শুরু হয়, তার ডাক নামও ছিল ‘দুখু মিয়া’। নজরুলের জীবন বাস্তবতায় শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দুঃখ-বেদনা ছিল নিত্যসঙ্গী।
১৯০৮ সালে পিতার মৃত্যু হলে নজরুল পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য হাজী পালোয়ানের মাজারের সেবক এবং মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। তিনি গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। কিন্তু দারিদ্র্য তাকে নিয়মতান্ত্রিক জীবনের দিশা দেয়নি। তিনি রুটির দোকানের কর্মচারী, গানের দলের সদস্য, সৈনিক ও সাংবাদিকের পেশা বেছে নিয়েছিলেন জীবনের নানা পর্যায়ে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। রবীন্দ্র-পরবর্তী সাহিত্যাঙ্গনে নজরুল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
নজরুল সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। নজরুলও আদালতে লিখিত রাজবন্দীর জবানবন্দী দিয়ে এবং প্রায় চল্লিশ দিন একটানা অনশন করে ইংরেজ সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
গান, কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র তথা সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে নজরুল ঈর্ষনীয় অবদান রেখেছেন। কিন্তু তার সাহিত্যজীবন ছিল স্বল্প। জীবনের মধ্য গগনচুম্বী সময়ে তিনি নির্বাক হয়ে যান। রোগে, শোকে, অবহেলায় পর্যুদস্ত নজরুল অত্যল্প সময়কালে যে বিশাল ও বহুবিচিত্র সাহিত্যসম্ভার উপহার দিয়েছেন, তা শুধু বিস্ময়কর নয়, ইতিহাসের পাতায় তুলনাহীনও বটে।
ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে ১৯৭২ সালের ২৪ মে নির্বাক কবিকে সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়। বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর এক বিশেষ সমাবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে। মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পার্শ্বে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে।
বিদ্রোহী রণক্লান্ত' নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীতে অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বাঙালি জাতি স্মরণ করে বাংলা ভাষার এই মহত্তম প্রতিভাকে।