২২ অক্টোবর বাংলা কবিতার এক বেদনাময় দিন। কলকাতার সড়কে ট্রামে চাপা পড়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এদিন মারা যান জীবনানন্দ দাশ। সালটি ছিল ১৯৫৪। বাংলাদেশের বরিশালে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ সালে জন্ম নিয়ে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতায় অর্জন করেন স্বতন্ত্র অবস্থান। পরিণত হন আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসের অনন্য ও অপরিহার্য্য একজনে।
রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতার উজ্জ্বলতম তারকা জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দের তুলনা জীবনানন্দ স্বয়ং। প্রচলিত কাব্যপ্রসিদ্ধি ও কবিতা কাঠামোর চেনা পথে না হেঁটে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক নিজস্ব পথ। যে পথ নির্জন এবং একান্তই জীবনানন্দের।
বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ অক্লান্ত স্বপ্নদ্রষ্টা, অভিযাত্রী। প্রেম, ইতিহাস, বিপন্ন বিস্ময়, স্মৃতি, রৌদ্র, ইন্দ্রিয়, ক্লান্তি, অবসাদ, মৃদ্যু, এমন বহু কিছু নিয়ে তিনি কবিতায় কথা বলেন। নিজের মতো প্রশ্ন করেন, উত্তর খোঁজেন। জন্মস্থান বরিশালের ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে/বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’
কিংবা শুনতে পাই, ‘বনলতা সেন’ কবিতায় তাঁর সঘন, পরিব্যাপ্ত উপস্থিতি, যা আমাদের অনন্ত বিস্ময়ের দিকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে যায়। সুদূর ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তাকানোর পরে, জীবনানন্দ দাশ আমাদের কুহেলি-মাখানো বাংলার নাটোরে মুহূর্তে দাঁড় করিয়ে দেন। রূপ, গন্ধ ও স্পর্শের এক ব্যাখ্যাতীত জগৎ তাঁর কবিতায় যেভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা অন্য কোনও কবির ক্ষেত্রে বিরল।
রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘চিত্ররূপময়’। কারণ, কবিতার মধ্যে তাঁর শিল্পীসত্ত্বা বহুক্ষেত্রেই ব্যাখ্যাতীত। তিনি যখন উচ্চারণ করেন, ‘কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়/পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা’, তখন এই চিত্রকল্পের সামনে দাঁড়িয়ে পাঠকের মনে হয়, কবিতা যেন, ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো’।
আধুনিক বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব এখনও গভীর এবং মর্মস্পর্শী। তাঁর কাব্যভাষা এতোটাই স্বতন্ত্র যে, তাঁর অনুকৃতি সহজেই চোখে পড়ে। তিনি বাংলা কাব্যে ‘একটি জ্বলন্ত তারা’।
অথচ জীবনানন্দ দাশ জীবৎকালে ছিলেন অনালোচিত, স্তিমিত, বিদ্রূপবিদ্ধ ও অস্বীকৃত। মৃত্যুর অব্যবহিত আগে, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় তিনি ঝলসে ওঠেন বাংলা কবিতাকাননে। দিনে দিনে তিনি বাংলা কবিতা পাঠকের নিকটবর্তী ও প্রশংসা-ধন্য হয়েছেন।
কবিতার জন্য প্রতিকূলতা, উপেক্ষা, বিদ্রূপ, সমালোচনা সহ্য করে তিনি লিখে গেছেন ভব্যিষতের দিকে তাকিয়ে। তৈরি করেছেন রোমান্টিকতার এক ধূসর ও পরাবাস্তব মহাপৃথিবী।
সমকালের নিঃসঙ্গতা থেকে যে কবি কথা বলেছেন মহাকালের পাঠকের সঙ্গে, তিনি কালোত্তীর্ণ হয়েছেন। মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও স্মরণের আলোয় উদ্ভাসিত তিনি। তাঁর কবিতা প্রজন্ম ও পরম্পরা পেরিয়ে বাংলা কবিতার পাঠক-শ্রোতাদের কণ্ঠে কণ্ঠে গুঞ্জরিত।
তিনি ছাড়া বাংলা কাব্যের জগৎ কিছুটা হলেও অসম্পূর্ণ। তাঁর কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণতা নিয়ে আলোচনা এখনও অব্যাহত। আধুনিক বাংলা কবিতার দিগন্তে হেমন্তের কুয়াশা-মিশ্রিত আলো-অন্ধকারের রহস্যময়তায় তিনি সমাসীন।
'হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’, উচ্চারণের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কাব্য-মহাপরিক্রমা বা চরৈবেতির জন্ম দিয়ে জীবনানন্দ দাশ ‘শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা’ হয়ে নিত্য আসা-যাওয়া করেন চিরায়ত বাংলার আদি ও অবিমিশ্রিত বাঙালির মননে। ‘ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে (যে) চিল’, তেমন এক পাখির উড়ালে তিনি ‘পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে’ও জেগে থাকেন বাংলা কবিতার স্বর ও ব্যাঞ্জন বর্ণের শাশ্বত অস্তিত্বের সুগভীর গহীন প্রদেশে। তিনি বলতেই থাকেন, 'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়।'