পাপিয়া জেরীনের একগুচ্ছ কবিতা

, শিল্প-সাহিত্য

পাপিয়া জেরীন | 2023-08-25 17:59:57

একুশতম আঙুল

ওরা গিয়েছিল ট্রান্সিলভ্যানিয়ান পর্বতে
সমগ্র বল্কান চষে পায়নি তোমার ধাতব হাত
অথচ, আলপাইনে খনির ভিতর
তোমার একুশতম আঙুল আমার শরীরে
গেঁথে ছিল—
ধাতব ছুরির মতো।

ওরা দেখেছিল—
ভেড়ার দাঁতের ভিতর ঘাসের মিহি হাড়
আর আমার সোনালী চুলের শরীরে
তোমার পৌরব রোদ, সভ্যতার কালো ভ্রূণ;
পুরোনো হাড়গোড় আর দিনলিপি দেখে জেনেছিল—
দানিয়ুব আর কাস্পিয়ানের জলেজঙ্গলে আমরা দুজন লবণ ধুয়েছি, মিলিত হয়েছি অধীর সঙ্গমে,

ওরা তখনও সমগ্র ভূমধ্যসাগর চষে পায়নি তোমার
দুইশত সাততম হাড়,

অথচ, সে অদৃশ্য হাড় আমার শরীরে গেঁথে ছিল
ধাতব ছুরির মতো!

সঙ সার

ব্লন্ড স্ট্রিপারের উদ্দাম নাচের দৃশ্য মাথায় নিয়ে তুমি বিছানার কাছাকাছি। জিভ চুয়ে পড়ছে ট্রাইবাল মদ। আমাকে আদর করতে এসে নিজেকে হারিয়ে ফেলছো ড্যান্সিং পোলে; আমিও ভেবে নিচ্ছি তোমাকে বেগানা পুরুষ।

এইভাবে বিছানার চাদরে লেপ্টে গেল অনু অনু বিকার। আমাদের হামিং পৌঁছে গেল ব্যালকনিতে।
ওটা ঘেষে নেমে নিচে গেছে ল্যাম্পপোস্ট।

আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে দেখো নওল কিশোর—

ফ্রি ওয়াইফাই জোনে টেনে নিচ্ছে শীৎকৃতির রেণু, চিউউইং হাউল!

উত্থিত উত্থান

দেখেছি ভাস্কর
তোমার শরীরের ভিতর উত্থিত হার্পুন
তাক হয়ে আছে ফঁ-দ্য-গউম এর দেয়ালে দেয়ালে;

নিসর্গ থেকে টেনে তোমাকে করেছি টানটান
প্রতিটা মোচড়ে, ভাঙনে—প্রতিটা বিন্দুর উলম্ব রেখায়,
উৎক্ষিপ্ত জলের পিঠটানে বেঁকে গেছে তোমার চারপায়া জলপোকা!

তোমাকে দাঁড় করায়ে নিচ থেকে দেখেছি, ভাস্কর
চাপা পড়ে আছে পলিযুগ, অমসৃণ ঢেলা, টেরাকোটা নির্মোক, বিরল ফণী
তার উপরে নাভিকণ্টক—
যেন কেশর সমেত ঝুঁকে আছে সবুজ জামরুল;

তোমাকে উপুড় করায়ে দেখেছি
মোসেসের ইশারায় দুই ভাগ হয়ে আছে চাঁদ
গলেছে ছাতিম দুধের কষ,
সর্পগন্ধার মতো বেঁকে আছে রোম, সেজদায়।

নিসর্গ থেকে টেনে তোমাকে দাঁড় করায়ে রেখেছি, ভাস্কর—
প্রতিটা বিন্দুর উলম্ব রেখায়,
তোমার ভিতর উত্থিত হার্পুন তাক করে আছে
ফঁ-দ্য-গউম এর দেয়ালে দেয়ালে!

কবি

নতমুখ কবি,
এইখানে আত্মগোপনে
প্রেমিকার জেরার মুখে আপনাকে
বলে যেতে হয় মিথ্যার মতো মিথ;
বলেছেন তাকে—
স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হলে আপনি প্রেমিকার কাছে ছোট হয়ে যান!

দেখেন, আপনার প্রেমিকার মতো অনিচ্ছুক সঙ্গম শেষে
আকাশে কেমন উল্টায়ে আছে প্রকাণ্ডকায় চাঁদ!
আপনিও প্রতিরাতে লিখে চলেছেন ডিজিমডার্ন পোয়েট্রি,
নর্দমার কীট খেয়ে নিচ্ছে আপনার উৎসারিত বঙ্কিম শিশুদের;

আপনি নতমস্তকে, আর
শিশ্নের মতো দৈবচয়িত অক্ষর নেমে আসে কখনো ভোররাতে,
আসে আলমোরা আর সিকিমের পাহাড়ি হলদেটে মেয়েমানুষ
ময়ূখ মুদ্রাসমেত মেকরান নটীদল—

অথচ, আপনাকে জেরার মুখে বলে যেতে হয় মিথ্যার মতো মিথ

স্ত্রীকে বলেছেন, কিউনিফর্মের মতো গাঁথা আছে খাগের কলম
আর প্রেমিকা জানে—
স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হলে আপনি তার কাছে ছোট হয়ে যান!

ক্রসফায়ারের আগে

প্রেমিকা বলেছে—আমি পলায়নপর
বাবা বলেছে, পালিয়ে যা তুই!
আজ, একশত ষোলো দিন পর
প্রেমিকার শরীরের মতো কবরের ফাঁদে
পড়ে আছি;

ওরা আমার দাঁতগুলো ভেঙে দিয়েছে
পা দুটো দুমড়ে মুচড়ে...

মেহগনি বনে শুয়ে আছি অবসন্ন কাঠ

এইসব বনের ভিতর আমি কতবার কেটে রেখেছি মানুষ
রক্তের বুদবুদ দিয়েছি শিকড়ে
আজ সেই রক্তের কাছে একশত ষোলো দিন শেষে
পড়ে আছি অবসন্ন কাঠ!

পাতা ফুটো করা রোদের বুলেট
সারি সারি অস্ত্র ঝুলে আছে মাটির উপর
প্রেমিকা বলেছিল, আমি পলায়নপর,
পুলিশও জানে;

পড়ে আছি ভাঁজ হয়ে মায়ের জঠরে যেমন,
যেমন কবিতা শেষে যতিচিহ্ন পড়ে থাকে শেষ অবসাদে,
আর অতীত পাশে ধাত্রীর মতো স্থির—
দেখি—হাঁটু গেড়ে বসে আছি মাঠে
সেইখানে ফুলভরা ফ্রক তুলে ধরে আছে মেয়ে
ব্যথার মতো ফুল , ফুলের মতো কীট!

জিভের প্রাচীরে লবণ জমে আছে
আর কিছু রক্তের কালো দানা
এমন লবণ নিয়েছি ঝিনুকের মুখ শুষে
দেবদারু পায়ের ভিতর!

বাবা বলেছিল, ‘পালিয়ে যা’
প্রেমিকা বলেছে—আমি পলায়নপর

স্মৃতিরা চলে যাচ্ছে রেলগাড়ি
আমি পড়ে আছি অবসন্ন প্ল্যাটফর্ম
রাইফেল তাক করা আছে
অপেক্ষিত মিনিট-সেকেন্ড-বিট—

মনে হলো মেলায় দাঁড়িয়ে আছি
হাতের মুঠোয় চিনি-গড়া বাঘ, হাতী
বাবা বলছে—হারিয়ে যাবি, খোকা!

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর