তিনটি বিহ্বল সময়ের গল্প

গল্প, শিল্প-সাহিত্য

ফারজিনা মালেক স্নিগ্ধা | 2023-08-31 21:36:08

   এক

“আন্টি, একটু পানি দিবেন?”—এই কণ্ঠটা খুব ভোগায় ফাতেমাকে। সেই কোন সালের কথা… ক্যাম্পাসের ওই দিকটায় খুব একটা বাসা নেই। যে গ্রামগুলো সরিয়ে দিয়ে ক্যাম্পাসটা হয়েছিল, সেগুলা এখন ক্যাম্পাসের গা ঘেঁষেই পেছনে জড়াজড়ি করে বিন্যস্ত হচ্ছে।

পরিপাটি শান্ত ফাঁকা ক্যাম্পাসের সীমানা পার হলেই বহু জীর্ণ কাপড়ে মোড়া বুড়ো পাগলের মতো গ্রামগুলো প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে আপনার গায়ে। এই শান্ত সুন্দর পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাসকে আরো সুন্দর পরিচ্ছন্ন রাখতে এই গ্রামগুলো থেকে বউয়েরা আসে। তাদের স্বামীগণ আসে রিক্সা চালাতে, সবজি বিক্রি করতে। আর আসে ছেলেমেয়েরা। কখনো চা-সিগারেট বিক্রি করতে, কখনোবা ক্যাম্পাস পাড়ি দিয়ে ওই পাড়ের স্কুলে যেতে। সেইদিন প্রথম ফাতেমারা ক্যাম্পাসের বাসায় উঠেছে। গা ছমছম করা ভয় যে ভরদুপুর বেলাতেও মনে ভর করতে পারে তা ও বুঝেছে এই এখানে এসেই। এতগুলা দরজা জানালার ঘরে সবকিছু হুহু করে ঢুকে—বাতাস, দুপুরের গা তাতানো গরম, বিকালের সোনা রোদ, রাতের ঘুটঘুটি অন্ধকার—সব। ঢাকার ছোট্ট ঘুপচি বাসায় যে কয়টা পর্দা ছিল তা দিয়ে শোবার ঘরটা মোটামুটিভাবে আড়াল করা গেছে। অবশিষ্ট ঘরগুলোয় সব কিছুই অনায়াসে ঢুকে পড়ে। দুপুরের রোদ, বিকালের বাতাস আর রাতের অন্ধকার। আর ঢুকে সেই কালো ছেলেটির বড় বড় দুই চোখ—“আন্টি, এক গ্লাস পানি দিবেন?”

শহরে থাকা অবিশ্বাসী ফাতেমার হঠাৎ বুক ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়। এক নিমিষে মাথার মধ্যে ছিঁচকা চোর,  ছেলেধরা,  বিরাট ডাকাত,  ভূত,  জ্বিন সবাই আসে যায়। তারপরও পানি দেয় ফাতেমা। স্কুল ফিরতি পথে পানি পানে কৃতজ্ঞ কিশোর ফিরে যায় তার গ্রামে। শান্ত ক্যাম্পাস পার হয়ে তার ঘিঞ্জি গ্রামে। দুই দিনের মধ্যেই ফাতেমা পর্দা লাগায়। নিজ হাতে দুপুরের রোদ, বিকালের হুহু করা বাতাস আর রাতের অন্ধকার বন্ধ করে সে। কিন্তু জোর করে বন্ধ করা সেই কিশোরের কণ্ঠ কিভাবে কিভাবে করে যেন থেকে যায়— “আন্টি এক গ্লাস পানি দিবেন?
আন্টি, এক গ্লাস পানি দিবেন?”
যেন হাঁপিয়ে ওঠা জীর্ণ ঘিঞ্জি গ্রামগুলো ফাঁকা ক্যাম্পাসটাকে বলছে—
“আমাদের আর একটু জায়গা দিবেন?”
“আমাদের আর একটু জায়গা দিবেন?”

   দুই

আজকে স্বপ্নে “শখের কুটির”-এ ছিলাম, আমার নানুবাড়ি। এখনকার শখের কুটিরে না। আমার ছোটবেলার বাসাটায়। তখন বারান্দাটা ছিল না। ডাইনিং টেবিল ছিল রান্নাঘরের পাশের ঘরটায়। আমি তখন ওই ঘরেই; নানার সাথে। নানা বসা আছে বিছানাটায়। যেমনটা বসা থাকত সবসময়। পা দুটোকে যোগাসনের ভঙ্গিতে। ডান হাতটা ডান পায়ের হাঁটুতে। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে knee cap বুলাচ্ছেন। যেমন বুলাতেন আর কি! হাত বুলাচ্ছেন আর আমার দিকে তাকিয়ে মুখটা একটু একটু করে দোলাচ্ছেন। হাত আর মুখের নড়ানড়ি বা দোলাদোলি একই ছন্দে চলছে। আমি স্বপ্নেই বুঝি উনি কিছু একটা বলবেন। কথা শুরু করার প্রস্তুতিটা এমনই হতো। নানা একটু হাসলেন। এবার বলা শুরু করলেন... “আমি..”। দুই তিন সেকেন্ড থেমে আবার শুরু করলেন... “আমি... মনে করলা... আমি একটা ব্যাডার চাক্কা।” এর পরের পুরো ঘটনা আমি আসলে জানি। নানার বলার দরকার নাই। এটা আমার ছোট বেলার ঘটনা। তবুও নানা বলে যায়...। আঙুল দিয়ে জানালার বাইরে দেখায় “ওই যে দেখো”, উনার খাটটা ছিল জানালার পাশে। জানালা পার হলেই বড় উঠান। লম্বা দড়িতে সারি সারি করে কাপড় শুকাতে দেওয়া আছে সেখানে। আমি সেখানে তাকাই, আবার নতুন করে বলি “নানা কী?” আবার সেই মুচকি হাসি; চটকরে হাসি গিলে ফেলা। এইবার মুখ আর হাঁটুতে হাতের সাথে সাথে শরীরটাও একটু দোলানো। “ওই যে দেখো” বলে কাপড়গুলো যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে চিকন বাঁশের একটা খুঁটি—ওইখানটায় নানা আঙুল পয়েন্ট করে। সেই বাঁশটার উপরে একটা সাদা রঙের টুপি। এইবার নানা শরীর দোলানো বন্ধ করে। চোখ মুখ সিরিয়াস করে বলে “আমি ....আমি.... হইলাম একটা ব্যাডার চাক্কা। আজকে পুকুরে গেলাম গোসল করতে। গোসল কইরা, টুপিটারে ধুইয়া, চিপ্পা, নিজেই শুকা দিয়া দিছি।” ছোটবেলার মতো এ বেলাতে এসেও আমি বুঝতে পারি না এত ছোট একটা কারণে মানুষটার চোখে মুখে এত তৃপ্তি কেন? আমি টুপিটাকে দেখার জন্য খাটের পাশের দরজা দিয়ে উঠানে যেতে চাই। দরজা দিয়ে বের হয়েই দেখি বারান্দা। আমি স্বপ্নেই আবার চোখ বন্ধ করি। আমি এই বারান্দাটা চাই না। আমি ঘুমের মধ্যেই বুঝি বারান্দাটা থাকলে নানা থাকবে না।

আমি তাড়াতাড়ি বারান্দাটা ইরেজ করি
সামনেই রঙ্গন ফুলের গাছ
ওটাকে কী করব আমি?
ওটাকেও মুছব? ওটা কবে যেন বোনা?
আমার মনে পড়ে না... শুধু নানুর লেখা একটা কবিতা
আনমনিকে নিয়ে...
“তুমি আসবে বলে... রঙ্গন গাছে..”
কী যেন একটা হয়েছিল..
কিন্তু আনমনা তো নানা মারা যাওয়ারও একমাস পরের কথা!
নানা, টুপি, বারান্দা—এইসব আমার কাছে এখন তুচ্ছ। আমি আকুল হয়ে ভাবছি রঙ্গন ফুলের গাছটাকে কি স্বপ্ন থেকে ইরেজ করব? নাকি করব না?
বিছানায় আমার শরীর কুঁকড়ে যাচ্ছে;
আমি ঘামছি;
আর জান-প্রাণ দিয়ে ভাবছি,
ঠিক কতখানি সময়কে মুছে দিতে পারলে আমি আবার সেই সময়ে যেতে পারব?

   তিন

বরইয়ের সবুজ আর ঘাস, লতা-পাতার সবুজ কিন্তু আলাদা। শীতকালের শেষে বরই গাছের তলায় জলাটার পানি প্রায় শুকিয়ে যেত। শুধু জলার মধ্যখানে গোঁড়ালি সমান পানি আর সব জায়গাটায় একটু কাদা কাদা ভাব থাকত। তখন সেখানে নানা ধরনের লতা পাতা হতো; ম্যালা রকমের ঘাস, শেঞ্চি শাক, কচু শাক হতো। আর কলমি শাক, কচুরি পানা এগুলো তো আগে থেকেই আছে। ওই সময়, শীতকালের শেষে, বরইগুলো একটু একটু করে বড় হতো। অল্প অল্প করে পাকাও শুরু করত। সারা রাত শিশির পড়ত আর টুপটাপ কইরা গাছ থেকে বরইও পড়ত। শিশিরের ফোঁটা ফোঁটা পানিগুলো ওই লতাপাতার ওপরে থাকত আর বরইগুলা লুকাত লতাপাতার নিচে। আমরা ওই লতা পাতার মধ্যে থেকে বরই খুঁজে বের করতাম। আমরা ছিলাম এদের খুব চেনা। প্রত্যেকটা সবুজ আলাদা করতে পারতাম; কলমি শাকের সবুজ, কচুরিপানার সবুজ, কচুশাকের হালকা সবুজ, শেঞ্চি শাকের গাঢ় সবুজ—সব। মাঝে মাঝে বরইগুলা একটু লাল লাল রঙ হতো। অনেক বেশি কচুরি পানার ডাঁটার মতো। চোখে ধান্দা লাগত মধ্যে মধ্যে; তবুও ঠিক খুঁজে বের করে ফেলতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই গাছের নিচে জলাটায় যেতাম। চার পাঁচটা বরই পেলেই দুনিয়া জয়ের আনন্দে বিহ্বল হতাম। সেগুলা খাওয়ার মজাও ছিল ম্যালা।

এইরকম ছোটবেলা নিশ্চয়ই ভত্তা বানায় যে মামাটা তারও ছিল। সেইজন্যই যখন তাকে বললাম ভত্তা খাব না মামা, দুই চারটা বরই ঘাসে ফেলে দেন তো,  খুঁজে বের করে খাই। সে একটু অবাক হলেও কিছু বলল না। একজন কাস্টমার ছিল, তাকে বিদায় দিলো। তারপর সত্যি সত্যি দুই তিনটা বরই পাশের ঘাসে ফেলে দিল। আমার প্রথমে একটু অস্বস্তি হলেও পরে গেলাম অবশ্য খুঁজতে। বড় হতে হতে কখন যে ঘাসের রঙ পাল্টে গেছে... নাকি পাল্টে গেছে বরইদের রঙ? বরই খুঁজে পেলাম না আর।

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর