করোনা হলোকাস্ট

, শিল্প-সাহিত্য

দেবদুলাল মুন্না | 2023-08-27 03:46:44

আমি আর যাব না ভেবে রেখেছিলাম সোফিয়ার বাসায়। কিন্তু এই লকডাউনে হোম কোয়ারেন্টিনের সন্ধ্যায় যেতে হলো। সোফিয়া পড়াশোনা করেছে বার্লিনে। ফিল্মের ওপর। তার প্রিয় পরিচালকদের একজন রুগেরো দেদাতো। ইতালিয়ান। উনার একটি মুভির নাম—ক্যাবিন্যাল হলোকাস্ট। সোফিয়ার বাসা বার্লিনের এন্ডিসোভি এলাকার জার্জেস লেনে। দোতলা বাড়ি। ভিক্টোরিয়ান ডিজাইনের। সন্ধ্যায় যাই বলে অনেক ওয়াইন আর নানা রকমের তিতা বিয়ার ছিল। ওখানে বসেই ক্যাবিন্যাল হলোকাস্ট মুভিটা দেখি। একটা রেস্কিউ দল গিয়ে (অবশ্যই পশ্চিমী) বিপদজ্জনক প্রজাতির ট্রাইবালদের ডকুমেন্টেশন বানায়। ওখানে দেখি এক নারী জঙ্গলে শুয়ে আছে। নেকেড। সে একটা স্ক্রু দিয়ে এক লোকের পাছার মাংস তুলে নিচ্ছে। ওই লোকের যৌনাঙ্গ কাটার আগে তার ওপরে ওঠে বসে লাফাচ্ছে। বিচ্ছিরি যৌনতা। ক্রোধ থেকে সে এসব করছে। সবশেষে লোকটির লাশ কেটে কেটে আগুনে পুড়ে সসেজ মাখিয়ে খাচ্ছে তার মাথার ওপর দিয়ে ঝরা পাতা ওড়ে যায়। জোরেসোরে বহে বাতাস। সে নির্বিকার।

ইনফ্যাক্ট এই মুভিটি যখন প্রথম রিলিজ হয় তখন ইতালিতে রুগেরো দেদাতোর বিরুদ্ধে আদালতে কেস হয়।

আজই জানলাম ইতালিতে ক্যাভলিনিয়া সে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ক্যাভলিনিয়ার যে স্টোরি প্রকাশ করেছে নিউজ উইথ আউট বর্ডারস অনলাইনে সেটি এরকম:

“মিলানের ফিফথ এভিনিউতে অফিস। পিসিতে কাজ করছিলাম। হঠাৎ মনে হলো মাথায় চাপচাপ ব্যথা। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। দেরি না করে বেরিয়ে ইট্রা হসপিটালে গেলাম। করোনার টেস্ট করালাম। রেজাল্ট এলো নেগেটিভ। তবু ডাক্তার হোম কোয়রেন্টিনে থাকার পরামর্শ দিলেন। বাসায় ফিরলাম। অফিসে মেইল করে ছুটির এপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিলাম। ৯ মার্চের ঘটনাবলি এসব। আমার বাবা ছিলেন হসপিটালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। সেই রাতেই ফোন পেলাম বাবা মারা গেছেন। হোম কোয়রেন্টিন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। গিয়ে দেখি বিশেষ সিকিওরিটি ফোর্স একটা কফিনকে ঘিরে রেখেছে। ডাক্তার ইশারায় ডাকলেন। জানালেন কফিনের বাক্স খোলা যাবে না। প্রিয় বাবার মুখ দেখা যাবে না। ভাইরাস সংক্রামিত হতে পারে। আমার বাবার কফিন কিনা কে জানে! তেইশটা কফিনের বাক্স থরে থরে সাজানো। আমাকে নির্দির্ষ্ট একটা কফিনের বাক্স দেখিয়ে বলা হলো এই কফিনে তোমার বাবা শুয়ে আছেন। আমি জানি না তিনি ওখানে শুয়ে আছেন কিনা! এরকম আরো তেইশজন তেইশটা কফিনের বাক্সের সামনে দাঁড়ানো। একজন জানতে চাইল তাদের শেষকৃত্য কোথায় হবে? তারা জানাল, সিস্টিনের গণকবরে। আমরা বাই জানালাম কফিনের বাক্সকে।

বাসায় ফিরে আসি। পাশের রুমে আমার হাজব্যান্ড বেইগি দরোজা বন্ধ করে হোমকোয়ারেন্টিনে। ছোট আমাদের মেয়েটি আমাকে দেখে দৌড়ে কাছে আসতে চাইল। আমি পালিয়ে আমার রুমে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিলাম। পিপিসোফান্ডা থেকে খাবার রেখে ফোন কল দিল। বেইগি ও আমি দুজনেই ফোনে কথা বললাম। আমাদের ছোট মেয়ে সিনিরিয়াকে বললাম খেয়ে নিতে। সে বুঝতে পারছিল না কিছু। কান্না করছিল। আহা বেচারি। পিপাকে (ওর প্রিয় কুকুর) জড়িয়ে কাঁদছে। পিপাই ওর সঙ্গী।

বাবার চেহারা মনে পড়ল। সিনিরিয়ার মতো যখন আমার বয়স তখন বাবা আমায় বলেছিলেন, যেদিন আমি মারা যাব, সেদিন তুই পিয়ানো বাজিয়ে আমাকে বিদায় দিস। আর যত বছর বয়সে মারা যাব ততোটা ক্যান্ডেল জ্বালাস।

কী এক দুঃসময় এলো! এই জগতে। আমার তো এমন কোনো ইচ্ছার কথা বলার দরকার নেই সিনিরিয়াকে? যীশু, তুমি কেন এরকম কফিনের বাক্স ভরে ফেলছো প্রিয়মুখকে না দেখার সুযোগ দিয়ে? আমি এরকম প্রিয়জনকে মরে যাওয়ার পর না দেখতে দেওয়ার জন্য মামলা করব নিশ্চিত।”

জার্মানিতেও অবস্থা ভালো নয়। তবু কেন যে এলাম সোফিয়ার বাসায় এমন দিনে আমি এর ব্যাখ্যা দিতে পারব না। জার্মানির সারলান্ড, বাভারিয়া, লোয়ার সাক্সোনি, বার্লিন ও নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে যেন দিন আর রাত একাকার হয়ে এলো। নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়ার রিনান নামের ছোট পাহাড়ি শহরে আমার বাস ছিল। ভাগ্যিস আমি এর আগেই বার্লিন চলে এসেছিলাম। ফেব্রুয়ারিতে। গতকাল আমার বন্ধু ফিলিপের একটা আবেগঘন মেইলে পাই।

“তুমি চলে গেলে। হয়তো কিছুটা নিরাপদ আছো। আমি মার্চের ১ তারিখ রাতে বাসায় ফেরার পর ডিনার শেষে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে টিভি ছাড়ার সাথে সাথে প্রথম দেখি সিটি মেয়র শহরটিকে লকডাউন করেছেন। এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় কিছুটা আতঙ্ক বিরাজ করছে সবখানে। এরপরই আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেনস স্পাহন একটি সংবাদ সম্মেলনে বলছেন, করোনা ভাইরাসটি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চাপের মধ্যে ফেলবে। সাধারণ মানুষের সুরক্ষায় সরকার বদ্ধপরিকর।

তিনি বলেন আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই তবে বেঁচে থাকতে হলে চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

আমি এ শহরের একটি কলেজে তুলনামূলক বিশ্বসাহিত্য পড়াই। আলবেয়ার কামুর দ্য প্লেগের কথা মনে পড়ল। কারণ আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আতঙ্ক ও সুরক্ষা বিষয়ে এক লাইনে পরস্পরবিরোধী কথা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কারণ রাজনীতিবিদরা যখন চাপে থাকেন তখনই এমন কথা বলেন।

যাক, লকডাউন মানে আর বাসা থেকে না বেরুলেও চলবে। কিন্তু খাবার তো কিনিনি যথেষ্ট। অষুধ, সেও নেই। সকালে মাস্ক ও গ্লাভস, ফ্লিফিথ ওভারকোট পরে বেরুলাম ওসব কিনতে। পুরো জিনিসগুলো কিনলাম মুভি চলাকালে যান্ত্রিক ক্রুটি হলে যেভাবে কোনো চরিত্র একবার এদিকে যায় তো আরেকবার অন্যদিকে সেরকম অবস্থায়। মানে নিয়ন্ত্রণ নেই নিজের ওপর। বাসায় ফিরে হোম কোয়ারেন্টিনে গেলাম। শহরের সবারই এক অবস্থা।

ঘরে বসে সময় কাটছে। এক/দুই তিনদিন পরপরই বিভিন্ন জায়গায় আক্রান্তের মৃত্যু সংবাদ পাচ্ছি। গণকবরে এসব লাশগুলো কবর দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে ৫ মার্চ স্তিফানি মরগেট নামের আমার ছাত্রীটি আমাকে ফোনকল দিল, জানতে চাইল, কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা! সে জানে আমি একা থাকি। পোলান্ডে মা থাকেন। বাবা নিখোঁজ। ওর প্রশ্নে জবাব না দিয়ে পাল্টা ওর কাছে জানতে চাইলাম, তুমি কেমন আছো? সে বলল সেও তার বন্ধুরা ঘরে বসে বসে বিভিন্ন রংয়ের ছবি আঁকছে।

জানতে চাইলাম সেসব ছবিতে কী আঁকছো? সে জানাল, প্রায় সব ছবিই পরাবাস্তব। কোনোটিতে একটা মুদ্রার ওপর ভাইরাস এসে বসেছে। অমনি মুদ্রাটির সামনের অংশ পাখি হয়ে উড়াল দিচ্ছে। কোনো ছবিতে বা একটি ফাঁকা থালার দিকে একটা হাত বাড়ানো, কিন্তু সেই হাত চাপা পড়েছে রাষ্ট্রনায়কদের পায়ের নিচে। এবার আমি তার কথা শুনে একটু চুপ হয়ে গেলাম। সে পরম উচ্ছ্বাসে বলে যাচ্ছিল। চুপ থাকায় জানতে চাইল, শুনছেন কি? আমি জানতে চাইলাম রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে কারা? সে বলল, ডোনাল্ড ট্রাম্প। একজনই।

সে বলল তারা লেখছে, আমরা হেরে যাওয়ার জন্য জন্মাইনি। নিশ্চয়ই সুদিন ফিরাব।

ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় রাত আটটায় শহরের সব বাসার সব বাতি নিভিয়ে দিয়ে ক্যান্ডেল জ্বালানো হয়। এরমানে জানান দেওয়া, ‘আমরা বেঁচে আছি।’ আমার বিশ্বাস যদি বেঁচে থাকি তাহলে রাইনের তীরে চেরিগাছের নিচে কোনো এক ভোরবেলা জগিং শেষে আমি গিয়ে একটু বসব, তখন স্তিফানি মরগেট তার দাদুকে নিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আমার দিকে তাকিয়ে বলবে, গুঠেন ঠাগ (শুভদিন)। আমি জানি আমি বা স্তিফানি মরগেট কোনোদিন অন্ধ হব না।

হোসে সারামাগোর বিখ্যাত উপন্যাস ব্লাইন্ডনেসের কথা ভুলে যাইনি আমি। উপন্যাসের প্রথম দিকে এক অন্ধ মানুষ স্বপ্ন দেখে সে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে! তারপর সত্যিই অন্ধ হয়ে যায় সে। অন্ধ মানুষগুলোকে শহরের কোনে অ্যাসাইলামে আটকে ফেলার পরও ছড়াতে থাকে মহামারিটি, আরো নতুন নতুন মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে থাকে প্রতিদিন। কিভাবে একটা অন্ধ চোখ, যা দেখতে পায় না, সেটি অন্য কারো চোখকে সংক্রমিত করে, তা বুঝতে পারে না কেউ। এ অবস্থায় কূলকিনারা করতে না পেরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সাহায্য চায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শেষ অবধি এক কর্নেল এ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, যেহেতু অন্ধ চোখই কেবল রোগটা ছড়াতে পারে, তাই সবচেয়ে ভালো সমাধান হলো অন্ধ হওয়ামাত্র সেই চোখটাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া। অন্ধ মানুষের চেয়ে বরং মৃত মানুষ ভালো! কী ভয়ানক আর নিদারুণ পরিহাস ছিল সারামাগোর!

নিশ্চয়ই সেই কর্নেলের মতো আমরা মৃতমানুষ চাই না। চাই না বলেই ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন আমাদের সব করোনার অষুধ কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখন আমাদের নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, এসব অষুধ শুধু আমেরিকার জন্য নয়, সারা বিশ্বের সবার, সকল মানুষের।”

ফিলিপের এ মেইলটা পড়েই মূলত আমার সোফিয়ার চোখের কথা মনে পড়ে। ব্লাইন্ডনেসের চোখ! সোফিয়া যখন ঢাকায় ছিল তখন পিজি হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসক হিসেবে ছিল। পরে বার্লিন যায় মুভি বানানো শিখতে। খেয়াল কত রকমের মানুষের।

মুভিটি দেখা শেষ হওয়ার পর সোফিয়াকে আমি বলি, এইরকম পারভারশন আমাকে দেখানোর জন্য না ডাকলেও পারতে এই লকডাউনের কালে। এটি কেন দেখিয়েছো?

সোফিয়া হাসে। ওয়াইনে চুমুক দিয়ে চুরুটে টান দেয়। বলে, সেক্সুয়াল একসাইটমেন্ট ইমিউন সিস্টেমকে সবল রাখে।

ওইদিন এরপর চলে আসি। এরপর আর কয়েকদিন সোফিয়া আমাকে ফোন দিয়ে যেতে বলেছে কিন্তু আমি যাইনি। বড় কারণ আমাদের ডিভোর্সের পর আমি ওর সাথে যোগাযোগ রাখতে চাইনি। সোফিয়া আসলে কেমন বা তার সাথে কেন আমার ডিভোর্স হলো সেটি বলা দরকার।

আমরা তখন ঢাকায়। সোফিয়ার আমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে আরেকটি বিয়ে হয়েছিল। সেই পরিবারে তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। সোফিয়ার আগের স্বামীর নাম জাভেদ পীরজাদা। তার মাধ্যমেই সোফিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার তখন চেম্বার কলাবাগান মাঠের উল্টোদিকে ল্যাবএইড ভবনের পাশের ভবনে তিনতলায়। রাত সাড়ে দশটার দিকে জাভেদ পীরজাদা এলেন। ওহ, আচ্ছা বলা হয়নি। আমি একজন সাইকিয়াট্রিক। জাভেদ আমার মুখোমুখি বসলেন। কিছু জানতে চাওয়ার আগেই বললেন, বলা শুরু করি?
পেশেন্ট কে? জানতে চাইলাম।
জাভেদ বললেন, মনে হয় আমার বউ। তার নাম সোফিয়া। বা আমিও হতে পারি। আমি কনফিউসড।
এমন কথায় কৌতূহল জন্মাল। জাভেদ বলা শুরু করলেন, সোফিয়াকে বাইরে থেকে দেখলে বেশ স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। সিঁথি কেটে, পাট করে আঁচড়ানো চুল, পরিপাটি পোশাক-আশাক। চোখের চাহনিতেও কোনো অসুস্থতার চিহ্ন নেই। ভালো করে নজর করছি দেখে আবার বললেন, বিশ্বাস করুন, আমার স্ত্রী অন্য গ্রহের জীব।
আমি হেসে বললাম, এ আর নতুন কথা কী? মেন আর ফ্রম মার্স, উইমেন আর ফ্রম ভেনাস।
জাভেদ কিঞ্চিৎ রেগে গেলেন, মনে হলো। বললেন হাসির কথা হচ্ছে না। সে সত্যিই অন্য গ্রহের জীব। মানুষ সেজে আমার সঙ্গে ঘর করছে।
আপনি কি একা এসেছেন না সঙ্গে কেউ আছে?
না, না, সেই নিয়ে এসেছে জোর করে। বাইরে বসে আছে, ডাকব?
একটু পরে। আগে আপনার সঙ্গে কথা বলে নিই। কতদিন বিয়ে হয়েছে বললেন আপনাদের?
তা সে অনেক দিন হলো। শেষ যেবার হ্যালীর ধূমকেতু দেখা গিয়েছিল। বছর তিরিশ আগে।
কবে থেকে বুঝছেন সে মানুষ নয়?
মাস ছয়েক… বড় ছেলের বাচ্চা হলো… তখন আমেরিকায় গিয়ে ছেলে-বৌয়ের সাথে ছিল মাস তিনেক। ফেরার পর বুঝলাম মানুষটা বদলে গেছে।

সাইকিয়াট্রিতে রোগটার একটা নির্দিষ্ট নাম আছে—ক্যাপগ্রাস ডিল্যুশান। এই রোগের পেশেন্টদের মনে হয় কোনো ভণ্ড তাদের কাছের লোক সেজে বসে আছে, তাদের উঠতে বসতে ঠকাচ্ছে। আসল মানুষটাকে বেমালুম হাপিশ করে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখে বুঝলেন বদলে গেছে?
জাভেদ কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তারপর বললেন, সোফিয়ার চোখের মণির রঙ বদলায়।
কী রকম?
এই ধরুন, বিরক্ত হলে সবুজ, রেগে গেলে কটকটে লাল। আজকাল বেশির ভাগ সময় রেগেই থাকে।
অন্য রঙ দেখেননি?
হ্যাঁ, নীল হতেও দেখেছি, তবে সে খুব কম।

জাভেদের চোখের পাতা পড়ল কয়েকবার। স্বাভাবিকের থেকে বেশি দ্রুত। মনে হলো সামান্য অস্বস্তিতে পড়েছেন। ঠিক কোন সময় চোখের মণি নীল হয় জিজ্ঞাসা করে তাঁকে অপ্রস্তুত করার ইচ্ছা হলো না। প্রসঙ্গান্তরে গেলাম, আর কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছেন কি?
একটু ইতস্তত করে বললেন, বোঝানো মুশকিল। কাছে গেলে একটা হালকা ফুলের গন্ধ পাই আজকাল। আগে কোনদিন পাইনি।
ছেলের কাছে আমেরিকায় গিয়েছিল বলছিলেন। হয়তো কোনো বিদেশি পারফিউমের গন্ধ। ছেলে কিনে দিয়েছে মাকে। আজকাল ফ্লোরাল পারফিউম খুব পপুলার। কোন ফুলের গন্ধ চিনতে পারেন?
জাভেদ অন্যমনস্ক ভাবে চোখ তুলে তাকালেন, বললেন, কয়েকদিন আগে শাহবাগে ফুলের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন গন্ধটা পেলাম। একটা ভিজে ভিজে মিষ্টি গন্ধ। দেখলাম স্তূপ করে নাল সুদ্ধ পদ্ম বিক্রি হচ্ছে। গন্ধটা সেখান থেকেই আসছে।
জানতে চাইলাম, এসব নিয়ে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেননি? তিনি কী বলেন?
আরে, জিজ্ঞাসা করেই তো বিপত্তি! আমার নাকি মাথা খারাপ হয়েছে। মা মেয়ে জোর করে আপনার এখানে টেনে আনল।
আপনার ছেলে মেয়ে কটি?
ওই দুজনই। ছেলে বড়, দু-বছর হলো বিয়ে দিয়েছি। বৌ-বাচ্চা নিয়ে আমেরিকায় সেটেল্ড। মেয়ে ইডেনে ইংরিজি অনার্স।
সব বুঝলাম, তাহলে আপনি এখন কী করবেন ডিসিশন নিয়েছেন?
সোফিয়ার সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। আমি আলাদা থাকতে চাই। ভাবছি ডিভোর্সের মামলা করব।
আমি মজা করে বললাম, আমার মনে হয় আদালতে আপনার কথা টিকবে না। আপনার স্ত্রী বলবেন তিনি রঙিন কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করছেন আজকাল। আর ফুলের গন্ধটা পারফিউমের।
তাহলে কী করি? জাভেদকে অসহায় দেখাল।
আপনাকে প্রমাণ করতে হবে উনি অন্য গ্রহের জীব। নাহলে চুপচাপ মেনে নিয়ে বাকি জীবনটা উনার সঙ্গেই কাটিয়ে দিতে হবে।

ক্যাপগ্রাস ডিল্যুশন অনেকসময় সাময়িক হয়। কিছুদিন পর নিজে থেকেই সেরে যায়। এমনিতে জাভেদকে আমার সুস্থ স্বাভাবিকই মনে হচ্ছিল। বললাম, আপনার স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গে একবার কথা বলে দেখি।

ইন্টারকমে হারুনকে বললাম, পেশেন্টের সঙ্গে যাঁরা এসেছেন তাঁদের নিয়ে এসো। দুই নারী চেম্বারের দরজা ঠেলে ভিতরে এলেন। চোখ ধাঁধানো রূপ। দুজনেরই। জানি বলে বুঝলাম, মা মেয়ে। নাহলে দুই বোন বলে ভুল হতো। দুজনকে বসতে বললাম। ভদ্রলোককে অনুরোধ করলাম চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করতে। আমি উনার স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই। ভদ্রলোক নিতান্ত অনিচ্ছাভরে উঠলেন।

হারুন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বলল, আর কোনো পেশেন্ট নেই স্যার। আমি কি যাব?

সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল। কাল ছুটি। হারুন সাভার যাবার জন্য উসখুস করছে। সাভারে ওর বউ-বাচ্চা থাকে। বললাম, ঠিক আছে, যাও। এনাকে ওয়েটিং এরিয়ায় বসিয়ে যাও। আপনি চা বা কফি কিছু নেবেন?
জাভেদ মাথা নেড়ে না বলে বেরিয়ে গেলেন। আমার চোখের ইশারায় হারুন চেম্বারের দরজাটা টেনে দিয়ে গেল। খুব সুন্দর মানুষ-জনের কাছাকাছি এলে একটা দমবন্ধভাব হয়। চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়। আমি একটু গুছিয়ে নিলাম। এক্ষেত্রে আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। মা মেয়ের দিকে ফিরলাম, বললাম, কী মতলব বলুন তো আপনাদের? বয়স্ক মানুষটাকে অযথা ব্যস্ত করছেন কেন?

সোফিয়া হকচকিয়ে গেল। নিজেও পিজিতে ডাক্তারি করে। ফলে এমন আচরণ হয়তো আশা করেনি। সেসব কথা আমাকে পরে বলেছে। সোফিয়া চুপ। মেয়েটি আমার দিকে প্রখর চোখে তাকাল, কী বলতে চান আপনি?
আমি মেয়েটির দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার সোফিয়ার দিকে ফিরলাম, উনাকে অসুস্থ ভেবে কী লাভ? কোনো সম্পত্তি টম্পত্তির ব্যাপার নেই তো এর মধ্যে?
মুহূর্তের জন্য সোফিয়ার চোখের মণি পান্নার মতো সবুজ হয়ে জ্বলে উঠেই নিভে গেল, স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি চমকালেও লাইনচ্যুত হলাম না, আসল ব্যাপারটা কী একটু বলুন তো।
এবার মেয়েটি কঠিন গলায় বলল, আপনি আম্মুর সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারেন না। আপনার কাছে আমরা সাহায্যের জন্যে এসেছিলাম। অনেক হয়েছে। আম্মু ওঠো। সোফিয়া মেয়েকে থামাল। বলল, আমার স্বামী কী বলেছেন আপনাকে?
‘উনার হঠাৎ ধারণা হয়েছে আপনি নাকি অন্য গ্রহের জীব। আপনার সঙ্গে থাকা ওনার আর পোষাচ্ছে না।

সোফিয়ার চোখের পাতা আর্দ্র হয়ে এলো। চোখের মণির রঙ বদলাল আবার। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কুয়াশার মতো ঘোলাটে সাদা। বলল, আপনার কাছে নিয়ে এসেছিলাম এই ভেবে যে আপনি ওঁকে বোঝাতে পারবেন উনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তাহলে আর কোনো ঝামেলা থাকত না।
তার মানে?
মানে, উনি একবর্ণ মিথ্যে বলেননি। আমি সত্যিই পৃথিবীর মানুষ নই। চার দেওয়ালের মধ্যে আপনি ব্যাপারটা জানলে ক্ষতি নেই। কারণ আপনি বাইরে চাউর করলেও আপনার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। ভাববে, মনের ডাক্তার নিজেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। এছাড়া রোগীর বিষয় বাইরে জানানোও ডাক্তারের কাজ না। এথিকস বলে কথা!

এ তো আচ্ছা মুশকিল হলো। সোফিয়া প্রলাপ বকতে শুরু করল। আমিও কনফিউসড। আসলেই তো সোফিয়ার চোখের রঙ বদলায়। অথচ কথাবার্তা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। মানসিক রোগের রোগীদের কথাবার্তায় সাধারণত সাযুজ্য থাকে না। ইনি বেশ যুক্তি সাজিয়ে কথা বলছেন। তাছাড়া, চোখের মণির রঙ পরিবর্তনের ব্যাপারটা যে সত্যি, আমি নিজের চোখে দেখেছি। মেডিকেল সায়ান্সে এর কোনো ব্যাখ্যা আছে কিনা আমি জানি না। সামান্য ইতস্তত করে বললাম, দেখুন, আমি মানসিক রোগের চিকিৎসক। এই চিকিৎসা বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি মেনে চলে।
আমাকে দোষারোপ করাও কি এই পদ্ধতির মধ্যে পড়ে?
কখনো কখনো রোগের মূলে পৌঁছনোর জন্য রোগীকে আঘাত করা অনিবার্য হয়ে পড়ে।
কিন্তু আমি তো রোগী নই। তাছাড়া, আপনাদের বিজ্ঞান তো চেতনার সীমান্তে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ওই বিজ্ঞান দিয়ে আমায় বুঝতে পারবেন না। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে আপনাদের পৃথিবীতে এসেছিলাম একটি সায়েন্টিফিক রিসার্চ টিমের মেম্বার হয়ে। আমাদের কাজ ছিল আপনাদের… মানে পৃথিবীর মানুষদের জীবন প্রণালী ভালো করে স্টাডি করা। আমাদের জিন কোডে একটা টেম্পোরাল চেঞ্জ করা হয়েছিল। আমরা সাময়িকভাবে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। তবে জানতাম ওই বদলটা ঠিক তিরিশ বছর স্থায়ী হবে। ওইটাই ছিল আমাদের মিশন টাইম। তারপর আমরা আবার নোবডি হয়ে যাব, আমাদের ফিরে যেতে হবে… অথচ ফিরে যেতে পারছি কই? হয়তো ফিরে যাব অন্য কোনো ভাইরাস এসে যদি তোমাদের মাঝে মহামারী ঘটায়।

শেষ বাক্যটা মনে হলো সোফিয়ার অন্যমনস্ক স্বগতোক্তি। আম্মুর দিকে তাকিয়ে মেয়েটা। সোফিয়া যেন সব সত্য বলছে। সোফিয়া যখন কথাগুলো বলে থামল ঠিক তখনি যে ঘটনাটা ঘটল তার জন্য আমরা তিনজনের কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। হুড়মুড় করে চেম্বারের দরজা ঠেলে জাভেদ ঢুকে পড়লেন। আঙ্গুল তুলে বললেন, অ্যায়, দেখেছেন তো! আগেই বলেছিলাম। তখন মানছিলেন না। এখন বিশ্বাস হলো তো ও মানুষ নয়।
সোফিয়া বলল, ছিঃ, ছিঃ! তুমি আড়ি পেতে সব শুনছিলে?
জাভেদ বললেন, শুধু শুনিনি, দেখছিলামও। আমি দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাই। তিন মাইল দূর থেকে কথার আওয়াজ শুনতে পাই।
সে কী!

এরপর তারা তিনজনই চলে গেলেন।আমার কাছ থেকে বিদায়ও নিলেন না।

পরের দিন সন্ধ্যার দিকে ফোনটা এলো, চিনতে পারছেন? গতকাল সন্ধেবেলা আব্বু আম্মুকে সঙ্গে করে আপনার চেম্বারে এসেছিলাম। আমার নাম এশা।
আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন উনারা?
ভালোই। আপনাকে ধন্যবাদ। দুজনে বেশ ভাব হয়ে গেছে। শনিবার কি আপনার চেম্বার খোলা থাকে?
থাকে।

শনিবার সন্ধ্যায় মেয়েটি এলো। মুখোমুখি বসে আমার দিকে তাকাল। চোখে ঘন মেঘের কালো। কথা বলতে বলতে রঙ বদলে অতলান্ত নীল। ভয় হল ডুবে যাব। ঠিক তখনই গন্ধটা পেলাম। কেক পেস্ট্রির গন্ধ ছাপিয়ে একটা ভিজে ভিজে মিষ্টি গন্ধ। সব চেনা গন্ধর থেকে আলাদা, অথচ খুব চেনা। বলল, আমার আম্মু আনহ্যাপি। জানে আপনি ডিভোর্সি। আমার আব্বুটা সত্যি অসুস্থ। আম্মু আপনাকে মিথ্যা বলেছিল যে সে অন্যগ্রহের। ভেবেছিল এমন বললে আপনি তাকে অসুস্থ ভাববেন এবং আব্বু তাকে তালাক দিবে। প্লিজ আপনি আমাদের আম্মুকে বিয়ে করেন।

মেয়েটির এমন অদ্ভুত প্রস্তাবে সত্যি কথা কি মেয়েটিকেও আমার অসুস্থ মনে হলো।

সেইরাতেই ফোন করল সোফিয়া। বলল, আপনার সাথে দেখা হওয়া জরুরি।

আমি গ্যাসের চুলোয় রান্না চাপিয়ে পাশে একটা উঁচু জিরাপ মার্কা টুলে বসে শহীদুল জহির পড়ছিলাম। কী বলব, বুঝে উঠতে পারলাম না। জানতে চাইলাম কোথায় দেখা করা যায়। সোফিয়া বলল ধানমন্ডির ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে (এটি এখন আর নেই)। সময়? সোফিয়া জানাল। পরদিন সোফিয়া এলো না।

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেল, কোনো যোগাযোগও নেই তাদের কারোর সঙ্গেই। আগ্রহও নেই বাড়তি। তবে একটু রহস্য মনের কোথাও ছিল। না হলে এক মাস পুরো হওয়ার আগেই সোফিয়াকে পিজি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সন্ধ্যার একটু পর আমি ডাক দেব কেন!

সোফিয়া পিজি থেকে বেরিয়ে শাহবাগের জনতা ব্যাংকের ব্রাঞ্চটা যেখানে সেখানকার সামনে এসে সম্ভবত টেক্সি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিল। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম আরেফিনের জন্য। সোফিয়ার দিকে নজর যেতেই ডাক দিলাম একটু এগিয়ে। আমার ডাকে এবং সামনাসামনি হয়ে যাওয়ায় জানতে চাইল, কেমন আছি। আমিও প্রায় যেন একই সময় কুশল জানতে চাইলাম। দুজনেরই মুখ থেকে ‘ভালো’ শব্দটি যেন বেরিয়ে প্রথম অক্ষর মিলিয়ে গেল রমনা উদ্যানের দিকে। আর শেষ অক্ষর মিশে গেল চারপাশের হাওয়ায়। সোফিয়া হাসল, বলল, এখানে কী করছেন?
তেমন কিছু না।
বাসা কোথায় আপনার?
আজিমপুর।
এখানে বুঝি প্রায়ই আসেন?
জ্বী। সময় পেলে।
ভালো তো! নেক্সট এলে আমাকে কল কইরেন। যদি হাসপাতালে থাকি তবে চইলা আইসেন। চায়ের দাওয়াত রইল।
আমি একটু থেমে ইতস্ততভাব কাটিয়ে বললাম, আচ্ছা ঘটনা কী, বলেন তো? ওইদিন ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে আসলেন না?

একথা বলার সময় যেন প্যারালালি এটিও ভাবছিলাম এশা যে তার আম্মু মানে সোফিয়াকে বিয়ে করতে আমাকে বলেছে দেখা করে সেটি বলব কিনা ! কিন্তু চেপে গেলাম।

মনে আছে শীতকাল ছিল। একটু শৈত্যপ্রবাহ বইছিল। সোফিয়া তার চাদরটিকে যেন ঠিক করল। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতল বের করে দু ঢোক পানি খেলো। এরপর বলল, ইয়ে আপনার সাথে আমার মেয়ে এশা দেখা করেছিল, তাই না?

আমার মধ্যে একটা থতমতো অবস্থা। সেটি সোফিয়া টের পেল সম্ভবত। কারণ এরপরই আমাকে আরো থতমতো করার জন্যই হয়তো-বা যেন বলল, এশা আপনাকে বলেছে না আমি আনহ্যাপি, আমাকে বিয়ে করার জন্য।

সত্যি নিজেকে কেমন লাগছিল বোঝাতে পারব না। ঠিক সেইসময়ই সোফিয়া সেই হাসিটি দিল। যে হাসিতে একই সঙ্গে মায়া ও শ্লেষ মেশানো থাকে। যে হাসিতে একই সঙ্গে ভালোবাসা ও তাচ্ছিল্য মেশানো থাকে। যে হাসিতে একই সঙ্গে কিছুই আসলে আদৌ থাকে না আবার অনেক কিছু যেন থাকে। এমন হাসিতে কিন্তু চোখেরও একটা ভাষা থাকে। মানসিক রোগের মধ্যে একটা রোগের নাম, ক্লিনিক্যাল লাইক্যানথ্রপি। এই সমস্যায় আক্রান্ত হলে রোগী মনে করেন, তিনি হঠাৎ করেই কোনো একটি জন্তুতে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন এবং অনেক সময়ে তারা আচরণও করা শুরু করেন জন্তুর মতো। আমার হঠাৎ করেই নিজেকে মনে হলো আমি গাধায় রূপান্তরিত হয়ে গেছি। কান বড় হয়ে গিয়েছে। গাধা একা থাকতে পছন্দ করে না। সঙ্গী হিসেবে অন্য প্রাণী তাদের পছন্দ। প্রতিবন্ধীরা গাধাদের সঙ্গে সময় কাটালে মানসিকভাবে অনেক সুস্থবোধ করে! আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। সোফিয়া হাসতেই থাকে। সেই কুহক হাসি। ওই হাসি ও তার চোখের কারণেই কিনা আমি নিশ্চিত না, আমাদের প্রেম হয়, বিয়েও হয়। এরপর যা হবার তাই হলো, মানে ডির্ভোস। কিন্তু এই জার্মানিতে এসেই আমাদের ফের দেখা হবে কেন?

বাসায় রাতের রান্না শেষে টিভিতে নিউজ দেখতে দেখতে এসব মনে পড়ছিল। তখনই দেশ থেকে ফোনকল দেয় মেসেঞ্জারে ছোটভাই কায়েস। কায়েস জানতে চায়, ভাইয়া কেমন আছো? উত্তর দিই। জানতে চাই তারা কেমন আছে। সে বলে, বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারছি না ভাইয়া। এরপর মিনমিনে কান্নার শব্দ। লাইন কেটে যায়। মনে পড়ে সোফিয়ার সেই বহু বহু দিন আগের কথা, যেটি সে আমার চেম্বারে বসে বলেছিল, আমাদের জিন কোডে একটা টেম্পোরাল চেঞ্জ করা হয়েছিল। আমরা সাময়িকভাবে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। ফিরে যাব যদি অন্য কোনো ভাইরাস এসে তোমাদের মাঝে মহামারী ঘটায়।

আমি ছোটভাই কায়েসকে কল করি।
না সে নেই। লগ আউট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর