অচেনা প্রভাত

গল্প, শিল্প-সাহিত্য

শাকুর মজিদ | 2023-08-31 02:04:02

অলকের ডাকে ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল বাবরের। কব্জিতে বাঁধা ক্যাসিও ঘড়িতে ডান হাতের তর্জনি টেপে। ঘড়ির লালচে আলোয় বাবর সময় দেখে। সকাল ৬টা ৩৮ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড। এত ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস বাবরের নেই। অলকেরও নেই। কিন্তু বাবর জানে আজ তাদের সকাল সকাল বিছানা ছাড়তে হবে। তবুও বাবর হিসেব করে দেখে সাড়ে সাতটা বাজতে ঢের বাকি। এত আগে ঘুম থেকে উঠে কী করবে। সাড়ে সাতটা পর্যন্ত যখন হলে থাকা যায়, কী দরকার এখনই বিছানা ছাড়ার?

বাবর মাথার নিচ থেকে নরম বালিশটি টেনে তুলে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আরেকবার ঘুমাবার চেষ্টা করে। তার এই অভ্যাসটি পুরনো। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলেও বিছানা ছাড়া হয় না। এ জন্য প্রায়ই সকাল আটটার ক্লাশে তাদের যাওয়া হয় না। কিন্তু আজ?

অলক আবার ডাকে, বাবর ভাই, তাড়াতাড়ি ওঠেন। নিচে পুলিশ।

পুলিশের কথা শুনে বাবর বিছানা থেকে মাথা তুলল। নিচে গুমগুম শব্দ করে গাড়ি আসছে। হ্যান্ডমাইকে কারা যেন ঘোষণা দিচ্ছে। বাবরের বুঝতে বাকি নেই। সে বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। অলক রুমে নেই। পিছন তাকিয়ে দেখে বারান্দার রেলিঙে হাত দিয়ে অলক দাঁড়িয়ে কী যেন খুব মনোযোগের সাথে দেখছে।

বাবরও বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। নিচে জলপাই রঙের অনেকগুলো গাড়ি। সব গাড়িতে চিতাবাঘের চামড়ার রঙের মতো পোশাক পরা মানুষ। সবার হাতেই দামী অস্ত্র। সব গাড়ির উপরে লাউডস্পিকার লাগানো।

চারতলার উপর থেকে সব দেখা যায়। বাবর দেখল হলগুলো ঘিরে রাখা হয়েছে পুলিশের গাড়ি দিয়ে। সে অলকের দিকে তাকাল। অলক বলে, বাবর ভাই, হল কি ছেড়ে দিতেই হবে?

বাবরও কোনো জবাব দিতে পারে না।

কালরাতে তারা তখন টিভির খবর দেখছিল। টিভির খবরের প্রতি কারো কখনো আগ্রহ দেখা যেত না। কিন্তু কাল দেখেছিল। ৩/৪ দিন আগে ঢাকা অবরোধের কর্মসূচির দিনে পুলিশ ৫ জনকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। ঢাকায় খুব উত্তেজনা। প্রতি রাতে জঙ্গি আকারে মিছিল বেরোয়। বাবরের মিছিলের প্রতি আগ্রহ থাকে না। কিন্তু এ কদিন ধরে সেও নিয়মিত মিছিল করেছে। বুয়েটের নেতা ভাইদের সাথে কথা বলেছে। এভাবে এতগুলো মানুষ মরে গেল, কিচ্ছু হবে না?

নেতারা বলতেন, অস্থির হয়ো না বাবর, দেখো... সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাবর বলল, যা করবার তাড়াতাড়ি করেন। কুইক। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

কালরাতে ও যখন টিভিতে খবর দেখতে গিয়ে শুনল ঢাকা শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তখন তার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। রক্ত একা তার মাথায় চড়েনি। আরো অনেকের চড়েছে। নাহলে টিভিরুম ছেড়ে দিয়ে সবাই বেরিয়ে আসবে কেন?

বাবর বান্দায় বেরিয়ে শোনে ওদিক থেকে একটা মিছিল শুরু হয়েছে। কারা যেন স্বর তুলে বলছে, এই ক্যাম্পাস আমাদের, এই ক্যাম্পাস ছাড়ব না। বাবর দৌড়ে গিয়ে মিছিলে যোগ দিয়েছে। একবার ভেবেছিল লুঙ্গিটা পাল্টে প্যান্ট পরবে। কিন্তু মনে হলো তাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। লুঙ্গি পরেই মিছিলে যোগ দিয়েছে। গিয়ে দেখে অনেক ছেলেই লুঙ্গি পরে এসেছে। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে ছেলেরা নেমে এসেছে হাজারের উপর ছাত্র জড়ো হয়েছে ভিসির বাসার সামনে। সবার এক কথা, ‘ক্যাম্পাস ছাড়ব না।’ ছাত্রনেতারা ঘণ্টাখানেক আলাপ করে ভিসির বাসা থেকে বেরিয়ে এলেন। বাবর একজনকে জিজ্ঞাসা করে, কী খবর ভাই? নেতা ভাই জবাব দেন, স্যারের কিছু করার নেই, তিনিও আমাদের মতো টিভির নিউজে খবর পেয়েছেন। একজন চিৎকার করে ওঠে, তাহলে ভিসিকে বলে দেন, আমরা ক্যাম্পাস ছাড়ব না।

নেতা ভাই কোনো জবাব দেন না।

মিছিল শেষে ছাত্ররা শহীদ মিনারের কাছে এসে জড়ো হয়। একজন নেতা আঙ্গুল উঠিয়ে বক্তৃতা করেন। তার বক্তব্য হলো, কেউ কোনো অবস্থায় ক্যাম্পাস ছাড়বে না। সবাই ক্যাম্পাসে থাকবে। আজ ভোরবেলা পুলিশের এ আগ্রাসন দেখে মনে হয় না ছাত্ররা হলে থাকবে। তাই বাবর বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না, মনে হয় থাকা যাবে না।

শফিক ভাইও পাশের কামরার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। বাবরকে বলেন, কী বাবর, তুমারও কি মনে অয় থাকতে পারবা?
বাবর বলে, দেখি না যতক্ষণ থাকা যায়।
শফিক ভাই বলেন, লাভ নাই। চুরাশিতে আছিলাম। সোহরাওয়ার্দী হলে বিডিআর ঢুইকা পোলাপানরে পিটাইছে। এইগুলাই আছিল। চেহারা দেইখা মনে অইতেছে আইজও পিটাইতে পারে। চলো যাইগা। তুমি যাইবা কোথায়?

শফিক ভাইয়ের সব কথার জবাব দিতে ইচ্ছা করে না। লোকটা কারণে অকারণে কথা বলে। ফেল করা ছাত্রদের অভ্যাসই এরকম। বছর বছর পড়ে থাকে। বন্ধুবান্ধব সব পাশ করে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যায়, নিজে সারাদিন জুনিয়রদের সাথে বকরবকর করে সময় কাটায়।
বাবর পাল্টা প্রশ্ন করে শফিক ভাইকে, আপনি তাহলে চলে যাচ্ছেন?
আরে কইলে অইলো? আমি যাইমু কোথায়? বাসার সবাই জানে আমি পাশ করে এখন চাকরি করি। যতবারই হল ভ্যাকেন্ট করে আমি থাইকা যাই। তুমি থাকবা নাকি?
কিভাবে থাকবেন?
টিরিক্স আছে। বাইত্থেকে তালা দিয়া ভিতরে থাকবা। রাইতের বেলা বাত্তি জ্বালানোর কাম কি? আন্ধাইরের মইধ্যে দারুণ লাগে। তুমিও থাকো, মজা হবে।
বাবর অলককে বলে, কী ভাবছো?
অলক কথা বলে না।
বাবর আবার জিজ্ঞেস করে, তোমরা তো বগুড়া থাকো, তাই না?
জ্বি।
ঢাকায় তোমার কে আছেন?
তেমন কেউ নাই।
আপনি কার বাসায় উঠবেন?
বাবর হঠাৎ কোনো জবাব দিতে পারল না। টের পেল নিঃশ্বাসটা দীর্ঘ হয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। ওটা চেপে রেখে বলল, দেখি, এখনো ঠিক করিনি।

আসলে এই ঢাকা শহরে বাবরের তেমন আত্মীয় বলে কেউ নেই। তার এক চাচা থাকেন গুলশানে। মাঝে মাঝে যায়; স্রেফ যোগাযোগটা রাখার জন্য। কিন্তু সে প্রায়ই টের পায় চাচা খুশি হন না। এমন ভঙ্গিতে তার সাথে কথা বলেন যে মনে হয় কেবল ভাত খাবার জন্য সে বাসায় গিয়েছে।

তাহলে কোথায় যাবে? বাবর তুমি যাবে কোথায়? নিজেকে প্রশ্ন করে। জবাব পায় না। বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে বন্ধ হয়েছে তাতে এক মাসের আগে খুলবে বলে মনে হয় না। ইচ্ছে করলেই সে বাড়ি চলে যেতে পারে। কিন্তু যাবে না। আজ সকাল এগারোটায় তাদের এক লোকের কাছে যাবার কথা। একটা ফার্মে ২০ তালার একটা মডেল বানানোর কথা রহিম কাজটা নিয়ে এসেছে। আগের বানানো মডেলের ছবি নিয়ে যেতে বলেছে। ছবি দেখে আগের কাজ পছন্দ হলে টাকাপয়সার আলাপ হবে কিছু এডভান্সও পাওয়া যেতে পারে। এ অবস্থায় বাড়ি চলে গেলে মারাত্মক ক্ষতি।

রহিমের দশটায় রুমে আসার কথা ছিল। কিন্তু সে এলো সকাল সাতটায়। নিচ থেকে বাবরকে ডাক দেয়। বাবর গলা বাড়িয়ে দেখে রহিমের কাঁধে ব্যাগ। সে বলল, তাড়াতাড়ি নেমে আয়, অবস্থা খারাপ।

বাবরের হল ছেড়ে বাসায় যাবার কোনো প্রস্তুতি নেই। মানিব্যাগ খুঁজে দেখে মাত্র বাষট্টি টাকা আছে। মাসের প্রথমেই মেসচার্জ চারশো টাকা দিয়েছে, নাস্তার জন্য আরা দুশো সবসময় এ্যাডভান্স করে রাখে ক্যান্টিনে। হাতখরচের জন্য যা থাকে, এ মাসে বেশি খরচ হয়ে গেছে। মডেল বানারোর কাজটা প্রায় সিওর হয়ে যাওয়াতে এ মাসে খরচও হয়েছে প্রচুর। এখন এ অবস্থায় বাড়ি যায় কিভাবে?

ঠিক করল আপাতত যে করেই হোক ঢাকা ছাড়া যাবে না। দু তিনটে কাপড়, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট আর মডেল বানানোর জিনিসপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে বাবর রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল।
রহিম বলল, চলো শহীদ মিনারের ওখানে বসে সিদ্ধান্ত নিই কী করা যায়।

শহীদ মিনারে সিঁড়িগুলোতে এই ভোরে অনেক ছাত্রের জটলা। কাল যে সব নেতা ‘কোনো অবস্থায় হল ছাড়বে না’ এ ধরনের কথাবার্তা বলে চেঁচামেচি করছিল তাদের একজনও সেখানে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। সবার কাঁধে একটা করে ব্যাগ। কয়েকজন দাঁত বের করে খিকখিক করে হাসছে, তালি দিচ্ছে। এদের দেখে মনে হয় সবাই মিলে পিকনিকে যাবে, গাড়ি আসেনি, বসে বসে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে।

লেডিস হল থেকে কয়েকটি মেয়ে বেরিয়ে এসে সামনের রাস্তা দিয়ে পলাশীর মোড়ের দিকে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তার ওপাশের পুলিশ ভ্যানের মধ্যে এবং রাস্তায় দাঁড়ানো অনেকগুলো জোয়ান। এরা এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, যেন তারা কখনো কোনো মেয়েকে হাঁটতে দেখেনি।

বেলা গড়াতে থাকে। ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা ক্রমেই পোড়ানো সীসার মতো রং ধরতে শুরু করল। রহিম বলে, কাজটার জন্য যাবি না?
বাবর বলে, ব্যাগ রাখবি কোথায়?
রহিম জবাব দেয়, চল, রিকশা নিই।
তারপর?
সেটা পরে দেখা যাবে।
দুজন রিকশায় উঠে গেল।
কই যাইবেন ছার?
এলিফ্যান্ট রোড। রহিম বলল।
এলিফ্যান্ট রোড কার বাসা?
চল না।
রিকশা নীলক্ষেতের কাছে যেতেই রহিম রিকশাওয়ালাকে বলে, একটু ঘুরান তো ভাই, আজিমপুর কলোনিতে ঢোকেন।
স্বপ্নার বাসায় যাবি?
হ্যাঁ, চল।
স্বপ্না বাবরদের সাথেই পড়ে। আজিমপুর বাসা। কলিংবেল টিপতেই একটা মেয়ে দরোজা খুলে দেয়।
কারে চান?
স্বপ্না আছে?
আপনারা কইথাইকা আইছেন?
আমার স্বপ্নার সাথে পড়ি।
আপায় তো ঘুমাইতেছে।
মেয়েটি ভেতরে চলে যায়। খানিক পরে ঘুম চোখে স্বপ্না এসে হাজির হয়। বাবর ভাবল চাচার অফিসে একটা ফোন করবে। হুট করে চাচার বাসায় না উঠে একটা ফোন করে যাওয়া ভালো। ঢাকায় যে কয়দিন আছে রাতে চাচার বাসায় থাকা যায়।

স্বপ্নার বাসা থেকেই চাচার অফিসে ফোন করল বাবর।
পত্রিকায় তো দেখলাম, তুই দেশে চলে যা। আড়াইটার ট্রেনেই চলে যা।
জ্বী আচ্ছা, স্লামালাইকুম।

ফোন রেখে বাবর ভাবল চাচার বাসায় যাওয়া যাবে না। রহিম আর বাবর মিলে ঠিক করল এখন কাজটার জন্য ধানমন্ডি যাবে। পজিটিভ কোনো সাড়া পেলে ফ্যাকাল্টিতেই কাজ করবে। রাতে ঘুমোবার একটা ব্যবস্থা ফ্যাকাল্টিতেই করতে পারবে।

স্বপ্নার মা এসে নাস্তা দিয়ে গেলেন। খেতে খেতে বললেন, তোমাদের অসুবিধা থাকলে এখানেও থাকতে পারো। অসুবিধা হবে না তো? বাবর বলল, না খালাম্মা, আমাদের ব্যবস্থা আছে, আপাতত ব্যাগটা থাকুক। আমরা বিকেলে এসে নিয়ে যাব।

বাবর আর রহিম আরেকটা রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ধানমন্ডি যাবার পথে ইচ্ছা করেই রিকশাটাকে বুয়েট পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনা হলো। বেলা তখন দশটা পার হয়ে গেছে। পরিচিত ক্যাম্পাসটা তার কাছে বড় বশি অপরিচিত মনে হতে লাগল। রিকশা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখে হলের গেটে তালা ঝুলছে। কলাপসিবল গেট তালা দিয়ে আটকানো। দারোয়ানও ভেতরে নেই। বাইরে পায়চারি করছে কতগুলো পুলিশ। হাতে বন্দুক। মাথা উঁচিয়ে চারতলার দিকে তাকায়। বাবরের রুমটি চারতলায়। কিন্তু এই হলটি সে চিনতে পারল না। মনে হলো হলটি সে এর আগে কখনো দেখেনি। এত চেনা সড়কটিকে বড় বেশি অচেনা মনে হয় তার। টুংটাং শব্দ করে রিকশা ছুটে যায়। বাবর আর রহিম, কেউ কোনো কথা বলে না।

রচনাকাল ১৯৯০

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর