রিপোর্টিংয়ের একদিন

, শিল্প-সাহিত্য

প্রিন্স আশরাফ | 2023-08-31 21:35:50

রাত তিনটের কাঁচা ঘুম থেকে মোবাইলের যন্ত্রণায় উঠে পড়ে ভোর সাড়ে চারটেয় বেরিয়ে পড়তে হলে চাকরির পশ্চাদদেশে লাথি কষাতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেটাকে অনেক কষ্টে দমন করে রিপোর্টার মাহফুজ মিথুন মোবাইলেই এক ঘণ্টা পরে এ্যালার্ম দিয়ে বালিশে মাথা লাগায়। মগজের কোষে কোষে এখনো চিফ রিপোর্টারের কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ছে, ‘সুবহে সাদিকের আগে ওদের পাকড়াও করে সচিত্র প্রতিবেদন নেবে। নিয়েই ল্যাপটপের ইন্টারনেট থেকে মেইল করে পাঠিয়ে দেবে। সকালের ফাস্ট নিউজ আওয়ারেই ওটা অনইয়ারে দিতে চাই। ফক্করবাদ গ্রামে আমাদের জেলা করসপন্ডেন্টস থাকবে। সেই নিউজটা...’ লাথিটা এবারে ওই করসপন্ডেন্টস ব্যাটার পশ্চাদদেশে দিতে ইচ্ছে করছে। শালার বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়! সামান্য ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে এরা এরকম বানায় যে খাওয়া ঘুম হারাম হয়ে যায়।

চ্যানেল ফাস্টের স্টিকার লাগানো মাইক্রো মেসের দোরগোড়ায় হাজির। ল্যাপটপ, মডেম, মোবাইল, পেনড্রাইভ নিয়ে পুরোপুরি ডিজিটাল মানুষ হয়ে মিথুন গাড়িতে উঠল। ড্রাইভার গোমড়ামুখে একমনে সিগারেট টেনে চলেছে। একেবারে পেছনের সিটে ক্যামেরা ক্রু ঝিমাচ্ছে। তার সহকারী রনক বসে আছে।

রনক তার জন্য জায়গা করে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, ‘বস, ঘটনা কী? স্যার এত তাড়াহুড়ো লাগাল কেন? কোনো ব্রেকিং নিউজ নাকি?’
মিথুন দাতে দাত চেপে বলল, ‘শীতের রাতে কাঁচা ঘুম ভেঙে বেরোনোর চেয়ে বড় কোনো ব্রেকিং নিউজ আর আছে নাকি?’
রনক দাত বেরে করে হেসে বলল, ‘বস, শুনলাম কোন যুবতি মাইয়া নাকি পীর হইছে। মাইয়া গায়ে হাত ছোঁয়াইলে অসুখ সেরে যাচ্ছে।’
‘তোর কোন অসুখ আছে নাকি?’ মিথুন সিটে গা এলিয়ে দিয়ে রসিকতা করল। ‘থাকলে কইস, ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
‘মাইয়া হাত বুলাইলে অসুখ আছে। সারা গায়ে অসুখ।’ রনকের দাঁত বেরিয়েই আছে। ছেলেটার হাসি রোগ আছে। ‘কন না, বস, কেস কী?’

মিথুন কোনো উত্তর না দিয়ে বাইরে দেখতে লাগল। খুব ভোরের অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে। সব কিছু অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতার দিকে যাচ্ছে। নতুন দিনের শুরুর প্রস্তুতি যেন। তাতে মন ভালো করার উপাদান গুড়ো গুড়ো হয়ে ছড়ানো রয়েছে। মিথুনের মন ধীরে ধীরে ভালো হতে থাকে।

মিথুন পিছনের সিটে আয়েশ করে হেলান দিতে দিতে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, ‘মজনু ভাই, জায়গাটা চেনেন? কদ্দুর যেতে হবে জানেন কিছু?’
মজুন ভাই সামনের কুয়াশা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, ‘জায়গা চিনি না। তবে কোন দিকে তা জানি। অনেকটা পথই যেতে হবে। পথে দুই দুইটা ফেরি পড়বে। ফেরিতেই ঘণ্টা কাবার। আপনি আরামে ঘুমান। দুপুরের আগে কোনোমতেই পৌছানো সম্ভব না।’
মিথুন আতকে উঠল, ‘সেকি! বস যে বলল, সকালের মধ্যেই প্রথম নিউজ আওয়ারে অনওয়ার করবে।’
মজুন ভাই ব্যঙ্গের হাসি ঠোটে ঝুলিয়ে বলল, ‘হ, গদি আটা চেয়ারে বসে কইলেই হলো। মাঠে নাইমাই দেখুক না! আমগোর মতন বনবাদাড় তো ঠ্যাঙায়ে বেড়াইতে হয় না।’
মিথুন ড্রাইভারকে আর ঘাটাল না। বকতে থাকলে ঘুম চটে যাবে। রনক ঝিমাচ্ছে। এই ফাঁকে সেও একটু ঝিমুনির মতো দিয়ে নিক।

মজনুর কথাই ঠিক। বেলা বারোটার পরে ফক্করবাদ গ্রামে ঢুকল চ্যানেল ফাস্টের গাড়ি। প্রতিনিধি গাজী শামস আরো কয়েকজন সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে পথের মোড়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদের নিরাশ করে সে গাড়িতে পথ চেনাতে ড্রাইভারের পাশে বসল।

কুশল বিনিময় শেষে প্রতিনিধিই আগ বাড়িয়ে ব্যাপারটা বলল, ‘এক জ্বিনসাধক ব্যাটা অনেকদিন ধরে করে খাচ্ছিল। ক্যান্সার এইডস থেকে শুরু করে হেন প্রকার অসুখ বিসুখ বা সমস্যা নেই যা জ্বিনসাধক জ্বিনের মাধ্যমে সারায় না। কাজ হোক আর না হোক দশ গ্রামের লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আমাদের গ্রামের রসুল অনেক দিন ধরে একটু পাগলাটে স্বভাবের। ইচ্ছেমত কাউকে কিছু না বলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায়। আবার কিছুদিন পর ফিরে আসে। রসুল এরকম কাজকাম করে যা তার মতো আটবছরের ছেলের করার কথা না। দেড়মণি ধানের বস্তা পযর্ন্ত উঁচু করে তুলতে পারে। সবাই বলে জ্বিনের আছর লাগছে।’
রনক হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘটনা কি এই রসুলকে নিয়ে?’
‘হ্যাঁ। রসুলের মা রসুলকে নিয়ে জিনসাধকের আস্তানায় যায়। আস্তানার উঠোনের মাটিতে বেশ গভীর গর্ত খোঁড়ে জ্বিনসাধক। তারপর সেই গর্তের মধ্যে রসুলকে দাঁড় করিয়ে দেয়। রসুলের মাথা পর্যন্ত গর্তের মধ্যে পুঁতে ফেলা হয়। চারিদিকে গ্রামের লোক তখন দাড়িয়ে দাড়িয়ে জ্বিনসাধকের কর্মকাণ্ড দেখতে থাকে। সাধক ব্যাটা নানান ভং চং করে। কী সব ছকটক বানায়। জাফরানী কালি দিয়ে ছকে কুফরী কালাম লেখে। আরো কী কী যেন করে। তারপরে সেই ভয়ংকর কর্মকাণ্ড শুরু করে।’
‘কী সেটা?’ প্রতিনিধির বাকোয়াজ বাজিতে অধৈর্য মিথুন জিজ্ঞেস করে।
‘মাথা পর্যন্ত পোঁতা রসুলের গর্তের মধ্যে গনগনে আগুন জ্বালিয়ে দেয় জ্বিনসাধক কবিরাজ। আগুন জ্বালিয়ে দেয় গর্তের চারপাশে। দাউ দাউ আগুনে পুড়তে থাকে শিশু রসুল। তার কান্না আর চিৎকারে আকাশবাতাস ভারী হয়ে ওঠে। জিনসাধক উল্লাসে চিৎকার করে, আগুনে জ্বিন পুড়তাছে। ক্যামুন পুড়তাছে। পুইড়া খাক হইয়া যাইতাছে। খবিস জ্বিন পুইড়া মরতাছে। মরণের আগে চিক্কুর দিতাছে। ক্যামুন কানতাছে। সবার চোখের সামনে পুড়ে মরতে থাকে শিশু রসুল। সবাই জ্বিনসাধকের জ্বিন পুড়ানোয় অভিভূত হলেও একজনের মধ্যে বিকার দেখা যায়।’
‘কার?’ ড্রাইভার আর জিজ্ঞেস না করে পারে না।
‘রসুলের মায়ের। মা ছুটে এসে হাউমাউ করে জ্বিনসাধকের পায়ে এসে কেঁদে পড়ে। তাও জ্বিনসাধক নাছোড়। কিন্তু মায়ের কান্না আর আহাজারিতে গ্রামের লোকের টনক নড়ে। কয়েকজন যুবক ছেলে ছুটে এসে গর্ত থেকে পুড়ে প্রায় কয়লা হওয়া রসুলকে টেনে তোলে। তখনও কবিরাজ ব্যাটার হম্বিতম্বি কথার তুবড়ি ছুটছে। কিন্তু গর্ত থেকে তোলা রসুলের মরণাপন্ন অবস্থা দেখে কবিরাজ খুব ভাব ধরে লোকজনের মধ্য থেকে বেরিয়ে যায়।’
‘তার মানে ভণ্ড জ্বিনসাধক পালিয়ে গেছে?’ মিথুন জিজ্ঞেস করে।
‘তাই তো মনে হচ্ছে। তারপর থেকে ব্যাটাকে আর আস্তানার আশেপাশেও দেখা যায়নি।’
‘ব্যাটাকে ধরে রাখতে পারলে সাক্ষাৎকার নিয়ে এক্সক্লুসিভ নিউজ করা যেত। ব্যাটাকে যে করেই হোক ধরার চেষ্টা করতে হবে। আপনি একটু গোপন সংবাদের মাধ্যমে দেখেন তো ব্যাটাকে পাওয়া যায় কিনা। কিছু টাকা পয়সা লাগলে খরচ করা যাবে। ব্যাটাকে পেলে টাকার লোভ দেখিয়ে একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে।’ মিথুন জোর গলায় বলল।
গাজী শামছু হেসে বলল, ‘সে কথা আমাকে বলে দিতে হবে না, মিথুন ভাই। আমি এরই মধ্যে ব্যাটার খোঁজে লোক লাগিয়ে দিয়েছি..’ শামছুর কথার মাঝখানে বাধা পড়ল। পথে অন্য আরেক পত্রিকার প্রতিনিধি সুশীল হালদার হাত দেখিয়ে গাড়ি থামাল।

পরিচয় পর্ব শেষে গাজি শামছু জিজ্ঞেস করল, ‘কি সুশীলদা, জ্বিনসাধকের কোনো খবর বের করতে পারলা?’
সুশীল হালদার হেসে বলল, ‘জ্বে, শামছু ভাই, কবিরাজের গোপন আস্তানার খবর পেয়েছি। কিন্তু সেখানে কবিরাজের সাগরেদেরা আছে। মারধোর করতে পারে।’
সবাই একটু চুপসে গেল। টাকা দিয়ে কাজ হাসিল করাটা সহজ। মারধোর খাওয়াটা সহজ নয়।
‘চিন্তা কইরেন না। ঢাকার রিপোর্টাররা আসছেন। ব্যবস্থাটা একটা হয়ে যাবে।’ সুশীল আশ্বস্ত করে।
‘ওই ছেলেটার কী অবস্থা?’ রনকের মাথায় রসুলের চিন্তা, ‘এখনো বেঁচে আছে?’
সুশীলই উত্তর দেয়, ‘রসুল বেঁচে আছে। তবে অবস্থা খুব একটা সুবিধার না। সারা শরীর আগুনে ঝলসে গেছে। বাঁচবে কিনা ভগবানই জানেন।’ সুশীল দু’হাত মাথার উপর তুলে ভগবানকে দেখায়।
‘ছেলেটারে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি?’
‘এরকম অজ পাড়াগাঁয়ে হাসপাতাল কোথায়?’ গাজী শামছু সুর মেলায়, ‘একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মতো আছে, তাতে না আছে ওষুধপত্তর, না আছে ডাক্তার। বড় ধরনের কিছু হলে যাওয়ার জায়গা নেই।’
মিথুন জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলেও ভিকটিম এখন কোথায়? বাড়িতে?’ তার শুধু রিপোটিংয়ের চিন্তা। পুড়ে ঝলসে যাওয়া রসুলের আপাদমস্তক ভিডিও করুণভাবে করতে হবে। জনগণের সহানুভূতি যোগ হবে। তাতে রিপোটিংটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এই রিপোটিংয়ের জন্য পুরস্কারটুরস্কার পেয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
‘না। ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই আছে।’ ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা করছে দেখে গাজী শামছু ক্যামেরা দিকে তাকিয়ে বলে। যাত্রার প্রথম থেকে পুরোটাই ক্যামেরা করা হয়। যাতে এই রিপোটিংয়ের পেছনে কতটা শ্রম ব্যয় করা হয়েছে সেটা দর্শকদের দেখানো যায়। ক্যামেরার কারসাজিতে কষ্টটা একটু বেশিই ধরা পড়ে।

মিথুনের নির্দেশে আগে জ্বিনসাধকের সাধনা আর রোগ সারানোর স্থলে যাওয়া হয়। গ্রামের কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। টিভি ক্যামেরা দেখে তারা বাড়িয়ে চাড়িয়ে ভয়াবহ রূপ দেয়। তাতে রিপোটিং আরো জোরালো হয়। জ্বিনসাধকের গর্তের ক্যামেরা করা হয়। গর্তের ভেতরের নিভন্ত আগুন, চারপাশের পরিবেশ, সেখানে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎকার সব মিলিয়ে পরিবেশটাকে আরো ভয়াবহ করে তোলা হয়। কৌতূহলী কয়েকজন গর্তের ভেতরে কাঠখড় দিয়ে আবার আগুন জ্বেলে দেয়। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। আগুনের লেলিহান শিখায় ভিডিও ফুটেজ ভরে উঠতে থাকে।

এবার রিপোর্টের গাড়ি ছুটে চলে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। গাড়ির পেছন পেছন গ্রামের লোক ভেঙে এসেছে। টিভি চ্যানেলের লোক দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তৎপর হয়ে ওঠে। খবর পেয়ে থানা সদরে প্র্যাকটিস করতে থাকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার ইকবাল মোটরসাইকেল চালিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। ডাক্তারের সামনেই রসুলের উলঙ্গ শরীরের ক্যামেরা করা হয়। এডিটিংয়ের সময় বাচ্চা ছেলেটার বিশেষ অঙ্গের ওখানটায় ঝাপসা করে দিলেই হবে। বাস্তবে যতটা বীভৎস দেখাচ্ছে ক্যামেরাম্যানের কারসাজিতে তার চেয়ে বীভৎস ফুটেজ ওঠে। ডাক্তারেরও ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। ডাক্তার ইকবাল জানান, সকাল থেকেই তিনি রসুলের তত্ত্বাবধান করছেন। (যদিও টিভি রিপোর্টার পৌঁছানোর মিনিট দশেক আগে এসে পৌঁছেছেন)। রসুলের প্রাইমারি কেয়ার নেওয়া হয়েছে। তবে পোড়াটা অনেক বেশি। ডাক্তারী ভাষায় থার্ড ডিগ্রি বার্ণ। আর এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কেন, জেলা সদরেও পোড়া রোগীর চিকিৎসার উপযুক্ত কোনো চিকিৎসা নেই। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটই সবচেয়ে উপযুক্ত।

মিথুনের রিপোটিংর মূল পর্ব শেষ। এখন একটু থানা পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন, চেয়্যারম্যান এদের করণীয় কিছু ইন্টারভিউ নিতে হবে। তবে সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ হবে যদি জ্বিনসাধকের ইন্টারভিউটা করা যায়। অনুষ্ঠানের শেষ চমক হিসাবে দেখানো যেতে পারে। এর মধ্যেই মিথুন মোবাইলে ঢাকার সাথে ডিটেলস আলাপ করে ল্যাপটপের ইন্টারনেট থেকে একটা ভিডিও ফুটেজ পাঠিয়ে দিয়েছে। এটা নিউজের সাথে একটা মাত্র দৃশ্য হিসাবে যাবে। আর নিউজে ঘোষণা থাকবে বিস্তারিত আজ রাত দশটায়। তার আগেই আশা করছে সবকিছু কমপ্লিট হয়ে যাবে।

খাওয়াদাওয়া ব্যবস্থা প্রতিনিধি গাজি শামছুর বাড়িতেই ছিল। দুপুরে ভুঁড়িভোজন করে একটা বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ল তারা। গোটা গ্রামের একটা চিত্র তুলে ধরতে হবে।

গ্রামের চিত্র শেষ করতে করতেই বিকাল গড়িয়ে গেল। তখনও জ্বিনসাধকের ব্যাপারে ওরা কোনো রকম অগ্রগতি করতে পারল না। শেষমেষ ফেরার তোড়জোড়ের সময় এক সাগরেদ এসে জানাল, ওস্তাদ টিভির সামনে কথা বলতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু শুধুমাত্র দু’জন আস্তানায় আসতে পারবে। রনকের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ক্যামেরাম্যান আর মিথুন দু’জনে সাগরেদের সাথে একটা বাড়িতে জ্বিনসাধকের গোপন আস্তানায় গেল। জিনসাধনার ধরনধারণসহ কিছু ডামি কর্মযজ্ঞ তাদের অনুরোধে দেখাল। তার জন্য অবশ্য তাদের বেশ কিছু টাকা আর প্রচার প্রসারের আশ্বাস দিতে হলো।

এদিকে মিথুনের কারসাজিতে থানায় খবর চলে গেছে। চলে গেছে জ্বিনসাধকের গোপন আস্তানার খবর। সাথে সাথে থানাওয়ালাদের হানা আস্তানায়। সাগরেদসহ ধৃত জিনসাধক। আবার দৃশ্যপটে টিভি ক্যামেরার আগমন। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বাঁশডলার পরে জ্বিনসাধকের সাক্ষাৎকার। এক্সক্লুসিভ।

সব এক্সক্লুসিভ শেষে ঢাকায় ফেরার পালা। ঢাকায় ফ্রি আসার এরকম সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয় প্রতিনিধি গাজি শামছু। তার সাথে যোগ দিয়েছে সুবল হালদার। আজ সারাদিনে বেচারা অনেক খাটাখাটনি করেছে। তাকে তো আর ফেলে রেখে যাওয়া যায় না।
গাড়ি ছাড়ার আগে মিথুন কানাঘুষো শুনতে পায়। অগ্নিদগ্ধ রসুলের অবস্থা নাকি খারাপের দিকে। সে কান কথায় কান দেয় না।
ডাক্তার ইকবালের সাথে দেখা হয়। তিনি জানান, রসুলের অবস্থা সংকটাপন্ন। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে না নিয়ে গেলে রসুলকে বাঁচানো যাবে না।
মিথুন ইউনিট নিয়ে ফিরে যাওয়ার তোড়জোড়ে ব্যস্ত। রাত দশটার নিউজের পরে এই রিপোর্ট টেলিকাস্ট হবে। তার অন্তত ঘণ্টাখানিক আগে যে করেই হোক পৌঁছাতে হবে। এডিটিংয়ের ব্যাপারস্যাপার আছে।

এদিকে রসুলের ব্যাপারে স্থানীয় হাসপাতাল জবাব দিয়ে দিয়েছে। ঢাকায় নিতে পারলে রসুল বাঁচবে। রসুলের হতদরিদ্র বাবামায়ের রসুলকে ঢাকা নেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। ভিটেমাটি বিক্রি করলেও হবে না। আর হলেও এই মুহূর্তে তা কিভাবে সম্ভব। গ্রামের মধ্য থেকে কে যেন রসুলের বাবামাকে বুদ্ধি দেয়, টিভির গাড়ি ঢাকায় যাইতাছে। ওতে করে রসুলরে ঢাকা নিতে পারলে বাঁচত।

নিরুপায় রসুলের মা স্টার্ট নেওয়া গাড়ির কাছে এসে আছড়ে পড়ে। আকুতি জানায়, আমার রসুলরে আপনারা ঢাকা নিয়া যান। রসুলরে বাঁচান।
আকুতি মিথুনের কানে পৌঁছালেও সে গুরুত্ব দেয় না। এই গাড়ি রিপোটিংয়ের, এ্যাম্বুলেন্স নয়।
রসুলের মা কাঁদতে কাঁদতে মাইক্রোর সামনে শুয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে মিথুনকে গাড়ি থেকে নামতে হয়। মিথুন নামতেই রসুলের মা মিথুনের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে পড়ে।
শেষমেশ অসহায় মিথুন মিথ্যের আশ্রয় নেয়। স্থানীয় জনতা আর রসুলের মাকে জানায়, আমরা তো আজকে ঢাকায় ফিরব না। আরেক জায়গায় সাতক্ষীরার দিকে রিপোটিং আছে। সেখানে যেতে হবে। ঢাকায় গেলে ঠিকই রসুলকে নিয়ে যেতাম।
ভুলভাল বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওরা কোনোমতে গ্রাম থেকে বেরিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে। গ্রামবাসি একবার ক্ষেপলে রক্ষা নেই।

ঢাকায় এসে রিপোর্ট জমা দিয়ে গরম কফিতে চুমুক দিচ্ছিল রিপোর্টার মাহফুজ মিথুন। তখনই চিফ রিপোর্টারের ঘরে তার ডাক পড়ে। চিফ রিপোর্টার জানান, এইমাত্র খবর এসেছে, ভণ্ড জ্বিনের ওঝার আগুনে পোড়া রসুল স্থানীয় হাসপাতালে মারা গেছে। আমাদের এই রিপোটিংয়ের ফলোআপ হিসাবে মৃত রসুলের একটা ফুটেজ নিতে হবে। এক্সুক্লুসিভ নিউজ করতে হবে।

রিপোটার মাহফুজ মিথুন মৃত রাসেলের এক্সক্লুসিভ নিউজের জন্য আবার বেরিয়ে পড়ে।

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর