তানিম জাবেরের একগুচ্ছ কবিতা

কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

তানিম জাবের | 2023-08-30 11:54:44

ক্রোধের মতো

আমি আলগোছে হাত নাড়ি
তারারা যেখানে
ঝইরা পড়তাছে
তর্জনী দিয়া
খালি বাতাসে
আঁচড়াই মহাশূন্য
যেন—তারার দল
যেখানে ঝইরা পড়তাছে
তার নিচে
ভিঞ্চির আঁকা চিত্রের মতো
চিত্রের গভীরের কোনো
অন্য চিত্রের খোঁজে।

তুমি
আরো একটু আগায়া আসলে
দক্ষিণের বাতাস
পুবে বইতে থাকে
মধ্যাহ্নবর্তী দেয়াল তো
আমরা, ভাইসা কি আরো—
কাছাকাছি সইরা আসি
অথবা
বসি কি কোনো পাথরের ওপর
গড়াইয়ে গড়াইয়ে।

এইরকম পাশাপাশি
বসিবার নিয়ম যখন
নাজিল হয়
তখনও আমরা মন থিকা
শরীরে যাওয়ার আয়াতে
অনবতীর্ণ,
তবু আমরা কি
অবাক তারার মতো
ঝইরা পড়তে পড়তে
নিজেদের ধরতে ধরতে
কাছাকাছিই আসতে থাকি
সীমা লংঘনের মতো—
যেন পাথরের ওপর গড়াইয়া নামতেছি
তেমন একটা বোধের মতো—
যেনবা কান্নার মতো—
যেন লংঘিত সীমার অসীম
ক্রোধের মতো— ।

ভান

মূলত আমি জীবিত—
এই থাকার অভিনয়ে পারঙ্গম,
তাই ভর দুপুরে
বড় সড়কের পাশে
রেল লাইনের নিচে ঝাপ দিব বলে
বসিয়া থাকিয়াছি—বহুকাল,
জীবনের প্রতি
নির্মোহ হইতে না পারার
ক্লেদ সহযোগে।
মূলত আমি মৃত্যু,
ভয় পাই—
ভয় পাওয়া আমারে, প্রতিদিন
ভয়ের সাথে শত্রুতার অভিনয়ে
ব্যস্ত থাকা আমারে,
আসলে তো ভয় আর আমি
একই গর্ভে জন্মানো সহোদর।
মূলত কবিতা আমারে
লিখছে যতটুকু
আমি ঠিক ততটুকুই।
তাই আজকাল আর অতশত ভাবি না,
শুধু এইসবের পাশে
বসে থাকি
আর দেখি কী করে
সন্ধ্যাগুলো তারার মতো টুপটাপ ঝরে যায়।

ফেরার আর কোনো ফিরে আসা নেই

এভাবেই কি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম?
নাকি নিজেই ফিরে গিয়েছিলাম দুয়ার থেকে?
নাকি ফিরিয়ে দিয়েছিল প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা
সহযোগে, অথবা নিজেই গিয়েছিল ফিরে—
যদিও এসব কথা ভাববার ঢের অবসর ছিল
তথাপি—অবসরগুলো ছাপিয়ে যায়
সেইসব পাতাঝরা শীতের কথা ভেবে
তুষার ভোরের মতো উজ্জ্বল দিন আর
হিম বৃষ্টির রাত অথবা
সার সার লন্ডন প্লেনেটরির ফাঁকে সূর্যের উঁকিঝুঁকি,
বিকেল বেলার হাইওয়ে ধরে ছুটে চলছে সময়
সাইসাই করে সরে যাচ্ছে সাবওয়ে সিটি
পেছনে পরে গেল একটা খাঁচায় ঘেরা শিশু পার্ক
লাল থেকে সবুজ হওয়া স্ট্রিট লাইট
চকমকে হেডস্কার্ফ পরা এক ইজিপশিয়ান বুড়ি
উড়ালসেতুর নিচে নাম না জানা ফুল
সমূহ অন্ধকার সমেত একটা ব্লাইন্ড লেন
শিপইয়ার্ড নৌ বন্দর বো তুলে ছেড়ে যাওয়া জাহাজঘাট
এইসব বহমান ঘটনা সাথে
তোমাকে ফিরিয়ে দেয়া অথবা তোমার ফিরে যাওয়া
ঘটনাবলির জন্য
নিয়ত এক অতি আশ্চর্য
ভাঙচুর হয়
এক জন্মে হয় পুনর্জন্মের লয়।
কে জানে হয়তো এভাবেই ফিরিয়ে দিয়েছিলাম
অথবা গিয়েছিল ফিরে।

স্বার্থপর

অথচ আরো বড় পাহাড় ভাঙার শব্দ বুকের ভিতর
আরো বড় সমুদ্র ঢেউ ভেঙে বালিয়াড়িতে মিশে
আরো ঝুরঝুরে অতীত নিঃশ্বাস দীর্ঘশ্বাস হয়,
গতানুশোচনার আগুনে পুড়ে নিষ্কৃতি চায় ভেতরে কেউ।
যেন আমারও ঘরে ফেরার কথা ছিল
কারো অন্তিম সময়ে বিছানার পাশে বসার কথা ছিল,
বলার ছিল অনেক রাত জাগার না বলা কথা—
কারো কাঁধে ভরসা হয়ে হাত রাখার কথা ছিল,
আমারও ইচ্ছে করে এইসব না ঘটা ঘটনার
পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে,
আলতো আঙ্গুল রাখতে স্মৃতির কপোলে,
আমারও ইচ্ছে করে ঘোর বর্ষার বরষায়
মাথা উঁচু করে বলি আমি ভালো আছি—
যেখানেই থাকো তুমিও ভালো থেকো।

তৃষ্ণা

রোদজোসনায়, বারান্দাতে, মধ্য রাতে
ঘুম লোপাটে, এমন কেন? তোরও কি হয়?
ভিজতে গেলে, গ্রিলটা গলে, চাদের আলো
ফের লুকালে, লোকাল ট্রেনের জানলা গলে
দৃষ্টি যখন, অই দূরে যায়, যত্ত দূরে, মাছরাঙাদের—
দোল খাওয়া ডাল, কলমি ছুঁয়ে, মেঘের ছায়ায়
দাগ কেটে যায়,
দাগটা এমন, পানির মতন
ঠান্ডা নরম, খুব গভীরে, বুঝতে কি পাস?
বারান্দাতেই, ফের ফেরা যাক, যেমন তেমন
গাছগুলো সব, টবের জীবন, ব্যাঙের মতন
কূয়ার জলে, চাঁদ ফুরালে, অন্ধকারে
চাঁদটাও নাই, এমন ক্যানো, ভাবতে গেলেই
জীবন জীবন,
জীবন তখন, কল্লা চেপে
হল্লা করে, কান পেতে থাক, শুনতে কি পাস?
না শুনলে থাক, সবার জীবন, এমন তো নয়
বৃত্ত আকাশ, ব্যস-পরিধি, মাপ জোকে তার
খুব সচেতন, একটু যদি, ফোকর গলে
জোসনা মেলে, অন্ধকারে, কার তাতে কি?
আমরা তো আর, কেউকেটা নই, খুব সাধারণ
গ্রিলের ফাঁকের, জোস্না চুষে, তৃষ্ণা মেটাই!

এ সম্পর্কিত আরও খবর