লড়তে হবে অদৃশ্য শত্রুর  বিরুদ্ধে

, ক্যাম্পাস

আখতার হোসেন আজাদ | 2023-08-31 23:46:02

আধুনিক বিশ্ব যত এগিয়ে চলছে, মানুষের জীবন ততই জটিল আকার ধারণ করছে। প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে অনেকেই বেছে নিচ্ছে কাপুরুষিত আত্মহত্যার পথ। প্রতিবছর দেশে ১০ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করছে; যার ঢেউ লেগেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিগত ৩ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি হারিয়েছে ১০জন মেধাবী নক্ষত্র। প্রাথমিক অবস্থায় থাকা এই মহামারি নির্মূল করার জন্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন আখতার হোসেন আজাদ।

নিজেকে ভালবাসতে শিখতে হবে

হতাশা ও আত্মহত্যার বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিক। ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকেই মানুষের মধ্যে হতাশার জন্ম নেয়। ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স বা হীনমন্যতা হলো এক ধরনের অনুভূতি যা আক্রান্ত ব্যক্তিকে মনে করিয়ে দেয় যে উনি অন্যদের তুলনায় কিছু ব্যাপারে নিচু বা নিকৃষ্ট। সন্তানের প্রতি বাবা-মা'র সব সময়ই নেতিবাচক মনোভাব, সামাজিক অসুবিধা ও বৈষম্য ইত্যাদি কারণে এই হীনমন্যতা তৈরি হতে পারে। একজন মানুষ যখন মনে করেন সমাজ থেকে উনি বিচ্ছিন্ন এবং এই ভেবে একাকীত্ব জীবন যাপন শুরু করেন তখন উনাকে হতাশা গ্রাস করে। আর এই হতাশা থেকেই মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তবে কয়েকটি বিষয় মেনে চললেই এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে নিজেকে বিরত রাখা সম্ভব বলে মনে হয়। প্রথমত, আত্মপ্রেমিক হওয়া অর্থাৎ নিজেকে ভালবাসা। দ্বিতীয়ত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেকে অন্যদের থেকে অধিক সক্ষম মনে করা অর্থাৎ কোন একটি বিশেষ কাজ আপনি অন্যদের থেকে অধিক সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারেন এমনটি ভাবা। সর্বোপরি যতসম্ভব পারা যায় নিজেকে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত রাখা। কারণ এমন কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি ও প্রশংসা নিজেকে মূল্যবান করে তোলে।

হাফিজ ইসলাম, সহকারি প্রক্টর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

নিজেকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে হবে

বর্তমানে আত্মহত্যা এক মারাত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। নানান ধরণের হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। অথচ ধর্ম কিংবা যেকোনো বিবেচনাতেই আত্মহত্যা একটি নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ।  চাহিদার সাথে প্রাপ্তির অসামঞ্জস্যতা হতাশা সৃষ্টির অন্যতম কারণ।  আর এটিই ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যায়। কেউ কাঙ্ক্ষিত চাকুরি না পেয়ে, কেউ প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করতে না পেরে, কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, আবার কেউ সমাজের কটুকথা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। অথচ ‘রাত যত গভীর হয়, ভোর যে ততই নিকটে আসে’ সে কথা হয়তো তারা দিব্যি ভুলে যায়। আকাশচুম্বী চাহিদার কাছে স্বপ্নিল জীবনকে হার মানানো যাবে না। গভীরভাবে জীবনকে উপলব্ধি করতে শিখলে, নিজ ও পিতামাতার স্বপ্নগুলোকে গভীরভাবে অনুধাবন করলে, নিজের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু আছে ততটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকলে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকাংশে কমে যেত বলে মনে করি। প্রত্যেক ধর্মেই আত্মহত্যাকে মহাপাপ ও জঘন্য কর্ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল কোরআনে একাধিকবার আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয়ে আশাবাদী হওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। হতাশা দূর করার জন্য মানসিকভাবে সতেজ থাকা জরুরি। শিক্ষাজীবনে ফল ভালো না হওয়া, চাকুরির প্রস্তুতিকালীন হতাশা, জীবনযুদ্ধে বিভিন্ন কারণে কখনোই হতাশ বা ভেঙে পড়া যাবে না। অপেক্ষায় থাকতে হবে নতুন ভোরের। আঁধার কেটে গেলেই আসবে নতুন সূর্য। সেই নতুনের আলোয় দূরীভূত হবে সকল অমানিশা। তবে এজন্য নিজেকে অবশ্যই আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে হবে।

আতিফা কাফি তৃণা, লেকচারার, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

লড়তে হবে হতাশা নামক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে

প্রত্যেকটি জীবন সুন্দর। বেঁচে থাকাটাই হলো পরম তৃপ্তির। এজন্য মনে কখনো হতাশা আনয়ন করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, যেখানে সমস্যা, সেখানেই সমাধান। হতাশা মানুষকে চরম নিকৃষ্ট কাজের দিকে ধাবিত করে দেয়। মনে রাখতে হবে, আমরা জন্ম থেকেই চ্যাম্পিয়ন। কোটি কোটি ভ্রুণের সাথে যুদ্ধ করে আমরা জন্ম নিয়েছি। প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে কখনো একটু পিছিয়ে গেলে হতাশ না হয়ে ভুল শুধরে সামনের দিকে এগুতে হবে। পরিশ্রমের দরুণ আগামী দিন হবে কেবল সম্ভাবনার। শুধু লড়াই করতে হবে হতাশা নামক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে।

মোস্তাফিজুর রহমান, ছাত্রনেতা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ইবি

আর্থিক সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রকে ভূমিকা পালন করতে হবে

নতুন প্রজন্মের বিশাল একটি অংশকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় হতাশাগ্রস্ত করা হচ্ছে বলে আমার অভিমত; যার পরিণতি অপমৃত্যু। হতাশা ও আত্মহত্যার বিভিন্ন কারণ থাকলেও মূলত আর্থিক সংকটের দরুণ মানুষ হতাশার সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়। দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। আসন্ন বাজেট পরিকল্পনামাফিক তৈরি করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সচ্ছতার সাথে নিয়োগ এবং বেকারভাতার সৃষ্টির মাধ্যমে যুবসমাজকে হতাশা থেকে উত্তরণ করা সম্ভব। আবার দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীদের মানসিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ কোনো সেল নেই। থাকলেও কার্যকারিতা নেই। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দৃষ্টি দিতে হবে।

আব্দুর রউফ, সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, ইবি

হারানোর কিছু নেই; জয় করার আছে গোটা বিশ্ব

মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মধ্যে হতাশা বেশি কাজ করে। পরিবারের সাথে কন্ট্রিবিউট করার তাগিদটা সব সময়ই থাকে তাদের। দেশের প্রেক্ষাপটে জীবনের নানামূখী অনিশ্চিতয়তার মধ্যে হতাশার পারদ চড়ে যায়। যারা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়চেতা, প্রজ্ঞাবান, জ্ঞান, মেধা ও বুদ্ধিমত্তায় সেরা তারাই টিকে থাকে পৃথিবীর বুকে। আজ যারা যুবা-তরুণ তাদের হারানোর কিছু নেই, নিজস্ব সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করে পাবার আছে পুরো জগতটাই। শুধু মনে রাখতে হবে, রাঙ্গা সূর্য সন্নিকটেই। একই সাথে ছাত্র সংগঠনগুলোকে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টিকল্পে কাজ করা উচিত।

জি.কে সাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ইবি

যেকোনো পরিস্থিতির জন্য সবসময় নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে

বন্ধুত্বের সম্পর্কে ফাটল, বন্ধুদের কাছে যথাযথ গুরুত্ব না পাওয়া, পরীক্ষার ফল প্রত্যাশানুযায়ী না হওয়া অনেকসময় মনে হতাশা সৃষ্টি করে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মূলত প্রেমের সম্পর্কের টানাপোড়েনের জন্যই সৃষ্টি হয় হতাশা, সহ্য করতে না পেরে পরিণতি আত্মহত্যা। এজন্য নিজেকে সবসময় যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে। অন্যের প্রতি কম প্রত্যাশা, নিজেকে সবসময় কর্মব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। কোনো সমস্যায় পতিত হলে অন্যের সাথে তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। একই সাথে সৃষ্টিকর্তার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে হবে। আমার সাথে যা হচ্ছে, সব সৃষ্টিকর্তার নির্দেশেই হচ্ছে, আমার ভালোর জন্যই হচ্ছে এটি সবসময় মনে রাখতে হবে।

জারিন তাসনিম, শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ

কর্ম পরিত্যাগ কখনোই কাম্য নয়

আমাদের বেঁচে থাকার জন্য  সব ক্ষেত্রেই সংগ্রাম করতে হয়। আমাদের জন্ম, বেড়ে উঠা সবকিছুই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। মহাবিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টি সংগ্রাম করে জীবনযাপন করে। মানুষ পৃথিবীর সেরা জীব। জীবনযুদ্ধে কখনো সাফল্যের মুখ না দেখলে কর্মকৌশল পরিবর্তন করা উচিত। কখনোই কর্ম পরিত্যাগ কাম্য নয়। হতাশায় ডুবে আত্মহত্যা করা হলো অস্থায়ী সমস্যার স্থায়ী সমাধানের মতো; যা কেবল বোকারাই করে।

বিকাশ চন্দ্র রয়, শিক্ষার্থী, ফোকলোর বিভাগ

জীবনযুদ্ধে কখনো পরাজিত সৈনিক হওয়া যাবে না

প্রত্যেকটি মানুষ একেকটি স্বপ্ন এবং সম্পদ। কিন্তু বর্তমানের সাময়িক সম্যস্যা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা মানুষের জীবনকে বিষাক্ত করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আর্থিক সমস্যা অনেকসময় হতাশা আনতে বাধ্য করে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশানের প্রকৃতি অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহযোগিতা করা উচিত। প্রাত্যহিক জীবনে যত সমস্যা আসুক, কখনো জীবনযুদ্ধের পথচলায় পরাজিত সৈনিক হওয়া যাবে না। হতাশার গহীন বালুচড়ে আছড়ে আর একটিও সম্ভাবনাময়ী প্রাণ না ঝরুক এটিই কাম্য। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও এ বিষয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

রুখসানা খাতুন ইতি, শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস সংস্কৃতি বিভাগ

লেখক: আখতার হোসেন আজাদ, শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

01792387438; 01521319453

এ সম্পর্কিত আরও খবর