গ্রামীণ কৃষিতে সবুজ বিল্পবের প্রভাব ও স্থানিক জ্ঞানের পরিসর

, ক্যাম্পাস

আসিফ হাসান রাজু | 2023-09-01 06:27:05

বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি এদেশের মানুষের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৮% মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। আবহমান বাংলায় প্রাচীন কাল থেকেই এ দেশের মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। আজ থেকে প্রায় ১০-১১ হাজার বছর আগে নিওলিথীক বিল্পবের সময় যখন জলবায়ুতে পরিবর্তন ঘটতে থাকে ধারনা করা হয় তখন থেকে কৃষির উদ্ভব (Origin of Agriculture: New World Encyclopedia).  কৃষি গবেষণার ফলে আজ পর্যন্ত মানুষ কৃষি উৎপাদনে মানুষ অন্তত চারটি বিল্পব ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। প্রথমটিকে বলা হয় নিওলিথীক বিল্পব, দ্বিতীয় কৃষি বিল্পবটিকে আরব কৃষি বিল্পব বলে যেটি ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চলে। তৃতীয় কৃষি বিল্পটি হয় সপ্তদশ থেকে উনিশ শতকে। এটিকে ব্রিটিশ কৃষি বিল্পব বলে।

সর্বশেষ বিল্পটিকে সবুজ বিল্পব হিসাবে অভিহিত করা হয়। নরম্যান বোরলগ ছিলেন এ বিল্পবের নায়ক। সবুজ বিপ্লব মূলত বৈশ্বিক কৃষি খাতে নতুন প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার কথা বলে। বাড়তি জনসংখ্যার খাবারের চাহিদা মেটাতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব না হলে বিশ্ববাসী বড় ধরনের দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বে। এ পরিস্থিতি এড়াতে উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং সর্বাধুনিক সেচ ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে দেশে দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টাই সহজ ভাষায় সবুজ বিপ্লবের সারকথা ছিল (ইসলাম; ২০১৮)।  বাংলাদেশের কৃষিতে সবুজ বিল্পবের প্রভাব শুরু হয় ষাটের দশকে পাকিস্তানী শাসনামলে। ফসল বৃদ্ধিকল্পে আধুনিক চাষাবাদে কীটনাশক, উদ্ভিদের পরাগায়ন, সার প্রয়োগ এবং প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর প্রানপন প্রয়াস চালানো হচ্ছে। এর ফলে, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতাসহ জীববৈচিত্র্যের ধ্বংসাযজ্ঞ দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মানব স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক ও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

বর্তমান সময়ে কৃষির পরিবর্তন গ্রামের চিরাচরিত কৃষক সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলছে। সবুজ বিল্পবের আগে আমাদের দেশের কৃষি ব্যবস্থা ছিল শুধু বেঁচে থাকার জন্য কিন্তু বর্তমানে তা বেঁচে থাকা ও অর্থনৈতিক উন্নতি উভয়ের জন্য করা হচ্ছে। কৃষক সম্প্রদায় তাদের নিজেদের গণ্ডি অতিক্রম করে বৃহৎ সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। কৃষক সম্প্রদায় সম্পর্কে পূর্বের যে ধারণা ছিল তাও পাল্টে যাচ্ছে। জীবিকার তাগিদে বর্তমানে কৃষকেরা কৃষির পাশাপাশি অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষির এ পরিবর্তনের পেছনে সবুজ বিল্পবের প্রভাব বিশেষ ভাবে লক্ষনীয়।

এছাড়া পরিবর্তনশীল এ কৃষি ব্যবস্থায় কৃষকের যে নিজস্ব জ্ঞান প্রয়োগ করে কৃষি কাজ পরিচালনা করতেন সেই স্থানিক জ্ঞানকেও প্রভাবিত করেছে এ আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা। অথচ এ স্থানিক জ্ঞানের সাথে জড়িয়ে আছে তাদের নিজস্ব সংষ্কৃতি। এছাড়া কৃষকরা স্বভাবগতভাবে উদ্ভাবক। তারা অসীম সৃজনীক্ষমতার অধিকারী। কৃষকরাই বড় ও প্রকৃত প্রকৃতি বিজ্ঞানী। গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাত্ত্বিক সূত্র না জানলেও নিবিষ্ট চিন্তাচর্চা ও প্রকৃতির গতিবিধির সঙ্গে সখ্যের খেলায় খেলায় উদ্ভাবন করেন নতুন পদ্ধতি-প্রক্রিয়া। যেমন, জ্ঞান গবেষণা ছাড়াই প্রাকৃতিক চর্চায় নতুন জাতের ‘হরি ধান’ উদ্ভাবন করেন হরিপদ কাপালি। ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার দুধসর গ্রামের কৃষক সমাজের উপর পরিচালিত সবুজ বিল্পবের প্রভাবে গ্রামীণ কৃষি কাঠামোতে পরিবর্তনের চিত্র ও স্থানিক জ্ঞান অনুশীলনের পরিসর সম্পর্কে অনুসন্ধানের নির্মিতে পরিচালিত গবেষণাটিতে দেখা গিয়েছে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি তাদের জীবন ধারায় নানা ধরনের পরিবর্তন এনেছে।  শিল্প খাতের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও এখনও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষিখাত একটি গুরুত্বপূর্ণখাত হিসাবে বিবেচিত। এছাড়া কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে।

কৃষি শুমারি ২০১৯ এর রির্পোট অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট সাধারণ বসবাসধীন খানার সংখ্যার মধ্যে মতকরা ৮৩.৩৭% গ্রামে আর মাত্র ১৬.৬৩% শহরে। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ এখনো গ্রামে বসবাস করে। তাদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ লোক কৃষিকাজের সাথে যুক্ত। অন্যদিকে শহরের শতকরা প্রায় ১১ ভাগ মানুষ সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত। মোট দেশজ উৎপাদনের হিসাবে জিডিপিতে এখন কৃষি খাতের অবদান শতকরা ১৩.৩১ ভাগ। কৃষির সাথে যুক্ত এ সকল মানুষের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। তবে সবুজ বিল্পবের ফলে তাদের কৃষি কাঠামোতে নানা ধরণের পরিবর্তন লক্ষণীয়। সবুজ বিল্পবের ফলে যেমনি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি কৃষক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বাজার চাহিদার উপর। পূর্বে যেখানে তারা নিজের চাহিদার জন্য উৎপাদন করত নিজস্ব জ্ঞানের প্রয়োগ করে এখন তারা অনেক বেশি নির্ভরশীল প্রযুক্তির উপর, সার কীটনাশকের উপর। অধিক ফসলের আশায় কৃষকরা এখন অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করে ফসল উৎপাদন করছে যার প্রভাব পড়ছে মাটির যে প্রাকৃতিক উৎপাদন শক্তি ছিল তার উপরে।

অন্যদিকে অতিরিক্ত সার প্রয়োগে উৎপন্ন হওয়া ফসল মানুষ যখন ভক্ষণ করছে যা মানবদেহেও প্রভাব ফেলছে। কৃষি ব্যবস্থার সাথে কৃষকদের নিজস্ব চিন্তাধারা তাদের সতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে বহন করে।  প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ততা তাদের জীবনধারায় পরিবর্তন এনেছে। বিনোদনের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। অন্য পেশার সাথে যুক্ত হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কৃষকেরা আধুনিক দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে কৃষির পাশাপাশি অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে নিজেদের ভাগ্যের উন্নতি ঘটানোর জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় তারা বিভিন্ন অঞ্চলে গমণ করছেন। এক কথায় বলা যায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৃষকদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করছে। নৃবিজ্ঞান এরিক উলফের ধারনা অনুযায়ী দুধসর গ্রামের বর্তমান কৃষকের বৈশিষ্ট্যর আলোকে ‘Open Peasnat’ এর  বৈশিষ্ট্যর সাথে মিল পাওয়া যায়। বর্তমান সময়ে এ এলাকার কৃষকেরা কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার করছে। যার ফলে তাদের উৎপাদন বেড়ে গেছে, বাজার ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ার কারণে কৃষকেরা ক্রয়-বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বাজারের সাথে যুক্ত হচ্ছে। সবুজ বিল্পবের প্রভাবে ও আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সহজ ভাবে প্রাপ্তির ফলে গবেষিত এলকার কৃষকদের কৃষি কাঠামোর পাশাপাশি তাদের সামগ্রিক জীবনে এর প্রভাব লক্ষ্যণীয় তবে গ্রামীণ কৃষির চিরায়ত রুপ অনেকটা হারিয়ে গিয়েছে, তারা এখন নিজস্ব জ্ঞানের তুলনায় আধুনিক কৃষির উপর নির্ভরশীল।

লেখক: শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী

এ সম্পর্কিত আরও খবর