কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) সোলার পাওয়ার স্থাপন প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ১৮টি সোলার প্যানেল লাগানো হয়েছিল। লাগানোর এক বছরের মাথায় সেটি অকেজো হয়ে পড়ে। প্রায় ১০ বছরও হতে চললেও ঠিক করার কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তৎকালীন সময়ে এই সোলার প্যানেল স্থাপনে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ৪৯ লাখ ৬৯ হাজার টাকা ব্যয়ে ৮.৪ কিলোওয়াটের সোলার প্যানেল বিশ্ববিদ্যালয়কে বুঝিয়ে দেয় বাংলাদেশ অলটারনেটিভ এনার্জি সিস্টেমস লিমিটেড। শুরুতে ৫ কিলোওয়াটের সোলার প্যানেল লাগানোর কথা থাকলেও ৮.৪ কিলোওয়াটের সোলার প্যানেল লাগানো হয়। এই পরিবর্তন সম্পর্কিত কোন নথিও পাওয়া যায়নি।
কুবি থেকে একমাত্র পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহেরসহ চার সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল ছয়টি মতামত দেয় এ ব্যাপারে। প্রতিটি প্যানেলে ৬০টি করে সেল আছে। যেখানে আবহাওয়ার বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৩৬টি অথবা ৭২টি করে সেল থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। ৬০টি করে সেল থাকার কারণে গ্রীষ্মকালে উচ্চ তাপমাত্রায় ব্যাটারির চার্জিংয়ে সমস্যা হতে পারে বলে মত দেন তারা। এছাড়া তিনটি চার্জ কন্ট্রোলারের মধ্যে দুটি (ডান পার্শ্বের) এমভিপি মুড-এ যায় কিন্তু বাম পার্শ্বের চার্জ কন্ট্রোলার স্টার্ট আপ মুড এ থাকলে এমভিপি মুডে না যাওয়ার ব্যাপারটি উল্লেখ করেন। এসব কিছু ঠিক করে দিয়ে তবেই উক্ত প্রতিষ্ঠানকে বিল প্রদানের কথা বলেন।
কিন্তু ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির আগে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেলকে না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ সদস্যের গঠিত হওয়া টেকনিক্যাল সাব কমিটির সদস্য ও তৎকালীন রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামানের উপস্থিতিতে সরেজমিনে ঘুরে সোলারটি সন্তোষজনকভাবে কাজ করছে বলে জানান এবং কোম্পানিকে তাদের নিরাপত্তা জামানত ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করেন। এরপরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মোট টাকার ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ টাকা কোম্পানিকে দিয়ে দেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকৌশল দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রথমে ৫ কিলোওয়াটের কথা থাকলেও হুট করে ৮.৪ কিলোওয়াটের সোলার লাগানো হয়েছে। যা শুধু প্রশাসনিক ভবন না বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনগুলোও কভার করতো। কিন্তু তৎকালীন প্রভাবশালী শিক্ষক নেতা অধ্যাপক তাহেরের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তাহের সাহেব একাই ৫৭টি কমিটিতে ছিলেন সে সময়। তিনিই কমিটিতে প্রভাব বিস্তার করে এখানে দুর্নীতি করেছেন।
এর আগে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ১০ টি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে। সেখান থেকে ৫ টি প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করা হয়। এই ৫ টি কোম্পানির মধ্যে ইন্ট্রাকো এনার্জি লিমিটেড, বাংলাদেশ অলটারনেটিভ এনার্জি সিস্টেমস লিমিটেড শুধু টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন জমা দিয়েছিল। ফলে বাকি তিনটি কোম্পানিকে কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা হয়নি। সর্বশেষ সিলেটের বাংলাদেশ অলটারনেটিভ এনার্জি সিস্টেমস লিমিটেড নামক একটি কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয়। যাদের বাজেট ছিল ৪৯ লাখ ৬৯ হাজার টাকা এবং প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬০ লাখ টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকৌশল দফতরের আরেক কর্মকর্তা বলেন, প্যানেলগুলো যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতো সেগুলো ইনভার্টারে জমা থাকবে। কিন্তু পানেলগুলো যে পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতো সে পরিমাণ বিদ্যুৎ ইনভার্টার ধারণ করতে পারতো না। ফলে এক সময় এসে ইনভার্টার পুড়ে গেছে। আর এই ইনভার্টার সংস্কার করার কোন উপায় নেই। নতুন করে কিনতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী এস.এম শহিদুল হাসান বলেন, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মো. আমির হোসেন খানের সময়ের ঘটনা। এটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ড. মো. আলী আশরাফ স্যার যখন ভিসি তখন আমরা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম। তবে ফলপ্রসূ হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধ্যাপক পদ মর্যাদার এক শিক্ষক বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সোলার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। কিন্তু তৎকালীন প্রশাসনের সাথে আবু তাহেরের সখ্যতা থাকার কারণে সোলারের সব টাকা নিজের ইচ্ছেমতো ব্যয় করেছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অল্টারনেটিভ এনার্জি সিস্টেমস লিমিটেডের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার আশরাফ আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমরাই কুবিতে সোলার লাগিয়েছিলাম। লাগানোর এক বছর পর্যন্ত সময়ে যদি নষ্ট হতো তাহলে আমরা দায়িত্ব নিতাম। কিন্তু এক বছরের পরবর্তী সময়ে তো আমাদের দায়িত্ব থাকে না। তবুও আমরা দুয়েকবার অভিযোগের প্রেক্ষিতে গিয়েছিলাম এবং সমস্যা সমাধান করেছিলাম।
সার্ভিস চার্জের টাকা কেন নেয়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ঐদিকে আমাদের যাওয়া হয়নি তাই এসব টাকা আর নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট কথা। এগুলো চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই না। সোলারের নষ্ট হওয়ার সাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই।
সোলার লাগানো কোম্পানির জামানতের জন্য আবেদন করলে অধ্যাপক তাহেরের সুপারিশে জামানতের টাকা পেয়েছিল এবং এর কিছুদিন পরই সোলার প্যানেল নষ্ট হয়। এ ব্যাপারে বলেন, আমার স্বাক্ষর থাকতেই পারে এতে কি হয়েছে? পরে এ ব্যাপারে তিনি আর কথা বলতে রাজি হননি।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, আমি এরকম একটি অভিযোগের কথা আগেও শুনেছি। আমি এই বিষয়ে খোঁজ নিব এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিব।