কিছু দুঃখ মানুষকে হতাশায় ডুবিয়ে দেয়। শারীরিক বাধা তেমনই একটি কষ্ট। আবার এমন প্রতিবন্ধকতা কারো কারো জীবনে দৃঢ় অনুপ্রেরণা হয়ে অদম্য জোগায় মনে।
এমনি এক শিক্ষার্থী নোয়াখালীর কবিরহাট সরকারি কলেজের জান্নাতুল ফেরদাউস সোনিয়া। পড়ছেন দ্বাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে।
সোনিয়া দেখতে শিশুর মতো হলেও তার বয়স এখন ২১। লম্বায় ৩ ফুট ১০ ইঞ্চি। বয়স বাড়লেও তার শারীরিক গড়ন বাড়েনি। শরীরের গঠন দেখতে ঠিক শিশুদের মতো।
তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সোনিয়া সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই তিনি পড়াশোনায় বেশ আগ্রহী।
২০১৬ সাল। ছোট বোন জান্নাতুল নাঈমের সঙ্গে স্থানীয় রাজুরগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তেন সোনিয়া। যখন ছোট বোনের শারীরিক গড়ন বাড়তে থাকে, তখন তার শারীরিক গড়নে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। এরপর শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটে তাকে পড়তে হতো কটূ কথার বেড়াজালে। কিন্তু তাতে দমে যাননি সোনিয়া। বরং রাস্তাঘাটে হয়রানির বিরুদ্ধে তার লড়াই ছিল একদম ব্যতিক্রমী। মানুষের কোনো উপহাস বা টিপ্পনি কখনোই গায়ে লাগাননি তিনি।
সোনিয়া নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার সুন্দলপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সগির ফাইক গ্রামের জমিদার বাড়ির নুরুল হকের মেয়ে। বাড়ির পাশের প্রাথমিকের গণ্ডি শেষ করে ২০২২ সালে স্থানীয় মিয়ারহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৩.৫৬ জিপিএ পেয়ে এসএসসি পাস করেন তিনি।
এরপর কলেজে ভর্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়ান মা রহিমা খাতুন। এরপর একটানা তিনদিন কান্নার পর মেয়ের প্রবল ইচ্ছার কাছে হার মানেন মা। দিনমজুর বাবার একান্ত সহযোগিতায় কলেজে ভর্তি হন সোনিয়া।
তারপর বাড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি কলেজে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এখন স্বপ্ন দেখেন সব প্রতিবন্ধকতাকে ছিন্ন করে একজন ব্যাংকার হয়ে পরিবারের পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু দিনমজুর বাবা পরপর দু'বার হার্ট অ্যাটাক করে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সোনিয়ার উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বপ্ন বলা চলে ভেস্তে যেতে বসেছে!
জান্নাতুল ফেরদাউস সোনিয়া বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘আমার বাবা একজন দিনমজুর। পরিবার আর্থিকভাবে অসচ্ছ্বল। পর পর দু'বার বাবার স্ট্রোক করার কারণে পরিবারে অভাব-অনটন দেখা দেয়। এতে আমার পড়ালেখার খরচ বহন করা পরিবারের পক্ষে এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমার স্বপ্ন, পড়ালেখা শেষ করে একজন ব্যাংকার হবো। আমি চাই, সরকার ও সমাজের বিত্তবান মানুষ আমার পাশে এসে দাঁড়াক!’
মা রহিমা খাতুন বলেন, ‘আমার বড় কোনো ছেলে নেই। আমার মেয়ে যেন তার পড়ালেখা আরেকটু চালিয়ে যেতে পারে। সরকার ও বিত্তবান মানুষের সহযোগিতায় আমার মেয়ে যেন তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে, এমনটাই প্রত্যাশা আমার!’
মামা জাকির হোসাইন বলেন, ‘সোনিয়া আমার বড় বোনের মেয়ে। সে ছোটবেলা থেকেই অনেক কষ্ট করে এ পর্যন্ত এসেছে। আর্থিক সংকটে পড়ে তার লেখাপড়া এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সবার কাছে নিবেদন, আমার এই ভাগ্নিটি লেখাপড়া চালিয়ে যেন স্বপ্ন পূরণ করতে পারে, সে জন্য তার পাশে এসে দাঁড়ান!’
সোনিয়া সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে কবিরহাট সরকারি কলেজের প্রভাষক মোহাম্মদ নূরুল হক মিলন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘সোনিয়া আমাদের কলেজের একজন নিয়মিত ছাত্রী। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও সে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়! সব ছাত্রছাত্রীদের জন্য এটা অনুকরণীয়!’
কবিরহাট সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘সোনিয়ার যে উদ্যম, তা কলেজের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। তার উচ্চ শিক্ষার জন্য যতটুকু সম্ভব, আমি আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো। একই সঙ্গে সমাজের হৃদয়বান, বিত্তবান মানুষ যেন তার পাশে এসে দাঁড়ান, সে আহ্বানও জানাচ্ছি। সোনিয়ার ইচ্ছা পূরণ হোক, অন্তর থেকে সে কামনা করি।'