দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে বর্জ্যের পরিমাণ। দৃশ্যমান হচ্ছে বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকভাবে ঢেলে সাজানো গেলে পরিবেশ দূষণ ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত সংকট অনেকটা দূর হবে বলে মনে করেন গবেষকরা। সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ‘বায়োচার’। ‘বায়োচার’ হলো বিশেষ ধরনের কয়লা যার মধ্যে ৩৫ থেকে ৫৫ শতাংশ কার্বন থাকে।
বর্জ্য অব্যবস্থাপনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত পরিবেশ দূষণ ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি। সম্প্রতি হাইইনডেক্স জার্নালে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ‘বায়োচার এবং টেকসই কৃষি ক্ষেত্রের ব্যবহার’ বিষয়ক রিভিউ আর্টিকেল প্রকাশ করেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) স্নাতকোত্তর অধ্যয়নরত মেহেদী আমীন। তার গবেষক দলে যুক্ত ছিলেন সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, সিঙ্গাপুর ও চীনের গবেষকরা।
মেহেদী আমীন বায়োচার সম্পর্কে বলেন, জৈব বর্জ্য বা সবুজ জাতীয় বর্জ্যকে স্বল্প অক্সিজেনযুক্ত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নির্দিষ্ট উচ্চ তাপমাত্রা প্রদান করলে চারকোল অনুরূপ উচ্চ সরল কার্বন বিশিষ্ট বস্তু পাওয়া যায় যা ‘বায়োচার’ নামে পরিচিত। জৈব বর্জ্য পদার্থ অর্থাৎ আমাদের চারপাশে যত্রতত্র পড়ে থাকা সবজির খোসা অথবা শস্য জাতীয় গাছের অবশিষ্টাংশ থেকে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসৃত হয়। যার ফলে প্রতিনিয়ত ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি এই আবর্জনাগুলোকে আমরা বায়োচারে রূপান্তর করতে পারি তাহলে বর্জ্য থেকে একটি সম্পদে পরিণত হবে এবং আমাদের পরিবেশও দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন কারণে মাটি থেকে নাইট্রোজেন ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা আমাদের দেশে কৃষি সেক্টরের অন্যতম বড় সমস্যা। নাইট্রোজেন লসের ফলে মাটি নাইট্রোজেন ধরে রাখতে পারে না। যার কারণে ফসলের উৎপাদন ধরে রাখতে প্রচুর পরিমাণ ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়। অন্যদিকে, অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহারে মাটি ও পানির পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। আমরা যদি মাটিতে ‘বায়োচার’ যুক্ত করি তাহলে নাইট্রোজেনের উদ্বায়ীকরণ প্রক্রিয়া কমে যায় এবং অনেকাংশে লস রোধ করা যায়। মাটিতে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাইক্রো পোর (ছিদ্র) আছে এগুলো দিয়ে পানি, নাইট্রোজেনসহ অন্যান্য খনিজ পদার্থ নিঃসরিত হয়। বায়োচারের ছিদ্র মাটির ছিদ্রের চেয়ে ছোট হওয়ায় এগুলোর নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। ফলে বায়োচার ব্যবহারে মাটি বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ ও পানি গাছের ব্যবহার উপযোগী রূপে আটকে রাখতে পারে।
একইভাবে বায়োচার নাইট্রোজেনসহ অন্যান্য প্রকার সারের নিঃসরণ কমিয়ে গাছের সার গ্রহণের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। বায়োচার মাটিতে থাকা হেভি মেটাল ও অন্যান্য দূষিত পদার্থকে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বন্ধনের মাধ্যমে আটকে রাখে। যার ফলে এই পদার্থগুলো উদ্ভিদের অভ্যন্তরে প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এছাড়াও লবণাক্ততা ও খরায় গাছের ফলন বৃদ্ধিতে বায়োচার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। বায়োচার উদ্ভিদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় খনিজ পদার্থ ও পানি ধরে রাখতে পারে যা টেকসই ফসল উৎপাদন করে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সর্বোপরি বায়োচারের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গ্রিন হাউস গ্যাস কমায়, বৈষ্ণিক উষ্ণায়ন কমায় এবং চক্রীয় জৈব চাষাবাদ ও অর্থনীতিকে প্রণোদিত করে।
আর্টিকেলটির সম্পর্কে মেহেদী বলেন, আমরা আর্টিকেলটিতে দেখানোর চেষ্টা করেছি কীভাবে জৈব বর্জ্য থেকে বায়োচার প্রস্তুত করা হয়, এসব বায়োচারের কি কি ধরনের বৈশিষ্ট্য ও উপাদান রয়েছে। এছাড়াও পাইরোলাইসিস তাপমাত্রার পরিবর্তনে বায়োচারের গুণাগুণের কি কি পরিবর্তন হয় এবং টেকসই সার হিসেবে গাছের বৃদ্ধি ও উৎপাদনে কি ধরনের প্রভাব ফেলে তার বৈজ্ঞানিক সত্যতা তুলে ধরেছি।
শেকৃবিতে ‘বায়োচার’ নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। মেহেদী ও তার গবেষকদল মনে করে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশে ‘বায়োচার’ নিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে গবেষণা হওয়া দরকার।