সবুজের চাদরে মোড়ানো ঘন বৃক্ষরাজি ও পাহাড় ঘেরা সুবিশাল আয়তনের এক নৈসর্গিক ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। সকাল হতেই শুরু হয় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকদের আনাগোনা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই ক্যাম্পাসে জ্ঞানপিপাসু শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘর। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র জাদুঘর এটি। যেখানে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস- ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বিশাল সংগ্রহশালা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য মতে বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব এবং শিল্প ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে ও উৎসাহিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ কর্তৃক জাদুঘরটির আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৪ জুন ১৯৭৩ সালে। যদিও এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দিন তথা ২৬ নভেম্বর ১৯৬৬ সালে শুরু হয় জাদুঘর চালুর প্রক্রিয়া।
সর্বমোট পাঁচবার স্থান পরিবর্তন করার পর ১০ আগস্ট ১৯৯২ সালে স্থায়ী প্রদর্শনীর জন্য পাহাড়ের কোলঘেঁষে চবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাশে ছোট্ট টিলার ওপর দ্বিতল একটি ভবনে জাদুঘরের বর্তমান অবস্থান। এর আগে প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষে ক্ষুদ্র পরিসরে জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীকালে কিছুদিন উক্ত ভবনের নিচতলার দুইটি কক্ষে পূর্বের চেয়ে বড় পরিসরে কিছু সময় জাদুঘরের কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। এরপর চট্টগ্রাম শহরের মৌলানা মোহাম্মদ আলী সড়কে অবস্থিত চট্টগ্রাম কলাভবনে (বর্তমানে জেলা শিল্পকলা একাডেমি) স্বল্প পরিসরে এই জাদুঘর পরিচালিত হয় এবং এরপর পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের চতৃর্থ তলায় জাদুঘরটি স্থানান্তরিত হয়।
ভবনটির নিচতলায় রয়েছে গবেষণা কেন্দ্র, আলোকচিত্র স্টুডিও, কনজারভেশন ল্যাবরেটরি, একটি অস্থায়ী প্রদর্শনী ও সেমিনার কক্ষ, একটি ডকুমেন্টেশন ও গবেষণা কেন্দ্র, জাদুঘরের স্টোর রুম, অফিস কক্ষসমূহ এবং আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ কোষ গ্রন্থাগার। জাদুঘর ভবনটির দ্বিতীয় তলা পাঁচটি গ্যালারিতে বিভক্তি।
প্রাগৈতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ব গ্যালারি
চবি জাদুঘর শুরুর দিক থেকেই প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহের বিষয়ে সচেতন ভূমিকা রাখে। চট্টগ্রাম মহানগরীর নাসিরাবাদ পাহাড় হতে প্রাপ্ত টারশিয়ারি যুগের একটি মাছের ফসিল উপহার হিসেবে পায় বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর। আর এটিই সংগ্রহশালার সর্বপ্রাচীন নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ইতিহাস অধ্যয়ন ও গবেষণায় এটির রয়েছে অসামান্য অবদান। এই গ্যালারিতে আরও রয়েছে প্রায় ২০ হাজার বছরের পুরনো কাঠের ফসিল, কুমিল্লার কোটবাড়ি থেকে পাওয়া সপ্তম শতাব্দীর ল্যাম্পস্ট্যাণ্ড, সোমপুর বিহার ও কোটবাড়ির পোড়া মাটির ফলক, ধাতুচিত্র, অলংকৃত ইট, কাদা মাটির মূর্তি ইত্যাদি।
প্রাচীন ভাস্কর্য গ্যালারি
ভাস্কর্য গ্যালারিতে সংরক্ষিত বিভিন্ন ভাস্কর্যসমূহ গৌরবময় অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয় দর্শনার্থীদের। ব্রাক্ষ্মণ্য ও বৌদ্ধ প্রতিকৃতিগুলো থেকে সহজেই তৎকালীন সময়ের বিশ্বাস, রীতিনীতি, সংস্কৃতি এবং অলংকার সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। এ সংগ্রহশালার সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয় দুষ্প্রাপ্য ৫২টি কষ্ঠিপাথরের মূর্তি। রয়েছে ২৮টি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য এবং ধাতু নির্মিত কিছু ভাস্কর্য যার অধিকাংশই পাল আমলের (৮০০-১২০০খ্রিষ্টাব্দ)। গুপ্ত সাম্রাজ্যের (৩২০-৫৫০খ্রিষ্টাব্দ) একটি সূর্য মূর্তি রয়েছে এ জাদুঘরে। আরও রয়েছে বৈষ্ণব, শিব, সুরিয়া, শাক্ত এবং গাণপত্য পৌরাণিক চরিত্রসমূহের মূর্তি এবং ভাস্কর্য। এছাড়া রয়েছে চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে প্রাপ্ত নবম শতকের সেণ্ড পাথরের ভাস্কর্যের গরুড় রাধা বিষ্ণুর একটি প্রাচীনতম নিদর্শন।
ইসলামিক শিল্প গ্যালারি
এ গ্যালারিতে সংরক্ষিত সামগ্রীগুলো মুসলিম সভ্যতার তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থার একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলে দর্শনার্থীদের সামনে। এ গ্যালারিতে রয়েছে হাতে লেখা কুরআন শরীফ, শিলালিপি, কারুকাজ মসজিদের দেয়ালের খণ্ডিত অংশ, নকশে সুলেমানি, ১২০৯ সালের আলমগীর নামা, ফার্সি ভাষার গুলিস্তা, ১২২৯-৩৬ সালের হাতে লেখা ফার্সি কাবিননামা, ১০৬১ হিজরীতে লেখা মেপতাহুস সালাত। সম্রাট শাহজাহানের কামান, মুঘল আমলের ঢাল-তলোয়ার, উমাইয়া এবং সুলতানি আমলের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা এ সংগ্রহশালাকে দান করেছে অনন্য উচ্চতা।
লোকশিল্প গ্যালারি
আবহমান বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অনন্য সংগ্রহশালার নাম চবি জাদুঘর। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া পালকি, গ্রামোফোন, শীতল পাটি, হাতে তৈরি চরকা, তাঁত ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যাবে এ গ্যালারিতে। তবে বাঘের মাথা, প্রথম যুগের সিরামিক সামগ্রী, রাজকীয় লাঠির মাথা, হাজার বছর আগেকার মানুষের ব্যবহৃত অলংকার দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে বেশি।
সমকালীন শিল্পকলা গ্যালারি
বাংলাদেশের খ্যাতিমান প্রায় সব শিল্পীর চিত্রকর্ম যারা অবলোকন করতে চান তাদের জন্যই এ গ্যালারি আদর্শ একটি মাধ্যম। এ গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতান, মর্তুজা বশীর, রশীদ চৌধুরী, নিতুন কুণ্ডু ও হাশেম খানের মতো শিল্পীদের নানা চিত্রকর্ম এবং সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের ভাস্কর্য।
তবে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম এই জাদুঘরের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বার্তা২৪.কমকে জানান, জাদুঘরে অনেক ম্যাটেরিয়ালস আছে যেগুলো নিয়ে এমফিল, পিএইচডি করা যায়। কিন্তু আব্দুল করিম স্যারের পর আর কেউ এটা নিয়ে কাজ করেনি। যা খুব হতাশার ব্যাপার। জাদুঘর কোন অফিস না কিন্তু এটা বর্তমানে অফিস হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত এই জাদুঘর থেকে একটা গবেষণাপত্র বের করতে পারেনি। একটা মিউজিয়ামের প্রাণ হচ্ছে ক্যাটালগ কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা একটা ক্যাটালগ বের করতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, মার্কিন ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটনসহ পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এখান থেকে তথ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন অথচ এটা এখন অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে। গবেষণাপত্র ও জার্নাল বের না করলে শিক্ষার্থীরা এমফিল, পিএইচডি কিভাবে করবে?