ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দুই দিন পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্যের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন অধ্যাপক নূরুল আলম। এতে শূন্য হয়ে পড়ে প্রশাসনের শীর্ষ এই পদটি।
এছাড়া উপাচার্যের পদত্যাগের পরপরই উপ-উপাচার্যদ্বয় ও কোষধ্যক্ষের পদত্যাগে শূন্য হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো প্রশাসনিক কাঠামো৷ এমতাবস্থায় নতুন উপাচার্য পদের নিয়োগ আলোচনায় অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন শিক্ষক ছাড়াও ৮ জন শিক্ষকের নাম উঠে এসেছে। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ উপাচার্যের পদে অবসরপ্রাপ্ত কাউকে চান না বলে বিভিন্ন মাধ্যমে উঠে এসেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩ এর ১১(১) ধারা মোতাবেক উপাচার্য পদে সিনেট সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ৩ সদস্যের প্যানেল থেকে যেকোনো একজনকে ৪ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য শর্ত সাপেক্ষে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। তবে প্রথম মেয়াদ শেষ হলে রাষ্ট্রপতি একই ব্যক্তিকে উক্ত পদে পুনরায় আরও ৪ বছর দায়িত্ব পালনের নির্বাচন করতে পারেন।
অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩ এর ১১(২) ধারা অনুসারে যদি ছুটি, অসুস্থতা, পদত্যাগ বা অন্য কোন কারণে উপাচার্যের পদে শূন্য হলে আচার্য উক্ত পদে দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা করবেন। সে হিসেবে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), উপ-উপাচার্য (প্রশাসন), কোষাধ্যক্ষ ও রেজিস্ট্রার পদ শূন্য হয়ে পড়ায় এবারে উপাচার্যসহ প্রশাসনের বাকিপদগুলোর নিয়োগ সমীকরণে আসছে পরিবর্তন।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদত্যাগ করায় বর্তমানে এই পদে স্থায়ী/ভারপ্রাপ্ত/চুক্তিভিত্তিক কেউ দায়িত্ব পালন করছেন না বিধায় উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের সুযোগ নেই বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্টের ১৬ ধারা অনুযায়ী সিনেট সচিব হিসেবে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। তিনি উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের বিধি মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার দায়িত্ব পালন করবেন। মনোনয়ন অথবা নির্বাচনী কার্যক্রমের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করার দায়িত্বও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের ওপর বর্তায়। যেহেতু এই পদে বর্তমানে স্থায়ী/ভারপ্রাপ্ত/চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কেউ নেই, তাই নির্বাচন আয়োজন পারতপক্ষে সম্ভব নয়। আর আয়োজন করলেও তা বিধিসম্মত হবে না।
এদিকে নতুন উপাচার্য হিসেবে আলোচনায় এসেছে ১০ শিক্ষকের নাম। বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী প্যানেল নির্বাচনের সুযোগ নেই বিধায় অন্তবর্তীকালীন সরকার যাকে যোগ্য মনে করবেন তাকেই এ পদে নিয়োগ দিলেও এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পছন্দ প্রাধান্য পাবে। অন্যথায় ফের আন্দোলনের সম্ভাবনার আশঙ্কা রয়েছে।
আলোচনায় থাকা শিক্ষকরা হলেন- প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সোহেল আহমেদ, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক কামরুল আহসান, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামছুল আলম, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দীন রুনু এবং গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের ডিন অধ্যাপক আব্দুর রব।
আলোচনায় থাকা শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক সোহেল আহমেদ আওয়ামীপন্থী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। এছাড়া গোলাম রববানী ব্যতীত বাকিরা বিএনপিপন্থী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত।
আলোচিত শিক্ষকদের মধ্যে শীর্ষে থাকা প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সোহেল আহমেদ আওয়ামীপন্থী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত থাকলেও যেকোনো যৌক্তিক আন্দোলনে ছিলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশে। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনেও শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে ব্যাপক সুনাম ও আস্থা কুঁড়িয়েছেন। তিনি বর্তমানে শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে প্রক্টর, হল প্রভোস্ট এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যানসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তিনি ৪৫টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন এবং কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন সময়ে ফ্রন্ট লাইনার হিসেবে কাজ করেছেন।
শীর্ষে রয়েছেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা পোষণ করে সাম্প্রতিক আন্দোলনে সরব ছিলেন৷ তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে বিএ (অনার্স), এমএ, এমফিল এবং নয়া দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন। তিনি পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক ইতিহাস (মধ্যযুগীয়), বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস, বাংলাদেশের উত্থান এবং দক্ষিণ এশীয় বিষয়ক বিষয়ে পড়ান। তিনি বর্তমানে নির্বাচিত সিনেটর এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ এবং একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য। এছাড়া তিনি জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের সহ-সভাপতি, আনন্দন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও উপদেষ্টা এবং রোটারাক্ট ক্লাব অফ জাহাঙ্গীরনগর এর সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন।
আলোচিত শিক্ষকদের মধ্যে শীর্ষে থাকা দর্শন বিভাগের অধ্যাপক কামরুল আহসান বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি যেকোনো যৌক্তিক আন্দোলন-সংগ্রামে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে সুনাম ও আস্থা কুড়িয়েছেন। তিনি শিক্ষকদের সংগঠন ‘জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম’ জাবি শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। রাজনীতির পাশাপাশি অ্যাকাডেমিক ও টক-শো ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তার পরিচিতি রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক, জাবি শিক্ষক সমিতির সম্পাদক সহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল মেম্বার, হল প্রাধ্যক্ষসহ প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করেছেন।
ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মাফরুহি সাত্তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। পাশাপাশি তিনি শিক্ষক সমিতির সম্পাদক, প্রক্টর, হল প্রভোস্ট, বিভাগীয় সভাপতিসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ জার্নাল অফ লাইফ সায়েন্সেসের সম্পাদকীয় বোর্ডে ছিলেন। তিনি এডি সায়েন্টিফিক ইনডেক্স র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশে ৭৮ তম স্থান অর্জন করেছেন। এছাড়া যেকোনো যৌক্তিক আন্দোলন-সংগ্রামে শিক্ষার্থীদের পাশে তাকে দেখা গেছে।
আলোচনায় থাকা বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে বিভাগের কার্যালয় থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি নামিয়ে ফেলে তিনি বেশ আলোচিত হয়েছেন। অধ্যাপক শামীমার ১৪টি গবেষণা প্রবন্ধ এবং একটি গ্রন্থ রয়েছে। এছাড়া হল প্রভোস্ট, ওয়ার্ডেনসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি সিনেটে নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি৷
সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম যেকোন যৌক্তিক আন্দোলনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশেও থেকেছেন৷ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের প্রভোস্ট, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান, পরিবহন অফিসের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক, উচ্চ শিক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান, একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য এবং নির্বাচিত সিনেটর ও সিন্ডিকেট সদস্য সহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তার অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে৷
এছাড়া আলোচনায় থাকা বাকি শিক্ষকরাও বিভিন্ন যৌক্তিক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ব্যাপক সুনাম ও আস্থা কুড়িয়েছেন৷ এদিকে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের উপাচার্য হিসেবে চান না শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ৷ তবে আলোচনায় থাকা অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন অধ্যাপকের মধ্যে রয়েছেন অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, আমির হোসেন প্রমুখ।
গত ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও বহিরাগত সন্ত্রাসীর হামলায় আহত শিক্ষক অধ্যাপক লুৎফুল এলাহী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মতামত জানিয়ে বলেন, অবসরে যাওয়াদের ভিসির দায়িত্ব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ওই সব ভিসিদের কোন দায়িত্ববোধ থাকেনা। কেননা তাদের মেয়াদ শেষ হলেই তারা শিক্ষকদের মাঝে আর ফিরে আসবেন না। ফলে দুর্নীতি, লুটপাট আর নিয়োগ বাণিজ্যের দিকেই তাদের মনোযোগ থাকে। আবার একজনকে একাধিকবার দায়িত্ব দেওয়ায় তারা যেমন স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে তেমনি স্বৈরাচারী সিন্ডিকেট গড়ে তুলে দুর্নীতির বলয়কে আরও প্রশস্ত করে তোলে। বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে অবসরপ্রাপ্তদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব না দেওয়াই শ্রেয়।