‘উড়লে আকাশে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি’ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) অনুষ্ঠিত হয়েছে চতুর্দশ প্রজাপতি মেলা। সারা দিন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে চলে এ মেলা।
শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) সুকালে প্রজাপতি মেলার উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান৷ দিনব্যাপী নানা আয়োজন শেষে বিকেল পাঁচটায় মেলার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়৷
দিনব্যাপী এ মেলায় ছিল প্রজাপতিবিষয়ক ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা (শিশু-কিশোরদের জন্য), প্রজাপতি ও প্রকৃতিবিষয়ক কুইজ প্রতিযোগিতা, প্রজাপতির আলোকচিত্র প্রদর্শনী, প্রজাপতিবিষয়ক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা, প্রজাপতিবিষয়ক ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী, প্রজাপতির আদলে ঘুড়ি উড্ডয়ন, বারোয়ারী বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ নানা আয়োজন। তাছাড়া মিলনায়তনের সামনের চত্বরে পাপেট শো সহ শিশুদের জন্যও ছিল নানা আয়োজন ।
মেলার আয়োজনকে ঘিরে শিশু-কিশোরদের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। হরেক রকমের প্রজাপতির ওড়াওড়ি শিশু-কিশোরদের মনে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করে। সাভার থেকে বাবার সঙ্গে মেলা দেখতে এসেছেন ছোট রাইসা৷ ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে এবং পাপেট শো দেখে খুবই উচ্ছ্বসিত দেখা যায় তাকে।
সকাল থেকেই রঙিন প্রজাপতির ওড়াওড়ি দেখতে মেলায় ভিড় জমান দর্শনার্থীরা। নগর জীবনের ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পেতে একটুখানি প্রশান্তির খোঁজে ঢাকার মিরপুর থেকে মেলা উপভোগ করতে দুই কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মিতুল হাসান৷ মেলায় এসে মেয়েরা ভীষণ আনন্দিত। প্রজাপতির হাটে রঙ-বেরঙের প্রজাপতি দেখতে তারা ছোটাছুটি করছে এদিক-সেদিক। তিনি মেয়েদের বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।
মানিকগঞ্জ থেকে আগত ফারজানা জানান, ইট-পাথরের শহুরে জীবনে প্রজাপতি দেখা পাওয়া দুর্লভ। প্রতিবছরই প্রজাপতি মেলায় নিয়ে আসি মেয়েদের। তারাও পাপেট শো, গান, ছবি আঁকায় চমৎকার সময় পার করে৷
সাভার থেকে ঘুরতে আসা সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি ফ্যামিলিসহ এখানে এসেছি। এটা খুবই চমৎকার একটি আয়োজন। শিশুরাও এখানে এসে খুবই উৎফুল্ল৷ ভিন্নধর্মী এ আয়োজন করার জন্য মেলার কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
এবারের আসরে প্রকৃতি সম্পর্কিত রিপোর্টিংয়ের জন্য বাটারফ্লাই মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন সজীবুর রহমান সজীব। পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ অবদানের জন্য বন ও প্রকৃতি বিষয়ক সংগঠন ‘প্ল্যানটেশন ফর নেচার’ এর প্রতিষ্ঠাতা সবুজ চাকমাকে বাটারফ্লাই অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। এ ছাড়া বাটারফ্লাই ইয়াং ইনথুসিয়াস্ট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সাব্বির আহমেদ।
মেলার আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, প্রজাপতি এই পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরাগায়নের মাধ্যমে প্রজাপতি পরিবেশ ও প্রকৃতি এবং বনাঞ্চল রক্ষায় ভূমিকা রাখছে। প্রজাপতিসহ বিভিন্ন পতঙ্গ আমাদের বাস্তুসংস্থান টিকিয়ে রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ আগের তুলনায় বিনষ্ট হওয়ার কারণে প্রজাপতিও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ২০১০ সালে প্রথম যখন প্রজাপতি মেলার আয়োজন করা হয় তখন প্রজাপতির বিভিন্ন প্রজাতির সংখ্যা ছিল ১১০টি। কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৫৭ তে। আমরা চেষ্টা করছি, যতগুলো রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণ করার। এজন্য পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়েও আমাদের সচেতন হতে হবে। প্রজাপতিসহ সকল পতঙ্গ টিকিয়ে রাখতে জৈববৈচিত্রের সাথে সমন্বয় করে দ্রুত মাস্টারপ্ল্যান কার্যকরের করতে হবে৷
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, প্রজাপতির কাছ থেকে মানুষের শেখার আছে। প্রজাপতি পরাগায়ণের মাধ্যমে কোনো প্রকার ক্ষতি ছাড়াই আমাদের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ধর্ম, বর্ণ এবং বৈচিত্র্যেভেদে মানুষের কাছেও সকল মানুষ নিরাপদ হতে হবে। প্রজাপতির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে গোটা বিশ্বকে নিরাপদ রাখার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে মানুষকে। সকল ষড়যন্ত্র থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে হবে। প্রকৃতির সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সবাইকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সোহেল আহমেদ, জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মাসুদ, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের অধিকর্তা মুকিত মজুমদার বাবু, বন বিভাগের বণ্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মো: ছানাউল্যা পাটওয়ারী এবং আরণ্যক ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি মুরাদ বিন আজিজ প্রমুখ৷
উল্লেখ্য, প্রজাপতি সংরক্ষণ ও গণসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজাপতি মেলা আয়োজিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ‘কীটতত্ত্ব’ শাখা এ মেলার আয়োজন করে৷