ছুটির ঘণ্টার ট্রাজেডি থেকে রক্ষা পেল তিনটি বিড়াল ছানা!

, ক্যাম্পাস

রেজা উদ দৌলাহ প্রধান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট,বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-31 00:07:57

মায়ের জন্য সন্তান, সাত রাজার ধন-অমূল্য, অতি আদরের। সন্তানের জন্য মায়ের মায়াটা তাই একটু বেশি-ই থাকে। সন্তানের যেকোনও বিপদ আপদ যেন মা-ই আগে টের পান। তাই সন্তানের যেকোনও বিপদে সবার আগে পাশে দাঁড়ান। চিরন্তন এই সত্যগুলো যেন প্রাণি জগেতের সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। হোক সেটা মানুষ কিংবা ভিন্ন কোনও প্রাণি।

মা-সন্তানের চিরাচরিত সম্পর্কের সেই চিত্র শনিবার (৩১ আগস্ট) দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে। তিনটি বিড়াল ছানা ও তাদের মাকে নিয়ে হয় ঘটনার সূত্রপাত। আজিজুর রহমান পরিচালিত ছুটির ঘণ্টা সিনেমার কিশোর খোকনের মতো কার্জন হলের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের  শ্রেণিকক্ষে আটকে পড়ে তিনটি বিড়াল ছানা। স্কুলের টয়লেটে খোকনের আটকে থাকার কথা কেউ না জানলেও এখানে বিড়াল ছানাগুলোর মা ঠিকই জেনেছে; তার সন্তানেরা আছে দরজার ওপারে। কেউ না জানার কারণে সিনেমায় খোকনের চিরতরে ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠলেও, এখানে নিজের ছানাগুলোকে রক্ষা করেছে মা বিড়ালটি।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শ্রেণিকক্ষে তালা লাগিয়ে দেয় অফিস সহকারী। তখন ভুলবশতই তিনটি বিড়াল ছানা ওই কক্ষেই আটকে যায়। এরপর থেকেই তারা আটকে ছিল সেখানে। শুক্র-শনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাপ্তাহিক ছুটি। ছাত্র-ছাত্রী, অফিস সহকারী কেউ আসেনা এ দুইদিন।

দুই দিন ধরেই তাই বদ্ধ সে কক্ষের বাইরে অপেক্ষায় ছিল তাদের মা। কখন দরজা খোলা হবে, তার সন্তানেরা বাইরে আসবে সে আশাতেই সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টার কাটা পেরিয়ে যায়, কক্ষের দরজা আর খোলে না, মায়ের অপেক্ষাও শেষ হয় না! যেন অজানা আতঙ্কে মায়ের মন ধরফর করে ওঠে। দরজার বাইরে নিজে অস্থির পায়চারী।কখনও চাপা শব্দে ম্যাও, ম্যাও ডেকে যান।

কাজর্নের বিশাল করিডরের বদ্ধ ঘরে তিনটি বিড়াল ছানা ও অজানা শঙ্কায় বাইরে মায়ের অস্থিরতার দৃশ্য তাই চোখের আড়ালেই থেকে যায়।

অবশেষে শনিবার (৩১ আগস্ট) দুপুরে ঘটনাটি নজরে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন বিভাগের ছাত্র আমির ফয়সালের। কার্জন হলের ভেতর দিয়ে আসার সময় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সামনে মা বিড়ালটি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও কাছে গিয়ে ঠিকেই বুঝে নেন ভেতরে কী হয়েছে। বদ্ধ ঘর থেকে বিড়াল ছানাগুলো উদ্ধারে তাৎক্ষণিক কোন উপায় না পেয়ে ঘটনার একটি ভিডিও ধারণ করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফেসবুক গ্রুপ ‘অপরাজেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে’ সে ভিডিও পোস্ট করেন ফয়সাল। মুহূর্তেই সেটি গ্রুপে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের নজরে আসে। বিড়াল ছানাগুলোকে উদ্ধারে মা বিড়ালের প্রাণন্তকর চেষ্টায় অনেকের হৃদয় তখন আর্দ্র হয়ে ওঠে। বিড়াল ছানাগুলোকে উদ্ধারে নিজেদের মত পরামর্শও তারা দিতে থাকেন।

আমির ফয়সালের ভাষায়, গত দুই দিন ধরে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের এই রুমে আটকে ছিল সদ্যজাত বিড়াল ছানাগুলো। হয়ত দুই দিন ধরেই না খাওয়া৷ মরেও যেতে পারত। মা বিড়ালটি একবার আমার দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়েছিল, যেন সাহায্য চাইল। কিন্তু চাবি ছাড়া আমিও অসহায়। তখনি ফেসবুক গ্রুপে ভিডিও পোস্ট করে সংশ্লিষ্ট মহলের নজরে আনার চেষ্টা করি।

ফেসবুক পোস্ট থেকে ঘটনাটি নজরে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসুর) সাংস্কৃতিক সম্পাদক আসিফ তালুকদারের। মানবিক যেকোন সমস্যার সমাধানে শিক্ষার্থীরা তার শরণাপন্ন হন। তিনিও সাধ্যমত চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে।

আসিফ তালুকদার বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে আটকে পড়া বিড়াল ছানার কথা জানতে পেরে আমি দুজন ছোটভাইকে সেখানে যেতে বলি। তারা দ্রুত সেখানে যান। বিভাগের চেয়ারম্যানের সহায়তায় বদ্ধ কক্ষের তালা খুলে বিড়াল ছানাগুলোকে উদ্ধার করা হয়।

আসিফের ফোন পেয়ে দ্রুত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে সামনে যান ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ও হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল ছাত্র সংসদের সদস্য আবদুর রহমান। কার্জনে আসতে বলেন বন্ধু সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফ সবুজকে। বন্ধুর ফোন পেয়ে সবুজ আরো একজনকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত কার্জনের দিকে চলে যান। কিছুটা খোঁজাখুজি করেই তারা দেখতে পান বদ্ধ একটি দরজা গা ঘেঁষে একটি বিড়াল চিৎকার ও দৌড়াদৌড়ি করছে। কখনো কখনো দরজার ফাকা দিয়ে ছানাগুলোকে ছুয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

আব্দুর রহমান বলেন, ডিপার্টমেন্ট বন্ধ থাকায় ওই ডিপার্টমেন্টে কাউকে পাচ্ছিলাম না। পরে এক স্যারের মাধ্যমে ওই বিভাগের চেয়ারম্যান স্যারের কাছ থেকে চাবি নিয়ে এসে বাচ্চাগুলোকে উদ্ধার করি।

বিড়াল ছানাগুলোকে দেখে মা বিড়ালটি আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। আদর করে বিড়াল ছানাগুলোর গা চেটে দেয়। এরপর ওই দরজার গা ঘেষেই অভুক্ত সন্তানগুলোকে দুধ পান করাতে শুরু করে।

সাইফ সবুজ বলেন, কার্জনের পরীক্ষার হলে থাকা এক শিক্ষকের কাছে আমরা ঘটনা খুলে বলি। তিনি সহযোগিতা করলেন। কয়েক জায়গায় ফোন দিয়ে অনেক কষ্টে প্রায় ১ ঘণ্টা পরে চাবি যোগার করে দেন। চাবি দিয়ে  দ্রুত তালা খুলে ঢুকেই একে একে বের করলাম ৩ টি সদ্য প্রসূত বিড়াল ছানা। ২ দিন আটকে থাকা ৩ টি অবলা প্রাণিকে বের করতে পেরেছি বলেই প্রশান্তিই পেলাম। ভালে লাগছে।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর