ঢাবিতে ‘টর্চার সেল’, হল সংসদের অস্বীকার!

বিবিধ, ক্যাম্পাস

ইমরান হোসাইন, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-09-01 01:27:26

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে গেস্টরুম, গণরুমের নামে টর্চার সেলের অস্তিত্ব রয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। যার সত্যতা মিলেছে ভুক্তভোগীরদের বক্তব্যে। এর প্রতিক্রিয়া হলে কোনো ধরনের ‘টর্চার সেল’ নেই বলে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয় হল সংসদগুলো।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, টর্চার সেল নামে বিশেষ কক্ষ না থাকলেও হলে হলে বিভিন্ন নামে টর্চার সেল রয়েছে। বিভিন্ন কায়দায় সেখানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

টর্চার সেল নিয়ে হল সংসদের বক্তব্য
ঢাবিতে কোন ধরনের টর্চার সেল নেই বলে দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংসদগুলো। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান ও মাস্টারদা সূর্যসেন হল সংসদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ও সোশ্যাল মিডিয়ার বরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে টর্চার সেল নামক যে বিশেষ কক্ষের উপস্থিতির কথা বলা হচ্ছে তাতে গভীর বিস্ময় প্রকাশ করছি।’

বিজয় একাত্তর ও কবি জসীম উদ্‌দীন হল সংসদের বক্তব্য


ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের বক্তব্য
‘টর্চার সেলের অস্তিত্ব নেই’ হল সংসদের এমন ঘোষণা মানতে নারাজ ভুক্তভোগী সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ টর্চার সেলের কোনো অস্তিত্ব নাই এটা একধরণের মিথ্যাচার এবং বিভ্রান্তি। তাদের দাবি, টর্চার সেল নামে কোনো বিশেষ কক্ষ নেই, এটা সত্য। কিন্তু শিক্ষার্থীদের যেসব রুমে নির্যাতন করা হয় সেসব রুমতো টর্চার সেলই।

সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সালমার ফারজিব বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আভিধানিক অর্থে ‘টর্চার সেল’ বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু নেই। এটা যেমন সত্য তেমনি গেস্টরুমের নামে সিনিয়ররা জুনিয়রদের ওপরে নিয়মিত মানসিক নির্যাতন করেন, কখনো কখনো তা শারীরিক নির্যাতনে রূপ নেয়, এটাও সত্য। ঢাবির গেস্টরুমে ছেলেদের পিটিয়ে মারে না, গেস্টরুমে মানসিক নির্যাতন করে শিক্ষার্থীদের স্বপ্নগুলোকে মেরে ফেলে। যদি ব্যক্তির স্বপ্নই মরে যায় তাহলে আর থাকলোটা কী?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী মাস্টারদা সূর্যসেন হলের শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, টর্চার সেল মানে সেখানে টর্চার সেল লেখা থাকে না। সেই কক্ষগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকে গেস্টরুম, মিনি গেস্টরুম, সিংগেল মিনি গেস্টরুম, মোস্ট পলিটিক্যাল ভাইদের রুম ইত্যাদি।


টর্চার সেলের বীভৎস বর্ণনা দিয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন। এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, সময়টা ছিল ৯ এপ্রিল ২০১৮ সালের ভোর ৫টা। শামসুন্নাহার হলের বিপরীত দিকের দেয়াল টপকিয়ে টিএসসির ভেতর থেকে বের হলাম, সাথে আরো কয়েকটা ছেলে ছিল। বের হওয়ার সাথে সাথে বর্তমানে অস্ত্র মামলায় গ্রেফতারকৃত হলের ছোট ভাই, তুষার আমাকে দেখে ফেললো। তুষারের ফোন পেয়ে মনে হয় ছোট ভাই জ্যোতিও চলে আসলো। এরা আমাকে বললো, ‘সানী ভাই আপনাকে যেতে বলছে’ (মেহেদী হাসান সানী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, মুহসীন হল ছাত্রলীগ)। আমাকে বাইকে করে নিয়ে যাওয়া হলো, কিছু সময় পরই সানী আসলো। আমাকে দেখেই বার বার তেড়ে আসছিলো এবং গালিগালাজ করতে লাগলো তবে গায়ে হাত দেয়নি। মুহসীন হলের ৩৩৩ নম্বর রুমে আনা হলো আমাকে, এক ঘণ্টা পর্যন্ত কি যে মানসিক টর্চার! সেটা শুধু আমিই জানি। বার বার ডাকার পরেও কেউ রুম খুলল না, বাধ্য হই পানির বোতলে প্রস্রাব করতে! সময়টা চোখের সামনে ভেসে উঠলে চোখে পানি চলে আসে।

বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-এর অনুসন্ধান
কয়েকটি হলের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গেস্টরুম, শয়নকক্ষ, গেমস রুম, গণরুম ইত্যাদি নামে বিভিন্ন হলে টর্চার সেলের অস্তিত্ব রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে গত ১৪ জুলাই ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় ২৪ জন শিক্ষার্থীকে রড-স্ট্যাম্প দিয়ে এলোপাথাড়ি মারধরের ঘটনা ঘটে। হল সংসদের এজিএস আব্দুল্লাহ মুমিন আবিরের নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটে। পরে ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী মুনিরুল ইসলামকে দেড় ঘণ্টা আটক রাখেন ছাত্রলীগ নেতারা। হলের ২০৬ নং কক্ষে তাদের আটক রেখে মারধর করা হয়।

এ ঘটনার কথা স্বীকার করেছে হল প্রশাসন। হল প্রভোস্ট জিয়া উদ্দীন দোষীদের বিচারের আশ্বাসও দেন। পরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন হলেও তার অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি।


মাস্টারদা সূর্যসেন হলে চারটি গ্রুপ সক্রিয়। ছাত্র সংসদের ভিপি, জিএস নিয়ন্ত্রিত গ্রুপের বিরুদ্ধে গত কয়েকমাসে শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের অভিযোগ না থাকলেও অন্য দুই গ্রুপের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানীর অনুসারীদের ফেব্রুয়ারির মাসের একটি অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়। অডিও ক্লিপে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলের ৬২৬ (ক) নং কক্ষে মানসিক এবং শারীরিকভাবে নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া যায়। তৃতীয় বর্ষের বড় ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীর 'যোগাযোগ থাকায়' তাকে নানাভাবে হেনস্তা ও জেরা করা হয়। একপর্যায়ে প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে চড় দেওয়ার শব্দও শোনা যায় অডিও ক্লিপে। অভিযোগের সত্যতাও মেলে শিক্ষার্থীদের বক্তব্যেও।

ডাকসু নেতা ও প্রশাসনের বক্তব্য
ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, প্রশাসন হলগুলোকে ছাত্রলীগের কাছে অলিখিতভাবে ইজারা দিয়েছে। তাই তারা যাচ্ছেতাই করে বেড়াচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে গেলে শিবির ব্লেইম দিয়ে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়।

ভিপি নুর বলেন, যদি হলগুলোতে টর্চার সেলই না থাকত তাহলে হাফিজুরদের মৃত্যুবরণ করতে হতো না। সামান্য একটি ক্যালকুলেটরকে কেন্দ্র করে এহসানের চোখ নষ্ট করা হতো না।


বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘গণরুম হবে বন্ধুরুম, এটা অন্যান্য রুমের মতই হবে।’ গেস্টরুম সম্পর্কে উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের হলগুলোতে গেস্টরুম রয়েছে। সেখানে অতিথিরা আসেন, তাদের বিশ্রামের জন্য তা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে নির্যাতন হয় কিনা তা আমার জানা নেই।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর