করোনাকালে চবি শিক্ষিকা সুইটির মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন

, ক্যাম্পাস

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 09:21:42

রোববার (৩১ মে) ভোর এলো তীব্র দুঃসংবাদে। একটি দুঃসহ মৃত্যুর স্পর্শে সকাল গড়িয়ে শুরু হলো দিন। জানা গেলে, বিগত রাত ২.৩০ মিনিটে তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক, প্রাক্তন পরিচালক সাবরিনা ইসলাম সুইটি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরতরে। তার জন্য একটি আইসিইউ বেড আপ্রাণ খুঁজেও স্বজনরা পাননি তারই প্রিয়তম চট্টগ্রাম শহরের কোনো হাসপাতালে।  

সাবরিনা ইসলাম সুইটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম যোগদান করেন সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে। প্রথম বর্ষে রাজনীতি বিজ্ঞান ও অনুষদের অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের যত্ন করে পড়ান তিনি। আমাদের সঙ্গে গড়ে ওঠে তার নিবিড় সম্পর্ক। পরে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে শিক্ষক হিসেবে চলে গেলেও এই বিনয়ী, ভদ্র, মৃদ্যু ও মিষ্টভাষী মানুষটির সঙ্গে চবির সকলেরই একটি মধুর ও সম্মানজক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।

বাসে, লাউঞ্জে, করিডোরে, ক্যাম্পাসের নানাস্থানে দেখা হলেই তিনি সালাম ও প্রীতি সম্ভাষণের মাধ্যমে সকলকে আপন করে নিতেন। শিক্ষার্থীদের বলতেন সন্তান। একজন আপাদমস্তক ভালো মানুষ ও সজ্জন শিক্ষকের প্রতিচ্ছবি ছিলেন সাবরিনা ইসলাম সুইটি।

কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি নিজেকে উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে যোগ্যতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। নিজের অন্তর্গত বিশ্বাসের বিষয়ে ছিলেন সুদৃঢ়। একটি শুদ্ধ, পবিত্র ও অর্থপূর্ণ জীবনযাপনের মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগত জীবনে স্থাপন করেছিলেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

কিছুদিন আগেই স্বামীকে নিয়ে পবিত্র মক্কা-মদিনায় গিয়ে ওমরাহ পালন করে আসেন তিনি। শহরের আগ্রাবাদের বাসিন্দা হলেও সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য চলে এসেছিলেন চট্টগ্রাম কলেজ এলাকায়। পেশা ও পরিবারের বৃত্তে চমৎকারভাবে তার জীবন বিন্যস্থ ছিল।

তার স্বামী তারই বিভাগীয় সহকর্মী অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক, প্রাক্তন পরিচালক। আচার-আচরণে, কথাবার্তায় তিনিও একজন অতি অমায়িক মানুষ। এই শিক্ষক দম্পতি চবি ক্যাম্পাসের সকলের প্রিয়ভাজন ছিলেন স্বকীয় গুণে।

উভয়েই ছিলেন চট্টগ্রামের দক্ষিণের উপজেলা বাঁশখালীর মানুষ। চট্টগ্রাম তাদের আত্মা ও অস্তিত্বের অংশ। সেই চট্টগ্রামে তিনি মারা গেলেন এক ধরনের বিনা চিকিৎসায়। একটি আইসিইউ পাওয়া গেলো না এই নিবেদিতপ্রাণ, মুমূর্ষু শিক্ষকের জন্য।

সাবরিনা ইসলাম সুইটি তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তার মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছিল, নাকি তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন, সেটা উপযুক্ত টেস্টের মাধ্যমে স্পষ্ট নয়। যা সকলের সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট, তা হলো, তিনি ভীষণ অসুস্থ ছিলেন, তার আইসিইউ বেডে নিবিড়ভাবে চিকিৎসার দরকার ছিল, কিন্তু তিনি তা পাননি।

সুদীর্ঘ জীবনের শিক্ষকতায় অসংখ্য শিক্ষার্থী ও সমাজকে তিনি উজাড় করে দিলেও জীবনের ঘোরতর সঙ্কটকালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগটুকুও পেলেন না। আমাদের সকলের জন্যেই এরচেয়ে গভীর দুঃখ, বেদনা, হতাশা ও ক্ষোভের বিষয় আর কিছুই হতে পারেনা। যে সমাজের জন্য তিনি সবকিছু করলেন, সেই সমাজের পক্ষে তার মতো একজন নিবেদিত শিক্ষকের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারার ব্যর্থতা কার?

সাবরিনা ইসলাম সুইটি চিরদিনের জন্যে পরপারে চলে যাওয়ার সময় যেন আমাদের সামনেই এইসব প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে গেলেন। জানিনা, কে এসব প্রশ্নের উত্তর দেবেন। কিন্তু এসব অসঙ্গতি, অবহেলা, অপ্রতুলতা ও প্রশ্নের উত্তর জানা সবার জন্যেই জরুরি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর