সুইটি ম্যাডাম: পুষ্পিত, চন্দিত মুখের এক মায়াবতী

, ক্যাম্পাস

সরওয়ার মোরশেদ | 2023-08-26 11:57:00

সামাজিক দূরত্ব চর্চায় আমি এক আজন্ম তাপস। তাই এই সামাজিকতা উপদ্রুত-উপকূলে সিদ্ধপুরুষদের ভিড়ে আমি এমনকি অর্ধসিদ্ধও না, রীতিমতো পূর্ণ-অসিদ্ধ। রোমে বসত করলে রোমান হওয়ার অন্ততঃ কসরত করতে হয় - এমারসোনিয়ান Self Reliance এর পাড় ভক্ত হয়েও আমি মাঝেসাঝে এই আপ্তোক্তি মানার চেষ্টা করি। এরকম সামাজিকতাবোধ তাড়িত হয়ে একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে ২০০৩ সালের কোন একদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক) গিয়েছিলাম।

প্রসঙ্গত, অসুস্থ ব্যক্তিদের দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, কিছু রোগী যেমন সঙ্কটাপন্ন পোস্ট-অপারেটিভ বা কার্ডিয়াক প্যাশেন্টদের দেখতে না যাওয়াই উত্তম কারণ দর্শনার্থী গেলে লৌকিকতা করে হলেও রোগীকে কথা বলতে হয় - এতে বিমারীগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষতির আশংকা থাকে। যাই হোক, চমেকের হৃদরোগ বিভাগে গিয়ে দেখি সুইটি ম্যাডাম আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-সহকর্মীকে পরম মমতায় বিভিন্ন ধরনের ফল কেটে ছোট ছোট টুকরো করে খাইয়ে দিচ্ছেন। সেদিন থেকে এ বিষময় বিশ (২০২০) পর্যন্ত আমার অন্তরে খোদিত হয়ে গিয়েছিল তাঁর অপরূপ মাতৃমূর্তি।

ম্যাডামের সাথে, যাকে তার পতি সাইফুল ভাইয়ের সূত্রে মাঝে মধ্যে 'ভাবী' বলেও সম্বোধন করতাম, আমার ছিল এক গতিময়, চলিষ্ণু সম্পর্ক। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নাম্বার রুটের যাত্রী হওয়ায় প্রায়ই বাসে দেখা হতো। আসন ফাঁকা থাকলে অনেক সময় সাইফুল ভাই আমার পাশে এসে বসতেন আর বিভিন্ন বিষয়ে মজাদার গল্প করতেন। পতিপ্রাণা সুইটি ম্যাডাম পিছন থেকে আমাদের সে আলাপে রসদ যোগাতেন আর প্রাণখুলে হাসতেন। স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিকতার বাইরে উনার সাথে আমার হরদম মোলাকাত হতো কলা অনুষদের করিডোরে, টিচার্স লাউঞ্জের আশপাশে - সবই ওই হন্টনরত অবস্থায়। সবসময় উনি অনেক দূর থেকেই তার ট্রেডমার্ক হাসি দিয়ে সম্ভাষণ জানাতেন। তিনি যেন আপনি আচরি অলক্ষ্যে আমাদের শেখাতেন, 'হাসতে পয়সা লাগেনা।'

ম্যাডামের বড় ছেলে সাজিদ বছর দেড়েক আগে আমাদের বিভাগে ভর্তি হয়। এরপর থেকে দেখা হলে তিনি ছেলের পড়াশোনার খবর নিতেন - তখন তিনি সহকর্মী নয়, একজন মমতাময়ী মা হিসেবেই কথা বলতেন, পরামর্শ চাইতেন। সাজিদদের সাথে প্রথম বর্ষের অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করার পর একদিন কলা অনুষদের যাত্রী ছাউনীতে শহরগামী বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একটু পরে সেখানে সপারিষদ সুইটি ম্যাডাম আসলেন। আমাকে দেখেই মন্জুভাষিণী সুইটি ম্যাডাম বললেন, ' ভাই, আপনিতো অনেক জনপ্রিয় শিক্ষক! সাজিদদের ক্লাসের বাচ্চাগুলোর মুখে আপনার সুনাম শুনে খুশি হয়েছি।' নিজের প্রশংসা শুনে তুষ্ট কিন্তু খানিক মধুরভাবে বিব্রত আমি চটুলসুরে বলেছিলাম, 'পরনিন্দা আর চরিত্রহননের এই সময়ে এতো মন ভালো করা শুভ সন্দেশ পরিবেশন করলেন! আপনি শতায়ু হউন। আপনার মুখ পুষ্পিত হউক, চন্দিত হউক।'

দুঃখের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের 'বাচ্চা' বলে সম্বোধন করা এই মমতাময়ী শতায়ু হওয়ার সাড়ে চারদশকাধিক আগেই গতায়ু হলেন। পুষ্পিত-চন্দিত মুখের সে মায়াবতী মায়া সায়র পাড়ি দিয়ে অসীমের যাত্রী হলেন। অনসূয়া সুইটি ম্যাডাম, আপনার যাত্রা শুভ হোক - Bon voyage!

 সরওয়ার মোরশেদ, প্রফেসর, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এ সম্পর্কিত আরও খবর