চীনের সিনোফার্মের বিবিআইবিপি-করভি টিকা কতটা নিরাপদ ও কার্যকরী

, যুক্তিতর্ক

ড. মো. আজিজুর রহমান | 2023-08-28 04:10:11

কোভিড-১৯ রোগের সূত্রপাত চীনে। চীনে সূত্রপাত হলেও চীন সরকারের দ্রুত ও সমন্বিত কঠোর পদক্ষেপ এবং জনগণের দেশপ্রেম ও সচেতনতার ফলে সার্স-কোভ-২ নামক ঘাতক ভাইরাসটি তেমন ক্ষতি করতে পারেনি এ দেশটির। আজ পর্যন্ত (১৯ মে ২০২১) চীনে সার্স-কোভ-২ করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মারা গেছে ৪,৬৩৬ জন। এ ভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে চীনের অবস্থান ৬০ তম। সেখানে বর্তমানে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা মাত্র ২৯৬ জন এবং তাদের মধ্যে মাত্র ৩ জন রোগীর অবস্থা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ। গত সাড়ে তিন মাসে এ রোগে কেউ মারাও যায়নি। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ি এ পর্যন্ত কোভিড-১৯-এর কারণে চীনের প্রত্যেক ১০ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র তিন জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। নতুন মৃত্যুর দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ভারতের। গত ১৮ মে সেখানে মারা গেছে ৪ হাজার ৫২৫ জন এবং সংক্রমিত হয়েছেন ২ লাখ ৬৭ হাজার ১৭৪ জন। ভারতে এ পর্যন্ত কোভিড-১৯-এ প্রতি দশ লাখে মারা গেছেন ২০৪ জন। এটা স্পষ্ট যে সার্স-কোভ-২ করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট, বি ১.৬১৭ এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সম্প্রতি বাংলাদেশেও এ ধরণটির উপস্থিতি ধরা পড়েছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বাংলাদেশেও ভয়াবহ পরিস্থিতির আশংকা রয়েছে।  

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চীন যেমন এগিয়ে, তেমনি ভ্যাকসিন আবিষ্কারেও বেশ এগিয়ে। এ পর্যন্ত করোনা প্রতিরোধে মোট ১৫টি ভ্যাকসিন একাধিক দেশে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে চীনের পাঁচটি। এ পাঁচটির মধ্যে রয়েছে সিনোফার্মের ২ টি- বিবিআইবিপি-করভি এবং ডাব্লিউআইবিপি-করভি, অ্যানহুই ঝিফেই লংকম বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির জেডএফ২০০১, ক্যানসিনো  বায়োলজিকস-এর অ্যাড৫-এনকোভ এবং সিনোভ্যাক কোম্পানীর করোনাভ্যাক।

করোনার যে ১৫টি ভ্যাকসিন বিভিন্ন দেশে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত হয়েছে তার মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দিয়েছে মাত্র ছয়টির। ছয় নম্বর ভ্যাকসিন হিসেবে চীনের সিনোফার্মের বিবিআইবিপি-করভি অনুমোদন পেয়েছে গত ৭ মে। পশ্চিমা দেশের বাইরে সিনোফার্মের বিবিআইবিপি-করভি প্রথম করোনার টিকা হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেল। এর আগে যে পাঁচটি টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দিয়েছে তার মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির ফাইজার-বায়ো-এন-টেক (৬ জানুয়ারি ২০২১), সুইডেনের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা (১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১), যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডসের জনসন অ্যান্ড জনসন (২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১) এবং যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না (১ মে ২০২১)। রাশিয়ার স্পুটনিক ভি এখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায় নি।

গত ১২ মে চীন সিনোফার্মের তৈরি বিবিআইবিপি-করভি ভ্যাকসিনের পাঁচ লাখ ডোজ উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে। নিশ্চিতভাবেই করোনার ভ্যাকসিনের এ চরম সংকটকালে চীনের এ মহামূল্যবান উপহার আমাদের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু, ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরিকৃত ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড এবং সিনোফার্মের তৈরি বিবিআইবিপি-করভি ভ্যাকসিন সম্পূর্ণ আলাদা প্রযুক্তিতে তৈরি বলে যারা কোভিশিল্ডের ১ম ডোজ নিয়েছেন তাদের বিবিআইবিপি-করভি নেয়ার কোন সুযোগ নেই। এখন পর্যন্ত গবেষণার তথ্য বলছে যারা কোভিশিল্ডের ১ম ডোজ নিয়েছে, তাদের সে ভ্যাকসিনেরই ২য় ডোজ নিতে হবে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ি  যারা কোভিশিল্ড টিকা নিতে নিবন্ধন করেছিলেন, কিন্তু টিকার প্রথম ডোজ পাননি এবং যারা নতুন করে নিবন্ধন করবেন তাদের সিনোফার্মের বিবিআইবিপি-করভি টিকা দেয়া হবে।

কিন্তু, প্রশ্ন হল এ ভ্যাকসিন কতটা নিরাপদ ও কার্যকরী? বিবিআইবিপি-করভি’র ১ম ও ২য় ফেজের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল জার্নালে প্রকাশিত হলেও, এর ৩য় ফেজের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল পিয়ার-রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত না হওয়ায় এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ও শঙ্কা ছিল। কিন্তু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ৭ মে অনুমোদন দেয়ায় সে শঙ্কা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। সংস্থাটি বিবিআইবিপি-করভি ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা, কার্যকারিতা এবং মান যাচাই করে দেখেছে এবং তাদের কাছে এ ভ্যাকসিন নিরাপদ ও কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হয়েছে। চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হাঙ্গেরি ও পাকিস্তান এ চারটি দেশ মিলিয়ে এ ভ্যাকসিনের ছয় কোটি ডোজ ইতোমধ্যে প্রয়োগ করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ ৫২টি দেশ জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য এ ভ্যাকসিনের অনুমতি দিয়েছে।

মূলত বিবিআইবিপি-করভি একটি সনাতন পদ্ধতির ভ্যাকসিন। এ ভ্যাকসিনে মৃত সার্স-কোভ-২ ভাইরাস (কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ি করোনাভাইরাস) ব্যবহার করা হয়েছে। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে বিবিআইবিপি-করভি ভ্যাকসিনের প্রিক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বিখ্যাত “সেল” জার্নালে (Development of an inactivated vaccine candidate, BBIBP-CorV, with potent protection against SARS-CoV-2, Cell, August 2020) এবং এ বছরের জানুয়ারিতে “ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজ” জার্নালে প্রকাশিত হয় এর প্রথম ও ২য় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল (Safety and immunogenicity of an inactivated SARS-CoV-2 vaccine, BBIBP-CorV: a randomised, double-blind, placebo-controlled, phase 1/2 trial, The Lancet Infectious Diseases, January 2021)। প্রকাশিত জার্নাল আর্টিকেল দুটির তথ্য অনুযায়ি, আফ্রিকার Chlorocebus sabaeus  প্রজাতির বানরের কিডনির এপিথেলিয়াল কোষ থেকে তৈরি এক ধরনের সেল লাইনে (যা ভেরো সেল নামেও পরিচিত) সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং বেটা-প্রপায়োল্যাকটন নামক এক ধরনের রাসায়নিক দিয়ে ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। এ নিস্ক্রিয় ভাইরাসকে ক্রমাটোগ্রাফির মাধ্যমে বিশুদ্ধকরণের পর অন্যান্য সহযোগী উপাদান মিশিয়ে বানানো হয়েছে বিবিআইবিপি-করভি ভ্যাকসিন।

জার্নালে প্রকাশিত তথ্য বলছে, বিবিআইবিপি-করভি ভ্যাকসিনের ১ম ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ১৯২ জন এবং ৩য় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৪৪৮ জন ব্যাক্তি অংশ নেয়। দেখা যায় বিবিআইবিপি-করভি নিরাপদ এবং সার্স-কোভ-২ করোনাভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে এমন অ্যান্টিবডি পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি করতে সক্ষম। কোন মারাত্মক বিরুপ প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়নি। প্রসঙ্গত, বিবিআইবিপি-করভি ভ্যাকসিনের ৩য় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল এখনও কোন পিয়ার-রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত হয়নি। তবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি অনুমোদনের অংশ হিসেবে এর ৩য় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল যাচাই করে বলছে বিবিআইবিপি-করভি কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে ৭৯% কার্যকরী। অর্থাৎ, সিনোফার্মের এ ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে প্রতি ১০০ জনের ৭৯ জনের কোভিড-১৯ রোগে সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা নেই। হাসপাতালে ভর্তি হবার মত পরিস্থিতি ঠেকানোর ক্ষেত্রেও এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৭৯%। কিন্তু, করোনার ভারতীয়, আফ্রিকান, যুক্তরাজ্য ইত্যাদি মারাত্মক ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিরুদ্ধে বিবিআইবিপি-করভির কার্যকারিতা এখনও জানা যায়নি।

স্পুটনিক ভি’র মত বিবিআইবিপি-করভি ভ্যাকসিন ২ ডোজে ২১ দিন ব্যবধানে প্রয়োগ করতে হয়। ফ্রিজের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় (২-৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) এটি মেয়াদ উত্তীর্ণকাল পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। সুতরাং, বাংলাদেশের মত দেশে কোল্ড চেইন বজায় রেখে বিতরণের জন্য বিবিআইবিপি-করভি বেশ উপযোগী।

করোনা মহামারী ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি ভ্যাকসিন ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। তাই, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সকলের জন্য  ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে সরকার আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে, রাশিয়ার স্পুটনিক ভি ও সিনোফার্মের বিবিআইবিপি-করভি আমাদানি প্রক্রিয়াধীন। রেনাটা লিমিটেড যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার টিকা আমদানির প্রস্তাব দিয়েছে। প্রসঙ্গত, এ পর্যন্ত যতগুলো টিকা অনুমোদিত হয়েছে তার মধ্যে মডার্নার টিকার কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশী (৯৪.১%)। পাশাপাশি এটি ফ্রিজের ফ্রিজার অংশে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত এবং ২-৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এক মাস সংরক্ষণ করা যায়। তাই, আমাদের দেশে বিতরণ ও সংরক্ষণের জন্যও মডার্নার টিকা উপযোগী। সরকারের উচিত হবে মডার্নার টিকাও দ্রুত অনুমোদন দেয়া এবং বেসরকারিভাবে হলেও এ টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। এতে সরকারের উপর চাপ কমবে এবং নিজ খরচে যারা টিকা নিতে আগ্রহী তারা নিতে পারবে।

ড. মো. আজিজুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ প্রশাসক, জনসংযোগ দপ্তর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইমেইল: ajijur.rubd@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর